কানাডায় এসে প্রতিকূল নতুন জীবনকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলাম : রিয়াজ
আমার পরিশ্রম ব্যর্থ হয়নি : আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে : আল্ল্লাহর উপর বিশ্বাস, ইচ্ছা এবং সত্যিকারের চেষ্টা থাকলে একদিন না একদিন মানুষ সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছাতে পারে
সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮
একজন সফল ব্যবসায়ী রিয়াজ আহমেদ। তিনি কানাডায় আসেন ২০০১ সালে। অসম্ভব পরিশ্রম আর মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি এদেশে গড়ে তুলেন দুটি স্বনামধন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তার একটি হলো তাজমহল ফুডস এবং অন্যটি স্টার হাক্কা চাইনিজ এ্যান্ড ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। একটি করে শাখাও রয়েছে এই দুটি প্রতিষ্ঠানেরই। আরো শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
রিয়াজ আহমেদের প্রতিষ্ঠান দুটোতে সার্বক্ষণিক কর্মীর সংখ্যা বর্তমানে ১২ জন। এরকম সাফল্য কানাডায় খুব কম সংখ্যাক বাংলাদেশীরই আছে।
ব্যাচেলর অব আর্টস শেষ করে বাংলাদেশে তিনি ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। সিটি অব ঢাকার নিবন্ধিত ঠিকাদার ছিলেন তিনি। একটি জেনারেল স্টোরও ছিল তার ঢাকায়।
খেলাধূলার সঙ্গেও ছিল তার গভীর সম্পর্ক। ঢাকার আরামবাগ টিম এর পক্ষ হয়ে ফুটবল খেলতেন তিনি।
সম্প্রতি আমরা উদ্যোমী, পরিশ্রমী এবং স্বপ্নচারী এই মানুষটির মুখমুখি হয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম তার সাফল্যগাঁথার পিছনের কথা।
প্রথমেই তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কানাডায় কেন এসেছিলেন। জবাবে রিয়াজ আহমেদ বলেন, এখানে আত্মীয়-স্বজন ছিল আগে থেকেই। তাছাড়া আমার জানা ছিল কানাডা একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। এই জন্যই এই দেশটিকে বেছে নেয়া।
রিয়াজ আহমেদের তিন মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে রায়ারসনে পড়ছে। মেঝো মেয়ে গ্রেড ৫ শেষ করে এবার হাই স্কুলে যাচ্ছে। ছোট মেয়ে গ্রেড ফাইভে। ছেলের বয়স দেড় বছর। রিয়াজ আহমেদের স্ত্রী উম্মে হানি কানাডায় আসেন বাবা-মা’র সঙ্গে। এখানে এসে কম্পিউটার বিষয়ে লেখাপড়া করেন।
কানাডায় আসার আগে এখানকার চাকরীর বাজারের কি অবস্থা তা নিয়ে কোন গবেষণা বা খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন কি না তা জানতে চাওয়া হলে রিয়াজ আহমেদ বলেন, না এ বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না। তাছাড়া ঐ সময় ইনফরমেশন গ্যাপ-ও ছিল। এক্সেসেসও ছিল না তেমন ইনফরমেশন সোর্সগুলোতে। ছিল না তেমন বাংলা পত্রিকাও। বাংলাদেশীদের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। বাংলাদেশী দোকানপাটও ছিল না তেমন। আর জব পাওয়াটা তখন খুবই কঠিন ছিল। ফলে কানাডায় এসে প্রথম দিকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। নতুন ইমিগ্রেন্টদেরকে এখনো সংগ্রাম করতে হয়। তবে তাদেরকে ইনফরমেশন গ্যাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে না। তাদের সুযোগও বেশী। হাত বাড়ালেই অনেক তথ্য মিলছে। অনেক বাংলাদেশী আছেন এখন যাদের কাছে নতুন ইমিগ্রেন্টরা নানারকম তথ্য ও সহযোগিতা পাচ্ছেন। এই তথ্য ও সহযোগিতার বিষয়গুলো আমাদের সময় ছিল খুবই সীমিত। ফলে প্রতি পদে পদে হোচট খেয়ে আমাদেরকে শিখতে হয়েছে কানাডার জীবন-জীবিকার চড়াই-উৎরাইগুলো।
কানাডা এসে দেশটি সম্পর্কে সর্বপ্রথম অনুভূতি কি হয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ আহমেদ বলেন, খুবই খারাপ অনুভূতি হয়েছিল। কারণ হলো, ফেব্র“য়ারী মাসে যখন কানাডায় এসে নামলাম তখন এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসার সময় দেখলাম চারদিকে সাদা বরফ আর পত্রবিহীন গাছপালা। কেমন যেন একটা নিষ্প্রাণ, নিরস দৃশ্য চারিদিকে। ভয় পাওয়ার মত একটি দৃশ্যপট। আমার তখন মনে হচ্ছিল এরকম একটি দেশে থাকবো কি করে?
সমসময়ই মন খারাপ লাগতো আত্মীয়-পরিজনদের জন্য। আমি ঢাকায়ই বড় হয়েছি। সেখানে খেলাধূলাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। প্রচুর আত্মীয়-বন্ধু ছিল। ফলে কানাডায় এসে প্রথমে হোমসিকনেসটা বেশ ভুগিয়েছিল। এখানকার একাকিত্বটা বেশ পীড়া দিতো। পরে অবশ্য আস্তে আস্তে তা সয়ে গেছে। সংসার- আর জীবন-জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে উঠার পর মন খারাপ করার সময় ছিল না। কিন্তু তারপরও বলবো, আজ এত বছর পরেও দেশ ও আত্মীয়-পরিজনের জন্য মনের গহীনে একটা টান রয়েই গেছে। সেই টান মুছে যাওয়ার নয়। তাই প্রতি বছরই আমি দেশে যাই একবার করে। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। ঐ দেশের প্রতি আমার টান থাকবেই।
রিয়াজ আহমেদের কাছে আরো জানতে চেয়েছিলাম সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশে এসে প্রথম দিকে আর কি কি সমস্যায় পড়তে হয়েছিল তাকে। তিনি বলেন, প্রথম সমস্যা হয়েছিল চাকরি পাওয়া নিয়ে। কেউ চাকরী দিতে চায় না। ইংরেজী, বিশেষ করে আমরা যে ব্রিটিশ ইংরেজী শিখেছি এবং যে একসেন্ট আমাদের সেটা নিয়ে এখানে সুবিধা করা যাচ্ছিল না। লোকসংখ্যাও ছিল এখনকার তুলনায় কম। কানাডিয়ানা প্রতিষ্ঠান হোক আর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানই হোক, কেউই চাকরী দিতে চাইত না। তারপরও যদি ভাগ্যক্রমে চারকরী একটা পাওয়া যেত- মালিকপক্ষ তিন ডলার বা চার ডলারের বেশী বেতন দিতে চাইত না। সে কারণে প্রথম দিকে কানাডার জীবন খুব কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে।
পরে অনকে চেষ্টা চরিত্র করে আত্মীয়-বন্ধুদের সহায়তায় একটি রেস্টুরেন্টে চাকরী পেয়েছিলাম। আর সেটাই ছিল আমার শুরু ।
তিনি বলেন, পরিচয় সংকট (আইডিয়েন্টি ক্রাইসিস) নিয়ে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি আমাকে। আর আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি পরিচয় সংকট বলতে কিছু নেই। এদেশে আমার কোন পূর্বপূরুষ ছিল না। পরিচয় এখানে বানিয়ে নিতে হবে। আমি যদি ক্ষনে ক্ষনে চিন্তা করি আমার কিছু নেই, আমি কে, তাহলে আমার এই ক্রাইসিস দূর হবে না কোন দিন।
আমি নিজেকে কিভাবে দেখতে চাই, কিভাবে মূল্যায়ন করতে চাই সেটা বড় কথা। যেদিন থেকে আমি নতুন এ দেশে কাজ শুরু করবো সেদিন থেকে আমার নতুন পরিচয় গড়ে উঠতে থাকবে।
কানাডায় বর্ণবাদ বা রেসিজম প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলেন, এটির অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশীতো আমাদের বাংলাদেশেই। কারণ ওখানে কোন ফোরামে বা প্রতিষ্ঠানে চরজন এক ডিস্ট্রিকের লোক থাকলে অন্য ডিস্ট্রিকের একজনকে কোন পাত্তাই দিতে চায় না। আর কানাডা তো আমাদের জন্য ভিন্ন দেশ। তারপরও এখানে আমাদের জন্য যে সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়েছে তার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। কানাডায় যে দু-চারটি বর্ণবাদী ঘটনা ঘটে তা খুবই ক্ষুদ্র এবং তা উদাহরণ হিসাবে আসাই উচিৎ নয়।
রিয়াজ আহমদের কাছে আরো প্রশ্ন ছিল – কানাডা আসার পর নানান প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় প্রায় প্রতিটি ইমিগ্রেন্টকেই। আপনাকেও মোকাবেলা করতে হয়েছে সেরকম কিছু প্রতিকূলতা। সে সময় কি কখনো মনে হয়েছে কানাডা ছেড়ে চলে যাই?
উত্তরে তিনি বলেন, সমস্যা হয়েছিল নানারকম। তবে আমি বিনাযুদ্ধে কানাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কখনো ভাবিনি। আমি সমস্যাগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলাম। দেশে আমার সবকিছুই ছিল। কিন্তু তারপরও আমার কাছে মনে হতো, দেশে ফিরে যাওয়ার অর্থ হলো জীবন যুদ্ধে পরাজিত হওয়া। আমি দেশে একটি প্রতিষ্ঠিত জীবন ত্যাগ করে কানাডায় এসেছি। এখন যদি কানাডার প্রতিকূলতাকে ভয় পেয়ে আত্মসমর্পন করি বা পিছনে ফিরে যাই তবে তা হবে একটা লজ্জার বিষয়। এই পরাজয় বা লজ্জাকে এড়ানোর জন্য তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, সামনে যত প্রতিকুলতাই থাকুক আমি এগিয়ে যাব।
সেই চিন্তা থেকেই চাকরী ছেড়ে নেমে পড়লাম ব্যবসায়। প্রথমে শেয়ারে ঢুকলাম তাজমহল ফুডস এ। ঐ সময় তাজমহলের অবস্থা সুবিধাজনক ছিল না। ঠিকাদারী ব্যবসার পাশাপাশি ঢাকায় একটি জেনারেল স্টোর পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল আমার। সেই অভিজ্ঞতা এবং কানাডায় সঞ্চিত কিছু অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাজমহল ফুডসকে চাঙ্গা করে তুললাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে। আমি আমার স্ত্রীকে ব্যবসা শুরুর আগেই বলে রেখেছিলাম আগামী দুই বছর সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ। দেশে যাওয়া বন্ধ। সম্পূর্ণ সময়টাই আমরা দেব ব্যবসাতে। এই দুই বছর ডাইহার্ড সংগ্রাম করে
যাব। যদি জয়ী হই তো ভাল, আর না হলে দেশে ফেরত যাব। এই দুই বছর আমি সত্যিকার অর্থেই দিনরাত পরিশ্রম করে গেছি। ডানে বায়ে তাকাইনি। কোন আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে যাইনি। কাউকে দাওয়াতও দেইনি। দেশেও যাইনি সেই দুই বছর। ব্যবসা শুরুর আগে যে চাকরীতে ঢুকেছিলাম সেখান থেকে ভালই বেতন পেতাম। কিন্তু চাকরী ছেড়ে ব্যবসা শুরুর পর প্রথম দুই বছর আমার কোন আয় ছিল না। বরং নতুন ব্যবসায় কিছু পূঁজিও ঢালতে হয়েছে। ঐ সময়টাতে আমার স্ত্রী আমার পাশে এসে না দাড়ালে আমার পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না।
আমার পরিশ্রম ব্যর্থ হয়নি। আল্ল্লাহর উপর বিশ্বাস, ইচ্ছা এবং সত্যিকারের চেষ্টা থাকলে একদিন না একদিন মানুষ সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছাতে পারে। ২০০১ সালে কানাডা আসার পর ২০০৫ সাল থেকে এই ব্যবসায় নামি। স্কারবরোতে সাফল্যের পর আমি ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারীতে মিসিসাগায়ও একটি ব্রাঞ্চ খুলি তাজমহল ফুডস এর। সেটি আয়তনে আরো বড়। আমার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সেই সাথে প্রবাসী বাঙ্গালী ভাই-বোনদের অকৃত্রিম সহযোগিতা সব মিলিয়ে তাজমহল ফুডস আজ টরন্টোতে একটি লিডিং নেইম ইন বাংলাদেশী সুপারমার্কেটস। তবে আমি তাজমহল ফুডস এর সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বেশী কৃতিত্ব দিব প্রবাসী বাঙ্গালী ভাই-বোনদেরকেই। তাদের আন্তরিক ও অপরিমেয় সহযোগিতা না পেলে তাজমহল ফুডস আজ এই অবস্থানে আসতে পারতো না। আর নেপথ্যে থেকে যিনি আমাকে সর্বক্ষণ সাহস ও সহযোগিতা যুগিয়ে গেছেন তিনি হলেন আমার স্ত্রী।
আমাদের অনেক ভুল ত্র“টি ছিল, এখনো আছে। আমরা সবসময় এগুলো সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারি না। কিন্তু তারপরও আমাদের সম্মানিত গ্রাহকগণ আমাদের সহযোগিতা করে গেছেন উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন।
আমি এখন এই দুটি ব্রাঞ্চ একাই চালাচ্ছি। আমার কোন পার্টনার নেই। আমার ইচ্ছে আছে প্রবাসী ভাই-বোনদের সহযোগিতা ও সমর্থন পেলে এজাক্স এবং পিকারিং এর দিকেও তাজমহল ফুডস এর শাখা খোলার।
কানাডায় আসার পর ব্যবসায় নামবো এমন পরিকল্পনা আসলে আমার ছিল না। বলা যায় প্রায় পরিকল্পনাহীনভাবেই কানাডায় আসা। কারণ দেশে থাকা অবস্থায় কানাডার চাকরী বাজার, ব্যবসা ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না।
রিয়াজ আহমেদ বলেন, তাজমহল ফুডস এর সাফল্যের পর আমি নতুন আরেক প্রকল্পে হাত দেই। সেটি হলো টরন্টোর স্টার হাক্কা চাইনিজ ও ইন্ডিয়ান কুজিন। একই ছাদের নিচে হাক্কা ও দেশী স্বাদের সমাহার এই স্টার রেস্টুরেন্ট। শুরু থেকেই প্রবাসীদের ভালবাসা ও আস্থা নিয়ে পথ চলা শুরু হয় স্টার হাক্কা চাইনিজ ও ইন্ডিয়ান কুজিন এর। ইতিমধ্যে চার বছর পার হয়ে গেছে। প্রবাসীদের ভালবাসার কমতি ঘটেনি এক রত্তিও, কমেনি আস্থাও। বরং তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে মিসিসাগায় খোলা হয়েছে স্টার এর দ্বিতীয় ব্রাঞ্চ। আমরা বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থেও ব্রাঞ্চ খোলার জন্য সুবিধাজনক জায়গা খুঁজছি। জায়গা পেলে অচিরেই সেখানেও ব্রাঞ্চ খুলবো।
শুরুতে আমাদেরকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রথম একবছর আমরা শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি বিভিন্ন খাবার তৈরী করে। যখন আমরা দেখলাম খাবারের মান ও স্বাদ সঠিক হয়েছে তখনই আমাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
রিয়াজ আহমদ বলেন, মুনাফার চেয়ে গ্রাহকদের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সততাই আমাদের কাছে বেশী গুরুত্বর্পূণ। আমরা চেষ্টা করে আসছি পুরানো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রন্ধন শিল্পের খ্যাতি ও খোশবুটাকে প্রবাসীদের সামনে হাজির করার জন্য। গ্রাহকরা যাতে শতভাগ পরিতৃপ্তি পান আমাদের রান্না করা খাবার খেয়ে সে ব্যাপারে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালি যাচ্ছি। আমাদের কাস্টমার এপ্রিসিয়েশন আমাদের অনেক ভাল। ফলে আমরা বেশ অনুপ্রেরণা পাই গ্রাহক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে। তারা রেস্টুরেন্ট এর খাবারের মান ও স্বাদ নিয়ে যে সুনাম করেন তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে আরো উন্নত সেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে। ইতমধ্যে আমাদের ক্যাটারিং সার্ভিস বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জন্মদিন, বিয়ে, হাউজ ওয়ার্মিং পার্টি ইত্যাদি সব ধরণের অনুষ্ঠানের জন্যই আমাদের রয়েছে ক্যাটিরিং সার্ভিস। আমাদের রেস্টুরেন্ট থেকে ৩০ জন থেকে শুরু করে ১২ শ লোকের খাবার সরবরাহ করতে পারি। আমাদের আরো রয়েছে ডেলিভারী সিস্টেম। একশ জন বা তারো বেশী হলে আমার ফ্রি ডেলিভারী করে থাকি যদি তা ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে।
রিয়াজ আহমেদ বলেন, কাস্টমারদের প্রতি আমার ম্যাসেজ হলো, খাবারের রিয়েল টেস্টকে উন্নত করার জন্য আমাদেরকে নিয়মিত ফিডব্যাক দিন। আমরা আমাদের চলার পথে আপনাদের যে সহযোগিতা পাচ্ছি সেটি আরো বেশী করে পেলে আমরা আপনাদের সেবায় আমরা আরো বেশী করে অনুপ্রাণিত হতে পারবো।
আজকে আমার চারটি প্রতিষ্ঠানে ১২ জন ফুলটাইম ওয়ার্কার রয়েছেন। অথচ এই আমি যখন কানাডায় এসেছিলাম তখন নিজেই চাকরী খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি সেদিন হতাশ হইনি। বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলাম।
কানাডায় সবাই একটা স্বপ্ন নিয়ে আসেন। আপনিও নিশ্চই একটি স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন। সে স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে বলে আপনার মনে
হয়। নাকি স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। এই প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ আহমেদ বলেন, আমি বলবো আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার একটাই স্বপ্ন ছিল ভাল ভাবে থাকা। আমি যখন কানাডায় আসি তখন বাংলাদেশে অপরচুনিটিটা তেমন ছিল না যেমনটি তৈরী হয়েছে ২০০৭ এর পর থেকে। আর দ্বিতীয়ত, কানাডায় না আসলে বুঝতে পারতাম না যে আমাদের কাজ করার এবিলিটি কি পরিমান রয়েছে। এটি বুঝতে পারলে এত লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশে আসার প্রয়োজন হতো না। দেশেই কিছু একটা করা যেত। এখানে আমরা যে হার্ড ওয়ার্ক করি এবং যে সিনসিয়ারিটি দেখাই তা যদি বাংলাদেশে করতাম তবে অনেক ভাল অবস্থায় বাংলাদেশেই থাকা যেত।
তারপরও বলবো, কানাডার জীবনে আমি সুখী। যখন চাকরী করতাম তখনও আমার কোন অভিযোগ ছিল না কানাডার জীবন নিয়ে, আর এখন ব্যবসা করি- এখনও আমার কোন অভিযোগ নেই এখানকার এই প্রবাসী জীবন নিয়ে। আমি একজন সুখী মানুষ।
রিয়াজ আহমদের কাছে এর পরের প্রশ্ন ছিল, কানাডায় আপনি একজন সুখী মানুষ এবং একজন সফল ব্যক্তিও। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
জবাবে তিনি বলেন, আমি আসলে কখনো ব্যবসায়ী হতে চাইনি কানাডায়। সবসময় চেয়েছি একজন ভাল মানুষ হতে, চেষ্টা করেছি সবার সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলার।
আমি মনে করি প্রতিটি মানুষ যদি ডিটারমাইন্ড হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এবং সে যদি মনে করে এতে সে আনন্দ পাচ্ছে, মানসিক শান্তি পাচ্ছে তাহলে সেই কাজে লেগে থাকা উচিৎ। বার বার লাইন বা টার্গেট চেঞ্জ করলে সাফল্য সহজে ধরা দেয় না। পিছিয়ে পড়তে হয়।
আর একটা বিষয় আমি বলবো, এখানে বাংলাদেশী অরিয়েন্টেড ব্যবসা করা খুবই কঠিন। কারণ, আমাদেরকে তখন নির্ভর করতে হয় শুধুমাত্র বাংলাদেশী কাস্টমারদের উপর। নির্ভর করতে হয় শুধুমাত্র বাংলাদেশী কর্মীদের উপর। বাংলাদেশী কর্মী ছাড়া বাংলাদেশী কাস্টমারদেরকে সেবা প্রদান করা কঠিন হয়ে দাড়ায়। অনেক সময় আমরা সেবা প্রদান সঠিকভাবে করতে পারি না। এবং দেখা গেছে, কখনো কখনো আমরা blackmail এর ও শিকার হই। এ সমস্ত কারণে এখানে বাংলাদেশী নির্ভর ব্যবসা করা কঠিন এবং ব্যবসায় লাভও কম হয়। কানাডিয়ান মেইনস্ট্রিমের ব্যবসা চালানোর যে খরচ হয়, তেমনি খরচ হয় আমাদের বাংলাদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। কিন্তু মেইনস্ট্রিম প্রতিষ্ঠানগুলোর মত প্রফিট বা লাভ আমরা করতে পারি না। তবু আমরা টিকে আছি বাংলাদেশী কাস্টমারদের সহযোগিতা ও সমর্থনের কারণেই। এই সহযোগিতা ও সমর্থন যতদিন থাকবে ততদিন বাংলাদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে থাকবে। আর যেদিন তাদের এই সমর্থণ থাকবে না সেদিন বাংলাদেশী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে থাকবে না।
আমি প্রবাসী বাঙ্গালী ভাই-বোনদের কাছে একটি আবেদন জানাবো, আপনারা বাংলাদেশী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহযোগিতার হাত আরো সম্প্রসারিত করুন। একমাত্র আপনারাই পারেন প্রবাসে বাংলাদেশী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে। আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমরা সামনে এগুতে পারবো না। আমাদেরকে ভাল দাম ও ভাল জিনিষ দিতে হলে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে যে কোন প্রতিষ্ঠানই অধিকতর স্বল্পমূল্যে মানসম্পন্ন পন্য সরবরাহ করতে পারে।
আর যে কমিউনিটিতে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশী সেই কমিউনিটির গুরুত্বও কানাডায় বেশী। সুখের বিষয়, কানাডায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধিকে অব্যাহত রাখতে হলে প্রতিটি বাংলাদেশীকেই সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করতে হবে। আমাদের কিছু ভুল-ত্র“টি থাকতে পারে। কিন্তুু সেটি যদি কাস্টমাররা আমাদেরকে ধরিয়ে দেন তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রতিটি ব্যবসায়ীই তা সমাধানে আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করবেন।
কানাডায় আমাদের কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদেরকে একতাবদ্ধ থাকতে হবে।