এশীয় কমিউনিটির বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ বৃদ্ধি
গত দুই বছরে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে টরন্টোতে এশীয় কমিউনিটির বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়েছে। পুলিশের নতুন এক পরিসংখ্যানে এই তথ্য উঠে এসেছে।
২০২১ সালে টরন্টো পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন ঘৃণাজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটে মোট ২৫৭টি, যা ২০২০ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে এমন ঘটনা ঘটেছিল ২১০টি।
অন্যদিকে গত ১৭ মার্চ, ২০২২ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডা’র নতুন এক রিপোটে বলা হয়েছে, শুধু টরন্টোতে নয়, গোটা কানাডায় বসবাসকারী পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের (Hate crime) মাত্রা বৃদ্ধি আগের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। সংস্থাটি জানায়, কভিড-১৯ মহামারীর প্রথম বছরে (২০২০) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় কানাডিয়ানাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০১%।
এদিকে কানাডায় নবাগতদের পরিষেবা দানকারী একটি সামাজিক গ্রুপ ‘সাকসেস’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কুইনি চু কানাডিয়ান প্রেস-কে বলেন, এখানে হেইট ক্রাইমের সংখ্যা আরও অনেক বেশি যেগুলি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয় না। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত, এটি হলো হিমবাহের সামান্য চূড়ামাত্র।”
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য এশিয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এর নিন্দাও করেছেন। ইতিপূর্বে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, “ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যের কোনও জায়গা কানাডায় নেই। কানাডীয় হিসাবে আমরা যেরকম, এরা (ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যকারীরা) সেরকম নয়।”
কানাডায় পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা কোন ঘটনাকে তখনই বিদ্বেষমূলক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় যখন, কেউ কারো জাতি, জাতীয় বা জাতিগত উৎস, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স, মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতা, যৌন অভিমুখীতা বা লিঙ্গ পরিচয় বা অভিব্যক্তি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তাঁর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে প্রথম করোনা অর্থাৎ কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কানাডায়ও ছড়িয়ে পড়ে এই কভিড-১৯ এর ভাইরাস। ঐ সময় থেকেই কানাডিয়ানদের অনেকের মধ্যেই চীন বিরোধী একটি মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে। করোনার জন্য তাঁরা চীনকে দুষতে থাকেন। একই সময় কভিড-১৯ গোটা ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। সেই সাথে এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশেও। এরপর ভারতীয়সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে আসা লোকদের প্রতিও কানাডিয়ানদের কেউ কেউ বিদ্বেষী হয়ে উঠতে আরম্ভ করেন। ফলে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের মাত্রা। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণায় সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে।
মহামারী এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কানাডায় এখনো প্রতিদিন অনেক মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এই অস্থিরতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যত এবং বেগতিক অর্থনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি এশিয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ও ইমিগ্রেন্টরা প্রতিনিয়ত বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন বিনা দোষে। করোনার শিকারও তাঁরাই বেশী হচ্ছেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে ফ্রন্টলাইনের কর্মী বেশী। অর্থাৎ তাঁরা শুধু করোনায় বেশী মাত্রায় সংক্রমিত হচ্ছেন তাই নয়, করোনার কারণে তাঁরা বিদ্বেষেরও শিকার হচ্ছেন। তাঁদের বিপদটা আসছে দুই দিক থেকে। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরী।
আমরা জানি কানাডা অশিক্ষিতের দেশ নয়। তবে একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও কুসংস্কারমুক্ত নয় এমন কিছু লোকের বসবাস রয়েছে দেশটিতে। তারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে এশিয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। এটি একটি সভ্য দেশের চিত্র এরকম হওয়া উচিত নয়। সরকারসহ মূলধারার প্রচার মাধ্যমের দায় রয়েছে কভিড নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি রয়েছে তা দূর করা। তাহলে এশিয়দের প্রতি বিদ্বেষ সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটাই কমবে বলে আমাদের বিশ্বাস।