প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯০

রীনা গুলশান

‘রোম’ কে মনে মনে বিদায় জানিয়ে রাতের ডিনার সেরে হোটেলে প্রবেশ করলাম। আগামী কাল খুব ভোরে ট্রেন। যাব ইটালীর ‘মিলান’ শহরে। ভোর ৫:২০ এর ট্রেন ছাড়বে। মিলানে পৌঁছে যাব ৮:৩০ এ। তিন ঘন্টার জার্নি। রাতে তাই আমরা বেশী সময় আড্ডা না মেরে সব গুছাতে শুরু করলাম। ৪:৩০ এ টেক্সি আসবে। কথা বলা আছে। যদিও স্টেশনে যেতে ১০ মিনিটের বেশী লাগবে না। তবু স্টেশনে অনেকরকম ফর্মালিটিস থাকে। তাই একটু আগে যাওয়া ভাল।

ভোরে উঠে গোছগাছ করে নীচে নেমে এলাম। পথে যেতে যেতে আবারো দু’চোখ ভরে রোম-কে দেখে নিচ্ছিলাম। চোখের ভিতরে স্মৃতির এ্যালবামে শুষে নিচ্ছিলাম।

এত ভোর, তবু স্টেশন ব্যস্ততায় ভরা। এখনো রাতের আঁধার পুরোপুরি কাটেনি। ২/৩টা দোকান ও রেস্টুরেন্ট ঘুরে রায়হান খাবার কিনলো। সকালের নাস্তা পথে যেতে যেতে সারবো। এমনকি কথা আছে আমরা মিলানে যেয়েই নাস্তা খেতে পারবো হোটেলে। কারণ ৯:৩০ থেকে ১০টা পর্যন্ত হোটেলে নাস্তা সার্ভ করে।

ট্রেনটা ছাড়লো একদম কাটায় কাটায়। এরা এত পাংচুয়াল যে চিন্তাই করা যায় না। ৩ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব মিলান। আমাদের কথা ছিল ভেনিসে যাবার। তারপর অনেক আলোচনার পর মিলান-কেই বেছে নিয়েছে রায়হান। আমার মূলত ভেনিসের সৌন্দর্য নয়, আমার ফুপাতো ভাই থাকে, তাকে দেখার আকর্ষণই বেশী ছিল। পরে শুনলাম আমার ভাই কাইয়ুম লন্ডনে গেছে। তাই আমরা মিলান-কেই বেছে নিয়েছি। কারণ ভেনিসের অনুরুপ সৌন্দর্য আমি ৪/৫ জায়গাতে দেখে এসেছি। তাছাড়া মিলান সিটি নানা কারণেই সুবিখ্যাত।

ইউরো ট্রেনে জার্নি করা অসম্ভব আনন্দদায়ক। ট্রেনে উঠেই খাবার নিয়ে জানালার পাশে বসলাম। সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝে মধ্যে ছবি তুলছিলাম। এরই মধ্যে ট্রেন কখন যেন চলে এলো মিলানে। ঘড়ি দেখলাম ৮:৩৫ এর মত। একটা উবার নিয়ে হোটেলে চলে এলাম। ভাবতেও পারিনি হোটেলটি এত কাছে। হোটেল ‘ক্রাউন প্লাজা’। মনে হলো এক ব্লক দূরেও না। যাই হোক আমরা যার যার রুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে, একেবারে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।

মিলান শহরটি অসম্ভব পরিচ্ছন্ন। একেবারেই রোমের মত নয়। গোটা রোম শহরটাকেই মনে হয় একটা মিউজিয়াম। কিন্তু মিলান অনেকটাই আলাদা। রাস্তাগুলো বেশ চওড়া। শহরটাও অনেটাই অন্যরকম। তাছাড়া মিলান সিটি নানান কারণে বিখ্যাত। প্যারিসের পরই ফ্যাশনের দিক দিয়ে মিলান এর অবস্থান। ইটালীর টোটাল বিজনেসের দিক দিয়ে মিলানের অবস্থান অন্যতম। বিশেষত স্টক এক্সচেঞ্জ। এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় মিলান নিত্য নতুন আইডিয়লজিতে বিশ্বাসী। এ ছাড়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রতে তারা অনেক এগিয়ে। যার জন্য ইটালীর বিখ্যাত শপিং মলও এই মিলান শহরেই।

সরা পৃথিবীর বিস্ময় খবড়হধৎফড় ফধ ঠরহপর ’র ‘খধংঃ ঝঁঢ়ঢ়বৎ’ শিল্পকর্ম। ছবি: লেখক

এছাড়া শিল্পকলায়ও মিলানের অবস্থান অন্যতম। তার মধ্যে সরা পৃথিবীর বিস্ময় Leonardo da Vinci ’র ‘Last Supper’ শিল্পকর্মটি এই শহরেই আছে। সারা পৃথিবীর ‘তুলি শিল্পী’ প্রেমীরা মিলানে ছুটে আসে এই ‘Last Supper’ দেখার জন্য।

মিলানে প্রচুর ভিজিটর আসে আর সেই কারণে শহরটি যথেষ্ট এক্সপেনসিভ। সারা পৃথিবীর মধ্যে ৩৩তম অবস্থানে আছে ব্যয়বহুলতার দিক থেকে। যেখানে রোম এর অবস্থান ৪৬তম।

আমরা সাবওয়ে নিয়ে মিলান শহরের ডাউন টাউনে চলে এলাম। আমাদেরকে একদিনের মধ্যেই মিলানের বিখ্যাত সব স্থানগুলো দেখতে হবে। যতটুকু সম্ভব।

প্রথমইে সিদ্ধান্ত নিলাম, ভিজিটররা প্রথমেই যেটা দেখতে আগ্রহী হয়, সেটার দিকেই চললাম। অর্থাৎ Duomo Milano Cathedral. কাছাকাছি যেতেই দেখলাম, এই সাতসকালেই দর্শনার্থীতে ভরপুর। দূর থেকেই এত ঝকঝকে। মনে হচ্ছে সদ্য নির্মিত। এর মার্বেল স্টোন থেকে একটা হালকা গোলাপী আভা বের হচ্ছে। Duomo Milano Cathedral এর প্রথম নির্মান কাজ শুরু হয় ১৩৮৬ সালে। এবং মজার ব্যাপার এর নির্মান কাজ শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হয় ১৯৬৫ সালে। এর নির্মান কাজ সম্পূর্ন ভাবে সমাপ্তির পর একবার বিশাল অগ্নিকান্ডে সম্পূর্ণ নির্মানটি ধ্বংস হয়েছিল। তারপরও এটা থেমে থাকেনি। পুনরায় নির্মানে এর সৌন্দর্য বেড়েছে  বৈ কমেনি। মানুষ ভাবতেও পারেনি মিলান ডুওমোর এর অভ্যন্তরটি অবিশ্বাস্য ভাবে দর্শনার্থীদের আজও সমভাবে স্বাগত জানিয়ে যাবে। এই ডুওমোরের জানালাগুলো এতটাই সুন্দর যে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। অপরূপ, রঙিন ডিজাইনের কাঁচের জানালায় বাইবেলের দৃশ্যগুলি দৃশ্যমান। এবং জানালার এই অপরূপ রঙিন কাজ, গির্জর মেঝেতেও প্রতিফলিত হয়। প্যালিও-ক্রিশ্চিয়ান এবং রোমানেস্ক বস্তগুলি দেখতে এবং মানুষকে মুগ্ধ করবার জন্য এখন তাই ক্যাথিড্রাল ট্রেজারের মধ্যে মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব করেছে। যাতে দর্শনার্থীরা প্রাণভরে দেখতে পারে। এমনকি বর্তমানে ক্যাথিড্রালের সিলিং পর্যন্ত আরোহন করা সম্ভব। যদিও আমি তা চিন্তাও করতে পারছিলাম না। তবে আমার জিমনাস্টিক ছেলে ঠিকই ওটাতে আরো অনেক ইয়ং ছেলেমেয়েদের সাথে আরোহন করলো। তবে এটা সত্যি এত ঝকঝকে এবং পরিচ্ছন্ন গীর্জা খুব কম দেখেছি।

Duomo Milano Cathedral. ছবি : লেখক

Duomo Cathedral দেখে অত্যন্ত পবিত্র মন দিলে এবারে চললাম অন্যত্র। এটা একদম কাছেই ইটালীর প্রখ্যাত শপিং মল Galleria Vittorio Emanuele. যেহেতু আগেই বলেছি, ইটালীর বিশিষ্ট সিটি হলো মিলান। ইটালীর প্রখ্যাত ধনী ব্যবসায়ীরা এখানে বসবাস করে। শহরের মধ্যে একটু ঘুরলেই সেটা বোঝা যায়। সব দামী দামী গাড়িতে স্থানীয়রা চলা ফেরা করছে। যেটা রোমে খুব কম দেখেছি।

যাইহোক মলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। কারণ ততক্ষণে লাঞ্চের সময়ও হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হবে। অর্থাৎ খাওয়া এবং দেখা একত্রে। এই  Galleria Vittorio Emanuele এর দুইটা পার্ট আছে। কারণ এই মলটির স্থাপনা ১৮৬৭ সালে। এটি প্রাচীনতম সক্রিয় মল। প্রাচীনতম মলটির পাশে অন্য পার্ট-টির স্থাপনা। এমনভাবে করা হয়েছে যে, বোঝাই যাবে না। উপরে রুফ টাউয়ার এক সুন্দর করে দিয়েছে বোঝার উপায় নাই। তবে নতুন পার্ট অর্থাৎ গ্যালেরিয়া-২ তেই সব প্রখ্যাত ব্রান্ডের দোকানগুলো। যেমন প্রাদা, গুচি এবং লুই ভিটনের (প্যারিসের পরেই মিলানেরটা দ্বিতীয় অবস্থান) দোকান গুলো। এবং অবশ্যই এর পাশাপাশি রয়েছে অন্যান্য হাই এন্ড বুটিক। আমি লুই ভিটনের সপ এ গেলাম। দুজন সুসজ্জিত সিক্যুরিটি আছে দরজায়। বেশ কিছুু পার্স (ভ্যানিটি ব্যাগ) দেখলাম কাঁচের বক্সের মধ্যে। একটি ব্যাগ খুব পছন্দ হলো। ওটার দাম দেখলাম ৭৫ ইউরো। কিছু উপরে শো কেসে আছে, যার প্রাইস ট্যাগ দেখা যাচ্ছে। মাথা ঘুরে পড়বার আগেই ভবলাম বের হয়ে যাই। একটি কোমরের বেল্ট এর দাম দেখলাম ৩৫,০০০ ইউরো? মাত্র?? কোন ব্যাপার না, পরের বার এসে কিনবো—হা — হা–।

যাই হোক মলটি সত্যি খুব সুন্দর। এদের সাজানোর স্টাইল বা পলিসি আমার খুব পছন্দ হলো।

এরপর আমরা মলের ফুড সাইডে হাটতে শুরু করলাম। এখানে অসংখ্য সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে মিলানের প্রাচনতম স্থাপনা, যেমন ‘ক্যাফে বিফি’ যা কিনা ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমি এখানেই খাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা প্লেন স্যান্ডউইচ এবং কফি অর্ডার করলাম। এদের ব্রেড আমার কাছে খুবই হার্ড মনে হয়। তবে ক্যাপাচিনো কফি’টা অসাধারণ। অবশ্য দামটাও অসাধারণ।

এই মলে প্রচুর এশিয় চলচ্চিত্র (হিন্দি, বাংলা) চিত্রায়িত হয়েছে। তাই এখানে প্রবেশ করলেই আপনার খুবই পরিচিত মনে হবে। মনে হবে ‘আরে মলটিতো আমাদের দেশেই আছে।’ এমন অনুভূতি হতে পারে।

এরপর আমরা সরাসরি চলে এলাম আর্ট মিউজিয়ামে। এটার নাম Museo Nazionale Scienza e Tecnologia Leonardo da Vinci. সেই ছোটবেলা থেকে একটি পেইন্টিং এর প্রতি আমার দারুন উৎসুক্য ছিল। ‘Last Supper’। সেটাই দেখতে এলাম। ইটালীর মূল অহঙ্কার এই চিত্র শিল্পী Leonardo da Vinci. আমরা সবাই তাকে চিনি

‘মোনালিসা’র পেইন্টিং-টার জন্য। মূলত তার ‘Last Supper’ নিয়ে আলোড়ন অনেক বেশী। বিশেষত ধর্মীয় দিক থেকে । ‘Last Supper’ পেইন্টিং-টি শিল্পী প্রথম অঙ্কন করেন একটি ওয়ালের উপর ১৪৯৫-১৪৯৮ এর দিকে। এরপর চিত্রটি অনেকবার নানাভাবে চিত্রিত হয়। কারণ প্রথমবার অঙ্কিত দেয়ালটি ভেঙ্গে পড়ে। তখন ‘নেপোলিয়ন বেনোপার্ট’ এর সময় এটা ঠিক করা হয়। এটা মূলত ধর্মীয় ভিত্তিক। যীশু তাঁর ১২ জন অনুসারিকে নিয়ে ছবিটির বিষয়বস্তু। এটা অঙ্কন করেন 15th সেঞ্চুরীতে Leonardo. যীশুর একজন অনুসারী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এবং তারা আত্মগোপন করেন। কথিত আছে মাত্র ১টি রুটিকে যীশু ১২ জন এর মধ্যে ভাগ করে দেন। এর পরই উনাদেরকে ক্রুসিফাইড করা হয় বলে খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসীগণ মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। ২০১৮ সালে এই ছবিটি নতুন করে মোডিফাইড করা হয়। আমি এই নতুন সংস্করণটি দেখেছি। চিত্র অঙ্কনের সুবিধার্থে টেবিলের চারপাশে না দিয়ে এক পাশেই ১২ জনকে দেখানো হয়ে থাকে। এটা বেশ বড় একটা পেইন্টিং ৪.৬x ৮.৮ মিটার। তবে পুরানো সংস্করণ কিছুটা হালকা হয়ে যাওয়াতে ২০১৮ সালে আরো উজ্জল করা হয়েছে।

মিলানের আর্ট গ্যালারীতেও প্যারিসের মত প্রচুর ওয়াল পেইন্টিং আছে। সবই প্রায় ১৪/১৫/১৬ শতকের। অন্যান্য আর্ট পিসও যত্ন সহকারে দেখে আমরা মিলানের আরো কিছু দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখলাম।

একটা খুবই নামকরা ফ্যাশন স্টোর এ দেখতে গেলাম। এটা মোটামুটি সব টুরিস্টরাই দেখতে যায়। আমরাও গেলাম। অনেক বড় ফ্যাশন স্টোর এটি। খুব সুন্দরী সব মেয়েরা এখানে কাজ করে। ড্রেসগুলো দেখতে অতি চমৎকার। দেখলাম ঐ মূহুর্তে বিশ্বের একজন নামকরা মডেল, ড্রেস কিনছিল। নামটা তখন শুনেওছিলাম, এখন নামটা মনে করতে পারলাম না। খুব সুন্দরী, দেখলাম সবাই তাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত। রায়হান আমাকে কিছু কিনতে বললো। আমি কিছুই কিনিনি। একটা ড্রেস খুব সুন্দর লাগাতে, দেখলাম দাম ৮৬৫ ইউরো। মাথা খারাপ??

যাইহোক আরো কিছু দেখে, হোটেলের দিকে ফিরে আসলাম। আগামী কাল আবার খুব ভোরে যাত্রা। অনেক দূরে কোথাও। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিস্ময় ‘সৌন্দর্য্যের’ দিকে। আমার মনটা শুধু এই চিন্তা করেই আবিষ্ট হয়ে আছে। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com