প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯১

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘বিশাল বিশ্বে চারিদিক হতে প্রতি কণা মোর টানিছে।

আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ শতকোটি কর হানিছে।

ওরে মাটি, তুই আমারে কি চাস?

মোর তরে, জল, দু’হাত বাড়াস?

নিশ^াসে বুকে পশিয়া বাতাস-চির-আহ্বান আনিছে।

পর ভাবি যারে তারা বারে বারে সবাই আমারে টানিছে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

ঘুম থেকে উঠে কবিগুরুর কবিতা দিয়ে মনটা গুনগুনিয়ে উঠলো। রাতেই সব ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। এখন যেহেতু জানি তাই ব্যাগ নিয়ে, ভোরের দিকে হালকা আঁধারের চাদর শরীরে জড়িয়ে সোজা হন্টন। মাত্র এক ব্লক। স্টেশনে মোটামুটি জনসমাগম। আমাদের ট্রেনে উঠে পড়লাম। তিনজনের জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে নিলাম। পানি এবং চিপস নিলাম।

মিলান থেকে জুখি যেতে প্রায় চার ঘন্টা। সাড়ে তিন ঘন্টার মত লাগবে। তবে পথে ইটালি এবং সুইজারল্যান্ডের বর্ডার, ‘চিয়াসো’ পড়বে। তাই এক্ষেত্রে বলা যাবে না ঠিক কখন আমরা জুরিখে যেয়ে পৌঁছাব। কারণ বর্ডার ক্রস করতে মিনিমাম ১ ঘন্টা লাগবে। আর ট্রেনে প্রচুর মানুষ। কি জাান কতক্ষণ লাগবে? সেই ভোর থেকেই মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে চলছে একাদিক্রমে ভাললাগা, গহীন ভালবাসা এবং অসম্ভব উত্তেজনা। কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না, আমি কি অসম্ভব পরিমান উত্তেজিত ছিলাম এই মিলান টু জুরিখ জার্নিতে। গোটা ইউরোপের জার্নিতে আমি এরকম উত্তেজনা অনুভব করিনি। ট্রেন এর মধ্যে বেশীর ভাগই টুরিস্ট ছিল কারণ কিছুক্ষণ পরই দেখলাম সবাই যার যার ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা কথা বলতে বলতে স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলাম।

সুইজারল্যান্ডে ক্রাউন প্লাজার সামনে লেখক

পথে যেতে যেতে প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো দেখে আমি বার বার চমকে উঠছিলাম। কউকে বলে দিতে হবে না যে আমরা স্বপ্নের দেশটির কাছাকাছি চলে এসেছি।

এদিকে মহিন এর এসএমএস আসছে একটু পর পর। আমার ভাইঝি। সে আমাদের সঙ্গে গোটা ইউরোপ ভ্রমণেই থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। কিন্তু অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি। তারপর ইটালিতে আমাদের কাছে আসার জন্য বাসের টিকিট কেটে রেখেছিল। কিন্তু সে বাসও মিস করেছে। মাহিন খুব ঘুম কাতুরে এবং দেখলাম একটু ধীরে সুস্থে কাজ করে। যাইহোক, আমি বকা দিয়েছিলাম। কারণ ওকে আমরাও খুব মিস করেছি গোটা ইটালি ট্যুরে। সে যেহেতু জার্মানীতে একা থাকে, পড়াশুনা মোটামুটি শেষ করে ভাল একটা চাকরীও পেয়েছে। তবে পার্টটাইম এমবিএ-টাও করছে। আগের বার বাস ফেল করার খেসারত স্বরূপ মাহিন এবার ৩/৪ ঘন্টা আগেই স্টেশনে এসে বসে আছে। বেচারী হোটেলেও যেতে পারছে না আমাদের ছাড়া। তাই জুরিখ এর রেল স্টেশনে বসে আছে। আর আমাদের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এবং একটু পর পর রায়হানের ফোনে কল করে  জিজ্ঞেস করছে, ভাইয়া আর কতক্ষণ? আমি বুঝতে পারছিলাম ওর মনের অবস্থাটা। কারো জন্য অপেক্ষা করাটা বড্ড কঠিন কাজ।

যাইহোক, এরই মধ্যে মন্ত্রমুগ্ধতা বেড়েই চলছিল। আমি ক্রমাগত ছবি তুলে যাচিছলাম। একসময় আমি টের পেলাম, আমার আর ছবি মোটেই তুলতে ইচ্ছা করছে না। রায়হানও বারবার বলছিল, মামনি দুচোখ ভরে দেখো, আবার কবে আসতে পারবে কে জানে। সত্যিই তাই। হয়তো আর আসতে পারবোই না কখনো। এবং সেটার চান্সই সব থেকে বেশী। দিনে দিনে প্রতিটি পায়ের ”িহ্নতো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছে। এই যে আর আমার স্বপ্নের দেশ (যেখানে আমি মনে মনে হানিমুনে যেতে চেয়েছিলাম, সারাটি জীবন আমি যে কটি দেশ দেখতে চেয়েছিলাম তার মধ্যে সুইজারল্যান্ড ছিল অন্যতম। নিসর্গের মধ্যে যদিও কেউ নিজেকে হারাতে চায়, তাহলে এই সুইজারল্যান্ড অন্যতম প্রধান একটি দেশ।

মনে মনে শতবার আমি আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকর আলহামদুলিল্লাহ জানাচ্ছিলাম। আর আমার ছেলে রায়হানের কাছে বার বার কৃতজ্ঞ হচ্ছিলাম। প্রতিটি বাবা-মাই বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তার সন্তানকে মানুষ করে। কিন্তু কজন বাচ্চা সেটা মনে রাখে? আর আমার এই বড় বেশী দুঃসময় ছিল ওটা, যখন আমি শরীরে মননে ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে ছিলাম। মানসিক শক্তি জিরোতে নেমে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, আর এই জীবনে কোনদিন হাটাতে পারবো না। পৃথিবী ঘুরে দেখাতো স্বপ্নের মত। আজ আমার রায়হান সেই আমার ছোট্ট বাচ্চাটি আমার ‘বাবা’ হয়ে আমার বাহু ধরে আমাকে পৃথিবীটা ঘুরে দেখাচ্ছে। আমার স্বপ্নের দেশগুলো একের পর এক। আমি মূলত দুই ছেলে কাছে কোনদিনই কিছু প্রত্যাশা করিনা। তাই অল্প কিছু পেলেই বড় বেশী উদ্বেল হয়ে যাই।

এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য্যে এতটাই মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম যে আমার দু’চোখে জল এসে যাচ্ছিল। এবং কখন জানি ট্রেনটি থেমেছে আমি খেয়ালই করিনি। এটা হলো সেই ইটালি এবং সুইজারল্যান্ডের বর্ডার ‘চিয়াসো’। আশে পাশে দেখলাম, বেশ বিস্তীর্ন এলাকা। ফাঁকা ফাঁকা। একটু পরেই দেখলাম বেশ কজন বর্ডার পুলিশ ট্রেনের ভিতর আসলো। এটি একটি বিশাল রুম। সবাই সুইজারল্যান্ডের যাত্রী। আমাদের পাসপোর্টও দেখলো এবং বললো, সুইজারল্যান্ডে আনন্দ করো। সুইচ পুলিশরা দেখলাম সুইচ জার্মানিতেই কথা বললো। তবে আমাদের সঙ্গে ইংরেজীতেই কথা বললো। খুবই লম্বা চওড়া। চোখ নীল। এবং মিষ্ট-ভাষি। আমি সমগ্র ইউরোপের পুলিশ বা সিকিউরিটিদের মত ভদ্র খুব কম দেখেছি। আর মিডল ইস্টের (ম্যাক্সিমাম) পুলিশদের মত অভদ্র কম দেখেছি। ওদের মধ্যে কোন ভব্যতা জ্ঞান নাই। নিজেদের যেন কি একটা মনে করে। পৃথিবীর সবাই ভিক্ষুক আর তারা হলেন রাজার রাজা। বিশেষ করে সৌদী আরবের পুলিশের মত বর্বর আমি খুবই কম দেখেছি।

সুইজারল্যান্ডে অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য। ছবি: লেখক

যাইহোক, চেকিং পর্ব চলাকালিন একজনকে নীচে নামিয়ে নিলো। জানিনা কেন। আরো অনেকগুলো প্রহর অতিক্রান্ত করে আমরা জুরিখ এ অবতরণ করলাম। যদিও পথে আরো একবার ট্রেন চেক করা লেগেছে। আমাদের ‘গো’ ট্রেনের মত। এবং অবশেষে কাঙ্খিত স্টেশনে নেমেই দূর থেকে দেখলাম বেচারী মাহিন দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রায় ৪/৫ঘন্টা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে কাঁদলো, তারপর খুশীর হাসি দিল। তারপর দেখালো সে এতক্ষণ স্টেশনে ঘুরে ঘুরে আমাদের জন্য সে বিলেতি গাব কিনেছে। রং অনেকটা তালের মত। কিন্তু আপেলের মত সাইজ এবং ভিতরেও ঐরকম। ওর ঠিক মত খাওয়া হয়নি। তাই আমরা প্রথমে হোটেলে এন্ট্রি করলাম। ক্রাউন প্লাজা। সবাই গোসল করে আবার রেডি হয়ে বাইরে বের হলাম। হোটেলের একুট দূরেই একটা রেস্টুরেন্ট থেকে আমরা অনিয়ন রিং এবং বার্গার খেলাম। এখন আমাদের খুবই সুবিধা হয়েছে, মাহিন এদের সাথে জার্মানীতে কথা বলছে। মাহিন জার্মানীতে ১২/১৩ বছর আছে। ওখানে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। ৪ বছর ধরে শুধু জার্মানী কোর্স করেছে। খুব ডিটেলসে। এবং খুব ভাল একটা প্রফেশনাল জব করে। হোটেলে রুম আগেই বুক করা ছিল। তাই মাহিন কোথায় পয়সা খরচা করবে বুঝতে পারছিল না। এবারে রেস্টুরেন্টে টাকা দিতে চাইলো, রায়হান একটা ভাল মতন বাঙ্গালী স্টাইলে দাবড়ানি দিল। রায়হানের কাছাকাছি বয়সের এবং তার থেকে ছোট বয়সের সবাই ওকে খুব সমীহ করে। কারণ ওর মেজাজের কারণে। যার জন্য সবাই ওকে ভালবাসেও। খাওয়া শেষ হলে একটা উবার নিয়ে আমরা  ডাউন টাউনের দিকে চল্লাম। ওখানে আমরা ট্রাভেল সেন্টারের উদ্দেশ্যে চললাম। ওখানে গিয়ে দেখি প্রচুর ভিড়। যদিও একসাথে প্রায় ২০ জন কর্মী কাজ করছে। তারপরও দীর্ঘ লাইন। আমাদের ডাক পড়লো অবশেষে। আমরা আজ নিয়ে মোট চারদিন থাকবো। আগামীকাল জুরিখ এবং আশে পাশের কিছু সিটি ঘুরবো। এবং তার পরের দিন পাহাড়ের উপরে উঠবো।

সুইজারল্যান্ডে রাষ্ট্রীয়ভাবেই ৪টি ভাষার প্রচলন। ইটালিয়ান, রোমান, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান ভাষা। জার্মান এরা বলে সুইজ জার্মান। যদিও এখানে সুইস জার্মান, ইটালিয়ান খুব বেশী চলে। তথাপী ইংরেজীর প্রভাব দিনে দিনে এখানে বেড়েই চলেছে। কারণটা হলো আর কিছু না, বাইরে থেকে আসা প্রচুর দর্শনার্থী। অতএব, ইদানিং সুইজারল্যান্ডে যে কোন চাকরীতেই ইংরেজী ভাষা জানা লোকদের ডিমান্ড বেড়ে চলেছে। যদিও স্থানীয়রা সুইজ জার্মান এবং ইটালিতেই বেশী কথা বলে থাকে। তবে ইদানিং ইটালিয়ান ভাষার চেয়ে ইংরেজীর প্রভাব অনেক বেশী।

সুইজারল্যান্ডের মূল সোর্স অব ইনকামই হলো টুরিজম এবং ব্যাংকিং। এই দুটোই মূলত ইংরেজীর সাথে জাড়িয়ে আছে। এবং সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত হলো এদের ঘড়ি, চকোলেট। একটু গ্রামের দিকে চকোলেটের প্রচুর ইন্ডাস্ট্রী ছড়িয়ে আছে। এছাড়া সুইস ঘড়ির নাম জানেনা এমন খুব কম মানুষই আছে।

তবে সবকিছুই মারাত্মক এক্সপেন্সিভ। সুইজারল্যান্ডে বসবাস করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এমনি স্থানীয়রা পর্যন্ত অনেকেই আসে পাশের দেশগুলোতে গিয়ে থাকে। তারপর বৃদ্ধ বয়সে আবার ফিরে আসে নিজ দেশ এক টুকরো স্বর্গ সুইজারল্যান্ডে। ততোদিনে হয়তো তারা বেশ কিছু টাকা জমিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসে। এখানে বৃদ্ধদের দেখাশোনার অত্যন্ত সুব্যবস্থা আছে। যদিও তার জন্য ভালো অঙ্কের টাকা লাগে। তবে একটি জিনিষ শুনে অত্যন্ত

আনন্দিত হলাম, পৃথিবীর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশী বেতন পেয়ে থাকেন। এবং তারপরই ডাক্তার এবং নার্সরা। তবে একটি প্রাইভেট স্কুলের বাচ্চাদের টিউশিন ফি শুনলেও মাথা ঘুরে যাবে।

সুইস ‘ফ্রাঙ্ক’ এর মূল্যও ইউরোপের মধ্যে সব থেকে বেশী। তবু এরা সুখী। অনেক সুখী।

পৃথিবীর সব থেকে সুখী দেশের মধ্যে ডেনমার্ক। এর পরেই স্থান সুইজারল্যান্ডের। বসবাসের জন্য জুরিখ-কে অন্যতম সুন্দর শহর বলে গণ্য করা হয়।

এই দেশে যদিও ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি ফলো করা হয়, তথাপী দেশটিতে মহিলাদের ভোট দেবার অধিকার রয়েছে। এই দেশের প্রকৃত নাগরিকরা আজও প্রাচীন মন-মানসিকতায় বিশ^াসী। পূরাতন সংস্কারকে আজও আকড়ে রয়েছে অনেক মানুষ; যদিও তার মধ্যেও চোরাকাটার মত ঢুকে পড়ছে পৃথিবীর নানান দেশের টুরিষ্টদের সভ্যতা এবং তাদের নিয়ে আসা সংস্কৃতি।

আমরা তিনদিনের ঘোরাঘুরির টিকিট কেটে ফেললাম। যদিও দ্বিতীয়দিনের ট্যুরটিতে কিঞ্চিত ক্লাইমেক্স আছে। পুরো ব্যাপাটি ওখানে না গেলে বোঝা যাবে না মনে হচ্ছে। আগামীকাল ট্যুারের ব্যাপারটি যদিও স্পষ্ট। এবং আজকের দিনটিতে আমরা নিজেরাই ঘুরবো বলে ঠিক করলাম। টিটিক কেটে বের হতেই দেখি আমাদের কানাডার এবং লন্ডনের মত স্ট্রিটকার এসে ওয়েট করছে। আমরা মাত্র একটি স্টজেপ দূরেত্বে যাবো। ওখানে স্থানীয়দের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি মেলা বসেছে। আমাদের হোটেল ক্রাউন প্লাজা’র ম্যানেজার নিজেই এটা জানালো। এবং সে বললো, ওখান থেকে বেশ কিছু শপিংও করতে পারবো।

আমরা স্ট্রীটকারে উঠলাম। একজন টিকিট চেকার এলো। রায়হান কোন স্টপেজ এ যাবে তা বললো। আমরা চারজনই পাসপোর্ট দেখালাম। এরপর লোকটা যথেষ্ট ‘ত’ মিলিয়ে বললো এজনয় সুইজারল্যান্ড এবং পয়সা নিলো না। আমাদের চারজনেরই মুখ গভীর বিস্ময়ে ‘হা’ হয়ে গেল, বিশাল আকারের। পরে পাশের একজন (স্থানীয়) বললো এই স্ট্রিটকারে ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে পয়সা নেওয়া হয় না। আমরা যারপরনাই খুশীতে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। যদিও এটিও আমাদের টরন্টোর মত অল্প কিছু রাস্তাতেই চলাচল করে। আমরা চারজনই খুউব আনন্দিত চিত্বে পরবর্তী স্টেশনে অবতরণ করলাম। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com