ন্যূনতম মজুরিতে পুরো সময় কাজ করেও কানাডায় ঘরভাড়া যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব

জুলাই ১৮, ২০১৯

১৮ জুলাই ২০১৯: কানাডার প্রায় সব শহরেই ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির পক্ষে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দিতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। অন্টারিও-ভিত্তিক এক থিঙ্কট্যাঙ্কের নতুন রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে। খবর সিবিসি নিউজের।

গত অক্টোবরে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার বেতন-কাঠামো সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত এবং একই মাসে মর্টগেজ অ্যান্ড হাউজিং করপোরেশনের ভাড়া সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস (সিসিপিএ) কানাডাজুড়ে তিন ডজন বৃহত্তম শহরের প্রায় ৮০০ মহল্লায় অনুসন্ধান চালায় এটা দেখার জন্য যে, ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করে কারও পক্ষে আবাসনসুবিধা খুঁজে পাওয়া কতটা সহজ।

অনুসন্ধানের ফলাফল একেবারেই বিরস

সিসিপিএ-র হিসাব অনুযায়ী, ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা একজন মানুষ দেশের মাত্র ২৪টি মহল্লায় এক থেকে দুই রুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পেতে পারেন। সংস্থাটি অনুসন্ধান চালিয়েছে ৭৯৫টি মহল্লায়। যদি একরুমের অ্যাপার্টমেন্টে নেমে আসেন তাহলে চিত্রটা কিছুটা ভালো কারণ সেক্ষেত্রে ৭০টি মহল্লায় সাধ্যের মধ্যে আবাসন পাওয়া সম্ভব, কিন্তু তারপরও এটা প্রতি ১০টি অনুসন্ধানের মধ্যে মাত্র একটির চেয়েও কম- আর এসব অ্যাপার্টমেন্টের সবগুলোই উচ্চ বেতন ও সুলভ চাকরির জায়গা অর্থাৎ নগরকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে।

টরন্টোতে একজন নিন্ম আয়ের শ্রমিককে এক রুমের বাড়ির জন্য সপ্তাহে ৭৯ ঘণ্টা এবং দুই রুমের বাড়ির জন্য ৯৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ছবি : অনলাইন

সিসিপিএ-র অর্থনীতিবিদ ডেভিড ম্যাকডোনাল্ড বলেন, কানাডার আবাসন বাজার নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি বাড়ির মালিকদের ওপর আলোকপাত করার কথা, কিন্তু মোট পরিবারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলেন ভাড়াটে আর তারা সাধ্যের মধ্যে বাড়ি খুঁজে পেতে চরম দুর্ভোগ পোহান। এটি তাদের জন্য বড় রকমের একটি বোঝা।

তিনি বলেন, “ভাড়াটেদের অনেকেই বিশেষ করে যারা ন্যূনতম মজুরিতে বা প্রায় ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন, যাদের আয় নির্দিষ্ট এবং এক ব্যক্তির আয়ে চলে এমন পরিবারের ভাড়াটেরা যেখানেই খোঁজ করুন না কেন সাধ্যের মধ্যে বা মোটামুটি বাসযোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট পাবেন না।”

সিসিপিএ তার বিশ্লেষণে ন্যূনতম মজুরিতে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করা একজন মানুষের আয়ের হিসাব বের করেছে, তারপর সেটিকে সিএমএইচসির ভাড়ার তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে। সেইসঙ্গে সংসারের অন্যান্য খাতের ব্যয় নির্বাহের জন্য একজন মানুষের মোট আয়ের ত্রিশ শতাংশের বেশি বাড়ি ভাড়ার পেছনে ব্যয় করা উচিৎ নয় এই প্রচলিত নিয়মও অনুসরণ করেছে। তত্ত্বগতভাবে, ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন এমন লোকেরা কেবল এইটুকু করতে পারেন যে, তিনি অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করবেন অথবা সংসারের অন্যান্য ব্যয় যে করেই হোক ব্যাপকভাবে কাটছাট করবেন। কিন্তু সাধ্যের মধ্যে থেকে বাড়ি ভাড়া পাওয়াটা এই নিয়মের মধ্যে পড়ে না।

তারা বাড়িভাড়া খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতেই থাকেন কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সক্ষমতা ক্রমশই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতির দিক থেকে এগিয়ে আছে ভ্যাঙ্কুভার। সেখানে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা একজন ব্যক্তিকে এক রুমের বাড়ির ভাড়া নেওয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা এবং দুই রুমের বাড়ির জন্য ১১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।

টরন্টোও খুব পিছিয়ে নেই। এখানে একজন শ্রমিককে এক রুমের বাড়ির জন্য সপ্তাহে ৭৯ ঘণ্টা এবং দুই রুমের বাড়ির জন্য ৯৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।

ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “কানাডার মতো একটি ধনী দেশে একা উপার্জন করেন এমন ব্যক্তি সপ্তাহের পুরো সময় কাজ করলেই কেবল পরিবারের জন্য দুই রুমের একটি মোটামুটি ভদ্রোচিত অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিন্তু টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারের মতো বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহরসহ কানাডার বেশিরভাগ শহরে এমন কোনও মহল্লা নেই যেখানে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির একক উপার্জনে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা সম্ভব।”

টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভারের পর এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অন্য শহরগুলো হলো ভিক্টোরিয়া, ক্যালগেরি এবং অটোয়া। এই তিনটি শহরেই দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে সক্ষম হতে হলে একজন লোককে ন্যূনতম মজুরিতে সপ্তাহে অন্তত ৭০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। এই তিন শহরেই সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে দুই বেডরুমের মানসম্মত অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করার সক্ষমতা অর্জন করতে হলে আপনাকে প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে ২৬ ডলার আয় করতে হবে।

‘এটি হয়ে উঠেছে রীতিমত সংগ্রাম’

নরমা জিন কুইবেল তার সঙ্গী এবং চার ও ১০ বছরের দুই সন্তানসহ অটোয়ায় বসবাস করেন। গৃহীনী মা হিসাবে তিনি বলেন যে, স্বল্প আয়ে জীবনের চাহিদা পূরণ করা যে কতটা কঠিন তা তিনি ভালো করেই জানেন। তিনি বলেন, “আমাদের বাড়িভাড়া খুব বেশি, তাই প্রতি মাসে কোনটা ছেড়ে কোন চাহিদাটা মেটাবো সেটাই এক সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।”

মোটামুটি ১,৫০০ ডলারের মধ্যে দুই বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া বাবদ প্রতিটি দম্পতির আয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। যদিও তিনি জানেন যে, এটা অনেক বেশি ব্যয়বহুল তারপরও তারা এই এলাকা ছেড়ে যেতে পারছেন না কারণ তাদের মেয়েটি প্রতিবন্ধী এবং স্থানীয় একটি কর্মসূচির আওতায় তার জন্য সহায়তা পাওয়া যায়। অন্য কোথাও সরে গেলে এই কর্মসূচির সহায়তা তারা আর পাবেন না।

তিনি বলেন, “কোনও কোনও মাসে নির্দিষ্ট বিল পরিশোধ করাও আমাদের জন্য মারাত্মক কঠিন হয়ে পড়ে।”

সিসিপিএ মাত্র তিনটি শহরের খোঁজ পেয়েছে যেখানে স্থানীয় ন্যূনতম মজুরিতে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করলে সহজেই এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করার মতো সক্ষমতা থাকে। তিনটি শহরই কুইবেকে: শেরব্রুক, সাগুয়েনে এবং ট্রয়িস-রিবেরিস।

আরও ১০টি শহরÑ অন্টারিও প্রদেশের কিংস্টন, লন্ডন, উইন্ডসর, সেন্ট ক্যাথারিনস, নিউ ব্রুন্সউইকে প্রদেশের মঙ্কটন ও সেন্ট জন এবং কুইবেকের কুইবেক সিটি, মন্ট্রিল ও গাতিনিউতে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ন্যূনতম মজুরির শ্রমিকদের জন্য সার্বিকভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে হলেও এসব শহরে এমন কিছু মহল্লা আছে যেখানে তাদের জন্য এক বেডরুমের

অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা সম্ভব। দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট তাদের জন্য এই সবগুলো শহরেই অসম্ভব যদিও সেন্ট ক্যাথারিন্স ও সাডবুরিতে কিছু মহল্লায় সেটাও সাধ্যের মধ্যে রয়েছে।

টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারের মত শহরে আকাশছোঁয়া বাড়িভাড়ার বিষয়টি কাগজপত্রে বেশ ভালোভাবেই উঠে এলেও সিসিপিএর রিপোর্ট বলছে, এটা কেবল বড় শহরের সমস্যা নয়। বরং মোটেই শহর হিসাবে গণ্য করা হয় না এমন জায়গাতেও এর প্রভাব পড়েছে।

আলটার ক্যানমোর-এ বসবাসকারী মেগান মুত্রি বলেন, এই টাউনে অন্য সব জায়গার মতই বাড়ি ভাড়ার সমস্যা বিদ্যমান। মিজ. ক্যানমোর বলেন, তিনি এখন যে গ্যারেজে বাস করেন সেখানে ওঠার আগে হতদরিদ্র আবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সবরকম বাছাইয়ের কাজ শেষ করেন। এরপর তিনি একটি নতুন শাখায় স্থানান্তরিত হন যেটা তার জন্য খুবই উপযোগী।

তিনি একই সঙ্গে একাধিক কাজ করে জীবিকার সংস্থান করেন কিন্তু তিনি তার চেয়েও কম অর্থ আছে যাদের তাদের সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “অনেক মানুষ দামের কাছে হেরে যান। আমার এমন বন্ধু আছেন যারা কোনও ট্রেইলারে বাস করেন যদিও তারা নিজেদের জন্য জায়গা ভাড়া করেছেন এবং তাদের নিজস্ব ব্যবসা আছে।”

তিনি বলেন, “সব ধরণের কাজের সুযোগ না থাকলে কোনও টাউন হতে পারে না।”

সিসিপিএর হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশের বাড়িভাড়ার হার অনুযায়ী একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে সক্ষম হতে হলে তাকে প্রতিঘণ্টায় ২২.৪০ ডলার করে আয় করতে হবে। আর এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার সক্ষমতা পাবার জন্য এই পরিমাণটা কমে ঘণ্টায় ২০.২০ ডলার হবে।

দেশে সবচেয়ে বেশি ন্যূনতম মজুরি হলো আলবার্টায়, এর পরিমাণ ঘণ্টায় ১৫ ডলার। কিন্তু তারপরও এটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করার সক্ষমতার উল্লেখিত দুইটি স্তরের চেয়ে নিচুতেই রয়েছে। কোনও কোনও প্রদেশে ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় মাত্র ১১ ডলার। অর্থাৎ এসব জায়গায় দুই বেডরুমের বাড়ি ভাড়া নেবার সক্ষমতার চেয়ে মজুরি অর্ধেকেরও কম।

ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ২০ ডলারে উন্নীত এবং প্রাপ্ত চাকরির সবগুলোই পূর্ণকালীন না হওয়া পর্যন্ত অনেক শ্রমিকের জন্যই বাড়িভাড়া একটি উল্লেখযোগ্য বোঝা হয়ে থাকবে।”

তিনি বলেন, “একটি সুন্দর আবাসন প্রত্যেকেরই প্রাপ্য।”