প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৪
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
‘মুসে ডি’অরসে’র ভেতরে ঢুকেই মনে হলো হঠাৎ করে, একটি সাগরের মধ্যে পড়ে গেছি। যার কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। মনে মনে ভেবে চলেছি কোনদিক দিয়ে শুরু করবো?
এতটা বড় হবার যথেষ্ট কারণ আছে। আসলে এটা প্রথমে একটি অসাধারণ শিল্পিত রেলস্টেশন ছিল। যার প্রতিটি দেয়ালে ‘ওয়াল পেইন্টিং’ অথবা গ্রাফিক্সে ভরপুর ছিল। মানুষের প্রচুর কৌতুহল ছিল এই রেল স্টেশনটা নিয়ে। তবে পরবর্তীতে রেলস্টেশনটি প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হয়ে গিয়েছিলো। যার জন্য এটার পাশেই নতুন করে খুব বড় আকারে একটি রেল স্টেশন নির্মান করা হয়। এবং শিল্পকলার দেশ ফ্রান্সের সরকার পরবর্তীতে পুরাতন রেলস্টেশনকে নবায়ন করে একে অন্য একটি আর্ট গ্যালারীতে রূপান্তর করে। এবং সিদ্ধান্ত হয়, এই আর্ট গ্যালারীটা হবে কেবল মাত্র ফরাসির আর্টিস্টদের জন্য। ১৮৯৮ থেকে ১৯০০ এর মধ্যে এটার নির্মান কাল। যেটা জনসাধারণের জন্য ওপেন হয়ে ১৯১৪ সালে। একেতো কেবলমাত্র ফরাসী শিল্পীদের জন্য এটা নির্মান করা হয়েছিল, তদুপরি নুতন রেলস্টেশন এর অতি নিকটে, তাই মানুষের জন্য অত্যন্ত সহজ হয়েছিলো এর দর্শন এবং জনপ্রিয়তাও অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে অন্যতম প্রধান দশটি আর্ট গ্যালারীর মধ্যে ‘মুসে ডি আরসে’ তিন নম্বর পজিশনে আছে।
এই গ্যালারী ভিজিট করবার সময়সীমাও আলাদা। সকাল ৯:৩০ থেকে রাত ৯:৩০ পর্যন্ত।
মোটামুটি যে সকল প্রখ্যাত শিল্পিদের আর্ট, স্থাপত্য, আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে এই গ্যালারীতে তারা হলেন, ক্লাউডি মনেট, ডি গাস, ম্যানেট, রেনিওর, সেজান, সিউব্যাট, সিসলী, জর্জ হেনড্রিক, গাওগুইন, মরিসাট, গ্রে হারমনি এবং ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
সাধারণের মধ্যে ধারণা আছে ‘লুভরি’ আর্ট মিউজিয়ামে বেশী মানুষ হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে ওখানে বেশী মানুষ হয়, তবে ‘লুভরি’তে ভিড় হবার অনেক গুলো কারণও রয়েছে। তবে এখানে যারা আসেন তারা প্রকৃতপক্ষে আর্টের প্রেমিক।
বেশীর ভাগ দর্শনার্থীরা দেখলাম ‘রেনিওর’ এর ওখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমি অবশ্য ঐ ভাবে দেখতে আগ্রহী নই। আমি ভাবলাম দোতালার ডান দিক থেকে দেখতে দেখতে যাবো।
নিকোল যাবার সময় আমাকে আস্তে আস্তে যে কথাটি বলেছিল সেটা হলো, আজ নাকি ভিনসেন্ট ভ্যান গগের এক্সিবিশন। ব্যাস সেই থেকে মনের মধ্যে গুনগুন করছে, কখন ওখানে যাবো? কিন্তু আমার স্বামী বললো, একবার ওখানে গিয়ে পড়লেতো আর বের হতে পারবে না। তার থেকে এঁদের আগে দেখে নেই। সময়ও খুব বেশী আছে তাও নয়।
ফরাসি এই সব পেইন্ট, স্থাপত্য, আলোকচিত্র এর সবই ১৮৪৮ থেকে ১৯১৪ এর মধ্যে নির্মিত। তারা এই সকল বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্প সামগ্রী কালেকশন করেছিল।
তবে এটা ঠিক, পেইন্টিং আমাকে মারাত্মক আকর্ষণ করলেও ‘মুসে ডি আরসে’তে আমাকে খুব বেশী আকর্ষণ করেছিলো এর স্থাপত্যের কালেকশন। কোনটা রেখে কোনটা বলবো। একেকটা দেখি আর বিমুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর শিল্পী এবং শিল্প কর্মের সময়সীমা দেখি, ছবি তুলি। আবার ডাইনে, বায়ে সামনে। কোনটা রেখে কোনটা বলবো?
প্রথমেই আমি বিল্ডিং এর ডানদিকের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। প্রথমেই দেখলাম, বিখ্যাত পেইন্টার ‘অস্কার ক্লাউডিমনেট। অসাধারণ তুলি শিল্পী। মনে হয় প্রতিটি আর্টের মধ্যে ঠিক সেই সময়ের, সেই বিষয় বস্তুর মধ্যে আপনি ঢুকে যাবেন। তবে মূলত প্রকৃতিকে বেশী এঁকেছেন। একটি পেইন্ট মনে হলো আমাদের ঠিক বাংলাদেশের পুকুরের মধ্যে পদ্ম ফুল। এত সুন্দর, এত রিয়ালিস্টিক। মনে হচ্ছে আমি পুকুরটা দেখতে পাচ্ছি। আর একটি ছবিও আমাদের বাংলাদেশের ধান যখন গ্রামের মানুষ উঠিয়ে পালা করে, ঠিক তেমনি। এত সুন্দর সূর্যাস্তের শেষ আলোর রঙ দিয়ে এঁকেছে। আমি ছবিটার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। যার জন্য প্রাকৃতিক তুলি শিল্পের ফিলোসফার বলা হয় ক্লাউডি মনেট কে। ১৮৪০ সালের ১৪ই নভেম্বর উনার জন্ম। এবং মৃত্যু ৫ই ডিসেম্বর ১৯২৬। উনার একাডেমিক পড়াশুনাও ছিল, ন্যাশনাল স্কুলে ফাইন আর্টের উপর।
এই কক্ষে কেবলমাত্র ক্লাউড মনেট এর ছবি দিয়েই সমৃদ্ধ ছিলো। যেহেতু মনেট একজন প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন, তাই এই কক্ষে বেশীর ভাগ বয়স্ক দর্শনার্থীরা ছিল। সেটা ভেবে ভালো লাগলো আমার যে, এখনও মানুষের প্রকৃত ভালোলাগার মধ্যে ‘ন্যুডিটি’ খুব একটা স্থান করেনি।
আসলে সব সৌন্দর্যের মধ্যেই কিছুটা আড়াল ভালো লাগে।
এরপর পর পর দুইটি ঘরেই ছিলো ‘পিয়েরা আগাস্টা রেনিয়রে’র পেইন্ট। যদিও ‘মুসে ডি অরসে’ মিউজিয়ামটা ১৪/১৫ জন আর্টিস্টকে হাইলাইট করেছে। তবুও তার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখলাম তারা ‘রেনিয়র’কেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছে। এমনকি এই আর্ট মিউজিয়ামের মধ্যে প্রবেশ মুখেই ‘আগস্টে রেনিয়র’ এর বিশাল একটি প্লাকার্ড যেটা দেখে আমি বেশ চমকে গিয়েছিলাম।
যদিও রেনিওর’কে ফ্রেন্স আর্ট এর প্রতিচ্ছায়াবাদী বা ইমপ্রেসনিস্ট এর এক লীডার বলা হয়। তবুও পরবর্তীতে দেখা যায়, এ ব্যাপারেও মনেট এগিয়ে আছেন। পিয়ের আগাস্টার জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৮৪০ সাল। এবং মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর, ১৯১৯ সাল। এই বয়সের মধ্যেই তিনি ফ্রেন্স আর্টে অনেক অবদান রেখে গেছেন। উনার সব থেকে মজার ব্যাপার ছিলো, উনি মারাত্মক পারফেকশনিস্ট বা খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিলেন। একটি পেইন্ট উনি ৩৩ বারও এঁকেছেন। অর্থাৎ একই বিষয়বস্তুর উপর। এতটাই খুঁতখুঁতে ছিলেন।
তার প্রতিটি পেইন্টের ফিনিশিং দেখলেই সেটা বোঝা যায়। প্রতিটা পেইন্টের উপর এতটা যত্ন এবং অসম্ভব একটা গ্লোজিনেস সেটা চিন্তাই করা যায় না। বিশেষ করে তার ফিনিশিংটা। যার জন্যই তাঁকে ‘প্রতিচ্ছায়াবাদী’ পেইন্টারদের লীডার বলা হয়। তার কয়েকটা পেইন্ট দেখে আমি স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলাম। এতটাই জীবন্ত। দেখে এবং ছবি তুলেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো, আহা ছবিটা যদি সাথে নিয়ে যেতে পারতাম। একেকটি ছবি এতোক্ষণ ধরে দেখতে ইচ্ছা করছিলো যে, পেছন থেকে অনেকেই বিরক্ত প্রকাশ করছিলো। কারণ, সবারই সময় কম। অবশ্য বেশ কিছু অসম্ভব বৃদ্ধ/বৃদ্ধা, এমনকি কেউ কেউ ছিলো হুইল চেয়ারে। তারা ভীষণ শান্তভাবে দেখছিলো। বোঝাই যাচ্ছে তারা, এসব ছবি বহুবার দেখে গেছে। আবারো দেখতে এসেছে। কিন্তু আমরাতো মাত্র একটি দিন। তাও গোটা প্যারিস?? এও কি সম্ভব?? এই দিন প্রথম বুঝলাম, ৬০ মিনিটে ১ ঘন্টা। কেও বিশ্বাস করবেন না, ঐ দিনের প্রতিটি মিনিট আমি কাজে লাগিয়েছি। এখনও অনেক কজন বাকি। পাশে থেকে আমার স্বামী মনে করিয়ে দিল। আরো আছে আমার ‘ভ্যান গগ’ এর ছবির এক্সিবিশন। মনটা আবারো ময়ূরের মত নেচে উঠলো। (চলবে)
রীনা গুলশান।
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com