প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭০
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
আমরা ‘লুভ্যর’ মিউজিয়াম দেখে গাড়িতে উঠলাম। আমার ‘লুভ্যর’ এর ঘোর কাটছিলো না। ওখান থেকে বের হতে হতে ভাবছিলাম আবার বেঁচে থাকলে প্যারিস আসবো, শুধুমাত্র এই আর্ট মিউজিয়ামের জন্য। প্যারিসে আরো অনেক কিছুই দেখার আছে, যা আমাকে মোটেই টানছে না। বড়জোর এক ধরণের কৌতুহল আছে। যা একেবারেই সহজাত। নতুন কিছু দেখার। নতুন কিছু জানার।
তবে এবারের যে ট্যুরে আমরা যাচ্ছি; আমাদের অন্য সঙ্গী কাপল-রা, খুশীতে একেবারে টগবগ করছে। আমাদের পেছনের সিটে বসে জেমিমা ক্রমাগত বকবক করেই চলেছে। তারা কত ছবি তুলবে, এখন উপরের ছাদে উঠবে, এরকম অনেক প্লান করছে। আমি মনমরা হয়ে, লুভ্যরে তোলা ছবিগুলো দেখছিলাম। নিকোল তখন ‘রোমান্টিক ট্যুরে’র নানান বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম ‘রোমান্টিক ট্যুর’ ভর দুপুরের আগে আগে কেন? পরে নিকোল নিজেই দেখলাম বলছিলো, আমাদের ট্যুর এই সময় কেন? কারণ বিকালে অর্থাৎ ৫/৬টার দিকে যে রোমান্টিক ট্যুর সেটাতে বাধ্যতামূলক (অনেকাংশে) ডিনার নিতে হয়। হু! এতক্ষণে বুঝলাম। আমার ছেলে রায়হান, এই সময় কেন নিয়েছে? আমরাতো এইসব ডিনার খেতে পারবো না। এই সব জায়গাতে তো আর হালাল খাবার পাবো না। তবে পরে আমাদের cruise এ বসে ঐ সব cruise –ও দেখছিলাম। আমার একদম আবদ্ধ মনে হয়েছিল। যদিও বাইরে থেকে অনেক গর্জিয়াস এই cruise গুলো। দেখলেই মাথা খারাপ। আমাদের জন্য নির্ধারিত cruise টা সুন্দর, সাদা রঙের। তিন তলা। কিন্তু চারপাস খোলা। লা-সেন নদীতে এই cruise পরিক্রমণ করবে। এই নদী বা লেকের পানিতে পরিক্রমণ শুরু করেছি সেই ১৯৯৬ সাল থেকে। প্রথম বাংলাদেশে রাঙ্গামাটিতে। অসাধরণ সেই পরিক্রমণ। বিশ্বাস হয় না সেটা বাংলাদেশ। লেকের চারপাশ ঘিরে ছিলো পাহাড় (খুব বেশী উঁচু না)। মজার ব্যাপার সেখানে একটা ফাউন্টেনও ছিলো। এত সুন্দর। তখন শান্তিবাহিনীর একটা আক্রমনের ব্যাপার ছিলো। তবু খুব রিস্ক নিয়ে দেখেছিলাম। এত মনোরম লেক আমি এই জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।
এরপর ভারতে যখন ৫ বছর ছিলাম তখন অনেকগুলো লেক বা নদীতে পরিক্রমণ করেছি। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ঊটি এবং নৈনিতাল এর বোট পরিক্রমণ। নৈনিতালের পানির রঙ ছিল গাঢ় ফিরোজা। অই রঙের পানি আর কখনো দেখিনি।
যাই হোক, আমাদের cruise এর জন্য লম্বা লাইন। আমাদের হাতে, যার যার টিকিট দিয়ে নিকোল বুঝিয়ে চলে গেল। কতক্ষণ পর সে আসবে এবং কোথায় দাঁড়াবে? এরপরের ট্যুর ‘আইফেল টাওয়ার’। সেখানেই যার যার মত লাঞ্চ করতে হবে।
যাই হোক cruise এর মধ্যে উঠলাম। বেশ বড়। আমি এক তলাতেই বসলাম। পাশাপাশি ২টা করে বসার সিট। মুখোমুখি আবার দুটো বসবার চেয়ার। আর মাঝখানে খাবার টেবিল। cruise এর দোতালায় খাবারের ক্যান্টিন আছে। কিছু কিনে খাওয়া যায়। আমরা লন্ডন থেকে প্রচুর খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম, যেন বাইরে থেকে কিছু কেনা না লাগে। মাজেদা আপা ভোরে উঠে প্রচুর খাবার রেডী করে দিয়েছে। শুধু চা, কফি কিনলেই হবে।
আমরা একটা সিট নিয়ে বসলাম। অন্য সবাই দোতালা থেকে তিনতলায় দৌড়ে গেল। আমি সিটেই বসে রইলাম। কারণ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় এর থেকে বেশী কিছুই দেখা যাবে না; যা আমি দেখছি এখান থেকে। উল্টো ওখানে গেলে ঠান্ডা লাগার সমূহ সম্ভাবনা। এখনও অনেক দেশে যেতে হবে। তাই ঠান্ডা লাগানো চলবে না। পায়ের ব্যাথাতো এমনিতেই সবসময় থাকেই।
প্যারিসের গোটা সিটি-টা ৭টা আইল্যান্ড নিয়ে করা। অনেকটা নিউইয়র্কের মত। এই লা-সেন নদীর পরিক্রমণটা এত সুন্দর করে করেছে যে, এই গোটা শহরটাই যেন আপনার দেখা হয়ে গেল। ক্রুজের ভেতরে থেকে, টুরিস্ট গাইড ক্রমাগত বর্ণনা করে যাচ্ছিল। প্রতিটি জায়গার। পার্লামেন্ট বিল্ডিং এবং বিশেষ বিশেষ জায়গার বর্ণনা এত সুন্দর করে করছিলো যে, আমাদের নদীতে বসেও সব জানা হয়ে যাচ্ছিল।
সব থেকে ভালো লাগছিলো, যখন একটা করে ব্রীজ আসছিলো। তখন cruise এর গতি বেশ কিছুটা আগে থেকেই শ্লো করে দিচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল যেন ক্রুজের ছাদ ব্রীজের সাথে টাচ লেগে যাবে। প্রতিটি ব্রীজের রং অলিভ রঙের। এত মজবুত চিন্তাই করা যায় না। সব থেকে মনোরম ক্রুজে যেতে যেতে দেখতে পারবেন এদের সৌন্দর্য বোধের অসাধারণ উপস্থাপনা। সারা পৃথিবীর সব প্রখ্যাত মডেলদের বিখ্যাত পোস্টারগুলো এখানে দেখতে পাবেন। ফ্রান্সের সমস্ত বিখ্যাত পারফিউমের পোস্টার এখানে দেখতে পাবেন। সবথেকে নয়নাভিরাম দৃশ্য আমার নিজের কাছে লেগেছে নদীর মধ্যে বেশ দূরে, ছোট্ট ছোট্ট একটা দ্বীপের মত। সম্ভব এটা এরাই করেছে। এর মধ্যে বৃক্ষের ভারে, স্থানটা মনে হচ্ছে হঠাত করে ঘন জঙ্গল। এত সুন্দর যে, চোখ দুটো সার্থক মনে হবে।
নেপোলিয়নের পুরানো এবং নতুন সব প্রাসাদ-ই আমরা নদী থেকে দেখতে পারছি। যদিও ভেতরটা খুবই বিশাল, জটিল। কিছুই বোঝার উপায় নাই।
গাইড বর্ণনা করছিল প্রথমে ফেঞ্চে তারপর ইংরেজীতে। আমাদের বুঝতে কোনই অসুবিধা হচ্ছিল না। ৪৫ মিনিট ঘোরার পরই বুঝলাম আর বেশীক্ষণ নাই। আমরা দূরে থেকে আইফেল টাওয়ার দেখছিলাম। দারুন একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এবারে ধারা বর্ণনায় ‘আইফেল টাওয়ার’ স্থান পেয়েছিলো।
আমাদের cruise টি পাড়ে চলে এলো। আমাদের নিকোল বলে দিয়েছিল সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। ইতিমধ্যে সে আইফেল টাওয়ারে প্রবেশ করবার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়েছিল টিকিট কাটবার জন্য। এতবড় লম্বা লাইন। আরো ৩ ঘন্টায়ও টিকিট পেতো না। যাইহোক সে কাহিনী পরে জানাবো। অতপর : অসাধারণ রোমান্টিক cruise ভ্রমণের পর মনটা খুবই ঝরঝরে লাগছিলো। খুবই আনন্দ চিত্তে আমরা অবতরণ করলাম। নিকোলের কথিত জায়গাতে যেয়ে দেখি, নিকোল নাই, ড্রাইভার দাড়িয়ে আছে। সে-ই আমাদের নিয়ে, অন্য এক জায়গাতে দাঁড় কারিয়ে দিল। দূরে দেখলাম নিকোল লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে হাত নাড়ালো। অসাধারণ এক অনুভূতি নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। (চলবে)
রীনা গুলশান
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com