যৌন হয়রানী একটি গুরুতর অপরাধ

মে 5, 2019

শিক্ষকতার মতো সম্মান আর মর্যাদাপূর্ণ পেশার মুখোশ পরা এক যৌন নিপীড়ক বাংলাদেশের সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল ঐ মাদ্রাসারই এক শিক্ষার্থী নুসরাত। ঐ ঘটনায় গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তার নৃশংস হত্যাকান্ড নিয়ে বাংলাদেশে এখনো তোলপাড় চলছে। আর সেই তোলপাড় এর ঢেউ এসে লেগেছে কানাডায় আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ স্থানীয় বাংলাদেশী মিডিয়াগুলোতেও প্রবাসীরা যৌন হয়রানী ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। যৌন হয়রানীর বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে গত ১১ এপ্রিল ড্যানফোর্থে বাংলাদেশীদের উদ্যোগে একটি সেমিনারও আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে উপস্থিত ছিলেন টরন্টোর কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। ঐ সেমিনারে হল ভর্তি লোকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

আসলে যৌন নিপীড়ন বা যৌন হয়রানী পৃথিবীর কোন নির্দিষ্ট দেশ সমাজ বা গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কানাডার মত উন্নত এক দেশে যেখানে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি ও মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত উন্নত, সেখানেও এই জঘন্য অপরাধটি ঘটে আসছে। হয়তো পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছে না। কিন্তু যৌন নিপীড়ন বা যৌন হয়রানীর ঘটনা ঘটছে যেটা কোনভাবেই কাম্য নয়।

গত মাসে হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায়, অন্টারিও প্রভিন্সের কলেজ ও ইউনিভার্সিটির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই যৌন হয়রানির শিকার। সরকার পরিচালিত এক জরীপে এই তথ্য প্রকাশ পায়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় এই তথ্য “ডিস্টার্বিং”।

অন্টারিও’র বিগত লিবারেল সরকারের আমলে নেয়া এই জরীপ কার্যক্রমে অংশ নেয় ১ লক্ষ ১৬ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ৬৩% শিক্ষার্থী জানায় তারা বিভিন্ন ধরণের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। জরীপে অংশগ্রহনকারী কলেজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার। তাদের মধ্যে ৪৯.৬% শিক্ষার্থী জানায় তারাও বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, শুধু কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতেই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা তা নয়। গ্রেটার টরন্টো সহ অন্টারিও প্রভিন্সের অন্যান্য অঞ্চলের স্কুলগুলোতেও যৌন হয়রানির ঘটনা প্রায়ই ঘটে আসছে। ইতিপূর্বে টরন্টোর আইনজীবী জুলিয়ান ফেলকনার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ‘বিপজ্জনক হারে’ এই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে স্কুলগুলোতে। ঐ জরিপে অংশগ্রহণকারী টরন্টোর একটি স্কুলের ১৯% ছাত্রী বলেছে তারা বিগত দুই বছরে বিভিন্ন সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

অন্যদিকে সেন্টার ফর এডিকশন এ্যান্ড মেন্টাল হেলথ এর নতুন এক গবেষণায় বলা হয়, এখানকার হাই স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্রীই অশালীন যৌন মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গির শিকার হয়। আর এক তৃতীয়াংশ ছাত্রী শারীরিক স্পর্শ, জড়িয়ে ধরা বা চিমটি কাটার শিকার হয়।

সাধারণত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে পিছু নেয়া, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে গান, ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, পথরোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি কর্মকান্ড যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। এছাড়াও পর্নোগ্রাফী, যৌনতার ছবি, কার্টুন ইত্যাদি পোস্ট করা বা শেয়ার করা, যৌনতাপূর্ণ কৌতুক করা, যৌনতা বিষয়ক গুজব ছড়ানো, বারংবার ডেটিং এর জন্য প্রস্তাব বা চাপ দেয়া। অসম্মতি প্রকাশের পরও সেটিকে গুরুত্ব না দেয়া এ সবই যৌন হায়রানীর অন্তর্গত।

আমরা মনে করি, যৌন হয়রানী করার এই স্বভাব বা মানসিকতাকে পাল্টানোর জন্য শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তেমনি প্রয়োজন রয়েছে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা তৈরি করা, বিশেষ করে বাংলাদেশে। নারীর প্রতি সহিংসতা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নও জরুরি। আমরা চাই মানব সমাজের সার্বিক কল্যানেই নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় যৌন হয়রানী নামক এই ব্যাধি সকল সমাজ থেকে দূর হোক।