তাসের আড্ডা-১৯

শুজা রশীদ

জনপ্রিয় কলামিস্ট শুজা রশীদ প্রায় তিন বছর বিরতির পর তাঁর তাসের আড্ডা নিয়ে আবার হাজির হয়েছেন পাঠকের দরবারে। বিরতির ঐ সময়ে তাঁর অনুদিত মাইকেল ওন্ডটিজি’র ‘ইন দি স্কিন অফ এ লায়ন’ উপন্যাসটি ‘সিংহের খোলস’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে। -সম্পাদক

বহুদিন পর সাইদ ভাইয়ের বাসায় জমায়েত হবার আহ্বান আসতে বেশ একটা সাড়া পড়ে গেল রনিদের গ্রুপে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের আক্রমণে ঘাপটি মেরে বাসায় বসে থাকতে থাকতে রনির শরীরে মরিচা ধরার জোগাড় হয়েছে। কাজকর্ম বাসা থেকেই চলছে, বাজার সওদা বেলা করছে, বাচ্চারাও বাসা থেকেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা একটু বড় হয়ে যাবার পর তাদের সাথে আর সময় কাটানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রবীণ মানুষদের তারা মানুষ বলেই গণ্য করে না। অনলাইনে তাস খেলে নিয়মিত কিন্তু সেই খেলা আর বন্ধু বান্ধব মিলে তাস পেটাতে পেটাতে আড্ডা মারা কি আর এক কথা হল?

কোভিড-১৯ মহামারির মাঝে যে একেবারেই দেখা সাক্ষাৎ হয় নি তা নয়, কিন্তু তাস খেলার সুযোগ হয় নি। চারদিকে এতো মানুষ শেষ ডাকে সাড়া দিয়েছে এই অর্বাচীণ ভাইরাসের আক্রমণে যে পরস্পরের সাক্ষাতে শুধু মনে হয়েছে, কার থেকে কার হয় বলার কি উপায়? পরস্পরের কাছ থেকে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে গল্প-সল্প করা যেতে পারে, তাস খেলা চলে না। তাছাড়া একই তাস সবাই মিলে ছোঁবার মধ্যেও ঝুঁকি থাকে। যাইহোক, বিজ্ঞানীকূলের কৃপায় ভ্যাকসিন আসার পর পরিস্থিতি পালটে গেছে। দু’ খানা ভ্যাকসিন নেবার পর খানিকটা হলেও মনের জোর বেড়েছে। এদিক সেদিক যাতায়াত শুরু হয়েছে। তাস খেলাই বা বাদ থাকবে কেন?

ডিসেম্বর মাসে বিকেল হতেই চারদিকে এমন ঝাঁপিয়ে অন্ধকার নামে যে মনে হয় মাঝ রাত। গ্রীষ্মে সন্ধ্যা আটটায় আসতে বললে সবাই গড়িমসি করতে করতে রাত দশটা বাজিয়ে দেয়, কিন্তু শীতে ঠিক উল্টো। আটটা বললে ছয়টার মধ্যে সবাই এসে হাজির হয়। মানব মনে আলো আঁধারীর যে প্রভাব সে আর অস্বীকার করার কি উপায়। অন্য সময় হলে রনিকে বাসা থেকে টেনে বের করতে হয়, আজ বলার আগেই লাফিয়ে রেডী হয়েছে। বেলা ঠোঁট টিপে হেসেছে। তাস খেলার জন্য মুখিয়ে আছে। আগ্রহের আতিশয্য দেখলেই বোঝা যায়।

সাইদের বাসায় তারা যখন পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা সাতটার মত। দেখা গেল রনিরাই প্রথম হাজির হয়েছে। রুমা প্রচুর চা নাস্তার আয়োজন করেছিল ডিনারের আগে। সাইদের সাথে লিভিং রুমে বসে তাই চিবুতে চিবুতে কথা বার্তা বলতে বলতে বাকীরাও চলে এলো। 

আটটা বাজতে না বাজতে কাঁচের গোল টেবিল ঘিরে শুরু হয়ে গেল তাস খেলা। বরাবরের মতই সাইদ আর রনি জোট পাকিয়েছে, প্রতিপক্ষে জালাল এবং জিত।

নিজের হাতের তাস দেখেই ঠোঁট উল্টাল রনি। “ভাগ্য শুরু থেকেই একেবারে বিরুপ হয়ে আছে দেখছি। তবুও যে খেলতে পারছি। তা এই মহামারির মধ্যে আপনারা কে কি করলেন?”

জিত হেসে বলল, “কি আর করব দাদা, ঘরে বসে বসে ভেরেন্ডা ভাজলাম। আমার তো আবার হার্টের প্রবলেম আছে। ভয়ে কোথাও যাবারই সাহস পাই নি। দেখা যাবে আরেক অসুখ বাধিয়ে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত অবস্থা হবে।”

জালাল যোগ করল,“আপনি তো তবুও ভেরেন্ডা ভেজেছেন, আমি তো তাও করি নি। গায়ে ব্যাথা লাগে। শুয়ে বসেই দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছি। এখন নড়াচড়া করতেও আলস্য লাগে। যুগ যুগ জিও বাবা প্যন্ডেমিক!”

সাইদ হাসতে হাসতে বলল,“তোমাকে দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে বেশ আরামেই ছিলে। শরীরের চেকনাই বেড়েছে, ভুড়িটাও বেশ নিটোল হয়েছে।”

জলাল ভুড়ি হাতড়াতে হাতড়াতে বলল, “ছিঃ ছি সাইদ ভাই, আমার ভুড়ি নিয়ে এমন একটা বিরুপ মন্তব্য করলেন। গত দু বছর ধরে তিল তিল করে গড়েছি এই ডাব্বা। দেখেন, কবীর মিয়াও কম যায় না। তারও আসি আসি করছে।”

কবীর প্রতিবাদ করল, “মোটেই না। আমি অনেক কনট্রোল করে খাওয়া দাওয়া করি। এমনিতেই কোথাও যাওয়া হয় না। বেশী খেলে ডাবল হয়ে যাবো।”

জালাল তার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলল, “আরে, ঠাট্টা করলাম। আমার ভুড়ি নিয়ে সবাই খোঁটা দেয় বলে আমি অন্যদের আমার দলে টানার আপ্রাণ চেষ্টা করি।”

রনি বল্ল, “এই বেয়াক্কল ভাইরাস যা শুরু করেছে, তাতে এখনই লাগাম না ধরলে কিন্তু খবর হয়ে যাবে। আমি তো আবার খেলা ধুলা শুরু করেছি। ইন্ডোর ফুটবল, ব্যাডমিন্টন দুটোতেই নাম লিখিয়েছি। একটু ঝুঁকি থাকলেও উপায় কি? এই শীতের মধ্যে আর কত বাসায় বসে বসে হা হুতাস করা যায়। ভেবেছিলাম ভ্যাক্সিন-ট্যাক্সিন দেয়া সারা এবার একটু পরিত্রাণের নিঃশ্বাস ফেলা যাবে। কিন্তু এই ওমিক্রন কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল। তবে একটা উপকার হয়েছে। কাজ থেকে চাপ আসছিল অফিসে হাজিরা দেবার। সেটা আপাতত কিছুদিনের জন্য বন্ধ হবে।”       

জিত বলল, “আপনাদের তো অনেক মজা। আমি তো সেই কবে থেকেই সপ্তাহে তিন দিন করে অফিসে যাচ্ছি। তবে ভাইরাসের কথাই যদি বলতে হয়, ওমিক্রন কিন্তু ছোঁয়াচে বেশী হলেও ডেল্টার মত অত বিপদজনক নয়। সমস্যা একটাই, দুই ডোজ ভ্যাক্সিনেও নাকি মাত্র ৩০% কাজ করবে। এখন তিন নম্বর ডোজ নেবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।”

রনি বলল, “আর এতো কিছুর মধ্যেও কতগুলো বেয়াক্কল এখনও ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে লেগে আছে। এরিন ও’টুলের কাজ কারবারটাও আমার ঠিক পছন্দ হল না। লিবারেল আর এন ডি পি তাদের এম.পি.দেরকে বলেছে অকারণে দেশের বাইরে ভ্রমণ না করতে আর ও’টুল বলছে উল্টো কথা। কঞ্জারবেটিভ এম.পি.রা যেখানে ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারবে। পার্টি থেকে কোন বাঁধা নিষেধ থাকবে না। নেতা গোছের মানুষেরা যদি সাধারণ মানুষের সামনে উদাহরণ হিসাবে না দাঁড়াতে পারে তাহলে সামগ্রিক মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি করে?”

সাইদ মৃদু হেসে বলল, “ভুলে যেও না, আমাদের প্রধান মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও কিন্তু নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। ভোটের আগে বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে সে কোভিডের নিয়ম নীতি মানে নি। ব্রাম্পটনেই তো একটা ইনডোর হলরুমে লিবারেলের র‌্যালিতে জনে জনারণ্য হয়ে গিয়েছিল। নিয়ম ছিল ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখার। কেউ রাখেনি, রাখা সম্ভব ছিল না। এখন জাস্টিন ট্রুডো যদি নিজের খেয়াল খুশীমত নিয়ম ভাঙে তাহলে বিরোধী পক্ষকে দোষ দিয়ে কি লাভ?”

“স্বীকার করছি কাজটা সে ঠিক করে নি কিন্তু ভোটের আগে সব পার্টিই তো কম বেশী নিয়ম ভেঙেছেই,” রনি যোগ করল।

জালাল বলল, “রনি ভাই, আপনি না আগে কঞ্জারবেটিভদের সমর্থক ছিলেন। হঠাৎ এমন লিবারেল প্রীতি হবার কি কারণ?”

রনি শ্রাগ করল। “দল পালটে ফেলেছি আপাতত। ভবিষ্যতে কার কি মতিগতি সেটা ভালো করে দেখেশুনে কাকে ভোট দেব সেই সিদ্ধান্ত নেব। এখন দল পাল্টানোর কারণটা যদি ব্যাখ্যা করি তাহলে যুক্তিটা একটু বাঁকা মনে হতে পারে কিন্তু মাঝে মাঝে একটু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করবার প্রয়োজন আছে। যদিও কানাডার প্রগ্রেসিভ কঞ্জারবেটিভ পার্টি বর্তমানের আমেরিকান রিপাবলিকান পার্টির মত নয় – যেটা এখন বস্তুত ট্রাম্পের পার্টিতে পরিণত হয়েছে, তারপরও হোয়াট টেররিজম বা এক্সট্রিমিজম যাই বলুন না কেন তাদের অবধারিত ভাবে ধারনা যদি কোন পার্টি তাদেরকে সমর্থন করে সেটা হবে কঞ্জারবেটিভ পার্টি। যদিও আমাদের এখানে সেইভাবে হোয়াইট টেররিজমের বিকাশ এখনও হয় নি কিন্তু তাই বলে তারা যে বিষ দাঁত বের করে কামড়ে ধরার জন্য মুখিয়ে নেই তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে ট্রাম্পের মদদ পেয়ে তারা যেভাবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণে তাতে তার হাওয়া আমাদের এই উত্তরে এসে ঝুট ঝামেলা পাকাবে না তার কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। বলতে পারেন সেই কারণেই লিবারেলের সমর্থক হয়ে গেছি। এই দাঙ্গাবাজ বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে আমাদের সবাইকে একজোট হতেই হবে।”

জালাল ঠাট্টা করে বলল, “যাক, শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি খুলেছে তাহলে দাদা!”

“বেশী খুশী হবেন না,” রনি সতর্ক করল। “বেশী দিল দরিয়া হয়ে ভোট কেনার জন্য দেদারসে টাকা পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে জাতীয় দেনার পরিমান বাড়িয়ে অর্থনীতির বারোটা বাজালে লিবারেলকেও ভোট দেব না। সুতরাং জাস্টিন ট্রুডোকে টাইট দিয়ে না রাখতে পারলে আবার হারাবেন আমাদের মত সমর্থকদের।”

জিত একটা নো ট্রাম্প কল দিয়ে বলল, “ভোটে তো আরেকটু হলে সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। ট্রুডো ভেবেছিল এই মহামারির সময় সে যেভাবে সব কিছু মোটামুটি ভালো ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে তাতে সাধারণ মানুষজন তার পার্টিকে ঢালাও ভাবে ভোট দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঠিক হয় নি। ভোটের ফলাফল সেই আগের বারের মতই হয়েছে খানিকটা। অযথা আগে আগে ভোট ডাক দিয়ে এতো গুলো টাকা পয়সার অপচয় হল।”

সাইদের হাত ভালো নয়। পাশ দিয়ে বলল, “হিসাবে একটু গোলমাল হয়ে গেছে ট্রুডোর। প্যান্ডেমিকে সে তো মোটামুটি ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, মানুষ জনের কিছু অসুবিধা হয়েছে কিন্তু এতো ভয়ংকর একটা সময়ে সেটা তো হবেই। কিন্তু অনেকেই এতো বিধি নিষেধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হয়ত সেই কারণেই লিবারেলরা যত ভোট পাবে বলে ভেবেছিল তার চেয়ে কমই পেয়েছে।”

বাকী দু’জনাও পাশ দেয়ায় জিতের এক নো ট্রাম্পের খেলাই দাঁড়িয়ে গেল। পার্টনারের হাত দেখে সে মাথা চুলকাল। “যা ভেবেছিলাম দাদা আপনার হাত তার চেয়ে খারাপ। এবার আর গেম হল না।”

জালাল ঠাট্টা করে বলল, “ট্রুডোরই গেম হল না আর আপনার!”

দরজায় কলিং বেল বাজছে। সাইদ গিয়ে দরজা খুলল। লাল ভাই সস্ত্রীক। “একটু দেরী হয়ে গেল,” লাজুক মুখে বলল সে।

রনি বলল, “লাল ভাই, আপনাদের দুজনকে ধরে তো আমরা এখন হয়ে গেলাম বারো জন। ওন্টারিওতে ইনডোর লিমিট এখন দশ। কেউ যদি রিপোর্ট করে আর পুলিশ যদি আসে আপনাকেই ধরবে।”

লাল মিয়া একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “ভাই, কেউ মানছে না। সবাই পার্টি দিচ্ছে। বহুদিন পর দেখা হল আপনাদের সাথে। পুলিশ ধরলে ধরুক। দেব ফাইন।”

“ফাইন তো আপনার হবে সামান্য। সাইদ ভাইয়ের দশ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। শুনেছি কয়েকটা কেসে প্রতিবেশীরা রিপোর্ট করার পর কয়েকজন বাড়িওয়ালার সত্যি সত্যিই নাকি জরিমানা হয়েছে।”

সাইদ বলল, “লাল, রনি তোমাকে ক্ষেপাচ্ছে। ছিলে কেমন?”

লাল বলল, “ছিলাম তো ভাই ভালোই। ভ্যাকসিন দিয়ে বুকে তাগদ বেড়ে গেছে। ভেবেছিলাম এই ভাইরাস আর ঝামেলা করতে পারবে না। কিন্তু এখন তো আবার বুস্টার লাগবে। এই করোনা তো শান্তি দিবে না রে ভাই।”

কবীর বলল, “করোনা নিজেই শান্তি পাচ্ছে না। সারাক্ষণ ভোল পাল্টাচ্ছে। ওমিক্রনের পর আরোও কত কি আসবে কে জানে। আমেরিকা যাবার প্ল্যান করেছিলাম। ভেবেছিলাম শর্ট ট্রিপ দেব, ৭২ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসব। মলেকিউলার টেস্ট করাতে হবে না। কিন্তু সেই নিয়মও ঝট করে পাল্টে দিয়েছে ডাগ ফোর্ড। ওপারে গেলেই টেস্ট করাতে হবে। কোন কারণে যদি টেস্ট পজিটিভ চলে আসে কিংবা ইনকনক্লুসিভ হয় তাহলে ফ্যাকড়া বেঁধে যাবে। গেলাম না। মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে।”

জিত ঠাট্টাচ্ছলে বলল, “আপনি আমেরিকা যেতে পারলেন না বলে আপনার মন খারাপ হচ্ছে। ডঃ মুরাদকে তো কানাডা ঢুকতেই দিল না। বেচারা এতো দূরে এসে খালি হাতে ফিরে গেল। তার কথাটা ভাবুন!”

রনি বলল, “ঢুকতে দেয় নি, বেশ করেছে। সারা পৃথিবীর জঞ্জালগুলো সব কানাডাতে এসে জড়ো হচ্ছে। একজন সরকারী প্রতিমন্ত্রী এই ধরনের আচরণ কিভাবে করে? মনে হয় যেন ক্ষমতার স্বাদ পেলেই মানুষের ব্যবহার সম্পূর্ণ পালটে যায়। এখানে তো আমরা জানিও না কে মন্ত্রী, কিসের মন্ত্রী। তাদের ক্ষমতাও অনেক সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাবার পর কারো কারো এমন ধরাকে সরা জ্ঞান করবার পেছনে কারণটা কি?”

সাইদ বলল, “কারণ তো খুব পরিষ্কার। শুধু বাংলাদেশ নয়, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শান্তি শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিণীগুলো- যেমন পুলিশ, র‌্যাব ক্ষমতাসীণ রাজনৈতিক দলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাহিণী হিসাবে কাজ করে বা করতে বাধ্য হয়। না করলে তাদেরই ক্যারিয়ার নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। যার ফলে একটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতার বলয়ের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতা থাকলেই কিংবা ক্ষমতাবান কারও সাথে দহরম মহরম থাকলেই যদি পুলিশ এবং র‌্যাবের মত প্রতিষ্ঠানকে নিজের হয়ে কাজ করানো যায়, মানুষকে ভয় দেখানো যায়, তাহলে ধরাকে সরা জ্ঞান কেন করবে না? চিন্তা কর, মাহিয়া মাহি এই ঘটনার পর কোথাও রিপোর্ট করে নি। সে তো সর্বজনবিদিত, তারই যদি একজন প্রতিমন্ত্রীর অশালীন মন্তব্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে তাহলে কার থাকবে? র‌্যাবের কথাই ধর। তারা কিন্তু টেররিজম, ড্রাগ কন্ট্রোল থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে। বাংলাদেশে অপরাধ দমনে তাদের অবশ্যই বিরাট ভুমিকা আছে। কিন্তু বেশ কিছু দূর্নীতিমূলক ঘটনার পর পুরো প্রতিষ্ঠানটার মর্যাদা মনে হয় যেন অনেক কমে গেছে।”

রনি বলল, “এক্সট্রা জুডিশিয়াল হত্যাকান্ডের সাথে তাদেরকে জড়িত করে অনেক কিছু বলা হয়। সব সত্য না হলেও কিছু তো নিশ্চয় সত্য। এক নজরে মনে হতে পারে সহজ পন্থায় ক্রস ফায়ারে ফেলে দিয়ে কোর্টের বাইরেই অপরাধীদের বিনাশ করতে পারলে ঝামেলা চুকে যায়, কিন্তু শেষতক তার পরিণতি কখনই ভালো হয় না।”

জালাল বলল, “আমেরিকা যে র‌্যাব এবং র‌্যাবের ৭ জন বর্তমান অথবা প্রাক্তন কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে স্যাঙ্কশন করেছে, সেটা কি ঠিক করেছে? বাংলাদেশ সরকার তো এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। কানাডাও হয়ত খুব শীঘ্রই কম বেশী কিছু একটা পদক্ষেপ নেবে, তাই না?”

জিতের এক নো ট্রাম্পের খেলা হয়ে গেল। সে তাসগুলো একজোট করে বাটতে লাগল পরের হাতের জন্য।

সাইদ বলল, “কানাডা কি করবে জানি না কিন্তু  আমেরিকার এতো বড় একটা পদক্ষেপ নেবার পেছনে নিশ্চয় কোন একটা কারণ আছে। সব তথ্যতো আর আমরা পাই না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার কি পালটা পদক্ষেপ নেবে নাকি র‌্যাবের নীতি পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানটাকে আরও স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলবে? হিউম্যান রাইটস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেটাকে হেলা ফেলা করলে আজকের দুনিয়ায় পার পাওয়াটা কঠিন। দুর্নীতিতো সব প্রতিষ্ঠানেই অল্প বেশী থাকেই। এখানেও পুলিশে যে নেই তা তো নয়। কিন্তু সেই ধরনের পদস্খলনকে দ্রুত সনাক্ত করে তাকে যথাযথভাবে শায়েস্তা করতে পারাটাই একটা ভালো সিস্টেমের লক্ষণ। একটা ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশে অনেকেই র‌্যাবের ভয় দেখিয়ে তাদের প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে চায়। এমনটা কখনই হতে দেয়া উচিৎ নয়। পুলিশ এবং র‌্যাব কাজ করবে স্বায়িত্বশাষিতভাবে। তাদের উপর প্রভাবশালী কোন মহলের কোন হাত থাকা উচিৎ নয়।”

জিত বলল, “কিন্তু এগুলো তো বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আপনার কি মনে হয় আমেরিকা বা অন্য কোন দেশের উচিৎ তাতে নাক গলানো?”

সাইদ বলল, “নাক থাকলে নাক তো গলাবেই। তাতে ভালো এবং মন্দ দুটো দিকই আছে। চীনে উইগর মুসলমানদের কথাই ভাবো। তাদের উপর যে ধরনের অন্যায় অবিচার করা হচ্ছে এবং হয়েছে, সারা দুনিয়া এখন নানাভাবে তার প্রতিবাদ করছে। চীন আর চুপিচুপি কিছু করতে পারছে না। তারাও বলতে পারে এটা তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু হাজার লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে যখন কথা তখন বহিরাগত শক্তিরা যদি এগিয়ে না আসে, দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে তো সেই পরিস্থিতির কখনই কোন উন্নতি হবে না।”

কবীর বলল, “একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আমাদের এখানেও পরিবর্তন আসা দরকার। বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা মেরে দিয়ে মানুষ জন এখানে এসে নগদ টাকায় মিলিয়ন ডলারের বাড়ি কিনছে। আমরা এতো কষ্ট করে একটু একটু করে জীবন গড়ছি, আর তারা কালো টাকা এখানে এনে সাদা করে ফেলছে। আমাদের স্থানীয় কমিউনিটিতে এখন একটা প্রতিরোধ তৈরী হচ্ছে এই ধারাটাকে রোধ করবার। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আমাদের সবার উচিৎ সেই প্রতিরোধে যোগ দেয়া। যে জন্য কানাডা এসেছিলাম, সেই দূর্নিতিবাজরাই যদি এখানে এসে কালো টাকার দাপট দেখায় তাহলে তো জীবনটাই বৃথা!”

জিত বলল, “এই জাতীয় মানুষেরা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবী থেকেই আসছে। আমাদের এখানে বাড়ীর দাম এমন আকাশচুম্বী হবার কারণটা তো সেটাই। এসে একেকজন নাকি এক সাথে একাধিক বাড়ী কেনে। কানাডার সরকারের উপর আমাদের সবার সম্মিলিতভাবে চাপ দিতে হবে। এভাবে চললে আমাদের ছেলেমেয়েরা একটা কনডোও কিনতে পারবে না। পাঁচশ স্কোয়ার ফুটের একটা কন্ডো ছয় লাখ, সাত লাখ ডলার। চিন্তা করা যায়?”

জলাল খুব মনযোগ দিয়ে তাস বাটছিল, এমন সময় বেলা দলবল নিয়ে এসে হামলা দিল তাদের আড্ডায়।

“তাস খেলতে খেলতে খুব গ্যাজান আপনারা, কুইবেকে যে এতো বড় একটা অণ্যায় হল তার বিরুদ্ধে কি করেছেন? বাংলাদেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে তো সমালোচনা করতে কোন কার্পণ্য দেখি না। এই দেশে যে অবিচার হচ্ছে সেটা নিয়ে কিছু বলছেন না কেন?”

মন্ট্রিয়লে হিজাব বিরোধী আইন (বিল-২১) পাশের পর বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: সিটিনিউজ অটোয়া

রিমা বলল, “এদের শুধু বকবকানি। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা।”

রনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, “কুইবেকের বিল ২১ নিয়ে উনি এখন ভয়ানক ক্ষেপে আছেন। বাসায় আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে।”

“দেবই তো,” বেলা মেজাজ দেখিয়ে বলল। “বলে কুইবেকের মানুষ যদি চায় তাহলে আমরা কেন আপত্তি করব। আরে, একটা মেয়ে মাথায় হিজাব দেয় বলে সরকারী স্কুলে পড়াতে পারবে না, এটা কোন নিয়ম হল? কানাডার মত দেশে এই রকম একটা অন্যায় কিভাবে হতে পারে? সাইদ ভাই, আপনি বলেন। কুইবেকের এই বিল কি করে পাশ হল?”

সাইদ বলল, “বিল তো ওদের ন্যাশানাল এসেম্বলি থেকে পাশ হয়েছে গন্তান্ত্রিকভাবেই। কুইবেকের মানুষজন আমাদের চেয়ে সেকুলারিজম বেশী পছন্দ করে। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সেখানে শতকরা ৬৫ জন মানুষ এই বিল সমর্থন করে। এখন গনতান্ত্রিকভাবে তারা যদি কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেয় সেটার বিরুদ্ধে আমরা কতখানি কি করতে পারি সেটা ভেবে দেখার মত বিষয়।”

রনি বলল, “আমারও সেটাই কথা। আর বিল ২১ তো শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে না। যে কোন পোশাক, অলংকার, পাগড়ি, কিপ্পাহ যা কোন ধর্মকে প্রতিফলিত করে কোন সরকারী কর্মচারী তা পরতে পারবে না। যদিও কুইবেকের ইংলিশ স্কুল বোর্ড কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে যে এই নিয়ম তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। সব কিছু আইনসম্মতভাবেই হচ্ছে। যে কোন স্থানের মানুষদের তো অধিকার আছে তারা কি ধরনের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে থাকেবে সেটা নির্ধারণ করার।”

লতা চোখ রাঙিয়ে বলল, “রনি ভাই, আপনাকে তো এই রকম ভাবি নি। আপনি কি করে বিল ২১ কে সমর্থন করতে পারেন?”

রনি দুই হাত দুলে সারেন্ডার করল। “ভাবী, আমি তো সমর্থন করছি না। শুধু বলছি যে গণতান্ত্রিক নিয়মে তাদের সেই অধিকার আছে।”

জিত বলল, “আমার কথা হল, মুসলমান হিজাবী মেয়েকে চাকরীতে নেবার কি যুক্তি যদি তাকে হিজাব পরে ক্লাসে নাই যেতে দেবে? জানা কথা সে হিজাব খুলে ক্লাসে যাবে না।”

লাল ভাই জোর গলায় বলল, “ওরা হচ্ছে বিধর্মি। ওদের এই সব নিয়ম করার পেছনে মুসলমানদের দমিয়ে রাখাই প্রধান কারণ। কুইবেকের মানুষজন একটু বর্ণবাদী আছে, বিশেষ করে যারা ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী।”

রনি মাথা নাড়ল। “আমি সেখানে কখন বাস করি নি কিন্তু যখন বেড়াতে যাই মানুষজন তো খুবই ভালো ব্যবহার করে। সুতরাং তাদেরকে আমি বর্ণবাদী বলব না। সবাইতো আর সমানভাবে ধর্মভীরু নয়। অনেকের কোন ধর্মবিশ্বাস নাও থাকতে পারে। তারা যদি মনে করে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় এমন কিছু থাকবে না যা অন্যের উপর এক রকম জোর করে একজনের ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেবে তার মধ্যে দোষের তো কিছু দেখি না।”

বেলা ধমকে উঠল, “তুমি থামো তো। অনুশাসন চাপিয়ে দিচ্ছে কে? একজন শিক্ষক মাথায় পাগড়ি পরল না হিজাব পরল তাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় কি সমস্যা হচ্ছে?  ট্রুডো কেন কিছু করছে না আমি বুঝতে পারছি না। কুইবেক তো কানাডারই অংশ, নাকি? ফেডারেল গভর্নমেন্টের একটা দায়িত্ব আছে না?”

লতা বলল, “ট্রুডো যদি এটা নিয়ে কিছু না করে তাহলে ওকে আমরা ভোট দেব না পরের বার। বুঝবে ঠ্যালা! শুধু চেহারা দেখিয়ে ভোট পাবে ভেবেছে!”

সবাই হেসে উঠল। লতা ভ্রূ কুঁচকাল। “আমি মোটেই ঠাট্টা করছিলাম না।”

সাইদ বলল, “ট্রুডো যে কিছু করছে না তা নয়। সেও জানে সে যদি কিছু না করে তাহলে মুসলিম ভোটাররা তার উপর ক্ষেপে যাবে। কিন্তু সে কতখানি কি করতে পারবে তাতে কিছু সন্দেহ আছে। হ্যাঁ, সে কোর্টে গিয়ে কুইবেকের এই নীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে কিন্তু তার ভয় সেটা করতে গিয়ে সে কুইবেকের সাথে একটা আইনী লড়াইয়ের মধ্যে জড়িয়ে যাবে। তার ভাষ্য হচ্ছে এই বিল ক্যন্সেল করতে হলে কুইবেকের মানুষজনকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে বলতে হবে এই বিলের বিরোধিতা করতে। সেটাই হচ্ছে এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান। কিন্তু তার অর্থ এই না যে আমরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারব না।”

বেলা বলল, “হ্যাঁ, আমি অন লাইনে ইতিমধ্যেই পিটিশন শুরু করেছি। আমরা যত চুপ করে থাকব ততই এসব অন্যায় বাড়তে থাকবে। কেউ মাথা ঢাকে বলে বাচ্চাদের কেন পড়াতে পারবে না? যার যার ধর্ম বিশ্বাস তার তার কাছে।”

রনি বলল, “কিন্তু ল অব দ্য ল্যন্ড বলে একটা কথা আছে না? তুমি যে ভুমিতে থাকবে সেই ভুমির নিয়ম তো মানতে হবে, নাকি?”

“তাই বলে অন্যায় নিয়ম মানতে হবে? এই বিলে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে কাদের? সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমান মেয়েদের এবং শিখদের যারা পাগড়ি পরে।”

বেলার দুই হাত কোমরে উঠে যেতে দেখে রণে ভংগ দিল রনি। “আরে, তুমি সারাক্ষণ আমার উপর ক্ষেপে যাচ্ছ কেন? পারলে কুইবেকের প্রিমিয়ামের সাথে গিয়ে আলাপ কর।”

“দরকার হয় তাই করব। অকম্মার ধাড়ী!” বেলা তার নারী বাহিণী নিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছিল, জিত থামাল।

“ভাবী, দাঁড়ান।  কভিড সংক্রান্ত একটা ছোট্ট কৌতুক শুনে যান।

কোভিডের কারণে লকডাউন চলছে। এক লোক দেখল তার পাশের বাসার মাঝ বয়েসী মহিলা নিজের পোষা বিড়ালের সাথে খুব আলাপ করছে। তার আচরণ দেখেই মনে হচ্ছে সে ভাবছে বিড়ালটা তার কথা খুব বুঝতে পারছে। লোকটা মুচকি হেসে নিজের কুকুরকে গিয়ে এই গল্প বলে দুজনে খুব একচোট হাসল।”

(চলবে)

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

টরন্টো