টরেটক্কা টরন্টো

ক্যারিয়ার গঠন- ৩


কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’-এ যোগদানের প্রথম দিনটির জন্য। এই উত্তেজনার কারণ অবশ্য একাধিক। প্রথমত কানাডাতে এটাই আমার প্রথম চাকুরী যা কিনা আমি এদেশে আসার প্রায় তিন মাসের মধ্যেই অনেকটা নিজের মেধা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জোগাড় করেছি। অবশ্য এখানে ‘গুডউইল জব শপ’-এর অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তারা আমাকে কিভাবে নিজেকে এদেশের জব মার্কেটের জন্য প্রস্তুত করতে হবে সে বিষয়ে সঠিকভাবে গাইড করেছে। এছাড়া তাদের আমন্ত্রিত এক জব এজেন্সীর কাছ থেকেই ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’ আমার রেজুমিটি পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত এর আগে আমার ক্যারিয়ার ছিল মূলত ইউনিভার্সিটি ভিত্তিক এডু-টেক ইন্ডাস্ট্রিতে, আর এখন আমাকে কাজ করতে হবে ফিনানশিয়াল ইনিস্টিটিউট ভিত্তিক ফিন-টেক ইন্ডাস্ট্রিতে যা আমার জন্য হবে একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এছাড়াও কানাডার অফিস কালচার কিংবা কাজের পরিবেশ কেমন হবে সেটা নিয়েও একটা টেনশন কাজ করছিল ভেতরে ভেতরে। দীর্ঘকাল সিঙ্গাপুরে কাজ করার কারণে সেখানকার অফিস ডেকোরামের সাথে আমি অনেকটাই টিউনড হয়ে গেছি। কিন্তু টরন্টোতে আসার পর লক্ষ্য করেছি যে এখানকার অফিসের কালচার সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। যেমন সিঙ্গাপুরে পুরুষেরা সাদা শার্ট পরে অফিসে যেতে বেশী পছন্দ করে অথচ এখানে সাদা শার্টের প্রচলন নেই বললেই চলে। আবার সিঙ্গাপুরে সাধারণত আমরা প্রায় প্রতিদিনই কলিগদের সাথে দল বেঁধে লাঞ্চ খেতে যেতাম হয় অফিসের ক্যান্টিনে কিংবা বাইরের কোন ফুড কোর্টে। কিন্তু এদেশে আসার পর লক্ষ্য করে দেখেছি যে এখানে প্রায় সবাই কাজে যাওয়ার সময় সাথে করে লাঞ্চ প্যাক করে নিয়ে যায় এবং নিজের ডেস্কে বসেই লাঞ্চ সেরে নেয়।
যস্মিন দেশে যদাচার, তাই চাকুরীতে যোগদানের নির্দিষ্ট দিনে সিঙ্গাপুর থেকে আনা ‘সান মাইক্রো সিস্টেম’-এর লোগো লাগানো একটি কাঁধে ঝুলানোর ব্যাগের ভিতর নতুন কেনা একটি লাঞ্চ বক্সে স্যান্ডউইচ ভরে হাজির হলাম ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’-এর অফিসে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই ফ্রন্ট ডেস্কে বসা লরি অ্যান আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে অফিসের ভিতরে নিয়ে গেল। ইন্টারভিউ দেয়ার দিনে আমাকে বসতে দেয়া হয়েছিল রিসেপশন এরিয়ার ঠিক পিছনেই অবস্থিত একটা বড়সড় কনফারেন্স রুমে। সেদিন আমার অফিসের ভিতরের চেহারা দেখার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। অফিসের ভিতরটা আসলে মোটামুটি মাঝারি আকারের একটি ওপেন স্পেস। সেই ওপেন স্পেসকে পার্টিশন দিয়ে বেশ কিছু ভাগ করা হয়েছে। ডেভেলপারদের জন্য যে জায়গাটা বরাদ্দ সেখানে দেখলাম দুই সারিতে তিনটি করে মোট ছয়টি টেবিল চেয়ার পাতা। একদম পেছনের এক টেবিলে বসে আছে ডেভ ম্যানেজার টেট এভেরি যে কিনা আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিল। আমাকে টেটের হাতে ছেড়ে দিয়ে লরি অ্যান তার ফ্রন্ট ডেস্কে ফেরত চলে গেল। টেট আমাকে প্রথমে ডেভেলপারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর আমাকে নিয়ে অফিসের অন্যান্যদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল। সেইসাথে আমাকে ঘুরিয়ে দেখাল অফিসের শেষ প্রান্তে অবস্থিত কিচেন কাম প্যান্ট্রি। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর আমাকে দেয়া হলো টেটের ঠিক সামনের সিট। সেই সাথে আমার পাশের টেবিলের ডেভেলপার সুনিতা নায়ারকে দেয়া হলো আমাকে র‌্যাম্প আপ করার দায়িত্ব। সুনিতা অবশ্য সেই দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করেছিল, ফলে আমি প্রথম দিনেই আমার কম্পিউটারে আমাদের কোম্পানীর তৈরি ‘ডিসিশনিং ইঞ্জিন’ সফটওয়্যারটির সোর্সকোড সফলভাবে ইন্সটল করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

ডিসিশনিং সল্যুশনের সিইও ড্যারেনের দেয়া গিফট কার্ড


কোম্পানীর সিইও ড্যারেন পার্কো-এর ব্রেইন চাইল্ড হচ্ছে এই সফটওয়্যার। কোন ব্যক্তি যখন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট কোন সেবা নেয়ার জন্য আবেদন করে তখন সেই ব্যক্তি অর্থাৎ প্রোসপেক্টিভ কাস্টমার সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানাটা সেই প্রতিষ্ঠানটির জন্য জরুরী হয়ে পড়ে। যেমন ধরা যাক আপনি কোন টেলিকম কোম্পানীর গ্রাহক হওয়ার জন্য কিংবা ব্যাংক থেকে বাড়ী কেনার জন্য লোনের আবেদন করেছেন। আমাদের এই সফটওয়্যারটির কাজ হচ্ছে আপনার ব্যাক গ্রাউন্ড চেক করে আপনার অ্যাপ্লিকেশন অ্যাপ্রুভ করা যাবে কিনা সে সম্পর্কে একটা ডিসিশন দেয়া। ব্যাংকসহ বড় বড় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ফাইকো’ নামক এক কোম্পানীর কাছ থেকে সাধারণত এই সেবা নিয়ে থাকে। ব্যাংকে কাজ করার সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে ফাইকোর এই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে করতে এক সময় ড্যারেন সিদ্ধান্ত নিল যে সে নিজের এই রকম একটা সফটওয়্যার তৈরি করবে। ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে ভাড়া করা এক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানীর মাধ্যমে ড্যারেন এই ‘ডিসিশনিং ইঞ্জিন’-টির প্রথম ভার্সন তৈরি করে নেয়। এই সময় সে টেটকে রিক্রুট করে ডেভ ম্যানেজার হিসেবে যার কাজ ছিল সফটওয়্যারটির সোর্সকোড সেই কোম্পানীর কাছ থেকে বুঝে নেয়া। হাতে গোনা কয়েকটি টেলিকম কোম্পানী আর অটো ডিলারশীপকে সেবা দেয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’-এর। আর্থিকভাবে সুলভ এবং ইউজার ফ্রেন্ডলি, এই দুই বিশেষণের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’-এর ক্লায়েন্টদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। প্রত্যেক ক্লায়েন্টের নিজস্ব কিছু রিকুয়্যারমেন্ট থাকে, যা কিনা মূল সফটওয়্যারের অংশ নয়। ফলে সফটওয়্যারকে একেক ক্লায়েন্টের জন্য একেক রকম ভাবে কাস্টোমাইজড করতে হচ্ছিল। আর সেই সাথে ক্লায়েন্টদের সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কোম্পানীর আকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ডেভ টিমের কলেবর বৃদ্ধিরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সুনিতা ছিল টেটের প্রথম রিক্রুট যার প্রধান কাজ হলো সফটওয়্যারটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবর্ধন। বছর খানেকের বেশী সময় ধরে কাজ করার ফলে সফটওয়্যারটির সোর্সকোডের খুঁটিনাটি ছিল তার নখদর্পণে। আমি একটা জিনিষ বেশ টের পেলাম যে এরা আমাকে প্রথম দিন থেকেই প্রোডাক্টিভ দেখতে চাচ্ছে। তাই আমি আর কাল বিলম্ব না করে সোর্সকোডের সেই বিশাল সমুদ্রে বিসমিল্লাহ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। যেহেতু ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’ একটি স্টার্টআপ কোম্পানী তাই সোর্সকোডের তেমন কোন প্রপার ডকুমেন্টেশনও নেই। আমাকে অনেকটা নিউজ পেপার পড়ার মতন করে লাইন বাই লাইন সোর্সকোড পড়ে বুঝতে হয়েছে সফটওয়্যারটি কিভাবে কাজ করে। কোথাও আটকে গেলে আমার ‘গো-টু পারসন’ ছিল সুনিতা। সুনিতা ছাড়াও আরো দুজন ডেভেলপার ছিল তখন। আর আমি জয়েন করার ঠিক এক সপ্তাহ পরে ভিয়েতনামিজ বংশোদ্ভূত ম্যাথিয়ু পাং নামের আরেকজন ডেভেলপার যোগ দেয় এই কোম্পানীতে। বয়সে আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ম্যাথিয়ু ছোট বেলাতে তার বাবা মার সাথে নৌকাতে চড়ে হংকং-এ আসে তারপর সেখান থেকে ইউরোপে যায়। ইউরোপে বেশ কিছু বছর থাকার পরে রেফিউজি স্ট্যাটাসে কানাডাতে আসে। আমার জীবনে এই প্রথম ভিয়েতনামিজ ‘বোট পিপল’-এর সাক্ষাৎ পেলাম। ম্যাথিয়ু যোগ দেয়ার ফলে মোট ডেভেলপারের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় পাঁচ জন। সাথে ডেভ ম্যানেজার টেট। ফলে আমাদের ডেভ টিমের জন্য বরাদ্দ ছয়টি ডেস্কই পূরণ হয়ে যায়।
ডিসিশনিং সল্যুশনে যোগ দেয়ার পর যে জিনিষটা আমার প্রথম চোখে পড়ল সেটা হলো কোম্পানীর মালিক এবং সিইও ড্যারেনের কর্মনিষ্ঠা। আমি ড্যারেনকে কখনই অফিসে আসতে কিংবা অফিস থেকে যেতে দেখিনি। অর্থাৎ সকাল নয়টায় আমি অফিসে আসার অনেক আগেই ড্যারেন এসে উপস্থিত। আবার বিকেল পাঁচটায় আমি যখন অফিস থেকে বের হতাম, তখন ড্যারেনকে দেখতাম তার রুমে বসে এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। ড্যারেনের ওয়াইফ লরি অ্যানের কাছ থেকে পরে জেনেছিলাম যে ড্যারেনের অফিস আওয়ার হচ্ছে সেভেন-টু-সেভেন। সেই প্রথম ব্যক্তি যে তালা খুলে অফিসে ঢুকে আবার সেই হচ্ছে শেষ ব্যক্তি যে তালা বন্ধ করে অফিস থেকে বের হয়। দুই সন্তানের মা লরি অ্যান নয়টায় অফিসে আসলেও বিকেল চারটার দিকে সে বাসায় চলে যায়। তাদের বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য একজন ফিলিপিনো মেইড তাদের বাসাতেই থাকে। এছাড়া সাসকাচুয়ান থেকে তার বাবাও এসে থাকে তাদের সাথে মাঝে মধ্যে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি প্রায়ই গল্প জমাতাম লরি অ্যানের সাথে। রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠা লরি অ্যান হচ্ছে তার বাবা মার একমাত্র সন্তান। মাকে হারিয়েছে বেশ অনেক বছর আগে যখন সে ড্যারেনের সাথে এখানকার এক নামকরা ব্যাংকে কাজ করত। ২০১১ সালে আমার আম্মা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন লরি অ্যান আমাকে আমার বাৎসরিক বরাদ্দকৃত দুই সপ্তাহ ছুটির বাইরেও আরও অতিরিক্ত দুই সপ্তাহের ছুটি দিয়েছিল। লরি অ্যান অনেকটা ‘মাদার ফিগার’ হয়ে ডিসিশনিং সল্যুশনের দেখভাল করত। অফিসের সব এমপ্লয়িদের জন্য সে কানাডার সবচেয়ে উঁচু মানের হেলথ ইনস্যুরেন্স নিশ্চিত করেছিল। এছাড়া কিচেনের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য ড্যারেন সহ সবার জন্য সে কাজ ভাগ করে দিয়েছিল। প্রায়ই সে ‘পটলাক’ অথবা বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে অফিসে ছোটখাট পার্টির আয়োজন করত। পটলাকগুলোতে আমার স্ত্রীর তৈরি করা চিকেন প্যাটি অফিসের সবাইকে বেশ আগ্রহ নিয়ে খেতে দেখেছি। এছাড়াও হ্যালোইনের দিন কস্টিউম কমপিটিশন অথবা সেন্ট প্যাট্রিকস ডে উপলক্ষে সবুজ কিছু পরা এইগুলি অর্গানাইজ করার ব্যাপারে লরি অ্যান ছিল অনন্য। ল্যাটিন বংশোদ্ভূত আমাদের বিজিনেস এনালিস্ট ‘হোসে’-কে হ্যালোইনের দিনে পাইরেটের কস্টিউমে দেখে মনে হয়ে ছিল আমি ‘দ্য পাইরেটস অব ক্যারাবিয়ান’-এর ‘জনি ডেপ’-কে সামনা সামনি দেখছি। তবে সবচেয়ে উৎসাহ নিয়ে উদযাপন করা হত বছর শেষে ক্রিসমাস। এই উপলক্ষ্যে ভালো কোন রেস্টুরেন্টে পার্টনার সহ ডিনারের ব্যবস্থা করত লরি অ্যান। সেই সাথে থাকত ‘গিফট এক্সচেঞ্জ’ – গোপন লটারিতে নাম উঠত কে কাকে ক্রিসমাস গিফট দিবে। তবে বলা থাকত যে গিফটের মূল্য যেন বিশ ডলারের ভিতর থাকে। সেই গিফট এক্সচেঞ্জে আমি একবার ড্যারেনের কাছ থেকে ত্রিশ ডলারের টিম হর্টন্সের একটা কার্ড পেয়েছিলাম। এতসব কর্মকান্ডের কারণে আমরা কখনই কাজ করতে করতে ক্লান্ত হতাম না। একসময় সবার অক্লান্ত চেষ্টায় ডিসিশনিং সল্যুশনের ক্লায়েন্ট লিষ্টে যোগ হল আমেরিকার বিখ্যাত টেলিকম কোম্পানী টি-মোবাইল। আমাদের কোম্পানীর জন্য এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। কারণ টি-মোবাইলের জন্য আমাদের সফটওয়্যারকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন দেখা দিল। ফলে দরকার হল আরো অনেক জনবলের। তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন মুখের আগমন হতে লাগল। এক সময় আমাদের অফিসের পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে একই বিল্ডিঙের পঁয়ত্রিশ তলাতে প্রায় চারগুণ স্পেসের নতুন অফিসে আমরা চলে গেলাম। আমি যখন যোগ দিয়েছিলাম তখন মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল বারো জন। ক্রমশ সেটা বেড়ে দাঁড়াল প্রায় অর্ধ শত জনে। আমাদের ডেভ টিমের গ্রোথ হল সবচেয়ে বেশী। ছয়জন থেকে প্রায় চব্বিশ পঁচিশ জন।
আমাদের ‘ডিসিশনিং ইঞ্জিন’ সফটওয়্যারটি বেশ কিছু মডিউলে বিভক্ত। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে এই মডিউলগুলির টেকনিক্যাল নাম কিন্তু শুরু হয়েছে ইংরেজী স্মল লেটার ‘ইউ’ দিয়ে। যেমন ‘অরিজিনেশন’ মডিউল যেখানে কাস্টমারের ডেটা সংগ্রহ করা হয়, তার নাম হচ্ছে ‘ইউ-অরিজিনেশন’। তারপর যে মডিউল দ্বারা কাস্টমারের অ্যাপ্লিকেশনকে বিশ্লেষণ বা অ্যাজুডিকেট করে অ্যাপ্রুভ অথবা কন্ডিশনাল অ্যাপ্রুভ কিংবা ডিক্লাইন্ড করা হয় তার নাম হচ্ছে ‘ইউ-অ্যাজুডিকেট’। এই সময় অ্যাপেল তার অন্যান্য প্রোডাক্ট যেমন ‘আইপড’ এবং ‘আইপ্যাড’-এর সাথে মিল রেখে তার বিখ্যাত মোবাইল ফোনকে বাজারে ছেড়েছিল ‘আইফোন’ নাম দিয়ে। আমি তখন ঠাট্টাচ্ছলে বলতাম, ডিসিশনিং সল্যুশন যদি কখনও ফোন তৈরি করার দায়িত্ব আমাকে দেয় তবে আমি সেটার নাম দিব ‘ইউফোন’। তবে ‘ইউফোন’ নয়, আমার কাঁধে এসে পড়ল ‘ইউ-ডক’ মডিউল তৈরির দায়িত্ব। এই নতুন মডিউলের কাজ হবে ইউজার যাতে কাস্টমারের বিভিন্ন ডকুমেন্ট আমাদের ‘ডিসিশনিং ইঞ্জিন’ সফটওয়্যারে আপলোড এবং সেই সাথে ডকুমেন্টগুলি পিডিএফ ফাইল হিসেবে দেখতে সক্ষম হয়। আমি যেমন আমার ‘ইউ-ডক’ প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, তেমনি অন্যেরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল অন্যান্য সব নতুন প্রজেক্ট নিয়ে। সবাই সবার কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে নিজের প্রজেক্টের বাইরে অন্যান্যদের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। একসময় আমি আমার ‘ইউ-ডক’ প্রজেক্ট সফলভাবে শেষ করি যা কিনা আমার লিংকডইন প্রোফাইলে উল্লেখ করা আছে। অন্য যে কোন স্টার্ট-আপ কোম্পানীর মতন আমাদের এখানে নতুন লোকের রিক্রুট যেমন হচ্ছে হরহামেশা, তেমনি আবার পুরাতন লোকেরাও চলে যাচ্ছে হুটহাট করে। অনেক সময় দেখেছি যে আমার পাশের ডেস্কে বসা লোকটি হঠাৎ আমাকে জানালো যে আজই তার শেষ দিন এখানে। প্রথম প্রথম খুব অবাক হতাম এই কালচারে, পরে অবশ্য অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। ফলে আমার কাছে টিমে নতুন কোন লোকের জয়েন করা কিংবা পুরানো কারো চলে যাওয়া, কোনটারই তেমন গুরুত্ব রইল না এক সময়। তবে লোকজনদের এই আসা যাওয়ার মাঝে আমি বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টারের সাক্ষাৎ পেয়েছি এবং সেই সাথে তাদের কাছ অনেক ধরণের লাইফ-লেসনও পেয়েছি। এমনই একজন হচ্ছে সেথ উইটেকার।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়ার একটি অংশ হচ্ছে ‘মর্নিং স্ট্যান্ড-আপ মিটিং’। ইতিমধ্যে আমাদের ডেভ টিম এতটাই বড় হয়েছে যে আমাদেরকে পাঁচটি ‘পড’ বা দলে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি পডের আবার একটি করে বাহারি নামও আছে। আমি তখন ‘ফ্যালকন’ পডের টিম লীড। টিম লীড হিসেবে আমাকে সকালের এই সেশন পরিচালনা করতে হয়। টেট যদিও সার্বিকভাবে আমাদের ডেভ টিমকে ম্যানেজ করে তবে তার কাজের পরিধি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তার কাজে সাহায্য করার জন্য অনেক দিন ধরেই আরেকজন ডেভ ম্যানেজার খোঁজা হচ্ছিল। একদিন সকালে স্ট্যান্ড-আপ মিটিং শেষে সবগুলি টিমকে এক সাথে কনফারেন্স রুমে ডাকল টেট। সাথে চল্লিশোর্ধ এক লোক, টেট তাকে পরিচয় করিয়ে দিল – “সিলভিও পাইভা হচ্ছে আমাদের নতুন ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার”। আমাদের সবার চোখ একসাথে ঘুরে স্থির হলো সিলভিও-র মুখের উপর। মোটা-সোটা শরীরে আঁটসাঁট কোট-টাই নিয়ে বেশ বিব্রত সে। নিজের পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করল – কথায় সাউথ আমেরিকান টান বেশ স্পষ্ট।
পরের দিন সিলভিও এলো অন্যান্য সবার মতন জিন্স আর টি-শার্ট পরে, প্রথমদিনের তুলনায় অনেকখানি সহজ আর সাবলীল সে তার আচরণে। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে কাজ শুরু করাটা অবশ্য ততটা সহজ ছিল না তার জন্য, কারণ বিজনেস এনালিস্ট জন ম্যাকগাওয়ান শুরু থেকেই অসহযোগিতা করে আসছিল। সিলভিও ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করলেও তার মাল্টি ডাইভার্সড স্কিলসেট-এর কারণে সে কিছুদিনের মধ্যেই ইউনিক্স আর ডেটাবেস সিস্টেম অ্যাডমিনদের বেস্ট ফ্রেন্ড-এ পরিণত হলো। ধীরে ধীরে কোম্পানীর ভিতর সে তার অবস্থান শক্ত করে নেয়। এমন সময় কোম্পানীর সিইও ড্যারেন জানায় যে টি-মোবাইলের পর আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজেনেস এনটিটি আমাদের সফটওয়্যারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে এবারের এই প্রোসপেক্টিভ কাস্টমারটি এতই গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিনানশিয়াল কোম্পানী যে সে তার নাম প্রকাশ করতে পারছে না। তবে তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে আমাদেরকে ‘মালটি-লিঙ্গুয়াল’ ফিচার যোগ করতে হবে। বিপুল উৎসাহে শুরু হয় আমাদের নতুন প্রজেক্ট -সেই প্রোসপেক্টিভ কাস্টমারের জন্য আমাদের সফটওয়্যারকে আবার গোড়া থেকে তৈরী করা। সময়ের সাথে তুমুল পাল্লা দিয়ে এই কাজ শেষ করতে হবে পরের বছর মার্চ মাসে।
দেখতে দেখতে এক সময় ডিসেম্বর চলে আসে। ক্রিসমাসের সময় সাধারণত সবাই লম্বা ছুটিতে যায়। আমি যেহেতু দুই ঈদের সময় ছুটি নেই, তাই এই সময়টায় অন্যদেরকে ছুটি নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য নিজে আর ছুটি নেই না। সিলভিও সেবার ক্রিসমাসের ছুটি নেয়নি। নিরিবিলি এই সময়টায় তাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার সুযোগ হয়। ইতালীতে জন্ম নেয়া সিলভিও-র বাড়ী হচ্ছে ব্রাজিলে। ইহুদী পিতার যোগসূত্রে ইসরাইলের সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিয়েছে তরুণ বয়সে। দুই কন্যার জনক, কিন্তু বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর সাথে বনিবনা হচ্ছে না। বর্তমানে ডিভোর্সের কেস চলছে। জীবনকে নতুন করে সাজানোর জন্যে ভিজিট ভিসা নিয়ে টরেন্টোতে আসে। রেজুমি হাতে নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানী ঘুরে যখন আমাদের রিসেপশন ডেস্কে আসে তখন তার পকেটে অবশিষ্ট ছিলো কয়েকটি মাত্র খুচরো ডলার। তাই মরিয়া হয়ে ডেস্কে বসা লরি অ্যান-কে জিজ্ঞেস করে – “তোমরা কি কানাডিয়ান ছাড়া অন্য কাউকে ইন্টারভিউতে ডাকো না? আমি দুই সপ্তাহ ধরে টরেন্টোর বিভিন্ন কোম্পানীতে রেজুমি দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা কলও পাইনি”। “দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি” বলে লরি অ্যান কিছুক্ষণ পরে ভিতর থেকে টেট-কে নিয়ে আসে ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। ডিসিশনিং সল্যুশনে এভাবেই তার প্রবেশ।
ক্রিসমাসের পরে আবার ঝড়ের গতিতে আমাদের কাজ এগিয়ে চলে যাতে কোনভাবেই যেন প্রোডাক্ট রিলিজের ডেডলাইন ফস্কে না যায়। এই রকম অবস্থায় অনেকেই সহজে স্ট্রেসড আপ হয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বহুল প্রচলিত সফটওয়্যার ডিজাইন নীতি কওঝঝ (কববঢ় ওঃ ঝরসঢ়ষব, ঝঃঁঢ়রফ) ফলো করতে বলায় এক ডেভেলপারের উপর আরেক ডেভেলপার মারমুখী হয়ে উঠে। আবার দেখা গেলো যে এক ডেভেলপারের সাথে কেউ সহজে কথা বলে না, কারণ তার গা থেকে নাকি দূর্গন্ধ বেরোয়। আবার একজনের বিরদ্ধে অভিযোগ সে নাকি তার ডেস্কে বসে নেইল ক্লিপ করে। ম্যানেজার হিসেবে সিলভিও এইসব উদ্ভট পরিস্থিতি সফলতার সাথে সামাল দিতে লাগল। তবে সবচেয়ে বেশী চ্যালেঞ্জিং ছিল এক ট্যালেন্টেড ডেভেলপার যে কিনা নিজেকে কানাডার সেরা ডেভেলপার বলে দাবী করত। সে এতটাই অ্যারোগান্ট ছিল যে সে তার লেখা কোডের পাশে কমেন্ট লিখে রাখত যে কেউ যেন তার কোডকে মডিফাই না করে। সেই ডেভেলপারকে নিয়ে সিলভিও-কে কম দূর্ভোগ পোহাতে হয়নি। এই জন্যই হয়ত বিল গেইটস কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে অনেকগুলি অনেক ট্যালেন্ট লোককে একটা টিমে রেখে একই সাথে কাজ করানো। যাই হোক সেই ডেভেলপারকে একদিন এক অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য সিকিউরিটি দিয়ে বের করে দেয়া হয়। এরপর অবশ্য সেই ডেভেলপার ‘গ্ল­াসডোর’ নামক পোর্টালে বেনামীতে ডিসিশনিং সল্যুশনের নামে অনেক নেগেটিভ মন্তব্য করে। কিন্তু তাতে আমাদের তেমন কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি, কারণ আমাদের এখানে যোগ দেয়ার জন্য অনেক নামিদামি
কোম্পানী থেকেও ডেভেলপাররা ইন্টারভিউ দিতে আসত।
বিশাল এই কর্মযজ্ঞের মাঝে হঠাৎ সিলভিও-কে যেতে হলো ব্রাজিল, ফ্যামিলি ইমার্জেন্সীর কারণে। ফিরে আসার পর তার ভিতর বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি – অধূমপায়ী সিলভিও দেখি পুরোপুরি চেইন স্মোকারে পরিণত হয়েছে। এফিডেভিট করে নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘সেথ উইটেকার’ করেছে। কোন এক নির্জন মুহুর্তে জানতে চাইলাম ঘটনা কি? কোর্টে স্ত্রীর সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে, যেটা সে নিজেই চাচ্ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তার মেয়েরা এতে এতখানি ভেঙ্গে পড়বে। তার মেয়েরা ভাবছে সে তাদেরকেও ত্যাগ করেছে। আরো একটা ব্যাপার তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, ডিভোর্স দেয়ার পর তার চার্চ তাকে ‘পারসন নন গ্রান্টা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অথচ এই চার্চেই সে ছোটবেলা থেকে ভায়োলিন বাজিয়ে এসেছে।
দেখতে দেখতে নতুন সফটওয়্যার তৈরী হলো নির্ধারিত সময়ের আগেই। ফলে কিছুটা মন্থর হলো আমাদের কাজের গতি। ততদিনে সিলভিও-কে আমরা তার নতুন নামে ডাকতে অভ্যস্থ হয়ে উঠলাম। মাঝে মাঝেই আমি তাকে সংগ দিতে একসাথে কফিশপে যাওয়া শুরু করলাম। ঠিক এই সময় বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মতন জানতে পারলাম যে ‘ডিসিশনিং সল্যুশন’ বিক্রি হয়ে গেছে। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো