প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯৭

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

এখনও সন্ধ্যা হতে কিছুটা বাকি। তবু চারপাশে সমস্ত মেঘেরা বন্ধুর মত, হাতের কাছে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কি অদ্ভূত। চোখে না দেখলে, এগুলো সত্যি বর্ণনা করা যাবে না। একই আকাশে নানা বর্ণের খেলা। এমনিতেই আকাশের রূপ আমায় দারুণ টানে। একপাশে একটু কালচে বর্ণ। তবে গোটা আকাশে এখন অস্বাভাবিক মেঘের ভেলা। হয়তো অনেক উপরে আছি, সে জন্যও হতে পারে।

অনেকটাই বাচ্চাদের মতন চারপাশে ছোটাছুটি করলাম। অতঃপর আমাদের ফিরতি ট্রেনের ডাক এলো। একটা অসম্ভব নিরাসক্ত ভাবে, ট্রেনের দিকে হেটে চললাম। মনে হলো যেন আমার ‘আমি’টাকে চিরকালের মতন এখানে রেখে যাচ্ছি। কি জানি কেন এমন হচ্ছে। সেই ভোর থেকে প্রায় রাত, তবু যেন কোন ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করছে না। কোন ক্ষুধা বোধ নেই। অথচ, ক্ষুধা লাগলে আমার অনেক পুরানো আলসারের ব্যাথা জানান দেয় ‘রীনা তোর ক্ষুধা লেগেছে’। অথচ আজ আমার কি যে হলো। আমি কি আমার সমগ্র চেতনায় ‘যাযাবর’ হয়ে গেছি?

‘একদিন যখন চলে গেলে চুপচাপ

পেছনে দেখোনি ভেঙ্গে চুরচুর সমস্ত আমিটাকে

জানি সেটা ছিল একটি ভুলে ভরা গল্প…

আমি তবু কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়॥

জানি যা কিছু যাবার সেটা চলে যায়,

যা কিছু রয়ে যায় ছিন্ন বস্ত্রের মত

মলিন বিবসনা এক আকাশ ভরা

শূন্য হাহাকার নিয়ে।’

ট্রেনে উঠে পড়লাম মালিন বিবসনা হয়ে।

কোন কথা নাই। সবাই কেমন যেন স্তব্দ। প্রকৃতির এক অদ্ভূত অমোঘ আকর্ষণ আছে। সবাইকেই কি এই ভাবে বিবস করে রেখেছে? নাকি সবাই বড় ক্লান্ত!

ট্রেনটা ছেড়ে দিল। জানিনা হয়তো একই পথে যাচ্ছে। তবু কেন মনে হচ্ছে বারবার ভুল পথে ট্রেনটা চলেছে। অতিরিক্ত সৌন্দর্য্যরে কাছে, মানুষ মূক এবং বধির হয়ে যায়। কিছুটা পথে, যেতে যেতে হঠাৎই পাহাড়ের কোলে রাতের আকাশ নেমে এলো। তবু পাহাড়ের উপর দূরে দূরে সাদা সাদা বাড়ি বা রিসোর্টগুলো দেখা যাচ্ছে। আর পাহাড়ের উপর কি যেন ঝিকিমিকি জ¦লছে। মজার ব্যাপার, চারপাশে রাতের অন্ধকার নেমে এলেও আমরা চারপাশটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তবে ছবি তুললে, সেগুলো অবশ্যই কালো কালো হয়ে যাচ্ছে। একসময় অপরূপ ট্রেনের এই জার্নি শ্লথ হয়ে এলো। আবারও আমাদের জন্য অপেক্ষমান বাসে সবাই উঠে পড়লাম। বাসটি এবারে বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। মোটামুটি আবারও ‘জুরিখ’ শহরের মধ্যে প্রদক্ষিণ করছিল। আমি যেন দ’ুচোখ ভরে অক্লেশে পান করছিলাম, ‘সুইজারল্যান্ডের’ সৌন্দর্য সুধা। অতপর পথিমধ্যে একটি বড় রেস্টুরেন্টে দাঁড় করালো, সবাই খাবার কিনবে। কারণ রাত প্রায় ১১টার মত বাজে। এখানে কিছু রেস্টুরেন্ট সারারাত ট্যুরিস্টদের জন্য খোলা থাকে। কিন্তু আমরা কিনলাম না। কারণ আমরা চমৎকার একটি ‘রেস্টুরেন্ট’ এর সন্ধ্যান পেয়েছিলাম সেটা আমাদের হোটেল ‘ক্রাউন প্লাজা’র বেশ সন্নিকটেই। একটি লেনানিজ খাবারের হোটেল। হালাল। অতপর আমরা সবাই বাস থেকে নেমে সবার কাছ থেকে সবাই বিদায় গ্রহণ করলাম। এই ৫/৬ দিনে মোটামুটি সবাই একই ট্যুরিস্ট কনটক্ট এ ছিলাম। তাই অনেকের সাথে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। পথের বন্ধু। অনেকের সাথে টেলিফোন নম্বর বিনিময় হলো। হয়তো বা কখনো ঐ সব নম্বরে ডায়াল করা হবে না। তাতে কি? ঐ মুহুর্তটা কিন্তু মিথ্যা ছিল না। গাঢ় আবেগের সুন্দর একটা সময়ের একত্রিভূত সাক্ষী ছিলাম। তারপর জীবনের কাছে এসে হয়তো অবিরাম ব্যস্ততা, দুঃখ, বেদনা, অসুস্থতায় আমরা তাদেরকে বিস্মৃত হবো। তবে ঐ সময়টাকে কোন দিন ভুলবো না।

STUTTGART এর উদ্দ্যেশে যাত্রার আগে লেখও তার বড় ছেলে রায়হান

ওখান থেকে আমরা হেটেই চলে এলাম বরাবরের মত। এবং রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এরপর যার যার মত খাবার অর্ডার করে, হাতে প্যাকেটা নিয়ে চললাম। হোটেলে গিয়ে আমি অবশ্যই অভ্যাসমতো গোসল করে, ডিনার করলাম।

পরদিন ১১টার দিকে আমাদের যাত্রা। এবারে জার্মানী। অত্যন্ত রোমাঞ্চকর একটি নাম। নানা কারণে জার্মানী পৃথিবীতে অন্যতম একটি দেশ হিসাবে পরিচিত। বিশেষত অর্থনৈতিক দিক থেকে অতি উন্নত একটি দেশ। পৃথিবীর মধ্যে বিশেষ করে ‘মেডিসিন’ এ জার্মানী অনেক অনেক উন্নত এবং ভাল পজিশনে আছে। আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন খুব চেষ্টা থাকতো জার্মানী ঔষধ সংগ্রহ করবার। সর্বপোরি এটা সেই বিখ্যাত এবং কুখ্যাত ‘হিটলার’ এর দেশ।

যদিও এর আগে একবার (২০১৭) জার্মানীতে আমার পদার্পন হয়েছিল। তথাপি বেশ উত্তেজনা নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। কোথাও যাবার আগে আমার ঠিক ঘুম আসে না। কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়েই আজ আমার প্রগাঢ় ঘুম এলো। 

ইংল্যান্ড থেকে আসবার আগেই জার্মানীর স্টুটগার্টে থাকা ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিল অনেক্ষণ। আমার একমাত্র ফুফুর বড় ছেলে। সে প্রায় ৪০/৪১ বছর ধরে জার্মানীতে থাকে। ওখান থেকেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করেছিল। তারপর বছর দশেক জব করে, বিয়ে করে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভালই সংসারি হয়েছিল। হঠাৎ মাথায় কি যে ব্যবসার ভূত চাপলো। এখন তার ২টা বিশাল আকারের নিউজপ্রিন্ট এবং পেট্রোল পাম্পের মালিক। তবে ভাইটাকে ব্যবসার মধ্যে আমরা হারিয়েছি। যাইহোক, ভাইয়ের সাথে কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সুইজারল্যান্ড থেকে স্টুটগার্ট হয়ে তারপর ফ্রাঙ্কফুর্ট যাবো। সম্ভবত আমরা ওখানে ২/৩ ঘন্টার মত অপেক্ষা করবো। ভাই ভাবী আসবে। আমরা ওখানেই ২/৩ ঘন্টা গল্প করে, পরের ট্রেন ধরে সোজা ফ্রাঙ্কফুর্ট চলে যাবো। ৩/৪ দিনে এত বড় বড় দেশ কোন ভাবেই দেখা সম্ভব না। তবু এবারে ভেবেছি, যেখানে যাইনি, এবারে সেখানেই যাবো।

যাইহোক, ভোরে ঘুম থেকে উঠেই গোসল করে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। মাহিনও উঠে দ্রুত গুছিলে নিল। অন্য ঘর থেকে বাপ-বেটাও একেবারে গুছিয়ে চলে এলো। বললো, আগে ব্রেকফাস্ট সেরে আসি, তারপর ব্যাগ নিয়ে যাবো। ডাইনিং এ গিয়ে বেশ ভাল ভাবেই খেয়ে আসলাম। আমরা নিচেই আলোকিত ও খুব দারুণভাবে সজ্জিত ক্রাউন প্লাজার লিভিং স্পেসে বসলাম। মাহিন আবার কিছু ছবি তুললো। রায়হান উপরে গিয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে আসলো।

সুইজারল্যান্ড ও জার্মানীর বর্ডার

ট্রেনের স্টেশন খুব দূরে নয়। আমাদের কারো কাছেই লাগেজ নাই, সব ক্যারিঅন। আমার আর কাজিম এর তো একটিই ক্যারিঅন। কারণ আমি কিছু টানতে পারবো না। আমার হাতে পিচ্চি একটা পার্স। সেটা নিয়েই ধীরে ধীরে হাটতে শুরু করলাম। মাহিন মজা করছিল এই বলে যে – ‘সুইজারল্যান্ড থেকে ফুফুর যাইতে ইচ্ছা করছে না। তাই না?’ কঠিন সত্যি। সত্যিই আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আহা, ছবির মত একটা দেশ। কার যেতে মন চায়? মনে হচ্ছে এর আকাশ বাতাসও আমাকে যেতে দিতে চাইছে না –

‘ কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,

সমস্ত পৃথিবী! চলিতেছি যতদূর

শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর

যেতে আমি দিব না তোমায়। ’

পথে বিষণ্নভাবে হাটতে হাটতে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতাটি অটোমেটিক মাথার মধ্যে চলে এলো। ছোটবেলা থেকেই এই কবিতাটি পড়ে আসছি। যতবার এই কবিতাটি পড়ি, আমি ততোবার অশ্রুসজল হয়ে যাই। হাটতে হাটতে কখন জানি স্টেশনে চলে এসেছি। সুইজারল্যান্ডের সব সৌন্দর্য্যরে মত এদের ‘ইউরো স্টার ট্রেন’ স্টেশনটাও অপরূপ সাজে সজ্জিত। কে বলবে এটা কোন স্টেশন? যেমন ঝকঝকে, তেমনি ওয়েল ডেকোরেটেড। লন্ডনের মত এখানেও চারপাশে পেইন্টিং। তবে পার্থক্য হলো, লন্ডনে মাটির নীচে। আর সুইজারল্যান্ডে মাটির উপরে। আমাদের টিকিট আগেই বুক করা ছিল। আমরা এখান থেকে সোজা স্টুটগার্টে যাবো। সেখানে আমরা ২/৩ ঘন্টা অপেক্ষা নিয়েছি, তারপর আমরা আবার ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে যাবো। পথে এখানে থামার একমাত্র উদ্দেশ্য আমার ভাই এবং তার পরিবারের সঙ্গে মিট করবার।

আমরা ট্রেনে উঠার প্রায় সাথে সাথেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। এত সুন্দর এই ট্রেনগুরো, যতবার উঠেছি ততবারই মুগ্ধ হচ্ছি। মাহিন যেহেতু জার্মানীর নাগরিক তাই মোটামুটি এই পথটা খুব ভাল করেই জানে। আমাকে বললো, ফুফু বর্ডার ক্রস করলেই একটু পরই একটা দারুণ ফসল আছে। ওখানে নাকি প্রচুর দর্শনার্থী আসে। যাইহোক ঠিক সময়মত বর্ডারে এলো। ট্রেনের ভিতরেই বর্ডার চেকিং গার্ডরা উঠে এলো। এবারে মাহিনই তাদের সঙ্গে জার্মান ভাষায় কথা বললো। মাহিন জার্মানে ফুল কোর্স করেছে, দুই বছরের।

তারপর একাউন্টিং এ মাস্টর্স করেছে। তাই এই ভাষাটা দারুণ ভাবে রপ্ত করেছে সে।

যাইহোক, পাসপোর্ট চেক করে যথারীতি কয়দিন থাকবো জিজ্ঞাসা করে সিল ছাপ্পর মেরে চলে গেল। এরপর আধাঘন্টার মধ্যেই ট্রেনটি ঐ বিশেষ জায়গাটিতে চলে এলো যদিও বেশ খানিকটা দূরে। তবুও দেখা যাচ্ছিল। দূর থেকে নায়াগ্রার মত। কিন্তু আসলে অত বড় নয়। তবু অসাধারণ ফলস এবং তার চারপাশ। অসম্ভব মনোমগ্ধকর।

যাইহোক আমরা সাড়ে তিনটার মধ্যে স্টুটডার্ট এ চলে এলাম। খুব বড় স্টেশনটা। আসবার পথে রায়হান এবং আমি যথাক্রমে ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলেছি। ভাবীর সাথেও বললাম। ভাবীতো বললো, আমি অনেক্ষণ হলো রেডী হয়ে, তোমার ভাইয়ের দোকানে চলে এসেছি। একটু পর স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিব। আমি বললাম কতক্ষণ লাগবে স্টেশনে আসতে? বললো ৪৫ মিনিটের মত ট্রাফিক না থাকলে।

অবশেষে আমরা স্টুটগার্টে অবতরণ করলাম। পরের ট্রেনে উঠবো ২ ঘন্টা পর। আমরা ঠিক করেছি, ভাই এলে আড্ডা মারতে মারতে লাঞ্চটাও সেরে ফেলবো কোন একটা রেস্টুরেন্টে। এদিক ওদিক দেখছি, ভাই আসেনি। এরপরতো ফোন চালাচালি হচ্ছে একভাবে। তখন ভাবীই কথা বলছিল। বললো, দোকানে হঠাৎ কি একটা প্রব্লেম হয়েছে।

আমরা কি করবো বুঝতে পারছি না। কথা বলতে বলতে স্টেশনের বাইরে চলে এলাম। বেশ একটু বলতে দূরেই চলে এলাম। খুব ছিমছাম শহরটি। তবে সুইজারল্যান্ড থেকে আসবার পর সব কিছু খুব পানসে লাগছে। তবে খুব প্রশস্ত শহরটি। আমরা এক ঘন্টার মত হাটছি ঘুরে ঘুরে। সব কিছু দেখছি। হঠাৎ একটা রেস্টুরেন্ট দেখলাম দূর থেকে, মনে হলো মিডলইস্টের। কাছে গিয়ে রায়হান কথা বললো, ঠিকই এরাও লেবানিজ। আমরা জিজ্ঞাসা করতে বললো সব হালাল। যাইহোক ওখানে পর্ক সেল হয় না। এটাই স্বস্তির কারণ। সবাই একটা করে র‌্যাপ নিলাম।

কথার মধ্যে মধ্যে ভাবীর সাথে কথা হচ্ছিল। ভাবী বললো, ভাই একটা কি ঝামেলায় পড়ে গিয়েছে। ভাবীকে খুবই বিব্রত এবং লজ্জিত মনে হলো। রায়হান বললো ঠিক আছে মামি, মামাকে রিলাক্স হয়ে কাজ করতে বলেন, এরকম ঝামেলা হতেই পারে, যেহেতু এটা বিজনেস।

আমার অবশ্য খুব মন খারাপ হলো। আমি জানি ভাই এটা ইচ্ছা করে করেনি। তাহলে সে আমাদের স্টুটগার্টে নামতেই বলতো না। বিরাট কোন ঝামেলা ছাড়া ভাই এটা করবে না। তবুও আমি বেশ বিষণ্ন হয়ে গেলাম। অবশেষে আমাদের ট্রেন এসে গেল, আমরা অতপর ফ্রাঙ্কফুর্ট এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।

আবার নতুন কোন সুন্দরের দিকে ধাবিত হলাম। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com