প্রায় ৫০% কানাডীয় মনে করেন বর্ণবাদী চিন্তা স্বাভাবিক

আগস্ট ১৮, ২০১৯

কানাডীয়দের প্রায় অর্ধেকই স্বীকার করেন যে, তাদের মধ্যে বর্ণবাদী চিন্তা-চেতনা আছে এবং আগের বছরগুলোর তুলনায় এখন তারা সেইসব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ইপসস-এর এক নতুন জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।

একান্তভাবে গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ এদেশে বর্ণবাদকে একটি গুরুতর সমস্যা বলে মনে করেন। অথচ ১৯৯২ সালে বর্ণবাদকে গুরুতর সমস্যা বলে মনে করতো ৬৯ শতাংশ মানুষ। অংশ গ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ নিজেকে বর্ণবাদী নন বলে দাবি করেছেন তবে অনেকেই বলেছেন যে, তারা বর্ণবাদী চিন্তা-ভাবনা লালন করেন কিন্তু সেগুলো তারা অন্য কারও সঙ্গে আলোচনা করেন না। (ইপসস-এর জরিপের সব ডেটা ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে)।

ইপসস-এর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট সিন সিম্পসন বলেন, “আমরা দেখেছি যে, (প্রায়) ৫০ শতাংশ মানুষ বর্ণবাদী চিন্তা-ভাবনা থাকার বিষয়টিকে যথার্থ এবং প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক বলে মানেন।”

সিম্পসন বলেন, ১৯৯২-এর পর কানাডীয়রা বর্ণবাদ বিষয়ে আলোচনা করতে অধিকতর খোলামেলা হয়েছেন। তার ভাষায়, এর কারণ সম্ভবত এই যে, “কানাডায় আমাদের আরও গুরুতর বিভিন্ন সমস্যা আছে।”

টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত একটি মসজিদের সামনে ইসলাম বিদ্বেষীদের সমাবেশ। ছবি : সিবিসি

এর পরও, এই সমস্যাটি মুসলিমসহ অনেক কানাডীয়র জন্য গুরুতর বিষয় হয়ে আছে। আর এই দেশটিতে মুসলিমদেরকেই বর্ণবাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জরিপে দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ কানাডীয় বিশ্বাস করে যে, মুসলিম ও আরবদের ব্যাপারে বিরূপ ধারণা পোষণ করা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।

ইপসস-এর জরিপে এটাও প্রকাশ পেয়েছে যে, কানাডায় বর্ণবাদের ছকবাঁধা ধারণা এখনও বলবৎ এবং ফুটন্ত অবস্থার কাছাকাছি রয়েছে। এই ছকবাঁধা ধারণা একটু বেশি জোরালো কুইবেকে। সেখানে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অনেক বেশি সংখ্যকেরই মুসলিম ও ইহুদিদের প্রতি বিরূপ ধারণা প্রকাশ করার সম্ভাবনা বেশি ছিলো।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া কুইবেকের ৩৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে, মুসলিমরা কানাডার আইনের পরিবর্তে শরিয়া আইন অনুসরণ করে। সার্বিক ফলাফলে দেখা যায়, প্রতি ১০ জনে তিনজন কানাডীয় মুসলিমদের শরিয়া আইন অনুসরণের বিষয়টি বিশ্বাস করে আর প্রতি ১০ জনের মধ্যে দুই জন মনে করে, ইহুদিরাই কানাডার অর্থনীতি ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে।

সিম্পসন বলেন, এই ছকবাঁধা ধারণাগুলো যখন যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ মেনে নেবে তখন এটি রাজনৈতিক চাপ তৈরির ইস্যু হয়ে উঠবে। তার ভাষায়, “সত্যিই এসব ধারণা বাস্তবে সক্রিয় কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলো সত্য না হলেও, মানুষ যদি তা বিশ্বাস করে তাহলে রাজনীতিকরা মনে করবেন, এ বিষয়ে তাদের সক্রিয় হওয়া দরকার আছে।”

সিম্পসন বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কানাডার পিপলস পার্টির নেতা ম্যাক্সিম বার্নিয়ের-এর মতো কিছু রাজনীতিক বর্ণবাদ বিষয়ক আলোচনার সীমা ভেঙ্গে ফেলতে মানুষকে উৎসাহ যুগিয়েছেন।

সিম্পসন গ্লোবাল নিউজকে বলেন, “যেসব বিষয় নিজে বিশ্বাস করলেও এখন পর্যন্ত মানুষ উঁচু স্বরে কথা বলতে অনাগ্রহী ছিলো, ওইসব রাজনীতিকরা সেই বিষয়গুলো নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে যাচ্ছেন।”

জরিপের ফল অনুযায়ী, কানাডার দৃশ্যমান সংখ্যালঘু মানুষদের (আদিবাসী ছাড়া অন্য সব অশ্বেতাঙ্গ) বর্ণবাদকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসাবে দেখার সম্ভাবনা দ্বিগুণ এবং বর্ণবাদের টার্গেট হওয়ার সম্ভাবনা তিনগুণ। বর্ণবাদী চিন্তা লালনের সম্ভাবনার দিক থেকেও দৃশ্যমান সংখ্যালঘুরাই এগিয়ে।

সিম্পসন বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বর্ণবাদ কেবল শ্বেতাঙ্গ থেকে অশ্বেতাঙ্গে কিংবা আরব থেকে ইহুদিতে অথবা এর বিপরীতভাবে ছড়িয়ে যায় তা নয়।”

জরিপে অংশ নেওয়া ২৩ শতাংশ মানুষ জানান, তারা ব্যক্তিগতভাবে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। ২০০৫ সালের চেয়ে এই সংখ্যা ৫শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে যারা বর্ণবাদী হামলার শিকার হয়েছে তাদের সংখ্যা ২৫শতাংশ।

পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল ছিলো কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ একটি বছর। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা গত মাসে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে এই তথ্য জানা যাচ্ছে। ২০১৬ সালের চেয়ে ২০১৭ সালে পুলিশের কাছে রিপোর্ট হওয়া ঘৃণাজনিত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছিলো ৪৭ শতাংশ। একই সময়কালে ধর্মসংশ্লিষ্ট হেইট ক্রাইমের পরিমাণ বেড়েছিলো ৮৩ শতাংশ। ওই বছর মন্ট্রিল ও টরন্টো এলাকায় অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলোতে মুসলিম ও আরবদের ওপর হামলা করা হয়।

ইপসস-এর জরিপে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতির লোকেদের মধ্যে এবং ভিন্ন জাতির প্রতিবেশির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোভাব ২০০৫ সালের মতো একই আছে।

অংশ গ্রহণকারীদের ১৫ শতাংশ বলেছেন, তারা কখনই ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা বিয়ে করবেন না। সিম্পসন বলেন, “এর কারণ সম্ভবত এই যে, কিছু অভিবাসী বিয়ে এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাদের ঐতিহ্যগত ধারণাগুলোই ধারণ করে থাকেন।”

সিম্পসন বলেন, জরিপে শিক্ষার স্তর ও বর্ণবাদী মনোভাবের মধ্যে জোরালো সম্পর্ক আছে এটাও উঠে এসেছে।

তিনি বলেন, কানাডায় সেইসব মানুষই কম সহিষ্ণু যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সবচেয়ে কম।

সিম্পসন মনে করেন, যেসব মানুষ মাধ্যমিক-পরবর্তী শিক্ষা অর্জন করেছে তারা সূক্ষèভাবে চিন্তা করেন এবং তাদের বন্ধু ও পরিবারের মধ্যে নির্দিষ্ট ধরণের চিন্তা থাকলে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।

জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় চারজন মনে করেন যে, অভিবাসন শ্বেতাঙ্গ কানাডীয়দের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর যেসব লোক হাইস্কুলের শিক্ষা সম্পন্ন করেনি তাদেরই এই ধারণা প্রকাশের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

সিম্পসন বলেন, জরিপে অংশ নেওয়া প্রত্যেক ব্যক্তিবিশেষের জন্য এই তথাকথিত “হুমকি” ভিন্ন হতে পারে। এটা হতে পারে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের “মহা প্রতিস্থাপন” বলে কথিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে শুরু করে কুইবেকবাসীদের নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা নিয়ে উদ্বেগের মতো ভিন্নতাসম্পন্ন বিষয়।

তিনি বলেন, “এই হুমকি সর্বজনীন নয়। এটি সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারণানির্ভর।”

ইপসস-এর জরিপে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ মানুষ ধর্ম ও অন্যান্য জাতিগত ইস্যুতে কথা বলার ব্যাপারে খোলামেলা বোধ করেন। আর যারা বছরে ৬০ হাজার থেকে লাখ ডলারের মধ্যে উপার্জন করেন তাদের মধ্যে এই ধরণের বোধশক্তি থাকার সম্ভাবনা অধিকতর।

জরিপে প্রকাশ, প্রতি ১০ জন কানাডীয়র মধ্যে নয়জনই মনে করেন বর্ণবাদ একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার।