কানাডায় এশীয় বাবা-মায়েরা কেন মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা বুঝতে চান না

এটা কীভাবে পাল্টানো যাবে

নভেম্বর ৪, ২০১৮

এসাবেলে খু

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় নিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা বেশিরভাগ মানুষের জন্যই খুব শক্ত, কিন্তু বিশেষ করে এশীয় কমিউনিটিতে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবটা খুবই প্রকট কারণ তারা এই সমস্যাটিকে প্রায়শ ভুল বোঝেন।

টরন্টোর সাইকোথেরাপিস্ট জেনি এস চেং-এর মতে, এশীয়দের পরিবারে মানসিক সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলেন না, এর কারণ হলো, এ নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হবে তারা জানেন না।

হাফপোস্ট কানাডাকে চেং বলেন, “আগের প্রজন্মের লোকেরা এবিষয়ে কথা বলার ভাষাই জানতো না। আমরা সবাই নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ে কীভাবে কথা বলতে হবে সেটা শিখি আমাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া এবং সামাজিক পারিপার্শ্ব থেকে। বহু কাল ধরে অভিবাসী বাবা-মার সামনে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কীভাবে কথা বলতে হবে তার কোনও বাস্তব দৃষ্টান্ত ছিলো না।”

চেং আরও বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য কী সে সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের অভাব ছিলো এবং অভিবাসী বাবা-মায়েদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের “সবচেয়ে চরম লক্ষণ”কেই শুধু সমস্যা বলে মনে করার প্রবণতা রয়েছে। মানসিক রোগের যে নানা প্রকরণ রয়েছে তা তারা মানেন না বরং এটিকে “খুবই সাধারণ” বিষয় বলে মনে করেন। সেই সঙ্গে এশীয়দের সমাজে মানসিক সমস্যাকে অগ্রাধিকারমূলক বিষয় হিসাবে দেখা হয় না।

এশীয়দের পরিবারে মানসিক সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলেন না। : ছবি : গেটি ইমেজ

চেং ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “বহু মানুষ কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসে উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু এখানে আসার পর তারা মুখোমুখি হয় টিকে থাকার লড়াইয়ের। কর্মসংস্থান, চাকরি, স্কুল… ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য বিষয় যা তাদের সময়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান। আর আমার মনে হয়, সেটা সাধারণভাবে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, শুধু এশীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নয়।”

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মনোবিদ্যার প্রফেসর ড. হিরাম মকও চেংয়ের মতের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন। গত মার্চে সিবিসির এক অনুষ্ঠানে মক উল্লেখ করেন যে, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ যেমন বৈরাগ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিদ্যমান বদনামের শঙ্কা এশীয় পরিবারগুলোকে এ বিষয়ে আলোচনায় বিরত রাখে।

আলাপ-আলোচনা শুরু করা খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়

আপনি যদি বাবা-মা অথবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় নিয়ে কখনই আলোচনা না করেন তাহলে এ নিয়ে কাজ শুরু করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। তবে চেং বলেন, আপনি যদি ছোটখাট দিক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন এবং বিষয়টি সরলভাবে উপস্থাপন করেন তাহলে আপনার পরিবারের সদস্যদেরকে এ বিষয়ে খোলামেলা হতে উৎসাহিত করতে পারেন। চেং বলেন, “বিশেষ করে আপনি যদি এ বিষয়ে বাবা-মার সঙ্গে কখনই আলোচনা করে না থাকেন বা তারা যদি এ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ না করেন তাহলে খুব ধীরস্থিরভাবে আলোচনা শুরু করুন।”

চেং পরামর্শ দেন, খুব স্বাভাবিকভাবে আলোচনা শুরু করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো কোনও একটি ঘটনার খবর নিয়ে তাদের সঙ্গে মতামত শেয়ার করা। উদাহরণ হিসাবে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার কেট স্পেড এবং সেলিব্রিটি শেফ অ্যান্থনি বোর্ডেইন-এর আত্মহত্যার মত সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তারা একজনের আত্মহত্যার তিনদিনের মাথায় আরেকজন আত্মহত্যা করেন।

কোনও সেলিব্রিটির মৃত্যুর ঘটনা বা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সরকারের কোনও উদ্যোগ কিংবা কোনও এশীয় দেশে সংঘটিত এ ধরণের ঘটনার শিরোনাম তাদের সামনে তুলে ধরুন এবং জিজ্ঞাসা করুন যে, “তারা এ বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখছেন” বা “এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা কি”?

তবে আলোচনাটা কেবল খবরের ঘটনার মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পপ কালচারে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে “১৩ রিজন্স হোয়াই” এবং “টু দ্য বোন”-এর মতো টিভি শো ও চলচ্চিত্রকে ধন্যবাদ যেখানে আত্মহত্যা থেকে শুরু করে বিষণœতা ও খাদ্যাভ্যাসে বিশৃংক্ষলার মত সমস্ত বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে।

চেং বলেন, আলোচনা শুরুর জন্য এ ধরণের বিষয়বস্তু ব্যবহার করলে সেটা আপনার পরিবারকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আলোচনায় সহজ হতে সহায়ক হবে।

আপনার বাবা-মাকে কিভাবে বলবেন যে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে

আপনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এবং এক্ষেত্রে তাদের সাহায্য দরকার এই কথাটি এশীয় কোনও বাবা-মাকে বলার চেষ্টা করা বেশ আবেগগত বিষয় হয়ে উঠতে পারে। গত বছর রেড্ডিট-এর এক সূত্রে প্রকাশ পায় যে, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বাবা-মায়ের জানাশোনা এবং বোধের অভাবের কারণে ওই ধরণের পরিস্থিতিতে কীভাবে অনেক তরুণ শিশু হতাশা ও মর্মাহত হবার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।

ভিয়েতনামী-চীনা বংশোদ্ভূত একজন ব্যবহারকারী লিখেন, “এশীয় সংস্কৃতি তাদের মনে কঠোর পরিশ্রমের ধারণা বদ্ধমূল করে দেয় এবং এর ফলে তুমি যদি কোনও কিছুতে ব্যর্থ হও তাহলে বাবা-মা ধরে নেন যে, তুমি যথেষ্ট চেষ্টা করোনি।”

আরেকজন যোগ করেন: “আমার মনে হয়, এশীয় বাবা-মায়েরা এ বিষয়ে অনেক পিছিয়ে আছেন… আর এর ফলে কঠোর পরিশ্রম এশীয় মূল্যবোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও নিছক ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার’ চেষ্টা করতে গিয়েই এমন একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সৃষ্টি হচ্ছে যারা মানসিক বৈকল্যের শিকার।”

চেং ব্যাখ্যা দেন যে, আপনার বাবা-মার যদি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে যথেষ্ট জানাশোনা না থাকে আর আপনি যদি তাদের বলেন যে, আপনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাহলে তারা বিষয়টি হেলায় পাশ কাটিয়ে যাবেন এবং কী করতে হবে তার দিশা খুঁজে পাবেন না। সেজন্যে চেং তরুণদেরকে জোর দিয়ে বলেন, বাবা-মাকে জানানোর আগে তাদেরকে এ বিষয়ে জ্ঞান দিন।

সাইকোথেরাপিস্ট চেংয়ের পরামর্শ, “আপনার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে আগে নিজে জানুন এবং তারপর খুঁজে দেখুন কি ধরণের সহায়তা আপনি পেতে পারেন। তারপর আপনার বাবা-মার কাছে গিয়ে বলুন, দেখুন আমি কি ধরণের সমস্যায় ভুগছি। আপনি যদি সাহায্য চেয়ে যথাযথভাবে তথ্য দিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন এবং আপনার কী ধরণের সাহায্য দরকার তা বুঝিয়ে বলতে পারেন তাহলে আমার মনে হয় এটা সহায়ক হবে।”

চেং আরও বলেন, “এমন কিছু সময় থাকতে পারে যখন বাবা-মা যে কোনও কারণেই হোক সাহায্য করতে পারছেন না। কিন্তু অন্তত তারা অবহিত থাকছেন আর এটাই হবে পরবর্তী পদক্ষেপের শুরু যখন আমি এ বিষয়ে আরও বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করবো। আমি জানি কীভাবে আপনার কাজে আসতে পারি।”

আপনার বাবা-মা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন এটা বুঝতে পারলে কী করবেন?

কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য সমিতির তথ্য অনুযায়ী, নির্দিষ্ট যে কোনও বছরে প্রতি পাঁচজন কানাডীয়র মধ্যে একজন মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভোগেন। আর মানসিক রোগ একেকজনের ওপর একেক রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অবশ্য প্রত্যেকের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট নয় যেমনটা প্রমাণিত হয়েছে আগে উল্লেখিত সেলিব্রিটিদের আত্মহননের ঘটনায়।

চেং বলেন, আর সেকারণেই একজন মানুষ কীভাবে জীবনের বড় পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়Ñ ইতিবাচক নাকি নেতিবাচকভাবেÑ সেটা লক্ষ্য করাই হলো অন্যের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকার একটি উপায়।

তিনি জানান, “বড় ধরণের পরিবর্তন কারও জীবন বিপর্যস্ত করতে পারে। আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে, তারা আগে যেটা পছন্দ করতেন সেই কাজটা আর করছেন না বা এমন কিছু বিষয় ছিলো যা তারা স্বাভাবিকভাবেই সামলে নিতে পারতেন কিন্তু এখন আর পারছেন না, তাহলে এগুলোই হলো সেই লক্ষণ যার ওপর নজর রাখতে হবে।”

কিন্তু আপনি যদি জানতে পারেন যে, আপনার পরিবারের কোনও সদস্যের মানসিক সমস্যা আছে তাহলে আপনি তাকে সাহায্য করার জন্য চাপাচাপি করতে পারেন না যদি তিনি সাহায্য নিতে আগ্রহী না হন।

আপনি যা করতে পারেন তা হলো তাদেরকে জানিয়ে দিতে পারেন যে, তারা যখনই আলোচনা করতে চাইবেন তখনই আপনি তাদের পাশে আছেন। চেং বলেন, সেজন্যেই “এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা এত গুরুত্বপূর্ণ যেখানে সাহায্য চাওয়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করা হবে, স্বাগত জানানো হবে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হবে।”

তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, অনেক সময়েই মানুষ সাহায্য চাইতে ভয় পায়, তারা মনে করে, অন্যরা তাদের দুর্বল ভাববে এবং মনে করবে যে তারা কোনওকিছু সামলে নিতে পারে না। তাই আমার মনে হয়, কেউ যদি কারও সেবাযতœ করতে আগ্রহী হয় তাহলে তিনি কেবল এইটুকু বলতে পারেন যে, ভাই, আমি লক্ষ্য করেছি আপনার জীবনে সহসাই বড় একটা পরিবর্তন ঘটেছে, আপনি আগে শখ করে যেটা করতেন সেটা এখন আর করছেন না। এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাইলে আমি আপনার পাশে আছি।”

বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যাপারে মাঝেমধ্যে বিষয়গুলি খতিয়ে দেখলে তা সেই সদস্যের জন্য সহজতর হয় যিনি অন্যদের সাহায্য করতে চান যখন তারা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকবে এবং এ বিষয়ে তারাও অবগত।

পরিবারগুলোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলোচনা করা জরুরী

মানসিক রোগ আপনার জীবনের সব দিককে প্রভাবিত করতে পারে সেজন্যেই এ বিষয়ে কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চেং ব্যাখ্যা করে বলেন, “এটা আমাদের জীবন যাপন, জীবন উপভোগ এবং অন্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার সক্ষমতার ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরিবারে যখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হয়… তখন আমরা এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করি যখন সদস্যরা জানবেন যে, প্রয়োজনে সাহায্য পাওয়া যাবে এবং যেখানে এটা বলা যথার্থ যে, ‘আমি সবকিছু টিকঠাক করতে পারছি না।’”

কানাডায় মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এমন প্রচুর উদ্যোগ রয়েছে যা এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভুল ধারণা ভেঙ্গে ফেলার লক্ষ্যে কাজ করে, যেমন, ‘বেল লেট’স টক’ বা ‘এলিফ্যান্ট ইন দি রুম’ আন্দোলন। আর তাই চেং বিশ্বাস করেন পারিবারিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আলোচনা শুরু করা হলে তা অবশ্যই জোরালো হবে।

তিনি বলেন, “পরিবারে যখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা হয় তখন একটি নতুন সংস্কৃতির সূচনা হয় যা সেখানে আগে ছিলো না। এটা হলো নিজেরাই নিজেদের পরিচর্যার দায়িত্ব গ্রহণের নতুন এক পথ।”

চেংয়ের মতে এটা হবে একটা শক্তিশালী গ্র“প যারা ছড়িয়ে পড়বে এবং পরিবারের বাইরে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সবাইকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আমরাই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করছি এটা নিশ্চিত করার জন্য যে সামাজিক পরিবর্তন দরকার তার সূচনা করতে এটি প্রায় একটি ঘাঁটির মত কাজ করবে।” – হাফিংটন পোস্ট