তাসের আড্ডা-২০

শুজা রশীদ

ওমিক্রনের প্রবল আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে ওন্টারিও গভর্নমেন্ট আবার নতুন করে বিধি নিষেধ আরোপ করার ফলে রনিদের তাসের আড্ডা দীর্ঘদিন পর শুরু হয়েও আবার বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল। নিয়ম হয়েছে অতিথিসহ কোন বাসায় চার জনের বেশী থাকতে পারবে না। যার অর্থ কোন বাসাতেই তাদের আপাতত জমায়েত হবার কোন উপায় নেই। সবাই যে নিয়মকানুন মানছে তা নয় কিন্তু রনিরা সবাই মোটামুটিভাবে নিয়ম মানতেই আগ্রহী। অকারণে অসুখ বিসুখ বাঁধিয়ে হুজ্জতে পড়তে কেউই চায় না। সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী জানুয়ারী মাসের শেষের যদি দৈনিক কোভিডে আক্রান্তদের সংখ্যা কমে আসে তাহলে নিয়ম শিথিল করা হবে। রনি তাস খেলাটা চালিয়ে যাবার পক্ষপাতী। সে প্রস্তাব দিয়েছে অনলাইনে তাস খেলা চলবে আর জুমে চলবে আড্ডা। কিছু ঝুট-ঝামেলার পর শনিবার রাতে সে নিজেই ব্যাক্তিগত উদ্যোগে আগ্রহীদেরকে অনলাইনে সমবেত করেছে। ফ্রি ব্রিজ খেলার কয়েকটা ভালো সাইট আছে। সেখানে তাসাড়ুরা লগ ইন করে যথেচ্ছা খেলতে পারে। বন্ধুরা নিজেদের বাছাই করা টেবিলে যোগ দিতে পারে। রনিরা যে সাইটে যোগ দিয়েছে সেটা কন্ট্রাক্ট ব্রিজের। তাদের দলে সবাই কন্ট্রাক্ট খেলতে পারে না, যে কারণে খেলা অকশনেই হচ্ছে। রনি আলাদা একটা কাগজে পয়েন্ট লিখছে। কন্ট্রাক্ট আর অকশন ব্রিজের পয়েন্ট সিস্টেম একেবারেই ভিন্ন। একটু সমস্যাজনক মনে হলেও সেই সব নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। সবাই মিলে একটু আড্ডা মারতে পারাটাই উদ্দ্যেশ্য।

                আজকের আলাপ শুরু করেছে জালাল। একটা অভিনব প্রসঙ্গ তুলেছে সে। “পিনাকি ভট্টাচার্যের নাম কি আপনারা কেউ শুনেছেন? আমি শুনিনি। কিন্তু তার একটা ভিডিও ক্লিপ দেখে একটু থমকে গেলাম। আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছে। আপনাদেরকে পাঠাই। দেখেন আগে।”

                রনি ভদ্রলোকের নাম কখন শোনেনি। ক্লিপটা দেখার পর ঝট করে একটু গুগল করল। সে ব্লগার, পলিটিকাল এক্টিভিস্ট এবং হিউম্যান রাইটসের সমর্থক। বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে সে এখন ফ্রান্সে রেফিউজি হিসাবে বসবাস করছে। 

                সাইদ বলল, “আমি শুনেছি তার কথা। কথবার্তা যা বলে সব একেবারে অযৌক্তিক নয়। হাসিনা আর মোদীর বিরুদ্ধে সোচ্চার।”

                জিত বলল, “ভিডিওটা দেখলাম। ৭০ এর নির্বাচনে কি হয়েছিল সেটা নিয়ে এতোদিন পর নতুন করে আলাপ শুরু করার দরকারটা কি?”

                জালাল বলল, “ইলিয়াস কাঞ্চন আর এম পি ফারুক ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কি বলেছিল সেটা দেখেছেন? ইলিয়াস কাঞ্চন বলছে তার তখনও ভোটা দেবারই বয়েস হয়নি কিন্তু সে প্রচুর ভুয়া ভোট দিয়েছিল ৭০ এর পাকিস্থানের সাধারণ নির্বাচনে। আর ফারুক মশাই বলছে সে নাকি তখন ক্লাশ এইটে পড়ে আর শেখ মুজিবর রহমান তাকে বলেছেন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে যেভাবে হোক পাশ করতে। যার অর্থ বঙ্গবন্ধু তাকে নকল করতে বলেছেন। তারা এই জাতীয় কথাবার্তা কি করে বলতে পারল? এর মধ্যে কি আসলেই কোন সত্যতা আছে?”

                রনি বলল, “তাদের মুখের কথা অবিশ্বাস করবার তো কারণ দেখি না। যদি সেই সময় পাকিস্থানের করাল গ্রাস থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য বঙ্গবন্ধু যদি নানা ধরনের পন্থার সুযোগ নিয়ে থাকেন তাহলে আমি অন্তত তকে দোষ দিতে পারব না। একটি গন্তাতান্ত্রিক দেশে প্রথাগত ভোট আর দুই অসম পাকিস্থানের ভোটের মধ্যে আমি তেমন যোগসাজষ দেখি না। আমাদের মুক্তি পাবার জন্য যদি কিছু অনৈতিক কাজ করে থাকতে হতে পারে তাহলে তাই সই। কিন্তু পিনাকির ভাষ্য অনুযায়ী ইলিয়াস কাঞ্চন এবং ফারুক বাংলেদেশের ইদানিংকার ভোটের কারচুপি জাতীয় ব্যাপারকে নৈতিকতা দেবার জন্যই ৭০ এর নির্বাচন এবং শেখ মুজিবকে টেনে এনেছে।”

                জিত বলল, “এই জাতীয় কথাবার্তা এখন বলার কোন অর্থ হয় না। কিছু পাকিস্থানী এখনও অজুহাত খোঁজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে। কয়েকদিন আগেই পড়ছিলাম পাকিস্তানে ‘জো বিচার গায়ে’ নামে একটা সিরিয়াল বানিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কে নিয়ে। সেখানে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিপ্লবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দেখানো হয়েছে অনাচারী হিসাবে আর পাকিস্থানী অফিসারেরা হচ্ছ নীতিপরায়ন ভদ্রলোক। চিন্তা করেন! স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও তারা এখনও আমাদের পেছনে লেগে আছে। তাদেরেকে ইন্ধন যোগানোর তো দরকার নেই।”

                সাইদ বললেন, “আরে, ঐ ইন্টারভিউ তো হয়েছিল ২০১৮ তে। তিন বছর আগে। তারপর কত জল গড়িয়ে গেছে।”

                রনি বলল, “এই জাতীয় তথ্য কেউ কখনও ভোলে না। যাদের যখন প্রয়োজন হবে তারা ঠিকই টেনে বের করবে।”

                কবীর বলল, “এই সব অনেক স্পর্শকাতর ব্যাপার। একেক জন একেকভাবে দেখে। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা যাঁচাই করাও অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য। আমার বাবা শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আমার কাছে পাকিস্থানী মাত্রই হারামী। ৭০ এর ভোটে কারচুপি হয়েছে কি হয়নি তাতে আজ আর কার কি আসে যায়? এই প্রসঙ্গে কথা না বলাই ভালো। অকারণে কাঁদা ঘাটা।”

                জালাল বলল, “কবীর মিয়া ঠিকই বলেছে। ওর মনে হয় খারাপ লাগছে এই আলাপ। আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”

                রনি বলল, “আগে হাতের তাস দেখে একটা কল দেন। গত পাঁচ মিনিট ধরে বসে আছি আপনার কলের অপেক্ষায়।”

                জালাল লজ্জিত কন্ঠে বলল, “দিচ্ছি, ভাই, দিচ্ছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল বলে মনযোগ দিতে পারছিলাম না। তাছাড়া আপনার এই ঘোড়ার ডিমের অনলাইন বোর্ডও আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”

                রনির কিছু সময় গেল জালালকে আবার সব কিছু ব্যাখ্যা করতে। শেষ পর্যন্ত জালাল কল দেবার পর খেলা দ্রুত এগুতে লাগল।

আদিবাসীদের সাথে কানাডা সরকারের ৪০ বিলিয়ন ডলারের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ডিল হয়েছে।  ছবিতে দেখা যাচ্ছে ন্যাশনাল ডে অফ ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন ডে উপলক্ষে আদিবাসী শিশুদের পদযাত্রা। ছবি: এড্রিয়ান ওয়াইল্ড/কানাডিয়ান প্রেস

                জিত বলল, “আদিবাসীদের সাথে কানাডা সরকারের ৪০ বিলিয়ন ডলারের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ডিল সম্বন্ধে আপনাদের কি মতামত?”

                এবারের খেলা নিয়েছে সাইদ। গেম হবার চান্স আছে। সে বলল, “দাঁড়াও, গেমটা দিয়ে নেই। তারপর বলছি।”

                রনি বলল, “কানাডা সরকারের তো পালাবার জায়গা নেই। আদিবাসীদের ছেলেমেয়েদেরকে রিজার্ভে

নিজেদের আবাস থেকে বের করে বোর্ডিং স্কুলে দিয়েছে, ফস্টার ফ্যামিলিতে দিয়েছে। দরকার ছিল সামগ্রিকভাবে রিজার্ভে আদিবাসীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সাহায্য করা। কত বাচ্চারা মারা গেছে বোর্ডিং স্কুলে। চুপি চুপি কবর দিয়ে মনে করেছে সমস্যা চুকে গেল।”

                জিত বলল, “এই জাতীয় একটা প্রোগ্রাম সরকার কি করে এতোগুলো বছর চালিয়ে গেল, ভাবতেও অবাক লাগে। কিছুদিন পরপরইতো নতুন নতুন কবরখানা বের হচ্ছে।”

                রনি বলল, “এবং পুরো প্রোগ্রামটাই হয়েছিল চার্চের তত্ত্বাবধানে। ভাবা যায়? রিজার্ভে বাসার বাইরে বাচ্চারা খেলছে সেখান থেকে পুলিশের সহায়তায় তাদেরকে তুলে বোর্ডিংয়ে দেয়া হয়েছে! অনেক ক্ষেত্রে নাকি বাবা-মাকেও জানানো হয় নি! অচিন্তনীয়!”

                সাইদ অনেক মনযোগ দিয়ে খেলেও শেষ রক্ষা করতে পারল না। একটা ট্রিকস শর্ট হয়ে গেল। সে মনক্ষুন্ন হয়ে বলল, “ধেত্তেরি! তোমাদের আলাপের জন্যই হিসাব গোলমাল হয়ে গেল।”

                জিত হাসতে হাসতে বলল, “হিসাব ঠিকই ছিল সাইদ ভাই, কলটা একটু বেশী দিয়ে ফেলেছেন। এবার আপনাদের গেম হত না। একটা ফিনেসও কাজ করে নি।”

                জালাল বলল, “আরে রাখেন আপনার গেম। মানুষের জীবন নিয়ে কথা। সাইদ ভাই, আপনার তো আবার স্মৃতি শক্তিটা খুব ভালো। কানাডার আদিবাসী সন্তানদের নিয়ে এই কেলেংকারীর ইতিহাসটা একটু খুলে বলেন তো।”

                সাইদ বলল, “সে তো অনেক বড় ইতিহাস। খুব সংক্ষেপে বলি। এই প্রোগ্রাম প্রথম শুরু হয়েছিল ১৮৩১ সালে। সরকারী অর্থে আর খৃষ্টান চার্চের তত্ত্বাবধায়নে। উদ্দ্যেশ্য কি ছিল সেটা সহজেই বোধগম্য। একই কাজ শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টানরা সবখানেই গিয়ে করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি আর খৃষ্টান ধর্ম আদিবাসীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া এবং ধীরে ধীরে স্থানীয় সংস্কৃতিকে সরিয়ে ফেলা। সমস্যা হচ্ছে বোর্ডিং স্কুলগুলোতে একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের হাতে ফলে বাচ্চারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতনের শীকার হলেও তার বহির্প্রকাশ কখন হয় নি। আর এই স্কুলগুলো রিজার্ভ থেকে এতো দূরে দূরে অবস্থিত ছিল যে বাবা-মায়েদের পক্ষে সেখানে গিয়ে খোঁজ খবর নেয়াও কঠিন ছিল। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত আরেকটা প্রোগ্রাম চালু ছিল। সেটাকে বলা হত Sixties Scoop।  আদিবাসীদের বাচ্চাদের ধরে ধরে হয় ফস্টার হোমে দেয়া হত নয়ত শ্বেতাঙ্গ পরিবারের কাছে দত্তক হিসাবে দেয়া হত। যাইহোক,বোর্ডিং স্কুলে যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদেরকে সরকার ইতিমধ্যেই ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এখন যে চুক্তিটা সরকার এবং আদিবাসীদের মধ্যে হচ্ছে সেটা হচ্ছে সিস্টেমেটিক আন্ডারফান্ডিংয়ের জন্য। যার অর্থ আদিবাসীদের সন্তানদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নে সরকার তুলনামূলকভাবে কম অর্থ প্রদান করেছে।”     

রনি বলল, “হ্যাঁ, এই চুক্তির সময় সীমা ১৯৯১ থেকে ২০২২ এর মার্চ মাস পর্যন্ত। সব ঠিক ঠাক মত হলে বাচ্চা প্রতি নিদেনপক্ষে ৪০ হাজার করে পাবে। অর্থটা যথাযথভাবে ব্যবহার হলেই হয়। রিজার্ভগুলোতে জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হলে সরকারকে আরোও অনেক অর্থ আর শ্রম দিতে হবে। দূর্নীতি সেখানেও প্রচুর। দারিদ্র, শিক্ষার অভাব, ড্রাগস, মদ সব মিলিয়ে অনেক রিজার্ভের সামগ্রিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।”

                বেলা এসে হাজির হল। “তোমাদের ভটভটানি কেমন চলছে?”

                “ভটভটানি? আমরা গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে আলাপ করছি।” রনি আপত্তি জানাল।

                জালাল বলল, “ভাবী, আমরা কিন্তু স্পিকারে সব শুনছি। আপনি আমাদের সম্বন্ধে এত মন্দ ধারনা পোষণ করেন?”

                বেলা হেসে ফেলল। “না, না, জালাল ভাই। আপনাদেরকে বলি নি। আমারটাকে বলছি। সারাক্ষণ এমন ভাব দেখায় যেন কি এক বিদ্যাগজ হয়ে গেছে।”

                স্পিকারে রুমার কন্ঠ শোনা গেল। “আরে বেলা, তোমারটা বিদ্যাগজ হলে আমারটাতো প্রফেসর। সবাইকে লেকচার দিচ্ছে। বললাম চল গাড়ী নিয়ে বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি। কারো বাসায় না গেলাম। কিন্তু উনি বসলেন তাস খেলতে।”

                “তোমরা তোমাদের মত আড্ডা দাও,“ সাইদের কন্ঠ শোনা গেল।

                বেলা বলল, “সাইদ ভাই, আপনাদেরকে না জ্বালালে আমাদের আড্ডা জমে না। আচ্ছা, টেক্সাস সিনাগগে যে জিম্মি নেবার ঘটনাটা ঘটল সেই ব্যাপারে আপনার মতামত কি?”

                সাইদ বলল, “আমি আর কি বলব? কয়েকজনকে জিম্মি নিয়ে একজন বড় মাত্রার হাজতির মুক্তি চাইলেই হল? আমেরিকা কখন ছাড়বে আফিয়া সিদ্দিকীকে!”

                “অনেকেরই তো ধারনা আফিয়া টেররিস্ট ছিল না,” বেলা বলল। “তার মুক্তির দাবীতে স্থানীয় ইসলামিক সংগঠনও সোচ্চার।”

                জালাল বলল, “আফিয়া সিদ্দিকী কে?”

                সাইদ বলল, “আফিয়া সিদ্দিকী ছিল এক পাকিস্থানী ছাত্রী। আমারিকায় ছিল ১৯৯১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত। এম আই টি থেকে বায়োলজিতে গ্রাজুয়েশন করেছিল। পি এইচ ডি করেছিল ব্র্যান্ডেইস থেকে। তাকে আমেরিকানরা বন্দী করেছিল আফগানিস্থানের গজনি থেকে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে। তার কাছে নাকি ডার্টি বোম্ব বানানোর ডকুমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল। আরোও ছিল নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন ল্যান্ডমার্কের উপর নোট যেমন এম্পেয়ার স্টেট বিল্ডিং, ব্রুকলিন ব্রিজ ইত্যাদি। আমারিকানরা যখন ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তখন সে কোত্থেকে একটা রাইফেল নিয়ে সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। সেই কারণেই এটেম্পটেড মার্ডার কেসে ফেঁসে যায়। এখন টেক্সাসে ফোর্ট ওয়ার্থ প্রিজনে ৮৬ বছরের জেল খাটছে।”

                বেলা বলল, “কিন্তু আসলেই কি আফিয়া কিছু করেছিল নাকি আমেরিকানরা টেরোরিজমের নামে তাকে অকারণে জেলে পুরেছে। ২০০১ এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আমেরিকানরা যাকে তাকে ধরে টেররিস্ট বানিয়েছে।”

                রনি বলল, “কিন্তু ব্রিটিশ পাকিস্থানি মালিক ফায়সাল যা করেছে সেটা তো নিশ্চয় টেররিজম।” 

                বেলা বলল, “আমি কি বলেছি ঐ লোকটা ঠিক কাজ করেছে? তার ভুলের মাশুল তো সে নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছেই। যাই হোক, একটা উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে অকারণে জেলে পচে মরছে পড়ে আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। তাই প্রসঙ্গটা তুল্লাম। যাই হোক, আপনারা কেউ চা নাস্তা খেতে চান?”

                কবির বলল, “ভাবী, চা নাস্তা কি ডেলিভারি দেবেন?”

                বেলা হাসতে হাসতে বলল, “না, ভাই। ডেলিভারী দেব না। ভার্চুয়ালী খেলতে যখন পারছেন, ওটাও ভার্চুয়ালীই পাবেন।”

                রনি বলল, “আমি তো বাস্তবেই তোমার সামনে। আমাকে অন্তত কিছু দাও।”

                “তুমি কখন আমার কোন কথায় সমর্থন কর না,” বেলা রাগ দেখিয়ে বলল। “নিজের চা নিজে বানিয়ে খাও। আমি চললাম। দেখি আমরা মেয়েরা একটা ভার্চুয়াল আড্ডা দিতে পারি কিনা।”

                 বেলা চলে যেতে জিত বলল, “আজ দেখি লাল ভাইয়ের খবর নেই। ওনার মনে হয় ভার্চুয়াল পছন্দ নয়।”

                রনি বলল, “লাল ভাইয়ের আবার টেকনলজিতে সমস্যা আছে। কিভাবে ঢোকা যাবে তার ইন্সট্রাকশন পাঠিয়েছিলাম। মনে হয় বুঝতে পারে নি। যদি এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে হাতে কলমে শিখাতে হবে। সাইদ ভাই, আবার শর্ট খেলেন?”

                সাইদ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। “আমার কি দোষ? তোমার ডাক হয় দুইটা, তুমি দিয়েছ চারটা।”

                রনি হসে ফেলল। “ভাই, আমি একটু অতিমাত্রায় অপটিমিস্টিক। অসুবিধা নেই। পরের বার একটু চেপে চেপে কল দেব।”

                কয়েক হাত খেলার পর জালাল বলল, “আচ্ছা, এই যে রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে এতো ঝড় ঝাপটা চলছে, রাশিয়া কি সত্যি সত্যিই ইউক্রেন আক্রমণ করে বসবে নাকি?”

                “অসম্ভব না,” জিত বলল। “আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন না থাকলে এতোদিনে নির্ঘাত করেই বসত। পুটিন এখন একটু হিসাব করছে। ঠিক কি করবে কে জানে। কিন্তু কিছু যে করবে তাতে সন্দেহ নেই তা সে এখনই হোক আর কয়েক মাস পরেই হোক।”

                কবীর বলল, “পুটিনের কাজই হচ্ছে ফ্যাঁকড়া বাঁধান। ইউক্রেন এখন সার্বভৌম দেশ। সেখানে গিয়ে সে কেন ঝামেলা করছে?”

                সাইদ বলল, “উপায় নেই তো। এই সব শুরু হয়েছিল ২০১৩ তে যখন ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে পলিটিকাল এবং ট্রেড ডিল করেছিল। ইউক্রেনিয়ানরা চায় রাশিয়ার প্রভাব থেকে সরে গিয়ে আরোও ইউরোপ ঘেঁষা হতে। রাশিয়া সঙ্গত কারণেই সেটা হতে দিতে চায় না। যে কারণে ২০১৪ তে রাশিয়ানপন্থী ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইউক্রেনের দানেস্ক এলাকায় রাশিয়ানপন্থী বিপ্লবীদেরকেও সরাসরি সহায়তা করতে শুরু করে।”

                জিত বলল, “নাটো ইউক্রেনে অস্ত্র সরবারাহ করছে, তাদের সেনাদের ট্রেনিং দিচ্ছে – এইসব পুটিনের পছন্দ হচ্ছে না। তার ভয় হচ্ছে আমেরিকা আর নাটো ইউক্রেনে উন্নতমানের মিসাইল সিস্টেম ডিপ্লয় করবে যেখান থেকে সহজেই রাশিয়াকে আক্রমণ করা সম্ভব হবে।”

                জালাল বলল, “সত্যি সত্যিই যদি রাশিয়া আক্রমন করে তাহলে আমেরিকা কিংবা নাটো কি করবে?”

                সাইদ বলল, “আক্রমণ করবে সেটা মনে হয় না। কিন্তু যদি কোন অজুহাতে রাশিয়া ইউক্রেনে ঢুকেই যায় তাহলে পশ্চিমা শক্তিরা কি করবে সেটা দেখার বিষয়। ইউক্রেন নাটো মেম্বার না, সুতরাং নাটো মেম্বারদের মত সেকিউরিটি গ্যারান্টি তার নেই। যদিও ভবিষ্যতে নাটো মেম্বার হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।”

                কবীর বলল, “জো বাইদেন তো দেখি শুধু স্যাংশনের কথাই বলে। তাতে কি কাজ হবে?”

                রনি বলল, “কিছু তো হবেই। ফরেইন ক্রেডীট আর ইনভেস্টমেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে রাশিয়ার ইকনমিক গ্রোথ একেবারে শূন্যতে নেমে আসবে। মানুষের কাজ কর্ম থাকবে না। তার একটা সরাসরি প্রভাব পুটিনের উপর তো পড়বেই। তাতে কাজ হয় বলেই তো পশ্চিমা দেশগুলো সেই ভয় দেখায়।”

                জিত বলল, “আচ্ছা, এই প্রসঙ্গে যখন আলাপ হচ্ছেই তখন এই বিষয়ে একটা জোক বলি।”

ইউক্রেন থেকে একটা কুকুর তড়িঘড়ি করে বর্ডার পার হয়ে রাশিয়া যাচ্ছে। একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি এতো তাড়াহুড়া করছ  কেন?”

কুকুরটা বলল, “ইউক্রেনে জীবন খুবই কঠিন। সেই জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাশিয়াতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সপ্তাহ খানেক পরে কুকুরটা পাগলের মত ছুটতে ছুটতে বর্ডার পার হয়ে ইউক্রেনে ঢুকল। একই ব্যাক্তি অবাক হয়ে জানতে চাইল, “কি ব্যাপার, তুমি এমন উন্মাদের মত পালিয়ে এলে কেন?”

কুকুরটা বলল, “তারা আমাকে ঘেউ ঘেউ করতেও দেয় না।”

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

টরন্টো