বন্দুক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য আমেরিকা!
নিজ দেশেই প্রতিবছর গুলি খেয়ে মারা যান ৪০ হাজারেরও বেশী আমেরিকান!!
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : বন্দুক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য এখন আমেরিকা! প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশী নিরাপরাধ মানুষ মারা যান বন্দুকধারীদের গুলিতে এবং এই মারা যাওয়াদের মধ্যে আছে অনেক নিষ্পাপ শিুশুও!!
গত ২৪ মে মঙ্গলবার আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের একটি এলিমেন্টারি স্কুলে এমনই আরেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। সেদিন এক বন্দুকধারীর গুলিতে ১৯ শিশুশিক্ষার্থী এবং ২ শিক্ষক নিহত হয়েছেন। একটি ক্লাস রূমে আটকে রেখে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয় নিষ্পাপ এই শিশুদের।
নিউইয়র্কের বাফেলো টপস সুপার মার্কেটে গুলি চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করার মাত্র ১০ দিন পরেই টেক্সাসে এ ঘটনা ঘটল। শ্বেতাঙ্গ এক তরুণের এলোপাথাড়ি বন্দুক হামলায় ঐ সুপার মার্কেটে যাঁরা নিহত হন, তাঁরা সবাই ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
টেক্সাসের এলিমেন্টারি স্কুলের এই ঘটনা অতীতের বড় দুটি বন্দুক হামলার ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এর একটি হলো ২০১২ সালের হামলা। ঐ হামলার ঘটনাটি ঘটে কানেটিকাটের একটি স্কুলে। সেদিনের হামলায় ২০ শিশুসহ ২৬ জন নিহত হয়। নিহত ওই শিশুদের বয়স ছিল ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ফ্লোরিডার একটি স্কুলে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় ১৭ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিহত হয়। ওই হামলার পর সবচেয়ে বেশি শিশু নিহত হলো এবার টেক্সাসের এলিমেন্টারি স্কুলে পরিচালিত ২৪ মে’র হামলায়।
টেক্সাস পুলিশ জানিয়েছে, ইউভালদের রব এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে ১৯ শিশুসহ ২১ জনকে হত্যা করেন সালভাদর রামোস (১৮)। কিন্তু তার আগে স্থানীয় পুলিশ এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে বাইরে অপেক্ষা করছিল। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পুলিশ কেন এত দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছিল তার ব্যাখ্যা চাইছেন নিহত শিশুদের পিতা-মাতাগণ।
অবশ্য পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন হামলাকারী রামোস। ওই হামলা চালানোর আগে রামোস বাড়িতে তার দাদিকে গুলি করেন। তবে তিনি বেঁচে গেছেন।
টেক্সাসের স্কুলে গুলির ঘটনার পর হোয়াইট হাউস থেকে এক আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, ‘অনেক মা-বাবাই আর তাঁদের সন্তানকে দেখতে পাবেন না। নিহত শিশু কখনোই আর তাদের মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরবে না। সন্তান হারানো এই মা-বাবারা আর আগের মতো থাকবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরেকটি বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ফুটফুটে, সুন্দর সব শিশু মারা গেল। এসব ঘটনায় আমি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
উল্লেখ্য যে, অতীতের ভয়াবহসব বন্দুক হামলার পর এরকম পদক্ষেপ নেয়ার কথা আরো বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে আরো অনেক রাজনীতিবিদ জোরালো সব বক্তব্য দিয়েছেন বন্দুক সস্ত্রাস বন্ধ করার জন্য। কিন্তু আমেরিকার সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্য হলো, বন্দুক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যত বক্তব্যই দেয়া হয়েছে এযাবৎকাল, তার কোনটাই কোন কাজে আসেনি। বন্দুক হামলা অব্যাহত রয়েছে। হামলাকারীরা সদর্পে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। অবস্থাটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে দেশটি বন্দুক সন্ত্রাসীদের এক অভায়ারণ্যে পরিনত হয়েছে।
আর এর পিছনে কাজ করছে মূলত আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফা। এরা এতটাই শক্তিশালী যে, এদের লবিং এবং হস্তক্ষেপের কারণে দেশটিতে অস্ত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বরং অস্ত্র ব্যবসা যাতে আরো বৃদ্বি পায় সে জন্য এখন লবিং চালানো হচ্ছে স্কুল শিক্ষকদের হাতেও অস্ত্র তুলে দেয়ার। আর তারই পরিনতিতে শিক্ষার্থীসহ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তথা বন্দুক তুলে দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রর ওহাইও অঙ্গরাজ্য। গত ৪ জুন এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, স্কুলের শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মীদের ২৪ ঘণ্টার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করার পরে তাদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া হবে।
আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং তাদের সমর্থকদের আশা, নতুন এই আইনটি কার্যকরের মাধ্যমে শিক্ষকদের সশস্ত্র করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে বন্দুক হামলা হ্রাস পাবে এবং এতে করে প্রাণহানির ঘটনায় কমবে। বিলের সমর্থকরা আরো বলছেন, নতুন এই আইনটি কার্যকর হলে স্কুলে হামলার সময় পুলিশ আসার আগেই সশস্ত্র আক্রমণকারীর মোকাবিলা করতে পারবেন স্কুলের কর্মীরা। বিলের স্পন্সর ও রিপ্রেজেন্টেটিভ সদস্য টমাস হল এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের স্কুলগুলোতে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিটি সেকেন্ডের গুরুত্ব রয়েছে এবং এই আইনের মাধ্যমে সম্ভাব্য ট্র্যাজেডি বা বিপর্যয় প্রতিরোধ করা যেতে পারে। তবে শিক্ষকদের ইউনিয়ন এবং ওহাইও অঙ্গরাজ্যের পুলিশ অফিসার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই বিলের বিরোধীতা করে বলা হয়েছে, এটি শিশুদের জন্য স্কুলগুলোকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে।
টেক্সাসের ঘটনার পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের বিছানায় শুইয়ে দেন, গল্প শোনান, গান শোনান। কিন্তু একই সাথে তাদের মনের মধ্যে সারাক্ষণ চিন্তা থাকে- আগামীকাল তাদের বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসার পর কিংবা খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পর, তারা কতটুকু নিরাপদে থাকবে। তিনি বলেন, একটি বন্দুক লবিং গ্রুপ এবং একটি রাজনৈতিক দল যারা এই ট্র্যাজেডিগুলো প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে, তারা এতে কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না।
উল্লেখ্য যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজেও চেষ্টা করেছেন অস্ত্র আইন কঠোর করার জন্য। কিন্তু পারেননি। ২০১৫ সালে, যখন তিনি ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নতুন বন্দুক আইন সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে তার প্রশাসন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় হতাশা।
সম্প্রতি আমেরিকার রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) জানিয়েছে, ২০২০ সালে দেশটিতে বন্দুকধারীর হামলা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বন্দুকধারীর হামলায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজারের বেশি, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। সংস্থাটি আরো জানায়, একবিংশ শতকে এসে আমেরিকায় মানুষের মধ্যে বন্দুক রাখার হারও বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছরে ১৩ কোটি ডলারের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করেছে আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সময় ৭ কোটি ডলার আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করেছে তারা। এর মধ্যে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ৯ মিলিমিটার পিস্তল, রয়েছে আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রও। অর্থাৎ অস্ত্রের সহজলভ্যতা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনা।
গত বছর পিউ রিসার্চ সেন্টারের জনমত জরিপে বলা হয়েছে, আমেরিকানরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনের পক্ষে। ৫৩ শতাংশ আমেরিকান চান আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন হোক। আর ৪৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, কঠোর আইন হলে নির্বিচার গুলির ঘটনা কমে আসবে।
কিন্তু রাজনীতিকেরা হেঁটেছেন উল্টো পথে। যে অঙ্গরাজ্যে মঙ্গলবার গুলির ঘটনা ঘটল, সেই টেক্সাসে গত বছর নতুন আইন পাস হয়েছে। টেক্সাসের নতুন আইন অনুসারে, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্স ছাড়া ১৮ বছর বয়সী তরুণ বা তরুণী আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে।
আমেরিকায় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ কারণে ক্ষমতায় এসেই ২০২১ সালের মার্চে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে দুটো বিলও পাশ করিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তার ওই বিল দুটিও ওসব কালো অস্ত্র থেকে রক্ষা করতে পারেনি নিরপরাধ আমেরিকানদের। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত দেশটিতে বন্দুক হামলা হয়েছে ২৭টি স্কুলে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সংস্থার হিসাব বলছে, ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমেরিকার স্কুলগুলোতে সবচেয়ে বেশি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। ঐ বছর দেশটির স্কুলগুলোতে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে ৯৪টি।
উল্লেখ্য যে, ১০৬৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৭ পর্যন্ত আমেরিকায় বন্দুক সন্ত্রাসীদের হাতে ১৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন। আর কেবল ২০২০ সালেই বন্দুক সন্ত্রাসীদের হাতে মারা গেছেন ৪৫ হজারেরও বেশী আমেরিকান। – তথ্য সূত্র : বিবিসি, এএফপি, এপি, রয়টার্স