প্রবাসে পরহিতকর্ম -১০১

ইউরোপের পথে পথে

রাতে বাড়িতে এসে ডিনার করে, বাচ্চা দুটোকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিল তিন্নি। এরপর আমাদের আড্ডা চললো। এসব আড্ডা অন্যরকম। না দেখার শূন্যতাগুলো ভারিয়ে দেওয়া। দীর্ঘ দিন/রাত্রী পর আমাদের এই দেখা। অতএব কবে, কখন, কোথায় এসব চললো আড্ডায়। কখনো ভাবিইনি এদের সাথে এই ভাবে তাদের আলয়ে দেখা হবে।

‘কথা কি শেষ হয়ে যায়? – সব কথা?

নাকি বুকের ভেতরে সব অসমাপ্ত ইচ্ছার মত

দ্বিধাগ্রস্ত জেগে থাকে বুকে নিয়ে বিনিদ্র রাত

জেগে জেগে নিজেকে দ্যাখে ভীষণ উৎসাহে??’

রাত প্রায় তিনটার দিকে ঘুমাতে যাওয়ার সময় রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র কবিতার লাইনগুলো ভাবছিলাম। কথাগুলো শেষ হয়ে যায় না। মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে গোটা সময় চলতে থাকে।

আগামীকাল আবার ৯টার মধ্যে বের হতে হবে।

পরদিন সকালে পারোটা, ডিমভাজি, ভুনা মাংশ, হালুয়া সব খেয়ে সবাই রেডি হলাম। পাশেই আমাদের এক আত্মীয়া বারবার বলছিলেন, তার বাসায় একটু বেড়াতে। গেলাম। আগেই বলে রেখেছিলাম তার বাসায় লাঞ্চ করবো না। তো উনি টেবিল ভরে নাস্তা দিল, যা লাঞ্চের থেকে বেশী হয়ে গেল। আবার আমাকে একটা গিফটের প্যাকেটও ধরিয়ে দিল।

তারপর আবার আমরা রওনা দিলাম। নাসির আজ আমাদেরকে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটিকে ঘুরিয়ে দেখাবে। তারপর আবার সেন্টার এ নেমে যাব। ওখানকার একটা মলে একটু কেনাকাটা করবো এবং ওখানেই ডিনার সারবো।

বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলোয় একটু থেমে তারপর আবার চলা। এভাবেই মোটমুটি একটা চক্কর মারা হলো। ইউরোপে যতগুলো শহর দেখলাম তার মধ্যে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটা একটু আলাদা। রাস্তাগুলোও মোটামুটি ভালই। গাড়িগুলো ঠিক ঠাক।

অতপর আমরা সেন্টার এ চলে এলাম। এদিন আবার টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সবাই একটু একটু ভিজে গেল। আমরা মোটামুটি দৌড়ে দৌড়ে মলের মধ্যে ঢুকলাম। MyZeil shopping center । দারুন সাজিয়েছে। ক্রীসমাসের আর দুই দিন আছে। তাই উপচে পড়া ভিড়। মলের ভিতরে দরুণ সাজিয়েছে। প্রথমে বেশ ঘোরাঘুরি করলাম। যাকে বলে উইন্ডো শপিং।

জার্মানী’র ফ্রাঙ্কফুর্ট সেন্টার এ লেখক ও অন্যান্যরা। ছবি : লেখক

একটু পরই তিন্নি, মাহিন আর রায়হান বিভিন্ন দোকানের ভিতরে শপিং করতে গেল। আমি নাসির আর কাজিম রেলিং এর ধারে দাড়িয়ে গল্প করতে করতে টিপটিপ বৃষ্টি দেখছিলাম।

রায়হান বাচ্চা ও বৌ এর জন্য কিছু গিফট কিনছিল। আমিতো কিছু কিনবো না। রাত প্রায় ৮ টার দিকে বেরিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। বেশ অভিজাত রেস্টুরেন্ট। ইটালিয়ান। আজ রায়হান খাওয়াবে। আমরা দুজন সব কিছু ভেজিটারিয়ান নিলাম। রাত প্রায় ১০টা বেজে গেল। বাসায় যেতে যেতে ১২টার মত বাজলো। যাবার সময় আবারও একটু আড্ডা মারার পর গাড়িতে উঠলো সবাই। আমি আবার চিন্তা করছিলাম, সাকাল সাড়ে ৮টায় ট্রেন। রায়হানের অন্য রুট। কারণ সেতো আমাদের সাথে আসেনি। সে যাবে ডাইরেক্ট লন্ডন। তারপর টেক্সাস।

আমরা এভাবেই রুট পছন্দ করেছিলাম। আমরা জার্মানী থেকে ব্রাসেলস যাবো, সেখানে আমাদের দেড় ঘন্টার একটু বেশী আপেক্ষা করতে হবে। তো মিঠুর সাথে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। সে বললো, সে আসবে এবং আমাদের নিয়ে বের হয়ে যাবে। যদিও এ ব্যাপারে আমি সহমত পোষণ করিনি।

যাইহোক খুব ভোরেই ফজরের নামাজ পড়েই ঝট করেই রেডি হয়ে নিলাম। তিন্নি ঐ ভোরেই একগাদা খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিল। অত ভোরে কি কিছু খাওয়া যায়? তবু তিন্নির বানানো অসম্ভব সুন্দর চায়ের সাথে একটু ‘টা’ খেয়েই মোটামুটি নীচে নামতে শুরু করলাম।

দু’চোখ ভরে কান্না নিয়ে ভাগনী আর ভাইজিকে জড়িয়ে বিদায় নিলাম। নাসিরের জন্যও খুবই খারাপ লাগছিল। আমি এত ভদ্র মানুষ খুব কম দেখেছি।

যাইহোক, ট্রেন চলতে শুরু করলো। শহরের বাতাবরণ খুব শিঘ্রই চলে গেল। এরপর সব মনোরম দৃশ্য। সুইজারল্যান্ডের মত ঠিক ওরকম – দু’পাশে পাহাড় আর লেকের সারি।

খুব জলদিই চলে এলাম ব্রাসেলস রেলওয়ে স্টেশনে। সেই পরিচিত স্টেশন। নামতেই দূর থেকে মিঠুর পরিচিত অবয়ব দেখতে পেলাম। সে আমাদের নিয়ে একটি সুন্দর চেয়ার টেবিল ঘেরা জায়গাতে বসালো। বাচ্চাদের মত আনন্দে উদ্ভাসিত সে। হাতে দেখলাম বড় সড় প্যাকেট। আমি বললাম, তোর হাতে কি? সে বললো, লাঞ্চের প্যাকেট।

সেকি তুই বাইরে যাবি না?

সে বললো- না। কারণ ভেবে দেখলাম, একবার বের হলে যদি টাইমলি পৌছাতে না পারি, তাহলে খুব প্রব্লেম। কারণ লন্ডনে যাবার এটাই লাস্ট ট্রেন। পরে আপনারা ঝামেলাতে পড়বেন।

আমি জার্মানী থাকতেই এই কথা বলেছিলাম। মিঠুও সম্ভবত বুঝেছে, সত্যিই বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না।

কিছুক্ষণ গল্প করেই খাবারের উপর মোটামুটি ঝাপিয়ে পড়লাম। খুবই ক্ষুধার্থ ছিলাম। দেখি আমার খুবই প্রিয় মরক্কোর সেই রেস্টুরেন্ট থেকে শর্মা নিয়ে এসেছে। এখনও বেশ গরম। খুব মজা এবং তৃপ্তি করে খেলাম আড্ডা দিতে দিতে। ব্রাসেলস এ আমাদেরকে মোট আড়াই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।

অবাক কান্ড, আড়াই ঘন্টা মনে হলো এক পলকেই শেষ হয়ে গেল। দেখলাম আমাদের ইউরোস্টার ট্রেন এসে গেছে।

এখন টানা ব্যাগ নিয়ে রওনা দিব। মিঠুর হাউমাউ কান্না। আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। খালাতো ভাই হলেও, আমরা পিঠেপিঠি বিধায়, খুবই প্রিয় এই ভাইটি আমার। কতকাল পরে দেখা হলো। আবার ওকে দেখতে পাবো কিনা তাও জানিনা।

কাঁদতে কাঁদতে লন্ডনগামী ইউরোস্টার এ উঠে পড়লাম। ঠিক দুই ঘন্টা ৫/১০ মিনিটেই পৌছে যাবে। আসবার সময় অসম্ভব উুুুৎফুল্ল হয়ে এসেছিলাম, যাবার সময় ততোটাই মৃয়মান হয়ে যাচ্ছি। এই অপরূপ সৌন্দর্য, মিঠুর সব কিছু হয়তো আর কোনদিন দেখতে পাবো না।

মনটা খুব খারাপ লাগছিল, তাই কখন যে সেন্ট পেনকার্স ইন্টারন্যাশনাল রেলওয়ে স্টেশনে পৌছে গেছি টেরই পাইনি। এবার একদম হুড়োহুড়ি করে নেমে পড়লাম। তবে যেহেতু এটা ইন্টারন্যাশনাল স্টেশন, প্রচন্ড ব্যস্ত। বেশ কিছুটা পথ হাটতে হলো। তারপর আমাদের প্লাটফর্মে চলে এলাম। এবারে ইস্ট হ্যাম এর ট্রেন এর অপেক্ষায়।

যাইহোক বাসায় যেতে যেতে বেশ রাত হলো। একটু খারাপ লাগছিল। মরুব্বীদের জন্য বেশ রাত। বাসার কাছে যেতে যেতে দেখছিলাম, বেশ দূর থেকেই দুটি ছায়া। ওমা, কাছে যেতেই দেখি মাজেদা আপা আর আয়াত দুলাভাই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। পাছে আমাদের কালিংবেলের শব্দে নীচের তলার ভাড়াটেদের ঘুম নষ্ট হয়, তাই দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে আপা জড়িয়ে ধরলো।

দোতালায় গিয়ে দেখি ডাইনিং টেবিলে আমাদের প্রিয় সব মেনু রান্না করে আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিল। এমনকি পিঠাও বানিয়েছে। এই সব ভালবাসার জন্য পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর। কতকাল পরে আপা/দুলাভাইকে দেখেছিলাম, তবু মনে হয়নি সেটা। প্রতি মুহুর্তে মনে হয়েছে, প্রতিনিয়ত দেখা শুনা।

খুব মজা করে চারজন এক সাথে খেলাম। পরদিন আমাদের কোন প্রোগ্রাম নাই। কেবল আশেপাশে একটু ঘুরবো। যাইহোক বেশ দেরীতেই ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন একটু দেরীতেই ঘুম থেকে উঠলাম। সকালের নাস্তা যদিও একসাথেই খেতে বসলাম। তখন হঠাৎ আয়াত দুলাভাই বললো, আগামীকাল এয়ারপোর্টে কেমন করে যাবে?

কেন দুলাভাই, যে ভাবে এসেছিলাম। প্রথমে সাবওয়ে। তারপর ভিক্টোরিয়া ট্রেনে।

আমার মনে হচ্ছিল তোমরা জানো না। তাই প্রশ্নটা করলাম। আগামীকাল ২৫ ডিসেম্বর, ইংল্যান্ডের সমস্ত সরকারী পরিবহন বন্ধ থাকবে। শুধু প্রাইভেট পরিবহনগুলো চালু থাকবে। এটাই এদেশের নিয়ম।

আমাদের দুজনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমরাতো সব পরিকল্পনা করেই রেখেছি, কিভাবে কোন রুটে যাবো এয়ারপোর্টে।

এখন কি হবে? পৃথিবীর অন্য কোথাও তো এই ব্যাপারটা নাই। কানাডা, আমেরিকা কোথাও নাই।

যদিও ইস্ট হাম থেকে এয়ারপোর্টের দূরত্ব অনেক বেশী, তবু অমরা দুজনই সিদ্ধান্ত নিলাম, টেক্সি ভাড়া করবো। আগেই দেখেছিলাম সাবওয়ে স্টেশনের পাশেই টেক্সি অফিস। আমরা সোজা ওখানেই গেলাম। কথা বললাম ম্যানেজারের সাথে। উনি টেবিলের উপর বড় খাতা দেখে বললো, আমাদের কোন টেক্সি খালি নাই।

মানে কি? এটা কেমন কথা? উনি কাজিমকে খাতা দেখালো, সত্যিই ওদের সাড়ে তিন শ

টেক্সি সব বুকড। আমরা খুব মিনতি করলামা। তখন উনি বললেন, যদি কেউ ক্যান্সেল করেন, ফর সিওর, আপনাদের ওটা দিব।

আমার মাথা প্রায় খারাপ। আমিতো প্রায় কেঁদে ফেলবার মত অবস্থায়। বাসায় গিয়ে সব বললাম। তার আগে একটু বাাজর করলাম। ড্রাইফুড (চিপস, নাট, বিস্কিট ইত্যাদি) কিনলাম প্লেনের জন্য। আসবার সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য।

বাসায় যেয়ে দুলাভাই আপাকে সব বললাম। আপা কার কার সাথে কথা বললেন। উপায়ন্তর না দেখে মেজ মামামাকে ফোনে সব বললাম। যদিও জানি মামা অনেকদিন থেকেই গাড়ি চালায় না। তখন হাফিজা মামী সব শুনে আমায় বললো, দেখিস যদি আর কোন ব্যবস্থা না করতে পারিস তো আমি দিয়ে আসবো। আমি ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিলাম।

কিন্তু কাজিম জোর আপত্তি করলো। সত্তর প্লাস বয়স মামীর। উনি উইম্বলডন থেকে ইস্টহামে এসে আমাদের পিক করবে এবং তারপর আবার গেটউইক এয়ারপোর্টে যাবে, আবার ফিরে আসবে। কি বল, এটা সম্ভব? দরকার হয় রাতেই হেটে রওনা দিব।

যাইহোক, যার কথা চিন্তার মধ্যেই আসেনি, সেখান থেকেই সাহায্যের হাত এলো। আপার বড় ছেলে সাজ্জাদ। কারণ আমি জানি যে, ওর জবে এলোমেলো ডিউটি হয়। তাই ওর কথা মাথায়ই আসেনি।

কিন্তু মাজেদা আপা বলতেই সাজ্জাদ বললো, কালতো আমার ডিউটি নাই।

ইয়া আল্লাহ! শুকর…আলহামদুলিল্লাহ।

সাড়ে ১২টায় ফ্লাইট। অতএব ফজরের নামাজ পড়েই রেডি হলাম, মাজেদা আপা অনেক কিছু টেবিলে সাজিয়েছে। টুকটাক খেলাম এবং চা খেলাম। সাজ্জাদ চলে এলো। আপা ব্যাগে প্রচুর খাবার দিলো। আমরাও কিনেছিলাম। একটা হাতব্যাগে সব নিলাম। এছাড়া কোন লাগেজ নাই। দুটোই ক্যারিঅন। পার্স, সেটাও ছোট।

চলে যাবার সময় হলো, সাড়ে সাতটায় রওনা দিব। যেতে লাগবে ১ ঘন্টা ১০/১৫ মিনিট। যাবার আগে আপা জড়িয়ে ধদের কেঁদে ফেললো। দুলাভাই আমাদের সাথেই চললো।

গেটউইক এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল না সাজ্জাদ। সেই একেবারে শেষ পর্যন্ত এলো। আমি সাজ্জাদকে শুধু এইটুকু বললাম, বেটা, জীবনেও তোমার ঋণ ভুলতে পারবো না। সে মিষ্টি করে হেসে বললো, খালা এটাতো আমার কর্তব্য। মাজেদা আপার চারটা বাচ্চাই অসম্ভব ভালো। আবার সাজ্জাদের বৌ প্রিয়া-ও খুব ভাল মেয়ে।

অবশেষে আমাদের প্রিয় কানাডায় অবতরণ করলাম। এয়ারপোটের তরণী পার হয়ে বাইরে বের হলাম। দেখলাম গোটা এয়ারপোর্ট এবং টরন্টো নববধুর সজ্জায় (২৫ ডিসেম্বরে বড়দিনের সাজ) আমাদের বরণ করে নিল।

আহ্! গভীর নিঃশ^াস নিলাম। নিজের শহর, নিজের। অন্যরকম একটা অনুভূতি। বাইরে বের হয়ে দেখি ছোট দুই বোন, শরবত আর রিঙ্কু’র জামাই ফিরোজ ভাই এবং জুয়েল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

দিনের আলো তখনও নির্বাপিত হয়নি। সেই আধো আলোর, পড়ন্ত সূর্যকে গভীর ভাল লাগায় অবলোকন করছিলাম। অসম্ভব ভাললাগায় মন ভরে গেল Ñ

“তবু শেষমেশ একটি নীলাভ প্রজাপতি জন্যও

যে যার স্মৃতির ফ্রেমে

কষ্টকে বাঁধিয়ে রাখেÑ

হাত বাড়ালেই ফুটে থাকা রক্তিম গোলাপ

তবু যে যার কাঁটার কাছে

ফিরে যায় একদিন,

একদিন যে যার নিঃসঙ্গতার কাছে॥

(রুদ্্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)

সমাপ্ত 

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com