প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯৯

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান     

একটা অসম্ভব সুন্দর সময়ে আমরা গিয়েছি ফ্রাঙ্কফুর্টে। মনে হচ্ছে বাড়ীর একমাত্র মেয়েটির বিবাহ। তাই সারাবাড়ী যেনবা সাজ সাজ রব। ঠিক জার্মানীর এখন এমনই অবস্থা। আর ৩/৪ দিন আছে বড়দিনের। মজার ব্যাপার, আগে দেশে থাকতে শুনতাম, জার্মানীর মানুষরা সব নাস্তিক। তারা কোন ধর্মকর্ম কিচ্ছু করে না। অথচ পর পর দুবার গেলাম দেশটিতে। দেখলাম অন্য চিত্র। বরং এটাই বলা চলে, ওটা সত্যিকারের একটা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যাদেরকে নাস্তিক বলে জানতাম, অথচ আমি অত্যন্ত অবাক হলাম, জার্মানীতে ২২৫০ টি মসজিদ আছে। এর মধ্যে আহমেদীয়াদেরও খুব বড় একটি মসজিদ আছে। শুধু তাই নয়, সেখানে ইসলামিক বিষয়বস্তু আলোচনার জন্য আলাদা সেন্টারও আছে।

এবং মজার ব্যাপার, ফ্রাঙ্কফুর্ট সেন্টারে ক্যাথিড্রাল নামে একটা কর্নার-ই আছে। দারুণ ভাবে সাজানো। মনে হচ্ছে সত্যি কারো বিয়ে হচ্ছে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট সেন্টার সত্যি খুব পরিপাটি। এবারে আমরা হাটতে হাটতে, আসলে বলা উচিত আড্ডা মারতে মারতে চললাম। এখানে আমরা কেউই কারো চেয়ে কম নই। অর্থাৎ আড্ডাবাজিতে। বিশেষ করে আমি, তিন্নি, মাহিন আর রায়হান সব এক সাথে হা হা হি হি চলছে। আমাদের তুলনায় নাসির আর কাজিম কিঞ্চিৎ কম, এবং তারা কিছুটা পেছনে হালকা মেজাজে আড্ডা মারছে।

          ফ্রাঙ্কফুর্ট কেথিড্রাল । ছবি:লেখক 

অবশেষে বিখ্যাত Romerberg (Frankfurt) এ পৌঁছালাম। এটা অবশ্যই একটা পাবলিক স্পেস। আমি হঠাৎ করে চমকে গেলাম। অবিকল ব্রাসেলস্ স্কায়ার এর মত। তবে তারপরই দ্রুত ভুল ভাঙ্গলো। এখানেই সারি সারি অতিব পুরানো প্রাসাদের সারি। তবে প্রাসদের ডিজাইন একদম আলাদা। এই বিল্ডিং এর ডিজাইনটার অভিনবত্ব অসাধারণ। বিল্ডিং এর ছাদের ডিজাইনটা তিন কোনা। খাড়া খাড়া। এবং দারুণ কালারফুল। কি যে সুন্দর। প্রতিটি বিল্ডিং এর কালারের অভিনবত্বে আমি বিস্মিতত হয়ে পড়লাম। মাঝখানে বেশ বড় একটা স্কয়ার খোলা জায়গা (ঠিক ব্রাসেলস এর মত)। এই Romerberg কে সেই জন্য Roman Mountain-ও বলা হয়ে থাকে। ফ্রাঙ্কফুর্টের সিটি রোমার বিল্ডিং এর সামনেই এটা। এবং এই Romerberg 15 century তে করা। বলাবাহুল্য, ক্রিসমাসের সময় এখানে আনন্দের হাট বসে।

এমনিতেও এটা সাধারণ ভাবে ব্যবসায়িক প্লেস। এবং এই Romerberg এ প্রত্যহ টুরিষ্টদের অজস্র সমাগমে ভরপুর থাকে। এত কালারফুল যে, আমার খুবই ভাল লেগে গেল। এখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম।

তারপর হাটি হাটি পা পা করে ফ্রাঙ্কফুর্ট কেথিড্রালের দিকে গেলাম। এটা বাইরে থেকে অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী কেথিড্রালের মত দেখতে। তবে বাইরে থেকে দেখতে এর রঙটা বেশ ডার্ক চকলেট এর মত। দেখলেই বোঝা যায় এর বয়স, অন্যান্য কেথিড্রালের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশী। ভেতরে যাবার পর বুঝলাম, আমার অনুমানই সঠিক। এটা 7th century তে বানানো। এবং এই কেথিড্রালের কোন রকম রেনোভেশন কারা হয় নাই। মনে হচ্ছে জীবন্ত মিউজিয়াম। এটাই এর বৈশিষ্ট্য। কারণ এটা অরিজিনাল। ভাবছিলাম কি ভাবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে? এই ৯৫ মিটার (৩১২ ফিট) হাইটের গীর্জা?? এই জন্য বাইরের কালারটা বেশ (ডার্ক চকলেট) কেমন মলিন বর্ণের হয়ে গেছে। সেই জন্য এটা আরো বেশী আকর্ষণীয় টুরিষ্টদের কাছে। তবে ভেতরটা খুব সুন্দর। এটা রোমান ক্যাথলিকদের চার্চ। এবং এটা হার্ট অফ দ্যা ফ্রাংফুর্ট। 

মধ্যবয়সী এক জার্মান রাস্তায় মিউজিক বাজাচ্ছে     

এই গীর্জাটি Gothic architecture স্টাইলে করা। এবং Architects:- madern, Gerthener, Hermann Mackler, Alois Giefer.

আমরা ভেতরে অনেক্ষণ ছিলাম। অনেক বড় বড় প্লেটে বিভিন্ন বক্তব্য লেখা আছে। এই গীর্জা বানাবার ইতিহাস থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছ্।ু তবে ভেতরে কোথাও ছবি তুলিনি। কারণ ওখানে কেউ ছবি তুলছিল না। এর আগেও আমার এরকম অভিজ্ঞতা যে হয়নি তা নয়। অটোয়ায়, কানাডার একটি এরকম বহু পুরাতন গীর্জায় গিয়েছিলাম, সেখানে যখন ভেতরে গিয়েছিলাম, দেখলাম লেখা আছে ছবি তোলা নিষেধ।

অথচ, রোমান ক্যাথলিকদের মেইন সেন্টার ভ্যাটিক্যান সিটিতে কিন্তু আমরা অবিরাম ছবি তুলেছি। এমনকি যেখানে সর্বদা প্রার্থনা হচ্ছে, সেখানেও দেখেছি টুরিস্টরা ছবি তুলছে। যদিও আমি তুলিনি।

যাইহোক, আমরা কেথিড্রাল থেকে বের হয়ে একটি ওপেন রেস্টুরেন্টে গেলাম। খুব মজার। ভেতরে অর্ডার দিতে হয়। বাইরে বেশ বড় একটা চত্ত্বর, প্রচুর চেয়ার টেবিল সাজানো, তার দুই সেট একত্রিত করে আমরা বসে পড়লাম। আমি আর কাজিম বাইরে গিয়ে খাবারের ব্যাপারে খুবই পিকি। যদি না খেতে পারি তো আরো ভাল হয়। কিন্তু তিন্নি, মাহিন, সব চিল্লা পাল্লা করলো, ‘রায়হান ভাইয়া ক্ষুধা লেগেছে’। অতএব নাসির আর রায়হান ভেতরে গিয়ে আর্ডার দিল। ঠিক ওখানে কোন হালাল খাবার নাই। আমরা অবশ্য সেটা আশাও করিনি। ওরা সবাই অবশ্য ভেজ বার্গার আর কফি নিল। আমি আর কাজিম বার্গার একদম পছন্দ করি না। অতএব আমরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিলাম এবং সবাই কফি নিলাম।

এখানে যেহেতু ওপেন ছিল- আশপাশে মজার কিছু দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। আমি এমনিতেই একজন দারুন মিউজিক প্রেমিক। তাই দারুন উপভোগ্য একটি দৃশ্য দেখে আমি একদম হতভম্ভ হয়ে গেলাম। দেখলাম একটি লোক কিছু একটা মিউজিক বাজাচ্ছে। এটা খুব আশ্চার্য্যের কিছুই নয়। সারা নর্থ আমেরিকা এবং ইউরোপের ডাউনটাউনে এগুলো দেখা যায়। অনেকে অনেক কিছু প্রদর্শন করে এবং অবশ্যই অর্থ প্রাপ্তির আশা করে। একটি দোকানের সামনে একজন মধ্যবয়সী এক জার্মান (ট্রাইব মনে হলো) মিউজিক বাজাচ্ছে। নেচেনেচে। আমি একমাত্র বাঁশি ছাড়া আর কোন কিছুর নাম মনে করতে পারছি না। অন্ততপক্ষে ২০ টির মত মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট বাজালো সে। এক একটি ৫/৭ মিনিট। আমি এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে খাওয়া ভুলে যাবার দশা হলো। ভাবছিলাম, এরকম একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি রাস্তায় ভিক্ষা করছে কেন? আশ্চর্য! নাসির বললো এরা খুবই স্বাধীনচেতা। কারো বশ্যতা পছন্দ করে না। তবে এর ইনকাম দেখলাম ভালই। একটি গিটারের বক্সে প্রচুর টাকা জমেছে। শুনলাম সে সপ্তাহে এখানে ৪ দিন আসে। আমি কিছু ইউরো দিলাম। আর মানুষটি অসম্ভব মনোযোগি। যেটাই বাজাচ্ছে, মনে হচ্ছে তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।

যাইহোক, খাওয়া হলো, মিউজিক শুনে দারুনভাবে মন ভরে গেল। এবারে জার্মানির একটি বিখ্যাত মিউজিয়াম দেখতে যাব। এটাও সেন্টারে। অতএব এবারে সে দিকে পা বাড়ালাম।

মিউজিয়ামটাও আজই দেখতে হবে, কাল সময় খুবই কম আমাদের। (চলবে)

রীনা গুলশান

টরন্টো

gulshanararina@gmail.com