মে ডে : মহান শ্রমিক দিবসের জন্ম কথা
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
নির্যাতিত নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন পৃথিবীতে কোথাও কখনো সহজ মসৃণ বা রক্তপাতহীন হয়নি। AFL (আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার) উদ্যোগে আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে শ্রমিকরা তাদের আট ঘন্টা কর্ম দিবস দাবীর ধারাবাহিক চলমান অন্দোলন এবং আগের দিন ৩ মে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে Heymarket Square এ এক প্রতিবাদ সভায় জমায়েত হয়। ঐ সময় শ্রমিকদের লাইন থেকে কে বা কারা পুলিশের প্রতি বোমা নিক্ষেপ করে। সেই বিস্ফোরনে এবং পুলিশি আক্রমণে নিহত হয় ১০-১২ জন। আমেরিকার ইতিহাসে এটা Heymarket tragedy হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়।
মেহনতি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের অন্দোলনকে স্বীকৃতি ও সন্মান জানাতে পৃথিবীব্যাপী পহেলা মে শ্রমিক দিবস বা May Day পালন করা হয়। May Day আন্দোলনের আলোর মিছিল আমেরিকা থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরে নোঙ্গর করে।
নির্যাতিত মেহনতি শ্রমিকদল জেগে উঠে উত্তাল সমুদ্রের মতন। তাদের অধিকার আদায়ের বজ্রকন্ঠের স্লোগানে -স্লোগানে কাপেঁ উঠে পৃথিবীর আকাশ বাতাস। First International Congress of Socialist Parties of Europe ১৪ জুলাই ১৮৮৯ পহেলা মে’কে প্রথম May Day ঘোষণা করে।
আমেরিকায় ঊনিশ শতকে শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া লাগার পর শ্রমিকদের কর্ম সংস্থানের পথ সীমিত হয়ে যায়। সেই সময় অমানুষিক পরিশ্রম ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং ন্যয্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত শ্রমিকরা অধিকার আদায়ের জন্য সরব হয়ে উঠেছিল। শিকাগো শহর ছিল আন্দোলনের অন্যতম উত্তাল জনপদ। কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের দৈনিক পনের ঘন্টা অমানুষিক পরিশ্রমের কাজের বিরুদ্ধে তারা গর্জে উঠেছিল। শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত বিভিন্ন স্কোয়ারে – রাস্তায় শ্রমিকরা ১৯ বার মিটিং মিছিলে জমায়েত হয়েছিল। ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিনে ট্রেড ইউনিয়ান, এনারকিস্ট, সোসালিস্টদের উদ্যোগে শিকাগো সিটি সেন্টারে শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে ন্যশনাল মুভমেন্ট ডাকা হয়। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে প্রায় তিরিশ হাজার শ্রমিক সিটি সেন্টারে জমায়েত হয়। ৩রা মে McCormic Reaper Plant কারখানার নিপিড়িত শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়। এতে দুইজন শ্রমিক নিহত হয় এবং চারজন আহত হয়। সে কারণে ৪ মে সন্ধ্যায় শিকাগো ট্রেড ইউনিয়ানিস্ট, সোসালিস্ট, এনারকিস্ট এবং সাধারণ শ্রমিকদের এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন ছিল শিকাগোর HeyMarket Square এ। শ্রমিকদের একমাত্র দাবী দৈনিক আট ঘন্টা কাজ। শ্রমিকদের সভা ছিল শান্তিপূর্ণ কিন্তু হটাৎ করে একজন বক্তা পুলিশের উপর আক্রমণ করার জন্য শ্রমিকদেরকে উত্তেজিত করে তোলে। ফলে শ্রমিকদের পিকেটিংলাইন থেকে রায়টপুলিশের দিকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে সাতজন পুলিশ নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়, ফলে পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে সাত আট জন শ্রমিক নিহত হয়।
আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে আমেরিকার শিকাগো শহরে নির্যাতিত শ্রমিকরা আধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম শুচনা করেছিলেন এবং সংগঠকরা জীবন উৎসর্গ করেছেন ফাসিঁ কাষ্ঠে। তাদের আন্দোলনের ফলে আজ পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিকদের সপ্তাহে ৪০ ঘন্টার কাজ, বাৎসরিক ছুটি, বাৎসরিক নির্ধারিত অসুস্থতার দিন, চিকিৎসা খরচ এবং সরকারি ছুটির দিনে বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে
আসছেন। পৃথিবীর ৮০টি দেশে মে ডে পালন করা হয়। প্রাক্তন সভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে এই দিনটি বিশেষ ভাবে পালন করা হয়।
May Day আজ আমাদের পৃথিবীতে মেহনতি শ্রমিকদের এক মহান দিবস। দুনিয়ার মেহনতি মজদুর মানুষের অধিকার দিবস।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে, খনিতে এবং বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকদের জন্য সপ্তাহে ছয় দিনে ৪৮ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু হয়। ইউরোপে ১৯২০ সালের দিকে সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা স্ট্যান্ডার্ড আওয়ারে রুপ নেয়। আমেরিকাতে ১৯৩৮ সালে Fair labor Standards Acts আইনের অধীনে শ্রমিকদের সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজ নির্ধারন করা হয়। ফ্রান্সে Popular Front সরকার ১৯৩৬ সালে ৪০ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করে। বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান দেশে সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা প্রথা শুরু হয় ১৯৭০ সালে। অস্ট্রেলিয়াতে সপ্তাহে চল্লিশ ঘন্টা কাজের নিয়ম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে এবং কানাডাতে শুরু হয় ১৯৬০ সালে।
HeyMarkt Square বোমা বিস্ফরণ মামলার বিচারপতি Joseph E Gery-র আদেশে Albert Parsons, George Engel, Adolph Fischer and August Spices চারজন কট্টর বিদ্রোহী সোসালিস্টদের ফাঁসি হয় এবং জেলের ভিতর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী Louis Lingg আত্নহত্যা করেন। এই বোমা মামলার বিচার একপেশে পক্ষপাতদুষ্ট ও Miscarrige of justice বলে আমেরিকা এবং বিভিন্ন দেশে প্রচন্ড অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলে ইলিনয় গভর্নর John Perter ১৮৯৬ সালের ২৬শে জুন চারজনের মৃত্যুদন্ড মৌকুফ করেন। এবং আটজনের পনের বছর জেল হয়। এখানে উল্লেক্ষযোগ্য যে, লেবার ইউনিয়ানের অধিকাংশ সংগঠক ও নেতারা ছিলেন জার্মান ইমিগ্রেন্ট। এই দিবসটি অমর করে গেছেন যারা তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকলেও মানুষের মনের আড়াল হয়ে গেছে।
তাদের ঐতিহাসিক অগ্নিঝরা সংগ্রাম প্রতিবাদ প্রতিরোধের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। জয় হোক দুনিয়ার মেহনতি মজদুর মানুষের। শ্রমিক দিবস অমর হোক।
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
৮ই মে,২০২৩, টরন্টো,কানাডা