আধুনিক আরব্য রজনী

রায়হান শাহরিয়ার

গল্পটা শুরুর আগে উনি আমাকে সতর্ক করে বললেন,

“কাউকে বলবেন না, শুধু আপনাকেই বলছি”।

আমি ক্লাস ওয়ানের ছাত্রের মতো মাথা নেড়ে বললাম,

“বলবো না” । 

অবশ্য আমি নিশ্চিত যে, এই গল্প উনি আগেও অনেকেই এভাবেই বলে দিয়েছেন।

সুলতান শাহরিয়ারের মৃত্যুদন্ড থেকে নিজে বাচঁতে, ভবিষ্যতে আরো অনেককে বাচাঁতে মহাকাব্যের গল্প আরব্য রজনী বলা শুরু করেছিলেন শেহেরজাদী।

শেহেরজাদীর মতোই উনি গল্প বলা শুরু করলেন আর আমি শাহরিয়ারের মতোই মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা।

উনি আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, তবে উনাদের সাথে আমাদের বাসার সবার যোগাযোগ বা যাতায়াত ছিল। নাম তমাল ভাই, বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার, অনেক ভাল জব করেন। তমাল ভাইদের পরিবার আগে থেকেই আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল। বিয়ে করার জন্য পাত্রী খুঁজে পেয়েছেন, মেয়ে ডাক্তার। আসলে বিয়ের সময় ডাক্তার তখনো হয়নি, ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তারী পড়ছে। মহা ধুমধামে ডাক্তার পাত্রী আর ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের বিয়ে হয়ে গেল। দুই পক্ষের পরিবার, আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই খুব খুশি এমন সোনায় সোহাগা মিল দেখে। তবে বিয়ের পরের দিন সকাল থেকেই নববিবাহিতদের মুখে হাসি নেই। তমাল ভাইয়ের মুখ আতঙ্কিত আর ডাক্তার সানজিদা ভাবির মুখ বেজার। কয়েকদিনের মধ্যে দেখা গেল তমাল ভাই শুধু সানজিদা ভাবির সব কথায়ই বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে শোনে আর সানজিদা ভাবি তমাল ভাইকে বাঘের মতো সব কথায়ই হুকুম করে। একমাস পরে অবস্থা আরো খারাপ হওয়াতে দুই পরিবারের সবাই মিলে মিটমাটের জন্য মিটিংয়ে বসল। মিটিংয়ে সানজিদা ভাবি অগ্নিমূর্তি হয়ে প্রকাশ করল সবার কাছে যে তমাল ভাইয়ের সমস্যা আছে, বিয়েতে প্রতারণা করা হয়েছে। তমাল ভাইয়ের সমস্যার কথা বিয়ের আগে জানানো হয়নি। এদিকে সবার চোখ তখন তমাল ভাইয়ের দিকে, উনি কাচুমাচু মুখ করে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে বললেন আমি তো বিয়ের আগে কখনো বুঝি নাই যে আমার এমন সমস্যা আছে।

উনার গল্প বলা থামিয়ে দিয়ে এবার আমি প্রশ্ন করলাম “তমাল ভাই কি ট্রান্সজেন্ডার ছিলেন?”

উনি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,

“আপনাকে নিয়ে আর পারি না, সব কিছু কি আপনাকে দাড়ি-কমাসহ বুঝায় বলতে হয়? তমাল ভাই ছিলেন অথর্ব”

আমি বুঝদারের মতো ভাব নিয়ে বললাম,

“ও আচ্ছা”।

এরপর আমার সঠিক প্রশ্ন,

“তারপর মিটিং এর পর কি হল? ডিভোর্স?”

উনি আবার বলা শুরু করলেন – আরে না, ডিভোর্স হয় নাই। তবে দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিল তমাল ভাইয়ের চিকিৎসা করানো হবে। চিকিৎসা শুরু হল, তমাল ভাই চিকিৎসার জন্য জার্মানীতে যাওয়া আসা শুরু করলেন আর সানজিদা ভাবি যেহেতু তখনো মেডিকেলে পড়ছিলেন, তো উনি মেডিকেলের হলে উঠে গেলেন। তবে তমাল ভাই জার্মানী থেকে দেশে যখন আসতেন তখন সানজিদা ভাবি তমাল ভাইদের বাসায় এসে থাকতেন। চিকিৎসার পরও তমাল ভাইয়ের অবস্থার নাকি কোন উন্নতি হচ্ছিল না। সানজিদা ভাবি দিনে দিনে আরো বাঘ হতে থাকলেন আর তমাল ভাই মেনি বিড়াল থেকে বিড়াল ছানা হতে থাকলেন। তারপরও তমাল ভাই সানজিদা ভাবিকে নিয়েই সংসার করতে চাইতেন। এভাবে চলার তিন বছর পর সানজিদা ভাবি সিদ্ধান্ত নিলেন তমাল ভাইয়ের যেহেতু কোন উন্নতি হচ্ছে না তো উনি আর এখানে সংসার করবেন না। সানজিদা ভাবি ডিভোর্স দিয়ে চলে গেলেন। এদিকে লজ্জায় অপমানে জর্জরিত তমাল ভাই ডিভোর্সের পর একদম ভেঙে পরলেন। কেমন যেন পাগল পাগল টাইপ হয়ে গিয়েছিলেন। আত্মীয়স্বজন তখন তমাল ভাইকে সান্ত্বনা আর উপদেশ দিতে প্রতিদিনই উনাদের বাসায় যাচ্ছেন। বুঝেন না মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আধ পাগলা একটা ইয়ং বেটা মানুষকে চিড়িয়াখানার চিড়িয়ার মতো দেখতে যাওয়া আর কি। আমি তখন ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ি। আমার আম্মাও আমাকে নিয়ে একদিন তমাল ভাইদের বাসায় গেলেন উনাকে দেখতে। তবে আমাকে খুব করে আম্মা সতর্ক করে দিল আমি যেন তমাল ভাইয়ের ধারে কাছে না যাই।

এবার আমি প্রশ্ন করলাম,

“কেন এমনটা করলেন তোমার আম্মা? উনি কি ভেবেছিলেন তুমি উনার সাথে লাইন মারতে পার?”

এবারে উনার মুখে বিরক্তি। বললেন,

“বোকার মতো কথা বলবেন না। ক্লাস নাইন টেনের একটা মেয়েকে দেখলে সব বয়সের ছেলে মানুষই লাইন মারতে চায়। আম্মার ভয় ছিল যদি উনি আমার পিছে লাগে। তবে মনোযোগ দিয়ে শোনেন, আসল গল্প এবার শুরু হচ্ছে”।

এবারে আসল গল্প উনি শুরু করলেন –

আমাদের মতো তানিয়া আপাও একদিন উনার আম্মার সাথে তমাল ভাইকে দেখতে গেলেন। তানিয়া আপারাও উনাদের একরকম দূর সম্পর্কের আত্মীয় হতেন। তখন তানিয়া আপা অনার্সের শেষের দিকে পড়েন, যতটা মনে পরে ইডেন কলেজে পড়তেন। তানিয়া আপারা তমাল ভাইদের চেয়ে টাকা পয়সায় একটু পিছিয়ে ছিলেন। যাইহোক, তানিয়া আপার সাথে তমাল ভাইয়ের ঐদিন কথা হয়েছিল। কথা বলে নাকি তানিয়া আপার তমাল ভাইকে খুব ভাল মানুষ মনে হয়েছিল। এরপর ওনারা আরো কথা বললেন, বাইরে দেখা করলেন, ফোনে কথা হতো। মাস তিনেক পর তানিয়া আপা আর তমাল ভাই ঘোষণা দিলেন তারা একজন আপরজনকে পছন্দ করেন আর তারা বিয়ে করতে চান। এই কথা শুনে সবইতো অবাক! তানিয়া একটা অবিবাহিত সুন্দরী মেয়ে জেনেশুনে কেন একটা অথর্ব ছেলেকে বিয়ে করতে চায়? আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হল ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আর বড়লোক পরিবার দেখে তানিয়ার মাথা খারাপ হয়েছে। তবে যে যাই বলুক, তমাল ভাই আর তানিয়া আপার ইচ্ছায় দুই পরিবারের অস্বস্তিতে উনাদের বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ের রাতের পর দিন সকালে উৎকন্ঠা নিয়ে সবার তানিয়া আপার কাছে জিজ্ঞাসা “অথর্বটার সাথে রাতে তুমি কি করলে?”

তানিয়া আপার উত্তর “আমরা রাতে দুজনে অনেক গল্প করেছি”

এরপর শুরু হল তাদের আরব্য রজনীর গল্পের জীবন। তমাল ভাইয়ের আগের সংসারে যে সব জিনিসপত্র, ফার্নিচার, জামাকাপড় ছিল, তানিয়া আপা সেসব সরিয়ে ফেলে আবার নতুন করে সব কিনতে শুরু করলেন। সবাই দেখল ভেঙে পড়া বিড়ালের মতো মিউ মিউ করা তমাল ভাই কিছুদিনের মধ্যেই সংসারী সুপুরুষ। ছয় মাস পর তমাল ভাই একা হজ্বে যাবেন, তানিয়া আপা তমাল ভাইয়ের বিরহে কেঁদে বুক ভাসালেন। আশেপাশের সবাই তখন মুখ টিপে হাসে আর কানাঘুষা করে,

“অথর্বটার জন্য তানিয়ার এত প্রেম কোথা থেকে আসে?”

তমাল ভাই হজ্বে চলে গেলেন আর সপ্তাহ খানেক পরেই সবাই জানতে পারল তানিয়া আপার বেবি হবে! আবার চারিদিকে কানাঘুষা,

“এবারে জার্মানীর চিকিৎসা ছাড়াই তানিয়া কি ভাবে প্রেগনেন্ট আর সানজিদা যেখানে এতই অসুখী ছিল সেখানে তমাল তানিয়া দুজনেই কিভাবে এত সুখের সংসার করে?”

নয় মাস পর তানিয়া আপার ফুটফুটে একটা ছেলে হল। দুই বছরের মধ্যে আরেক ছেলে। দুই ছেলেই দেখতে অবিকল তমাল ভাইয়ের চেহারা। তাদের সুখের সংসার আর ভালবাসা দেখে এখন কারো মনেই নেই যে এক সময় তমাল ভাই অথর্ব ছিল।

এবার তিনি গল্পের ইতি টানলেন-

“দেখলেন ভালবাসা সবকিছুকেই ঠিক করতে পারে, তমাল ভাইয়ের কিন্তু আর জার্মানী যেতে হয় নাই অথর্ব রোগের চিকিৎসা করতে। আমাকে ভালবাসবেন তো?”

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ” তোমাকে ভালবাসবো অনন্তকাল”

লেখকের কথাঃ এটি একটি শ্রুতি গল্প। গল্পটি যিনি আমাকে শুনিয়েছেন তিনি গল্পের শুরুতেই আমাকে বলেছেন “কাউকে বলবেন না, শুধু আপনাকেই বলছি”। তাই গল্পের সমস্ত কৃতিত্ব তার হলেও নামটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

(গল্পের লেখক কানাডা প্রবাসী রায়হান শাহরিয়ার )