টিউলিপ আর আমরা ক’জনা
মে ১৪, ২০১৭
ফারহানা পল্লব
বাংলাদেশে থাকতে চোখধাঁধানো টিউলিপ ফুল দেখতাম শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় যখন এপ্রিল আর মে মাস আসতো। আর দেখতাম মুভিতে- যেমনটা দেখেছি ‘দূরদেশ’ বা ‘সিলসিলা’য়। এই ফুলটা আমাদের দেশে ফোটে না, হয়তো জলবায়ুর কারণে। কানাডা এসে প্রথম একটা টিউলিপ দেখেছিলাম আমাদের বাড়ির সামনে- সে কি আনন্দ তখন আমার। তারপর সামার এলেই যখন নায়াগ্রা যেতাম তখন টিউলিপ দেখতে পেতাম। অনেকদিন ধরে টিউলিপ ফেস্টিভ্যালের নাম শুনেছি লোকমুখে, কিন্তু সেই একটি বিশেষ সপ্তাহে আমাদের যাওয়া হয়ে উঠেনি নানান ব্যস্ততার কারণে।
দুই বছর আগে কানাডার বসন্ত মৌসুমে সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম অটোয়ার টিউলিপ উৎসবে যাব। ঠিক হলো, সবাই মিলে একটা বাস ভাড়া করে অটোয়া যাবো, যেমন করে দেশে পিকনিকে যেতাম দল বেধে। টিউলিপ উৎসবে যাওয়া পাকাপাকি হবার পর আনন্দ আর উত্তেজনায় সবাই আত্মহারা।
দেশের পিকনিকেগুলো হত শালনা, জয়দেবপুর বা মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। মা আয়োজন করতেন, হয়তো পাড়ার সবাই বা স্কুল কলিগদের পরিবার নিয়ে। একবার খোলা ট্রাক এ চড়ে পিকনিক গিয়েছিলাম, ট্রাক এর পিছনে স্কুল বেঞ্চ বসানো হয়েছিলো, ফেরার সময় অনেক ঠান্ডা লেগেছিল। আরেকবার শালনা গিয়ে ভাইয়া পুকুড়ে নামতেই আমিও মহা আনন্দে পুকুড়ে নেমে পড়লাম। তখন মাথায় আসেনি যে আমি সাঁতার জানিনা। আমার বয়স তখন ৫ কি ৬ হবে। আমার ছোট কাকা সেই শালনার বেত দিয়ে পিটিয়ে আমাকে পানি থেকে তুলেছিলেন, সেই অপমান কি ভুলা যায়? ভাইয়ার নাগাল তিনি পান নি, কারণ ভাইয়া সাতার কেটে ততক্ষণে অনেক দূরে পালিয়ে গিয়েছিল।
আরেকবার যখন চিরিয়াখানার পাশে বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম সবাই, মন তো পড়ে রইলো চিড়িয়াখানায়। কিন্তু সেই বাগানের বিচিত্র সব গাছগাছালি আর গোলাপের বাগান আমার মনে গেথে গেলো চিরকালের মত। গতবছর ভ্যাঙ্কুভার গিয়ে স্থানীয় এক গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের সেই দেশী গোলাপ বাগানের সাথে তুলনাই হয় না। মিরপুরের বোট্যানিকেল গার্ডেনের সেই গোলাপ বাগানের তত্বাবধানে ছিলেন আমাদের সাত্তার খালু, নিলু আপার আব্বা। আমাদের সেই নিলু আপা আর দুলাভাই এখন ড্যানফোর্থে থাকেন তাদের তিন ছেলে সাগর, আকাশ আর হৃদয়কে নিয়ে। সাত্তার খালুর তত্বাবধানে গড়ে উঠা বাগানে দেখেছি কত রঙের আর কত প্রজাতির গোলাপ ফুল। পেশার পাশাপাশি ফুল ফোটানো যেনো খালুর নেশাও ছিল। আমি তখন বেশ ছোট, তাই হেটে হেটে হয়রান হয়ে বসে পড়েছিলাম, মনে হয় পুরো বাগান টা দেখা শেষ হয়নি আমার। উনারা দেশ বিদেশ থেকে গাছ গাছালি এনে, পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। তাদের সেই গবেষনার ফল ছিলো অসাধারণ। জানিনা আজো সেইভাবে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ হয় কিনা, তবে যারা দেশ বিদেশের বাগান দেখতে যান আর যারা প্রবাসে থাকেন তাদেরকে বলবো একবার বলদা গার্ডেন আর বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুড়ে আসবেন, বাংলাদেশের এই বাগান দুটি অনেক আকর্ষণীয়।
যাই হোক, আমাদের অটোয়া যাওয়ার দিনক্ষণ এসে হাজির। কথা ছিল সবাই বাঙ্গালী পাড়ার ক্রিসেন্ট টাউনে সমবেত হব সকাল বেলায়। হলামও তাই। কিন্তু তখনো বাস আসেনি। ওদিকে ক্যাটারিং এর খাবার তৈরী হলো কি না খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি সেটাও রেডি হয়নি। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। খাবার নিয়ে ক্রিসেন্ট টাউনে ফিরে এসে দেখি বাস হাজির। কিন্তু অপেক্ষমান যাত্রীদের কেউ কেউ কিছুটা ক্ষিপ্ত দেরী দেখে। বাকীরা ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি পৌছানোর পর ক্ষিপ্ত জনগণ ঠান্ডা হলেন। বিনিত ক্ষমা প্রার্থনা করে আমরা দেশি নাস্তা পর্ব দিয়ে বাসের ভ্রমণ শুরু করলাম। বাস চলা মাত্র আনন্দ আর ধরে না। সকলে পরোটা ভাজি, ডিম আর কলা খেয়ে আহ্লাদিত, আমি বিশেষ করে, কারণ সকাল থেকে কফি ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি। শুরু হল ফটো তোলা- শাহাদাত পলাশ ভাইয়ের দারুন স্থিরচিত্র আর এক বিশেষ ভিডিও ধারণ। নাদিম ইকবাল ভাইয়ের সেই ভিডিও চিত্র পরবর্তিতে দেখলাম কলা বিষয়ক, এবং তুমুল হাস্যরসে ভরা।
অটোয়ার পথে গান গেয়ে আর কৌতুক করে চলতে থাকলো আমাদের আনন্দ যাত্রা। মাঝে যাত্রা বিরতি। বিশ্রামাগারে সবাই ওয়াসরুম সেরে নিল। বাসে উঠে দ্বিতীয় পর্বের কফি পরিবেশন। সাথে চিপস আর হাল্কা নাস্তা। সিদ্ধান্ত হল একেবারে অটোয়া গিয়ে সবাই মধ্যাহ্ন ভোজন সারবো। এর মাঝে মুনমুন ভাবী, উর্মি, মাফিয়া, শাওলী আমাদেরকে গানে গানে মাতিয়ে রাখলো। আর আবীর তো নেচে গেয়ে একাকার, নিজেও আনন্দ পেল সকলকে আনন্দ দিয়ে গেলো। মাহিনা, পরমা তাদের মত সেলফি করে গেলো। বাচ্চাগুলো যার যার মত গল্প আনন্দ করে কাটালো।
দেরি হয়ে যাবে বলে আমরা বাস আর কোথাও থামালাম না। সবারই কম বেশী আবার পেটে চাপ এলো। আমাদের কাজ হলো তাদেরকে ‘এইতো চলে এসছি’ বলে ভুলিয়ে রাখা। আলো ভাবির হাসির গল্পে আমরা ভালোই ভুলে রইলাম। আমরা সেদিন সবাই যেনো বয়স থেকে কিছুটা পেছনে ফিরে গিয়েছিলাম।
গন্তব্যে পৌঁছে প্রথমকাজ ওয়াশরুম খোঁজা- কিসের ওয়াসরুম-দেখি শুধুই মাঠের মধ্যে সারি সারি পোর্ট্যাবল টয়লেট- তাতেও অনেক লম্বা লাইন। জীবনের এই অভিজ্ঞতাও হয়ে গালো, অগত্যা সেই লাইন ধরে সেখানেই কাপর বদলানো, আর ফ্রেশ হতে হল।
এদিকে ক্ষুধায় সবার পেট চুই চুই করছে। আলো ভাবিকে দায়িত্ব দিয়ে আমি, বিরতি নিয়ে এলাম। রাস্তার পাশে বাসের আড়ালেই চাদর বিছিয়ে খেতে বসে পরবো ভেবেছিলাম, কিন্তু চাদর খুঁজে পেলাম না। তখন খালি ঘাসের উপরেই বিরিয়ানীর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বিরিয়ানী তখন অমৃতের মত লাগলো।
তারপর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম ফুলের বাহার দেখতে। সে যে কি অপরূপ নানা রঙের বাহার, সত্যি চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শাহাদাত পলাশ ভাই আর নাদিম ভাইয়ের ফটো তোলার ব্যাস্ততা বেড়ে গেলো। সেদিন আমরা সবাই মডেল, সবাই স্বামীর সাথে নায়িকা। আবার যারা পরিবার নিয়ে গেছে তাদের পরিবারের ছবি। সাথে চলতে থাকলো যার যার নিজের সেলোফোন দিয়ে সেলফি আর গ্রুপফির হিরিক।
জায়গাটা অনেক বিস্তৃত না, তবুও হাটতে হয় অনেকটা, রাস্তা বন্ধ করে পথের একধারে নদী আর আরেক ধার ছড়িয়ে সব টিউলিপ ফুল। এতো রঙের টিউলিপ আছে এখানে না গেলে হয়তো জানতাম না। মাঠের মাঝে চলছে গান বাজনার অনুষ্ঠান, গ্যালারীতে পেইন্টিং আর ফুল সাজানোর আয়োজন। একেকবার মন চাইছিলো ওদের সাথে নাচে যোগ দেই। আস্তে আস্তে আমরাও একটু ঝিমিয়ে এলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সবাই দেখি লেকের পাশে আসন নিচ্ছে। পরে জানলাম এই আয়োজন আতশবাজি দেখার। আমরাও সবাই ঘুড়ে ফিরে এক জায়গায় জড়ো হলাম। সেখানেও সন্ধ্যার ঘণ নীল আকাশের সাথে আরো ছবি তোলা হল মন ভরে। তারপর সুর্যাস্তের সাথে সাথে শুরু হল সেই ফায়ারওয়ার্কস।
সে আরেক যাদুর কাহিনী- কি যে একেক রঙের সেই একেক ঢঙ্গের আতশবাজি ফুটে চল্ল, আমরা উল্লাস আর চিৎকার করতে করতে হয়রান হলাম। পলক ফেলতে ভুলে গেছি, পাছে কিছু যাদু মিস করে ফেলি। কখনো আকাশ জুড়ে কদম ফুল ফুটে ছড়িয়ে পরে, আবার কখন নীলাম্বরী তারার মেলা এক কোনা থেকে ফুটতে থাকে আবার তা মিলিয়ে যাবার আগেই হয়তো বেগুনী রঙের ফুলঝুড়ি এক সারিতে ফুটতে শুরু করে। একটা আরেকটা থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন, আর একেক রকম তার সৌন্দর্য- পুরো বিষয়টা লেকের পানির উপরে ঘটছে। আর পানিতে ফায়ারওয়ার্কস এর প্রতিবিম্ব যেনো আরএক মোহময় অধ্যায় বিছিয়ে দিলো। ৩০ মনিটের এই যাদুখেলা আমাদের সম্মোহিত করে দিয়েছিলো, আমরা আনন্দের আধিক্যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফেরার বাসে উঠলাম।
এত আনন্দের পরেও আবার মনে হয় কি যেনো বাকী রয়ে গেলো। ফেরার পথ যেনো আর ফুরায় না, আমাদের বাসের চালক নিজেও ক্লান্ত, আর ঘুম চোখে অতি ধীরে আমাদের সেই রাত ৩টায় পৌঁছে দিলো ড্যানফোর্থে। মাঝে রাতের খাওয়ার বিরতি ছিল, কিন্তু আমাদের শখের খিচুরীতে পচাগন্ধ ছড়িয়ে পরায় খাওয়াটা মন মত হলনা। পুরো পথটা চালক কে গল্প করে জাগিয়ে রাখেন আমাদের খসরু ভাই আর আরিফ, । আর টিটু ভাইয়ের গানে আমরা সারাপথ হইচই করে ফিরেছি। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। কিন্তু তারপর সেই দলের যার সাথেই যেখানেই দেখা হয়েছে একই অনুরোধ শুনেছি, “আবার চলোনা এরকম একটা ভ্রমণে যাই”। সেই থেকে মনের কোণে আবার ইচ্ছা আরেকবার সময় নিয়ে একটু যেতে হবে। গতবারের ভ্রমণে আমরা সবাই যেনো আমাদের বসন্তে আরেকবার ফিরে গিয়েছিলাম, আরেকবার গেলে মন্দ হয় না।
ফারহানা পল্লব, টরন্টো