প্রবাসে ইতিবাচক দিকে আলোকপাত জরুরী
নবাগত অভিবাসীরা যখন নতুন দেশে বসতি স্থাপনের নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছেন তখন তাদের জন্য ইতিবাচক মানসিকতা থাকা খুবই জরুরী
আগস্ট ৫, ২০১৭
দিলনওয়াজ কামার
স্যাম গিল (গোপনীয়তার স্বার্থে নাম পাল্টে দেয়া হলো) ও তার স্বামী জন ও তাদের দুই সন্তান কানাডায় আসার ২৯তম দিনে আমার অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তারা তাদের নতুন দেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে বেশ চাপের মধ্যে ছিলেন। তারা নতুন শহরে নিজেদেরকে নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন এবং কোনওরকম সামাজিক সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করছিলেন। তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করার বিষয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন।
আমাদের প্রথম দফা সাক্ষাৎ ছিলো তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সম্পর্কে শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্বামী জন ছিলেন হতাশ, কারণ তারা কেন্দ্রীয় সরকারের দক্ষ কর্মীর শ্রেণীতে অভিবাসনের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং তারা ছিলেন নিজেদের কর্মক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তাদের প্রমাণপত্রগুলো এদেশে স্বীকৃত নয়। নিজ দশে জন একজন স্থাপত্যবিদ এবং তার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। এক পর্যায়ে এই দম্পতি নিজেদের দেশে ফিরে যাবার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে শুরু করেন।
একজন অভিবাসী হিসাবে এটুকু পড়ে আপনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন তারা কী অবস্থার মধ্য দিয়ে এসেছেন, কারণ কানাডায় এই একই ধরণের বহু কাহিনী রয়েছে। সেই প্রথম সাক্ষাতের সময় আমি বুঝতে পারি যে, তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা এর আগে আর কাউকে বলেননি, সুতরাং আমার সঙ্গে তাদের চ্যালেঞ্জগুলো ভাগ করে নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন একজন অভিবাসী হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা তাদের কাছে তুলে ধরি তখন তারা বুঝতে পারেন যে তারা নিঃসঙ্গ নন। তবে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে থেকে যাওয়ার চেয়ে আমার লক্ষ্য ছিলো আপাত নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ইতিবাচক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করা।
নিচে এমনই কিছু উপায় তুলে ধরছি যাতে নবাগত অভিবাসীরা নিজেদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে পারেন। এটি নতুন দেশে তাদের সাফল্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি নিঃসঙ্গ নন
অভিবাসন একটি কঠিন ও প্রবল মানসিক চাপের অভিজ্ঞতা। সুতরাং নানা ধরণের অভিঘাতের মোকাবিলা করতে হবে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু তাতে নিরুৎসাহিত হবেন না। আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে এসব অভিঘাতের মোকাবিলা করতে হচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়। আপনার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করুন, তাহলে আপনি জানতে পারবেন যে, নতুন দেশে নতুন করে জীবন শুরু করার সময় প্রত্যেক অভিবাসীকেই কঠিন সময় পেরুতে হয়েছে। এই মনোভাব দোদুল্যমান এবং হীনমন্যতাবোধ চিরদিন থাকবে না। অন্যথায় বেশিরভাগ অভিবাসী নিজ দেশে ফিরে যেতো। এটি হলো নিছক সময়ের ব্যাপার, সঠিক সংযোগ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়।
এটি হলো মানসিক প্রবণতার বিষয়
আমি প্রায়শ আমার গ্রহকদেরকে বলি যে, আপনি যদি একটি কালো রঙের চশমা পরেন তাহলে চারপাশের সবকিছুই কালো এবং তমসাচ্ছন্ন দেখা যাবে, কিন্তু যদি কালো চশমা পাল্টে স্বচ্ছ চশমা পরেন তাহলে সবকিছুই ঝকঝকে দেখাবে। এই উপলব্ধি অনেকের জীবনেই বাঁক ফেরানোর কাজ করেছে। আমরা যখন কোনও পরিস্থিতিকে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা করি তখন আমরা আশাবাদী ও উৎসাহিত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাই। মানসিক প্রবণতার পরিবর্তন আমাদের জীবন পাল্টে দেয়। একটি পাত্রকে আপনি অর্ধেক পূর্ণ বা অর্ধেক খালি দেখাটা আপনার ওপরেই নির্ভর করে।
ঘ্যানঘ্যান করা ছাড়–ন
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন: “সব সময় অভিযোগ করতে থাকা আমরা যে সাচ্ছন্দ্য উপভোগ করি তার সবকিছুর প্রতি সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রতিদান।” আমি জানি, নতুন অভিবাসীদের জীবন সহজ নয় এবং অনেক সময় মনে হতে পারে যে, তর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে, কিন্তু সারাক্ষণ অসন্তুষ্টির বোধ আমাদেরকে কোনও গন্তব্যে পৌঁছে দেবে না। আমরা প্রায়শ অভিযোগ করি কারণ কোনটি সঠিক এবং উত্তম তা খুঁজে বের করার চেয়ে অভিযোগ করা সহজ।
কানাডায় একমাস কাটানোর পর আমার স্বামী বলেন যে, তার কাছে মনে হচ্ছে জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে এবং কোনও কিছুই ঠিকমত চলছে না। আমি তাকে আমাদের কানাডায় পৌঁছার দিনটি স্মরণ করতে বললাম। আমরা যেদিন কানাডায় ল্যান্ড করি সেদিন আমরা কিছুই চিনতাম না এবং সবকিছুর জন্যই অন্যদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। একমাস পর আমরা অন্তত এটুকু জানি যে কীভাবে নিজেরাই মুদি দোকানে, গীর্জায় বা লাইব্রেরিতে যেতে পারি। এই ক্ষুদ্র সাফল্যটুকুও উদযাপন করা যেতে পারে। আর প্রতি মাসেই আপনি আরও বেশি অর্জন করতে পারবেন।
সুখ আমাদের নিজেদের ভেতরেই থাকে
সন্তুষ্টি বা সুখের অবস্থান আমাদের হৃদয়ে। একজন রাজাকে নিয়ে একটি পুরনো উপকথা আছে। রাজা সবসময়ই অসুখি ও বিষন্ন থাকতেন। নিজের বিষন্নতায় বিরক্ত হয়ে তিনি পরামর্শ দেয়ার জন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের ডাকলেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাকে একজন সুখি মানুষের জামা গায়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন, এতে করে তিনি সুখি হবেন। রাজা তৎক্ষণাৎ তার লোকদের পাঠিয়ে দিলেন একজন সুখি মানুষকে খুঁজে নিয়ে আসার জন্য। এক বছর ধরে খুঁজে রাজার লোকেরা একজন সুখি মানুষের দেখা পেলেন। রাজা সুখি লোকটির জামা নিয়ে আসার জন্য তার লোকদের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন যে, লোকটির কোনও জামা নেই। সুতরাং আমাদের সুখ হলো বস্তুগত বিষয়নিরপেক্ষ, আমাদের যা আছে, আমাদের চারপাশে যারা আছে এবং আমাদের পরিবেশ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সত্যিকারের সুখ বা পরিতৃপ্তির উৎস হলো আমাদের নিজেদের হৃদয়।
কৃতজ্ঞতার মনোভাব গড়ে তুলুন
আমার আরেক গ্রাহক আছেন যিনি তার জীবনের একটি কঠিন সময় পার করছেন। তিনি একজন একক মা এবং তার দুটি শিশু সন্তান আছে যাদের জন্য বিশেষ যতেœর প্রয়োজন রয়েছে। শারীরিক ও মানসিক চাপে তিনি অসহায় হয়ে পড়ছেন এবং রাতের বেলা আকুল হয়ে ঈশ্বরের কাছে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করেন। আমি তাকে তার বিছানার পাশে একটি “জার্নাল অব গ্রাটিচুড” (কৃতজ্ঞতা বিষয়ক সাময়িকী) রাখার এবং রাতের প্রার্থনার পর ওই দিনের ঘটনাবলীর মধ্য থেকে এমন তিনটি জিনিস লিখে রাখার পরামর্শ দিই যা তাকে ধন্যবাদার্হ্য করে। পরামর্শ অনুযায়ী কাজ শুরু করার পর তিনি আমাকে জানান যে, তিনি আগের চেয়ে বেশি ইতিবাচক হয়ে উঠেছেন এবং এমন বোধ করছেন যে, তার জীবনে দায়িত্বের যে বোঝা চেপেছে তা অনেকটাই বহনযোগ্য কারণ এমন অনেক মানুষ আছেন যাদেরকে তার চেয়েও অনেক বড় বোঝা বয়ে চলতে হচ্ছে। একটি নতন দেশে পৌঁছার পর প্রাথমিক দিনগুলি খুবই চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আপনি যদি নিজের মধ্যে ধন্যবাদ দেয়া মানসিকতা এবং কৃতজ্ঞতার মনোভাব গড়ে তোলেন তাহলে আপন আপনি সেই বিষয়টিতেই বেশি মনোযোগ দেবেন যা আপনার কাছে এসেছে আশির্বাদ হিসাবেÑ আর সেটা হলো একটি নতুন দেশ, সুযোগ-সুবিধায় পূর্ণ একটি ভূখন্ড এবং অগ্রগতির একটি পথ। একজন ধর্মযাজক এবং ধর্ম বিষয়ক লেখক উইলিয়াম সেকের লিখেছেন, “কৃতজ্ঞতাবোধে পূর্ণ মন হলো একই সঙ্গে মহৎ এবং সুখি মন।
-সৈজন্যে : মিসিসাগা নিউজ
লেখক পরিচিতি: পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত দিলনওয়াজ কামার হলেন ব্রাম্পটন মাল্টিকালচারাল কমিউনিটি সেন্টারের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা।