“বৃষ্টি তোমাকে দিলাম” ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা-

নভেম্বর ১৪, ২০১৬

ফারহানা পল্লব

কিছু কথা আছে সময়মত না লিখে ফেললে তার ভাবটা হারাতে বসে। তেমনি একটি অভিজ্ঞতা “বৃষ্টি তোমাকে দিলাম” এর আয়োজন আর শ্রীকান্ত আচার্য কে জানা। আমাদের শহরে যেভাবে হেমন্ত সকল পাতা ঝড়িয়ে শীতের আগমনী জানাচ্ছে- ভাবলাম এখুনি লিখে ফেলি নইলে ভাবনা গুলো হারিয়ে যাবে।
গত জানুয়ারী মাসের এক মিটিং-এ অনুরোধ জানালাম এবার শ্রীকান্ত আচার্য কে নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করলে কেমন হয়? সকলেই সম্মতি জানালেন।
সেই থেকে যোগাযোগ শুরু, দুরুদুরু বুকে এতবড় আয়োজনে নেমে পড়লাম। শুধু তো ফান্ড সংগ্রহ না, হাজার কাজের ভিড়ে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম। এক পর্যায়ে দেখি রান্না বাজার, ঘর সংসার সব ভুলে বসে আছি।
আমরা ভীষণ ব্যস্ততায় দিন গুণছি কবে সেই সময় আসবে-তারপর যখন সময় ঘণিয়ে এলো, তখন অনেক গুঞ্জন উঠলো, কেউ বলে শ্রীকান্ত আচার্য আসবেন না, কেউ বলে তাঁকে কে চেনে? এত টাকা টিকেট কেটে কেউ আসবে না । আবার শুনলাম কোন মন্দিরে তাঁকে আমন্ত্রণ জানা্নাে হয়েছে, তিনি দুর্গা পূজায় বিনে টিকেটে গাইবেন- এতে করে আমাদের স্পন্সররা আমাকে সতর্ক করলেন যেন এইরকমটি না হয়। মা আর আমার জীবন সংগী আরিফ আমাকে অভয় দিয়ে বল্লেন- কিছু হবে না আল্লাহ ভরসা। আমাদের ওবিসিএস এর সকল কে নিয়ে বিপুলভাবে প্রচারণা শুরু করলাম। পূজার সময় প্রতিদিন সব মন্দিরে যাই-ঘোষণা দেই আর লোকদের নিমন্ত্রণ করি।

তারপর আলো ভাবিকে নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিকেট বিক্রি শুরু করলাম, কখনো রিচমন্ডহিল, কখনো মারখাম, কখনো মিসিসাগা। আর ফোন করা, ফেস বুকে নোটিফাই, পোস্টার শেয়ার এগুলো নিয়ে মহা ব্যস্ত, শিল্পীরা আমেরিকাতে চলে এসছেন খেয়ালই করিনি। একদিন শ্রীকান্ত আচার্য টেক্সট করে বললেন কথা বলা দরকার, তখন আমার যেনো কাজের নেশা ভাঙলো-নির্ধারিত দিনটিতে, শিল্পীরা সকলে পৌঁছে গেলেন।
বিমান বন্দর পৌঁছে ১০ মিনিটের মধ্যেই তাঁরা বেরিয়ে এলেন নির্ধারিত দরজা দিয়ে-আমারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম সেই দেবদ্যুতের আগমন পথে, অনেক প্রতীক্ষা আর তার প্রাপ্তিক্ষণটি বুঝি এমনি ঘড়ির কাঁটা থামিয়ে দেয়, আমরা স্তব্ধ, আমরা বিহবল, হঠাৎ যেনো ভুলে গেলাম এখন কি করনিয়- ফুল দিয়ে তাঁদের বরণ করে আনলাম। ছবি তুলার কিছুটা হিরিক পরলেও তা সামলে নেয়া গেলো। গাড়িতে বউদি আর দাদা কে তুলে আলো ভাবির লেক্সাস উড়িয়ে নিয়ে চললাম।
শুরু হল ট্রাফিক- দাদা বউদির সাথে টুকটাক কথার ফাঁকে জেনে নিলাম তাদের কিছু অভিজ্ঞতা। তাঁরা এই দেড় দু’ঘন্টার ট্রাফিক জ্যামে অস্থির হয়ে উঠলেও আমার আর আলো ভাবির মনে মহা আনন্দ- আমরা মনে মনে গুন গুন করি “ এই পথ যদি না শেষ হয়……”

এর পর পুরো টরন্টো সফররত সময়টায় যে যখনই শ্রীকান্ত আচার্য কে নিয়ে গাড়ি চালিয়েছেন সকলের মনেই এই গান গুঞ্জন তুলেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই- শুধু রফিক ভাই ছাড়া।
শ্রীকান্ত আচার্য কে সামনে থেকে শুনবো এই স্বপ্নে বিভোর যখন- অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যস্ততায় খেয়ালই করিনি যে সেই ঘোর লেগেছে সারা শহরে- কেউ শাড়ী কিনছে, বান্ধবীদের ফোনালাপের বিষয়- কে কি পরবে, কোন গান অনুরোধ করবে, কেমন লাগবে এইসব।
মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রদর্শন আর সঙ্গীতপ্রিয় দর্শকের উপস্থিতি, এই ছিল অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। আশাতীত দর্শকের উপস্থিতিতে এক পর্যায়ে টিকেট বিক্রয় বন্ধ করতে হয়। আবার কিছু দর্শক বসার জায়গা পাবেন না বলে তাঁদের টিকেটের টাকা ফেরত দিয়ে দেয়া হয়- এইটি ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা।
আরেকটি বিষয় আমাকে অভিভূত করেছে, “বসার জায়গা নে পেলেও -আমরা সিঁড়িতে বসে, দাঁড়িয়ে শুনবো”। এই ছিল দর্শকশ্রোতাদের আবদার। শ্রীকান্ত আচার্য আমাদের খুব পছন্দের শিল্পী এটুকুই শুধু ধারণা ছিল আমার- এবার তিনি এসে খুব শান্তভাবে যে ঝড় তুলে গেলেন, সে ঝড়ে আজো আমরা মূহ্যমাণ। ভাষা হারিয়ে আমি অভিভূত। প্রায় এক মাস লেগে গেল আবার প্রাত্যহিক জীবনে ফিরে আসতে। কাজের দৌড়াদৌড়ি আর ঝামেলায়, পুরো অনুষ্ঠান ঠিকমত দেখা হয়নি আমার। অভিযোগ নেই সে বিষয়ে- দুটা গান শুনেছি- আর সাথে গলা মিলিয়েছি। আর আমার অনুরোধের সেই গানটা- “দেখো জোছনা ভেজা এই রাত ……… আর একটু ভাবতে দাও তুমি যে আমার”

অনেক ভাবছি- এই যে অনুভূতি শিল্পীকে নিয়ে তাঁর সঙ্গীত নিয়ে, সেটা কি সঠিক? আমার সব সংশয় ফুতকারে উড়িয়ে দেয় আরিফ- একই অনুভূতিতে সে যখন গলা মিলায় এই জাদুকর শিল্পীর গানে। সহজাত ধারণা ছিল- নারী দর্শকই বেশী হবে- আমাদের ধারণাকে অমুলক প্রমাণ করে সমানে সমানে ছিল নারী- পুরুষের ভিড়। শ্রীকান্ত আচার্য যেন সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হয়ে আমাদের সকলের মন মাতিয়ে গেলেন। এখন ফিরে ফিরে দেখি- সেদিন, ছিল কোজাগোরী চাঁদের রাত, নারী ছিল পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে, নারীর পুরুষটি একটু বেশি ঝুঁকে ছিল প্রিয় নারীর দিকে- দুজনায় তাদের প্রিয় গানগুলোয় গলা মিলিয়ে গেয়েছে। গানের ফাঁকে ফাঁকে কথাগুলো যেন কবিতা- কিভাবে শিল্পী তাঁর সুর আর কথার মায়াজালে আমাদের জড়িয়ে ফেললেন; বুঝতেই পারিনি। শিল্পীর মন ভরেনা গান গেয়ে আর আমাদের মন ভরে না গান শুনে- এই গাওয়া আর শোনার যেন আর শেষ নেই। আমি দেখি সন্ধ্যাকাশের বিস্তীর্ণ দিগন্তের মত অসীমের দিকে চলেছি – শিল্পী আর আমরা শ্রোতা। শিল্পীর যন্ত্রীদল ছিল নিজ নিজ যন্ত্রে দক্ষ, তাঁরা সম্মোহিতের মত অনুসরণ করে চলেছেন সুরের গুরুকে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে অভিভূত- এই নামকরা, এতো বড় মাপের শিল্পীর বিনয় দেখে। আমি শিখছি প্রতিটি মুহূর্তে। আমি দেখি তাঁর শিশুসুলভ সরলতায় হাসির গল্প করা, আবার নিজের কাজগুলোয় কাউকে বিরক্ত না করে নিজের হাতে করে নেয়া। যন্ত্র বাজিয়েদের সাথে শিল্পীর সম্পর্কটা যেন ঠিক দাদা বা পিতৃসুলভ- কখনো বলছেন এই টুপিটা পড়ে নে, কখনো নিষেধ করছেন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকিস না; ঠান্ডা লেগে যাবে। পাশে রয়েছেন বরাবর বউদি, সে ও এক দারুণ মনের মানুষ, খুব অল্প বলে মনের ভিতরে উঁকি দিয়ে যাবার ভীষণ ক্ষমতা রাখেন তিনি- অর্না সীল। ঠান্ডা মাথায় সকলের তদারকি করে চলেছেন তিনি। ভক্তরা যতই ফটো তুলুক, আমরা সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছি, কিন্তু তাঁদের হাসিমাখা মুখে একটিবারও না শুনিনি, আমরা বলাতে উত্তর দিলেন, থাক না ওরা ভালবেসে এরকম করে। সকল লোভ লালসা আর চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে গেলেই বুঝি এভাবে সঙ্গীতকে পাওয়া যায়।
টরন্টোবাসীর মতে তার অবয়ব, গঠন আর উচ্চতা ছিল তাদের আশার চাইতে অনেক বেশী। বিভিন্ন সিডি কভারে তার যেসব ছবি দেখা যায় তার চাইতে বহুগুণ সুদর্শন এই শিল্পী। তাঁর এই বাহ্যিক সুশ্রী যেন পরিপূর্ণতা পায় অন্তর্গত দেবশিশুর মত নিষ্পাপ মানসিকতায়। ভীষণ গুরুগম্ভির কন্ঠস্বর আর এই অবয়ব খুব কাছে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলেন, যে কারোর বুকের মাঝে দুরু দুরু করে উঠবে – কিন্তু একটু দূরে গিয়ে যখন তাঁর সরলতা মাখানো দৃষ্টি দেখা যায়, ভীষণ আপন মনে হয়।
একজন মানুষ এতোটা বিশেষ হয়েও কি করে সাধারণের এতোটা কাছে আসতে পারেন সেটাই ভাবছি। উনি সত্যি সেই খোলা জানালা- যেখানে শিল্প মানুষকে অতিমানব করে, এক সাধারণকে দেবতুল্য করে।

ফারহানা পল্লব
টরণ্টো