“দি সার্কেল অব লাইফ”

নভেম্বর ৯, ২০১৯

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

বাবা-মা বুঝতে পারে। এক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পারে তাদের সন্তানের কিছু একটা হয়েছে। কিভাবে বুঝতে পারে? জানি না। আমি এখন বাবা হয়েছি। আমিও বুঝতে পারি। কিভাবে পারি জানি না।

ছেলেকে গত কয়েক দিন থেকেই দেখছি। কিছু একটা ঠিক নেই। কি সেটা বুঝতে পারছি না। কয়েক বার এটা-সেটা বলে বুঝতে চেয়েছি। কাজ হয় নি। সে মুখ খোলেনি। বয়স চৌদ্দ হয়েছে। সে কি বড় হয়ে গেছে? এখন বলতে চায় না? আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আজ বিকেলে এসে বললো…”চলো আব্বা বাইরে যাই। হেঁটে আসি।“

আমরা বাইরে বেরুলাম। চমৎকার দিন আজ। ঠান্ডা প্রায় নেই বললেই চলে। ঝকঝকে রোদ….অনেক দিন পর পুরো টরন্টো শহরকে ধুয়ে দিচ্ছে। বাতাস আছে। আমরা চুপচাপ হাঁটছি। আমি জানি তরঙ্গ কথা বলবে। আমি অপেক্ষা করে আছি।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা পেট্রল পাম্পের কাছে চলে এলাম। ছেলে পেট্রল পাম্প দেখিয়ে বলল, “আব্বা জানো…এই পেট্রল পাম্পে ‘পোলার পপ’ পাওয়া যায়।”

পপ মানে জানি। কানাডায় সফ্‌ট ড্রিংস..কোক…পেপসি..এই সবকে পপ বলে। কিন্তু পোলার পপ কি? জানি না। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম। সে হেসে দিয়ে বললো…“তুমি জানো না!…আমি শিখিয়ে দিচ্ছি….তুমি সফ্‌ট ড্রিংস একটা বিশেষ ফোমের তৈরী গø­াসে নিতে পারো। গø­াসটা ফ্লাস্কের মতো পপকে অনেকক্ষন ঠান্ডা রাখে। এটাকে পোলার পপ বলে।“

দি লায়ন কিং চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি : অনলাইন

“তুমি কি এখন একটা কিনতে চাও?”

“না।” চট করে দেখলাম ছেলের মুখ আবার কালো হয়ে গেল। কিছুক্ষন চুপ করে রইলো।

ছেলের কিছু একটা হয়েছে। আমি বললাম, “তুমি কি কিছু আমাকে বলতে চাও? শেয়ার করলে অনেক সময় মন ভালো হয়।”

ছেলে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা নিরিবিলি রাস্তা ধরলাম। সে আমার কাছে ঘনিয়ে এলো, “কালকে স্কুল ছুটির পর আমরা তিন বন্ধু স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে এই পেট্রল পাম্পে এসে পোলার পপ কিনেছিলাম। এটা আর কখনো সম্ভব হবে না।”

আমি চমকে উঠলাম। শেষের কথাটা ছেলে দীর্ঘ শ্বাসের সংগে বলল। আমি এই প্রথম তার দীর্ঘ শ্বাস শুনলাম। শিশুরা দীর্ঘ শ্বাস নেয় না। তাদের এতো দু:খ থাকে না। বেদনাসিক্ত দীর্ঘ শ্বাস শুধু বড়দের জন্য। আমার ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে!

আমি তাকে কাছে টেনে বললাম…“কি হয়েছে আমাকে বলো।” এবার সে আর থামতে পারলো না।

“আমার বন্ধু সিরি forever ইন্ডিয়া চলে গেছে। আর আসবে না। কালকে আমাদের সংগে তার শেষ দিন ছিলো। তাই আমরা হেঁটে হেঁটে কার্লোসদের বাসায় গেছি। তারপর এই পেট্রল পাম্পে এসেছি। তারপর তাকে বিদায় দিয়ে আমি বাসে করে বাসায় চলে এসেছি। সিরি’র সংগে আর কোন দিন আমার দেখা হবে না।….আব্বা….আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিৎ…তুমি কি জানো কি করলে আমার ভালো লাগবে…?….আমি সিরিকে খুব পছন্দ করতাম। সেও আমাকে..।”

আমি চুপচাপ হাঁটতে থাকলাম। ছেলের দিকে তাকাতে সাহস হলো না। জানি ছেলে আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার বাবার কাছ এই ব্যাথার সমাধান চায়। সে আর কার কাছে চাইবে?!

বোঝার মতো বড় হওয়ার পর আমার ছেলেটি এই প্রথম প্রিয় বন্ধু..প্রিয় জন হারানোর কষ্ট পেয়েছে।

এই শুরু হলো। আমি জানি এরপর…অজস্র বিচ্ছেদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি জানি প্রকৃতি কি নিদারুনভাবে একটার পর একটা বিচ্ছেদ তাকে উপহার দেবে। মানব জীবনের সবচেয়ে তীব্র কষ্টগুলো আসে প্রিয়জন হারানোর বেদনা থেকে। এইসব হারিয়ে যাওয়াকে সংগে নিয়ে কি করে বেঁচে থাকতে হয় প্রত্যেক মানুষকে তা শিখে নিতে হয়। এটা পাল্টানোর কোন উপায় আমাদের হাতে নেই।

হঠাৎ মনে হলো….মনে হলো সেই চুড়ান্ত বিচ্ছেদের কথা। যেটা আমি নিজেই ভাবতে চাই না। আমার নিজের মন বিষাদে ভরে গেল। মনে হতে থাকলো…একদিন আমিও থাকবো না। আমার বাচ্চা ছেলেটা একা একা এই পৃথিবীতে থাকবে। আমাকে খুঁজবে। কোনদিন পাবে না। আমি অসহায় বোধ করলাম।

আমরা হাঁটছিলাম। কানাডায় বসন্ত এসে গেছে। কিন্তু গাছগুলো এখনো কেমন বিবর্ণ আর রুক্ষ। আমি আমার তীব্র কষ্ট লুকিয়ে রেখে ছেলের জন্য একটা আনন্দের ছবি বর্ণনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রত্যেক বাবাই তাই করেন। সেই ছবিটার সব কিছু সত্য হয় না। সব খাটি সত্য দিয়ে কোন রংগীন ছবি হয় না। আমরা বেঁচে থাকি কিছুটা সত্য আর অনেক অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে। যার অনেক কিছুই হয়তো সত্য হবে না।

চুড়ান্ত অনিশ্চিত এই জীবন…ঘোলা ঘোলা কুয়াশা ঘেরা, অষ্পষ্ট এই জীবন পাড়ি দেয়ার এটাই একমাত্র রাস্তা। এটাই একমাত্র হাতিয়ার।

আমি শুরু করলাম।

“একটা কবিতা শুনবে?”

ছেলে কথা বললো না।

“Good byes are not forever
Good byes are not the end
They simply mean IÕll miss you…
Until we meet again!”

“মজার কবিতা না?”

ছেলে কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকালো..“সিরি’র সংগে কি আমার আবার দেখা হতে পারে? ওর বাবা বলেছে সে আর কানাডা আসবে না।”

“তোমার পুরো জীবনই সামনে পড়ে আছে। কত্তো কিছু হতে পারে। তোমার ইন্ডিয়া যাওয়া হতে পারে। ওরাও আবার কানাডা চলে আসতে পারে। কিংবা ধরো…তুমি ইন্ডিয়া গেলে না। সিরিও কানাডা এলো না। তোমরা দুজন একই সময় অন্য কোন দেশে গেলে…রাস্তা দিয়ে হাঁটছো..হঠাৎ দেখা হয়ে গেল….হতে পারে না? সেটা আরো এক্‌সাইটিং হবে না?”

ছেলে খুব মজা পেল।

“ঠিক..ঠিক সেরকম হতেই পারে। হবে কিনা…সেটা জানার কি কোন উপায় আছে?”

“ঠিক সেভাবে নেই। তবে Circle of Life বলে একটা কথা আছে জানোতো? জীবনে অনেক কিছু ঘুরে ঘুরে আসে। এই নামে বিখ্যাত একটা গান আছে আমার খুব প্রিয় মুভি The Lion King ছবিতে…..

“It’s the Circle of Life
And it moves us all
Through despair and hope
Through faith and love”

বেশি কঠিন কিছু বললাম নাতো? ভাবছি কিভাবে ব্যাখ্যা করবো।

দি লায়ন কিং চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি : অনলাইন

কিন্তু ছেলে কি বুঝলো সেই জানে। হঠাৎ সে খুশীতে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। “আব্বা…. The Lion King আবার আসছে!!! এবার এটা Live action movie!! ট্রেলার রিলিজ হয়ে গেছে। best animation I’ve ever seen….। এই জুলাইয়ে আসছে। আমরা দুইজন এক সাথে এই মুভি দেখবো। প্লি­জ..প্লি­জ…।”

ছেলের এই চেনা হাসি মুখ দেখে আমার সকল বিষাদ এক নিমিষে দূর হয়ে গেল। অনেক অনেক দিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হলো।

আমি শক্ত হাতে তার হাত ধরে বললাম, “অবশ্যই দেখবো আব্বা। তোমার আম্মাসহ…আমরা পুরো ফ্যামিলী এক সাথে দেখবো।”

কথাগুলো বলেই মনে হলো এই সামান্য কথাটাও কি নিশ্চিৎ সত্য কথা? নাকি শুধুমাত্র আশাবাদের কথা?

ধুর…ভাবলে অন্য কেউ ভাবুক। আমাদের দায় নেয়ার দরকার নেই। আমরা সাধারণ মানুষেরা….এই ছোট ছোট আশা নিয়েই না হয় বেঁচে থাকি।

“From the day we arrive on the planet
And, blinking, step into the sun
There’s more to be seen
Than can ever be seen
More to do than can ever be done”

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

টরন্টো