সাম্প্রদায়িকতার অনলে জ্বলছে বাংলাদেশ : জ্বলছে রংপুরে হিন্দু জেলে পল্লী
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
আপনাকে কোন হিন্দু মুসলমান খৃস্টান ইহুদী জৌন বা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হতে হবে না। শুধুমাত্র আপনার যদি একটি পরিচ্ছন্ন বিবেক, ঝকঝক সচ্ছ শুদ্ধ চিন্তা, সংস্কারমুক্ত মন থাকে এবং বিঁন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব বোধ ধারন করেন তবে বাংলাদেশে কুমিল্লার একটি পূজা মন্ডপে কোরান পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরে হিন্দুদের উপর যে সহিংস অত্যাচার তান্ডব হত্যাকান্ড রংপুরে হিন্দু জেলে পল্লীতে আগুন লুট নোয়াখলিতে সংর্ঘষ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় চলছে তার জন্য আপনার মন ব্যথিত হবে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে মন ভেংগে অশ্রুপ্লাবন নামবে দুচোখ ভাসিয়ে। যদি থাকে আপনার মনুষ্য বিবেকি মন দহনে পোড়নে অংগার হবে আর লজ্জায়-লজ্জায় নতজানু হবে মুসলমানি উঁচু মাথা। দুই শতবছর আগে বৃটিশ ভারতে বৃটিশদের বপন করা ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ এর বিষাক্ত বীজ রাজনীতির খোলসে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক (মুসলমান- হিন্দু ) দাংগায় লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, বাংলা -পাঞ্জাবের মানচিত্রে ছোপ -ছোপ রক্তের দাগ, জীবন পরিবার সংসার স্বপ্ন বিধ্বস্ত তছনছ হয়ে যাওয়া দেশান্তরী উদবাস্তু মানুষের আহাজারী এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। রাজনৈতিক (কংগ্রেস- লীগ)ক্ষমতার লড়াইয়ে স্বদেশ জন্মভূমি ভাগের সাথে গণ মানুষের ভাগ্য বিপর্যয়ের হৃদয় বিদারক করুন গল্প কাহিনী পূর্ব-পশ্চিম বাংলার বরেণ্য লেখকদের অনবদ্য লেখায় ধারণ করে গেছেন। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে হিন্দু মুসলমান বোদ্ধ খৃস্টান চাকমা গারো আস্তিক নাস্তিক সহ বিভিন্ন উপজাতি কাঁধে কাধঁ রেখে জীবন বাজী রেখে স্বদেশ মৃত্তিকা স্বাধীন করেছেন। তারা বুকে মাইন বেঁধে শত্রুর ট্যংক বাংকার জাহাজ রেলপথ ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। সন্মুখ যুদ্ধে বন্দুক মেশিনগান স্টেন গান আর গ্রেনেডের আক্রমণে শত্রুশিবির মাটিতে গুড়িয়ে দিয়েছিল। কোন কোন যুদ্ধে শত্রুর মেশিন গানের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল শিবু দাশ, অরুন সাহা, তপন ভৌমিক, অশোক পাল, শিশির ভট্ট্যাচার্য আর তারাপদ চৌধুরীর বুক-পিঠ। ‘জয় বাংলা’ বলে গগন কম্পিত স্লোগান তুলে জীবনের শেষ গুলিটি চালিয়েছিল রামতনু লাহড়ী ৭১ এর নভেম্বরের এক শীত সকালে কুমিল্লায়। তরুন জেলে অশোক, তাতী হিমেল, চাষী তপন ও পাট শ্রমিক মুতালেব ঢাকার রিকশা শ্রমিক আমিন আর বি এল কলেজ ছাত্র শফিউল কাঁধে মেশিন গান নিয়ে আমিরগঞ্জ গ্রামের রেল লাইনের পাশে পাকিস্তানী সৈন্যদের সামনাসামনি যুদ্ধে মোকাবেলা করেছে। ভারতে যুদ্ধকালীন সময়ে ট্রনিং কেম্পে একই পাতে খেয়েছেন এক বিছানায় শুয়েছেন একই ঘরে উপাসনা করেছেন যার যার মত করে। সে সময় কারোর মনে কোন বিদ্বেষ ঘৃণার চিহ্ন ছিল না কোন বিধর্মের প্রতি। তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গণা নারীর সম্ভ্রমহানীতার রক্তাক্ত শাড়ীর আচলের লজ্জ্বায় অর্জিত স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে সংখালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন জুলুম হত্যা কিন্তু বন্ধ হয়নি। স্বাধীন গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংবিধানে জাত ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে বলে লিখিত থাকা সত্বেও সেই অধিকার অনেক হিন্দু ধর্মালম্বীদের বেলায় কার্যকর হয়নি। দূষিত রাজনীতির ক্ষমতাশীন দল বা ধনাঢ্য প্রভাবশালী ব্যক্তির অগ্রাসান নির্যাতন ভয় ভীতি হুমকির কারণে অনেক পরিবার তাদের বাপ দাদাদের ভিটা মাটি থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে পাশের দেশ ভারতে। প্রশ্ন রাখুন নিজ মনে, পৃথিবীর কোন মানুষ তার স্বদেশ জন্মভূমি, বাপ দাদা, পূর্ব পুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে অন্য দেশে বসত করতে যায় স্বেচ্ছায়? (বর্তমানে স্বেচ্ছায় অর্থনৈতিক বা সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রবাসী হওয়া ছাড়া)। যে পবিত্র মাটিতে জন্ম ও বেড়ে উঠা, শৌশব কৈশোরের অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে জীবনের পাতায় পাতায় সে জীবন ছেড়ে শুধুমাত্র জীবন বাঁচানোর তাগিদে দেশছাড়া হতে হচ্ছে তাদেরকে! বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে গত প্রায় একশ বছর সময় ধরে। এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে তার একমাত্র এবং অন্যতম কারণ তাদের জীবন যাপন ব্যবসা বাণিজ্যের নিরাপত্তাহীনতা। যদিও আমাদের মধ্যে অনেক মুসলমান এটা স্বীকার করতে চাননা। কিন্তু এতে করে সত্যটা বদলে যায় না। ইতিহাস বদলে যায় না। মুসলমাদের অপরাধ কমে যায় না আর এতে করে আমাদের পাপ মোচনও হয় না।
তবে এটা আমরা অত্যন্ত জোর গলায় বলতেই পারি রাজনৈতিক গণদেবতাগন কিছু সংখ্যক পথভ্রষ্ট ধর্মান্ধ মৌলবাদী লোকদের ব্যবহার করে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছিল আগেও এবং ছড়াচ্ছে আজও। দাংগা সহিংসতা লুঠ নির্যাতন ধর্ষণ হত্যা করে দেশে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। এতে করে রাজনৈতিক দলগুলোর ফয়দা উঠছে তাদের ঘরে।
তবে রংপুরে জেলে পল্লীতে আগুন ও লুঠ এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ব^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জাগরণ, চট্টগ্রামে প্রতিবাদী গণমানুষের মিছিলের ঢেউ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আলোর মিনার এখনও নিভে যায়নি। মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মুসলমান মানুষের অসাম্প্রদায়িক মন মানসিকতা ও ভাবমূর্তি উঁচু করে ধরে রেখেছে।
তবে লক্ষনীয় যে, আওয়ামী সরকার তাদের চিরচারিত নিয়মে বিরোধী দল বি এন পি-কে দোষারোপ করে চলেছে এবং বি এন পি-ও এই ন্যক্কারজনক কর্মকান্ডের জন্য আওয়ামী লিগকে দোষারোপ করছে। চলছে ব্লেম -ব্লেম গেম। এখানে একটা প্রসংগে কথা বলে রাখি যেটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত, আমার বন্ধুসম শামীম ভাইয়ের পাঠানো এক ভিডিওতে দেখলাম পিনাকি ভট্টাচার্য (হিউমেন রাইটস এক্টিভিস্ট, ব্লগার , একজাইল ইন প্যারিস) বলেছেন, এই কর্মকান্ডের মূল কারিগর ভারতের বিজেপি দল। তার তথ্য উপাত্য বিশ্লেষণ ব্যখ্যায় তিনি তুলে ধরে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, এতে করে বিজেপি দল তাদের নির্বাচনে জেতার কৌশল হাতে নিয়েছে। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশে ভারতের অসীম প্রভাব এবং উচু মহলে অসংখ্য হিন্দু কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খাটিয়ে Raw‘র কার্যসিদ্ধি করা যে খুব সহজ কাজ সেটা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমি নিজেও ভারতের এক টিভি খবরে দেখেছি বাংলাদেশের এই ঘটনায় বিজেপির মিছিল। অথচ এই বিজেপি ক্ষমতায় এসে ভারতে প্রায় হাজার বছর ধরে বসতী গড়া মুসলমানদের বলেছে জন্ম সনদ দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা ভারতীয়। কাশ্মীরে সেনাদের দিয়ে করিয়েছে অবরোধ ও নির্লজ্ব আগ্রাসন। আমি পিনাকি ভট্টাচার্যের বক্তব্য বিশ্লেষনে কিছুটা হলেও সহমত পোষন করি। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে নজর রাখবে না সেটি কি সম্ভব?
আওয়ামী লীগ সরকার র্যাব পুলিশ দিয়ে জোর তদন্ত করিয়ে চলছে। ইতি মধ্যে ৪৫০ জন গ্রেফতার হয়েছে। সাত জনের প্রাণহানি ঘটেছে সহিংসতায়। এই গ্রেফতারের মধ্যে রংপুরের জেলে পাড়ার কিশোরও রয়েছে। এগুলো সরকারের প্রভাবশালী মহলের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা বর্ণচোরা ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠির কর্মকান্ড কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে সরকারি মহলের সহায়তা ছাড়া এসকল কর্মকান্ড করা সম্ভব নয়। অবশ্য সরকার জোর গলায় বলছে, আমরা এই কর্মকান্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করব এবং আইনের আওতায় আনা হবে তারা যে দলেই হোক। আমরা সেটাই চাই। হাজার- হাজার বছর ধরে একই গ্রামে গঞ্জে শহরে পাশাপাশি বসত করে, হিন্দু-মুসলমান হাত ধরাধরি করে বেড়ে উঠেছে। শৈশবে আর যৌবনে ঈদ পূজা পর্বন উৎসবে মিলেমিশে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে তারা।
কোন কোন অঞ্চলে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজে মুসলমান শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে জজ ব্যরিস্টার হয়েছে। এটাই বাংলাদেশ। এটাই আমাদের ইতিহাস।
আমরা সবাই বাংগালী। মুসলমান হিন্দু খৃস্টান বৌদ্ধ সাওতাল সবার দেশ এই বাংলাদেশ।
আসুন আমরা সবাই ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই। আজ যদি আমি বাংলাদেশে থাকতাম তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে দাড়িয়ে তাদের প্রতিবাদী কন্ঠের সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে বলতাম সাম্প্রদায়ীকতার বিষ দাঁত গুড়িয়ে দাও। ধর্ম নিরেপক্ষ দেশ আমার বাংলাদেশ-বাংলাদেশ। হিন্দু মুসলমান খৃস্টান বৌদ্ধ আমরা সবাই বাংগালী। আসুন আমরা যারা প্রবাসে আছি তারাও উচ্চস্বরে প্রিয় স্বদেশ ভূমির জন্য আওয়াজ তুলি সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আওয়াজ তুলি Save Hindus in Bangladesh.
যেমন করে গান বেঁধেছিলেন বাউল শাহ আব্দুল করিম:
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নৌজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম
বর্ষা যখন আইত গাজীর গান হইত
রংয়ে ঢংয়ে গাইত
আনন্দ পাইতাম
হিন্দু বাড়ীতে যাত্রা গান হইত
আমরা যাইতাম
বাউলা ঘাটু গান আনন্দের তুফান
গাইয়া জারি গান নাউ দৌড়াইতাম।
এই আমাদের বাংলাদেশ। এই আমার বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক আমার জন্মভূমি।
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
অক্টোবর ২১/২১
টরন্টো, কানাডা