নৈপুণ্যে আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়েছেন মুশফিক

ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩

প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : আড়াই বছর আগে জিম্বাবুইয়ে সফরটা দারুণ দুঃসহ ছিল বাংলাদেশ দলের জন্য। ২০১১ সালের আগস্টে সেবার বাংলাদেশ দল টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে হেরে যায়। আর ফলশ্রুতিতে অধিনায়কত্ব হারান শাকিব আল হাসান। সে বছর ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব বর্তায় মুশফিকুর রহীমের কাঁধে। নেতৃত্ব একটা বড় দায়িত্বের গুরুভার। শুরুটা দারুণ হয়েছিল মুশফিকের। সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একমাত্র টি২০ ম্যাচে জয় দিয়ে শুরু করে বাংলাদেশ তাঁর নেতৃত্বে। এরপর থেকে বাংলাদেশ দল একের পর এক সাফল্য পেয়ে যাচ্ছে মুশফিকের নেতৃত্বে। শুধু দলগতভাবেই উন্নতি এসেছে মুশফিকের হাত ধরে বিষয়টি এমন নয়। নিজেও নৈপুণ্যে আগের চেয়ে হয়েছেন উজ্জ্বল। ধারাবাহিকভাবে দুই বছর ধরে নিয়মিত ভাল খেলে যাচ্ছেন তিনি সব ফরমেটে। যেকোন পর্যায়ের ক্রিকেটে মুশফিক ব্যাট হাতে নামলেই রান বেরিয়ে আসছে তাঁর উইলো থেকে। ওয়ানডে, টেস্ট কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট আসরে নিয়মিত ভাল খেলে যাওয়া মুশফিক দেশের ক্রিকেটে হয়ে উঠছেন আস্থা ও নির্ভরতার মূর্ত প্রতীক। এবার সদ্য সমাপ্ত ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগের ৪টি করে ম্যাচ খেলতে পারেননি জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। সফরকারী নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরোয়া সিরিজ খেলা নিয়ে ব্যস্ততার কারণে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের এ ম্যাচগুলো খেলা হয়নি। তবে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সর্বশেষ সিরিজে খেলা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে মুশফিক একাই ছিলেন উজ্জ্বল। চার ম্যাচ না খেললেও সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের তালিকায় মুশফিক আছেন তিন নম্বরে। শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের অধিনায়ক মুশফিক ১২ ম্যাচে ৬৯.৩৩ গড়ে করেছেন ৬২৪ রান। সঙ্গে আছে ৩ অর্ধশতক ও ১ সেঞ্চুরি। লীগে সর্বাধিক ছক্কাও তাঁর দখলে। ওয়ানডে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে রানের খেলা। আর সেটারই যেন নিদর্শন দেখিয়েছেন মুশফিক। ১২ ম্যাচে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ২৫ ছক্কার মার। এবার চার ম্যাচ কম খেলার কারণে রান করার দিক থেকে তৃতীয় হলেও গতবার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনিই। গতবারই প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লীগ ক্রিকেটে আসে শেখ জামাল। আর দলটির অধিনায়কত্ব কাঁধে নিয়ে দলকেও মোটামুটি সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। এর পেছনে ছিল মুশফিকের বিশাল অবদান। তিনি একাই করেছিলেন ১৬ ম্যাচে ৯৫১ রান। গড় ৭৩.১৫! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেরও তিন ফরমেটে একই ধারাবাহিকতায় খেলে যাচ্ছেন তিনি। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেল অধিনায়ক হওয়ার পর তাঁর পারফরমেন্সের পারদ অনেক উপরে উঠেছে। আর সে কারণেই এক যোগ্য নেতা পেয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। সবমিলিয়ে আহামরি বড় মাপের বেশি ইনিংস উপহার না দিতে পারলেও ধারাবাহিকভাবে যেভাবে রান করছেন সেটা দেশের প্রতিটি ব্যাটসম্যানের জন্য অনুকরণীয় উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত।

দলের কা-ারির ওপর নির্ভর করে কোন পথে যাবে দলটি। সেনাপতি নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে স্বীয় কর্মে উজ্জ্বল হতে না পারলে সৈনিকরাও দিশেহারা অবস্থায় থাকে। ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান মুশফিক। ঘরোয়া সিরিজে ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে লড়াইটা ছিল প্রথম মিশন তাঁর। এর আগে জিম্বাবুইয়ে সফর শেষে ফেরা শাকিবের দলটি একেবারে যন্ত্রণাদায়ক নৈপুণ্য নিয়েই ফিরেছে। কারণ ওয়ানডে কিংবা টেস্ট উভয় ফরমেটের র্যাঙ্কিংয়েই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে জিম্বাবুইয়ে। তাদের কাছে দুই সিরিজেই পরাজয় মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। যার কারণে শাকিবের স্থলাভিষিক্ত মুশফিক। অধিনায়ক হয়ে শুধু দলকে যোগ্যভাবে নেতৃত্ব দেয়াই নয় বরং পাশাপাশি ব্যাট হাতে দারুণ কিছু করেও দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা শুরু করেন মুশফিক। সেটা তিনি ধরে রেখে চলেছেন। এখন পর্যন্ত ২৪ ওয়ানডে, ১২ টেস্ট আর ১৫ টি২০ ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুশফিক। পুরো ক্যারিয়ার থেকে এ কয়েকটি ম্যাচ বাদ দিলে পরিবর্তনটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনেক এগিয়েছেন মুশফিক ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে। অধিনায়ক হিসেবে ২৪ ওয়ানডেতে ২৮.৭০ গড়ে করেছেন ৫৭৪ রান। অথচ পুরো ক্যারিয়ারের গড় ২৬.৩৩। টেস্ট ক্রিকেটেও দারুণ কিছু উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন মুশফিক।

চলতি বছর মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে যে ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তাতে করে দেশের ক্রিকেট ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হয়েছে। প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ত্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন অধিনায়ক মুশফিক। সবমিলিয়ে দলের নেতৃত্ব নেয়ার পর থেকে ১২ টেস্টে ৪৪.১৫ গড়ে করেছেন ৮৮৩ রান। অথচ এর আগের ২৪ টেস্টে তাঁর রান মাত্র ২৭.৭৯ গড়ে ১১৯৫। মুশফিকের দারুণ এ নৈপুণ্যের কারণেই এবার শ্রীলঙ্কা সফর থেকে বেশ কিছু গৌরব সঙ্গে করে নিয়ে ফেরে বাংলাদেশ দল। তবে মুশফিকের অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারে এই শ্রীলঙ্কা সফরের পরেই আসে সবচেয়ে বাজে সময়টা। আবারও সেই জিম্বাবুইয়ে সফর। দুই বছর আগে যে সফর শেষে দলকে সাফল্যের ঠিকানা পাইয়ে দেয়া অধিনায়ক শাকিব নেতৃত্ব খুইয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কা সফরটা দারুণভাবে শেষ করার কারণে এমনিতেও বাংলাদেশ দলের ওপর ভরসা এবং আশা বেড়ে গিয়েছিল সবার। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন জিম্বাবুইয়ে সফরে নিরঙ্কুশ জয় ছিনিয়ে নেবে মুশফিকবাহিনী। কিন্তু আদতে উল্টোটাই ঘটে। টেস্ট সিরিজ না হারলেও ১-১ সমতা এবং ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ। নিচের র্যাঙ্কিংয়ে থাকা দলের কাছে এমন পরাজয় বাংলাদেশ দলের শৃঙ্খলাও নষ্ট করে দেয়। সফরের মাঝামাঝিই দেশে ফেরার পর অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন মুশফিক। দেশের ক্রিকেটাঙ্গন তর্ক-বিতর্কের ঝড়ে গরম হয়ে ওঠে। সে সময় মুশফিক নেতৃত্ব ছাড়তে চাওয়ার পেছনে যুক্তি দেখিয়েছেন-পরাজয়, দলকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে না পারা এবং নিজে কিছুটা চাপমুক্ত থেকে ভালভাবে চেষ্টা করার কথা বলে। শেষ পর্যন্ত মুশফিকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাঁর ওপরেই আস্থা রাখে এবং পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করে। সে কারণে নেতৃত্বে বহাল থেকে যান মুশফিক। দারুণ একটা সুযোগও পেয়ে যান মুশফিক। বাজে সময়টা কাটিয়ে, মানসিকভাবে চাঙ্গা হওয়ার জন্য ফুরফুরে অবস্থায় ফেরার জন্য অখ- অবসর পেয়ে যান আন্তর্জাতিক খেলা আর না থাকার কারণে। এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটও ছিল বন্ধ। এ সুযোগে আত্মশিক্ষায় বলীয়ান হয়ে ওঠা এবং মানসিক শক্তি ফিরে পাওয়ার যথেষ্ট সময় পেয়েছেন মুশফিক। সময় পেয়েছেন দেশের ক্রিকেটাররাও। সাড়ে পাঁচ মাস পর এ কারণেই আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ দল। নিজেকেও পুরুনোদ্যমে ফিরে পেয়েছেন মুশফিক। সেটা বোঝা যাচ্ছিল এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ শুরু হতেই। গতবারের মতো এবারও শেখ জামালের নেতৃত্ব মুশফিকের কাঁধে। সে গুরুদায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের পাশাপাশি ঠিকই নিজের ব্যাটসম্যান পরিচয়টাও তুলে ধরেছেন। দলের অন্য সবার জন্য হয়েছেন অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত। দলের অধিনায়ক ভাল করলে সে প্রভাবটা অবশ্য অন্য সদস্যের ওপরও পড়ে যায়। মাঝে যে কয়েকটি ম্যাচ খেলেননি দলও ভাল করতে পারেনি। তবে মুশফিক নিজে ১২ ম্যাচে করেছেন ৬৯.৩৩ গড়ে ৬২৪ রান। গত আসরে জামালের জার্সি গায়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন মুশফিক ৭৩.১৫ গড়ে ৯৫১ রান করে। হাঁকিয়েছিলেন ৬টি অর্ধশতক ও ৪টি শতক। এবার তেমনটা হয়নি। তবে সব ম্যাচ নিয়মিত খেলতে পারলে মুশফিক আবারও যদি শীর্ষ রান সংগ্রাহক হতেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কারণ সার্বিক তালিকায় তিনি তৃতীয় স্থানে হলেও দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র ইমরুল কায়েসই আছেন তাঁর ওপর। মুশফিকের চেয়ে ইমরুল চার ম্যাচ বেশি খেলে রান বেশি করেছেন মাত্র ৩১। গত আসরে সমপরিমাণ ম্যাচে ৬৯০ রান করেছিলেন ইমরুল এবং মুশফিকের পরেই ছিলেন দুই নম্বর অবস্থানে। গত আসরে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা ব্যাটিংয়ে দারুণ করলেও এবার মুশফিকর ছাড়া আর কাউকে সেভাবে উজ্জ্বল দেখা যায়নি। জাতীয় দলের হয়ে সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরে খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে সেরা দশ ব্যাটসম্যানের তালিকায় আছেন আর মাত্র দুজন। মুমিনুল হক (১০) ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (৯)। কিন্তু এখানেও সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে নিজেকে যোগ্য নেতা হিসেবেই প্রমাণ করেছেন মুশফিক।