প্রবাসে পরহিতকর্ম -১০২

আলবার্টার পথে পথে

রীনা গুলশান

আমাদের ছোট ছেলে রুম্মান চাকরীর কারণে তার পরিবারসহ আমাদের ছেড়ে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় চলে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল। তার বেড়ে উঠা মূলত টরন্টোতেই।

২০১৯ এর শেষের দিকের ঘটনা। তখন আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম প্রায় আড়াই মাসের জন্য। আমার নিজের বই এর প্রকাশনা এবং সমস্ত ‘বই মেলা’র আনন্দের নির্যাস টুকু চুষে নেবার জন্য। এবং ক্রেডিট পুরোটাই রায়হান, মানে আমার বড় ছেলের। সে নিজেও কুড়ি বছর পর বাংলাদেশে গিয়েছিল, মামনির বই প্রকাশনা উৎসবে। আমরা মার্চ এর ৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলাম, তারপর আমরা তিন মা/ বাপ/ বেটা, আরব আমিরাত ট্যুরে গিয়েছিলাম। রায়হান ই বলেছিল, প্রতিবার কেবল দুবাই, দেখে দেখে চলে আসো। কোন মানে হয় না। তাই সে সমগ্র আরব আমিরাতের প্রতিটি কোন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।

আর সেই সময় একদিন  আমার ছোট ছেলে রুম্মানের ফোন এলো, সে তার কাঙ্খিত জবটা পেয়ে গেছে। রুমু এতটাই উত্তেজিত ছিল যে, রীতিমত উত্তেজনায় চেচিয়ে কথা বলছিল। যদিও রুমু “লাইফ ল্যাবে” খুব ভাল পজিশনে জব করছিলো। তবু এই উত্তেজনা কেন? কারণ এটা SYSMEX কোম্পানি। জাপানি মালিকাধীনে, শিকাগোতে হেড অফিস। সারা পৃথিবীতে ছড়ানো এই কোম্পানির পরিব্যপ্তি। এরা মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টের টপ টু বটম সাপ্লাই করে। এবং নিজেদের দক্ষ কারিগর দিয়ে সেই সমস্ত মেসিনারিজ ইরেকসন করে। আমার ছেলে একজন মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিস্ট। হাসপাতালগুলো, ওদের কোম্পানির ইন্সট্রুমেন্ট কেনে। ওদের অফিসের ম্যাকানিকসরা গিয়ে সেগুলো ইনস্টলেশন করে। রুম্মান কম্পিউটার এর মাধ্যমে তাদের ইনসট্রাকসন দেয়। 

আলবার্টায় পর্বতমালার একটি দৃশ্য। ছবি : লেখক

রুম্মানের জব স্ট্যাটাস হলো- Clinical Application specialist II at SYSMEX Canada Inc. এটা মূলত মেডিকেল Diagnostic company. এবং মূল জব হলো, Handling all project implementations in western Canada, BC, Alberta, Saskatchewan, and Territories

যাই হোক তাকে প্রথম পোস্টিং দিল ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়। রুমু ভ্যাঙ্কুভারে ঘর ভাড়া করলো। ওখানে ওরা দু বছর ছিল। কিন্তু ঐ সময় টাতেই শুরু হলো ঘন ঘোর তমশা ( করোনা)। ভ্যাঙ্কুভারে থাকা অবস্থায় রুম্মান SYSMEX এ সেরা পারফরমেন্সের জন্য ঐ বছরের (২০২০) সেরা  এ্যাওয়ার্ড পেলো। সমস্ত নর্থ আমেরিকার মধ্যে। এবং তারপরই রুম্মানকে চারটি প্রভিন্সের চিফ করে দিল। যেখানে আগে শুধু মাত্র ব্রিটিশকলম্বিয়ার হেড ছিল। ইন্টারেস্টিংলি, রুম্মানের ভ্যাঙ্কুভার ভাল লাগছিল না। আবাহাওয়া জনিত কারনে। তার মেঘলা আবাহাওয়ায় প্রচন্ড মাথায় যন্ত্রণা (সাইনাসের প্রবলেম) হচ্ছিল, প্লাস টিপ টিপ বৃষ্টিতে তার ড্রাইভ করতেও অসম্ভব ইরিটেশন  হচ্ছিলো। তার যেহেতু মাসের মধ্যে ৮/৯ বার হাসপাতাল পরিদর্শন করতে হয়। যদিও অনেক জায়গাতে প্লেনেও যায়। আবার ড্রাইভও করতে হয় প্রচুর। ড্রাইভ করতে গেলেই সে, সিঁক হয়ে পড়ছিল। দিনে দিনে সেটা সাইনাসের দিকে যাচ্ছিলো ।

এরপরই রুম্মানের বাবা খন্দকার কাজিম বললো, তুই তাহলে আলবার্টার দিকে চলে যা। সেই মোতাবেক রুম্মান ক্যালগেরীর আবাহাওয়া দেখার জন্য, হলিডে ইন, এ দু মাস ছিল। তখন ক্যালগেরী তার ভাল লেগে যায়। এরপর একটা কন্ডো ভাড়া নিয়ে ছিল। এবং একই সময়  Carrington Close NW Calgary তে নিজের একটা বাড়ী অর্ডার করে বিল্ডারের কাছে। এবং বাড়ীটা পাবার কথা ছিল মার্চ মাসে। কিন্তু করোনার জন্য দেরী হয়েছে পেতে। ২৭ শে আগস্ট পেয়েছে চাবি।

এবারে আর না বলার মত কোন বাধাই রইলো না। অতএব ২৮ সেপ্টেম্বর আমরা জীবনে প্রথম বারের মত ক্যালগেরীর মাটিতে পদার্পন করলাম WESTJET আকাশযানে। আমাদের ভীষণ অবাক করে দিয়ে WESTJET একদম পারফেক্ট টাইমে স্টার্ট করলো এবং একদম কারেক্ট টাইমে অবতরণ করলো। আমার লাগেজ ছিল একটি। দুটি ক্যারি অন। আমাকে যথাবিহিত ভাবে “হুইল চেয়ারে” করে একজন ফিলিপিনস মহিলা নিয়ে এলো, লাগেজ, যেখানে আসবে সেখানে। অনেক্ষণ অপেক্ষা করলো মহিলাটি। আমি অতপর তাকে বিদায় করে দিলাম। এখানেই মারাত্মক টুইস্ট এলো, আমাকে প্রবল ভাবে অবাক করে দিয়ে। রুম্মান আমাদের নিতে এসেছে Calgary international Airport এর বাইরে। আমরা ক্রমাগত দুজন দুজনার সাথে ফোনে কথা বলে, কনট্যাক্ট করে চলেছি। আমি ক্রমশ অবাক থেকে অবাক হয়ে চলেছি। আপনি ঠিক কতক্ষণ চিন্তা করতে পারেন, লাগেজের জন্য? সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করছি, আজ পর্যন্ত লাগেজের জন্য এতটা সময় অপেক্ষা করেছি বলে মনে পড়ছে না। এমন কি বাংলাদেশেও না। সেখানেও অবতরণ থেকে, লাগেজ রাউন্ড পর্যন্ত আসতে আসতে দেখেছি স্যুটকেস চলে আসে। খুবই অবাক করা ঘটনা, ৭/৮ টা করে সুটকেস রাউন্ডে আসছিল। জনগন অস্থির হয়ে পড়ছে। আমি না পেরে একটা বেঞ্চ এ বসে পড়লাম। দেখলাম পাশেই একটা অল্প বয়সি মহিলা (২৫/২৮) বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কোন বই পড়ছে। আমাদের এই সব অস্থিরতা তাকে মোটেই স্পর্শ করছে না। সে খুব গভীর মনোযোগে একটি বই পড়ছে। আমি একটু উকি দিলাম, দেখি ফাইনান্সের উপর একটি বই পড়ছে। আমার তাকানো দেখে হেসে বললো, ঃচিন্তা করো না, আরাম করে বসো, লাগেজ পেতে এখনো ঘন্টা খানেক লাগবে!

ঃ বলো কি? অলরেডী এক ঘন্টা হয়ে গেছে।

ঃ এখন তো খুব ভাল, দেড় থেকে দুই ঘন্টার মধ্যে পাওয়া যায়, বছর ৫/৭ আগে ৩/৪ ঘন্টা লাগতো। বলেই হেসে বলো ঃ আমি স্টেফেনি। এখানকার স্থানীয়। আমার হাসবেন্ড কে রিসিভ করার জন্য বসে আছি, সে টরেন্টো তে গিয়েছিল একটা মিটিং এ।

আমি আমার নাম বলে বললাম, আমি টরেন্টো থেকে এসেছি, ছেলের কাছে বেড়াতে। স্টেফানির সাথে কথা বলে অনেক মজা পাচ্ছিলাম। তার আর আমার পছন্দে  প্রচুর মিল ছিল। বিশেষত বই এবং লেখকদের নিয়ে। বেশ অবাক হচ্ছিলাম। আমার আর ওর প্রচুর কমন লেখক ছিল। মজার ব্যাপার, আমাদের দুজনেরই অতি প্রিয় লেখক, শেকসপিয়ার। তার লেখার বিখ্যাত কয়েকটি পংত্তি, এক সাথে বললাম। নিজেই এত মজা পেলাম। ছোট বেলার মত হাত তালি দিয়ে উঠলাম।

এরই মধ্যে হঠাৎ, ওর হাসবেন্ড, “কাবাব মে হাড্ডি”র, মত সামনে উদয় হলো। বললো তার লাগেজ পেয়ে গেছে। আমরা দুজন দাড়িয়ে, দুজন দুজনাকে হাগ করলাম। তার হাসবেন্ডের সাথেও আলাপ হলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের লাগেজও চলে আসলো। অতঃপর, অপেক্ষারত রুম্মানের গাড়িতে উঠে পড়লাম। তখনও দিনের আলো যথেষ্ট ছিল। রুম্মান, আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আনছিল। ক্যালগেরী শহর টা দেখাচ্ছিল। অসম্ভব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। কেমন যেন এক একটা রেসিডেন্স এরিয়া অনেক দূরে দূরে। সব থেকে মজার ব্যাপার আরো অনেক পরে জানলাম। অন্টারিও বা টরেন্টোর মত প্রত্যেকটা এরিয়ার আলাদা আলাদা করে নামকরণ নাই। এখানে চারটে নামকরণের মাধ্যমে টোটাল ক্যালগারীকে চেনা যায়। যেমন- North East, North West, South East, South west .

যেমন North East থেকে North west এর দূরত্ব অনেক। আমার ছেলে আগে রেন্ট করে একটা কন্ডো তে থাকতো। সেটা South East.

একসময় ছোট ছেলের বাড়িতে এলাম। একদম নতুন গাড়ীর মত এরা বাড়ীও (মানে মেইন দরোজা টা) সুন্দর আকাশী রঙের চওড়া সার্টিনের ফিতা দিয়ে একটা “বো” করে দিয়েছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ছেলে। “বো”  টা কাটেনি। বাপীর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা আসার পর বো কাটা হলো। Ashley, homestore থেকে দুটি সোফা শুধু কিনেছে। বাকী সব ফার্নিচার, অর্থাৎ সব বেডরুম সেট আমাদের নিয়ে অর্ডার দিয়ে এলো। আর যেহেতু আমি এসেছি, তাই পেইন্টিং না কিনলে কি হয়?  তিনটি পেইন্টিং কেনা হলো। যদিও এখনও সাপ্লাই আসেনি। যাই হোক, টুকটাক ঘর গোছানো হচ্ছে। এর মধ্যে কাজিম খন্দকার, এসেই বেইজমেন্ট বানানোর কাজ শুরু করেছে।

আমি দু/ তিন দিনের মধ্যে বের হতে চাইছিলাম না। একেবার তাই ঠিক হলো, শুক্রবার আসে পাশে একটু ঘুরবো। তারপর “ব্যানফ” এ যাবো, শনি/রবিবার। ততোদিন নতুন জায়গায় শরীর টাকে ধাতস্থ করতে হবে। আসবার পর থেকে কিয়ারা’র (রুম্মানের কন্যা, ৬ বছর তার বয়স) অভিমান ভাঙ্গাচ্ছি। তার জন্ম, সাড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা, সম্পূর্ণ আমাদের হাতে। তাকে কিছুতেই বোঝানো যায় না যে, ওকে ছেড়ে, আমরা চলে আসিনি। সেই ই আমাদের ছেড়ে চলে এসেছে। কিয়ারার দাদা, তাকে ক্রমাগত আদরে আদরে, তার উষ্ণ অভিমানকে দ্রবিভূত করবার প্রয়াসে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com