নায়েগ্রায় পিকনিক

শুজা রশীদ

শীত প্রধান দেশগুলোতে মাস ছয়েক শীতে কাঁপাকাঁপি করে যখন শেষ পর্যন্ত— গ্রীষ্ম আসে তখন চারদিকে যেন একটা উৎসবের আমেজ চলে আসে। বিশেষ করে আমরা যারা গরম প্রধান এলাকা থেকে এসে এখানে সংসার পেতেছি তাদের কাছে গ্রীষ্ম হচ্ছে পরিত্রাণ। খুব দীর্ঘদিনের জন্য নয়, তবুও নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।

গ্রীষ্মে বাংলাদেশীদের প্রিয় কর্মকান্ডের দু’টি হচ্ছে  পিকনিক ও মাছ ধরা। এখানে অজস্র ন্যাশনাল, প্রভিনসিয়াল এবং লোকাল পার্ক আছে। কিছু পার্কে ফি দিয়ে ঢুকতে হয়, কতগুলো ফ্রি। প্রায় প্রতিটিই প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সারাটা দিন বেশ হাসি খুশীতে কাটানো যায়। অনেকগুলিতেই লেক আছে। বাচ্চারা লেকের তীরের বালুতে খেলতে

অসম্ভব পছন্দ করে। আমি সাঁতার না জানলেও স্বল্প গভীর পানিতে হাত পা আছড়িয়ে প্রচুর অনন্দ পাই। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহেই প্রায় প্রতি গ্রীষ্মেই প্রচুর পিকনিক হয়ে থাকে।

নায়েগ্রা ফল্সে কখনো এই উদ্দেশ্য নিয়ে যাই নি। কিন্তু গ্রূপের বেশ কয়েকজন আগ্রহ দেখানোয় ইতিবাচক সায় দিলাম। নায়েগ্রা জলপ্রপাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দুটি শহর। একটি নায়েগ্রা ফল্স্ আমেরিকা, অন্যটি নায়েগ্রা ফল্স্ কানাডা। আমরা কানাডার দিকেই থাকবো। পিকনিকের জায়গা আছে কিনা কেউই সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নয়। তবে ধারণা করা হলো সেখানে গিয়ে পার্ক জাতীয় কিছু একটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে। সেখানেই থেমে সকলে খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের কাছে চলে যাবো। ঠিক হলো খাবার দাবার বাসা থেকেই নিয়ে যাওয়া হবে। সাধারণত পিকনিকে গেলে আমরা বারবিকিউ চুলা সাথে নিয়ে যাই। যুতসই মতো জায়গায় আসন গেড়ে রান্নাবান্নায় লেগে যাই। এইবার তার অন্যথা হলো। আমরা পাঁচটি পরিবার যাবো । মোট চারটি ভ্যান, একটি কার। একদল দায়িত্ব নিলো খিঁচুড়ি এবং সালাদের।

অন্যদল ভুনা গরুর গোশত। ঠিক হলো পাঁচটি গাড়ি সারি বেঁধে যাবে। ভালো জায়গা পেলে সেখানে থেমে ভুরিভোজন সারা হবে।

রওনা দিতে দিতেই দুপুর হয়ে গেলো। প্রায় সবারই একাধিক বাচ্চা-কাচ্চা। তাদেরকে সাজিয়ে গুজিয়ে, প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বেঁধে ঘর থেকে বের হতে সময় নিতান্ত কম লাগে না। দেরিতে বের হবার প্রধান অসুবিধা রাস্তায় গাড়ির ভিড় হয়ে যায়।

হাইওয়ে ৪০১ এ আমরা পাঁচটা গাড়ি নিয়ে যখন নামলাম তখন দেড়টা বাজে। সবার অগ্রভাগে আমি, শিলি ও জাকি। আমাদের ঠিক পেছনেই সীমা, তার স্বামী মাসুম ও তিন বাচ্চা। শিলির ছোটবোনের বান্ধবী সীমা। অসম্ভব ভারিক্কী

শরীর এবং ভয়ানক রসিক। তার ছেলে জনির সঙ্গে জাকির গলায় গলায় ভাব। দু’জনাই স্পাইডারম্যান বলতে অজ্ঞান।

তাদের পরের ভ্যানটি আলতাফ ভাইয়ের। স্ত্রী বিভা ও দুই ছেলে তার সঙ্গী। তাকে অনুসরণ করছেন নোমান ভাই, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে। সবশেষে বিলাল ভাই স্ত্রী রিমা ও দুই সন্তান নিয়ে তার কারে। আমাদের ছোট্ট কাফেলাটি রাস্তায় গাড়ীর ভিড় ঠেলে এগুতে থাকে নায়েগ্রাভিমুখে। আমরা সাথে নিয়েছি কিছু ø্যাকস, সীমা নিয়েছে খিঁচুড়ি, নোমান ভাইরা সালাদ, আলতাফ ভাইরা ভুনা গোশত এবং বিলাল ভাইরা থালা বাসন। আমার সকালে নাস্তা খাবার অভ্যাস নেই। পেটের মধ্যে ইতিমধ্যেই মোচড় অনুভব করছি।

টরোন্ট থেকে নায়েগ্রা ফল্স্ দেড়শ’ কিলোমিটার। হাইওয়ে ৪০১ ধরে গিয়ে ছঊড (ছঁববহ ঊষরুধনবঃয ঐরমযধিু) নিতে হয়। পরে ৪২০ ধরে নায়েগ্রা ফল্স্ শহরের অভ্যন্ত—রে চলে যাওয়া যায়। ছঊড তে ওঠা পর্যন্ত— সবাই একসাথেই ছিলাম। তারপরে কি হতে কি হয়ে গেলো, আমাদের কাফেলায় ভাঙ্গন ধরলো। শেষ পর্যন্ত— নায়েগ্রা ফলসে যখন পৌঁছালাম তখন আমরা, সীমারা এবং নোমান ভাইরা একত্র হতে পারলাম। আলতাফ ভাই এবং বিলাল ভাইয়ের কোন খবর নেই। তাদের দুজনার কারো কাছেই মোবাইল ফোন নেই। সুতরাং হাল হকিকত জানবারও কোন উপায় নেই।

দুপুর গড়িয়েছে বেশ আগেই। সন্দেহ নেই সকলেরই উদরে গুরূম গুরূম মেঘের নিনাদ চলছে। আমরা বিস্তর চিন্তা ভাবনা করে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের সামনে গিয়ে পার্ক করলাম। মনে কিঞ্চিৎ আশা, আলতাফ ভাই ও বিলাল ভাই হয়তো আমাদেরকে খুঁজতে খুঁজতে বুদ্ধি করে এখানে এসে হাজির হবেন। জলপ্রপাতের ঠিক শরীর ঘেষে নায়েগ্রা পার্কওয়ে।

পার্কওয়ে বরাবর উঁচু রেলিং ঘেরা প্রশস্ত পায়ে চলা পথ নায়েগ্রা রিভারকে অনুসরণ করে বেশ অনেকখানি চলে গেছে। এই পথের উপরেই পরপর দু’টি ভিজিটর সেন্টার। সেখানে খাবার-দাবার এবং সুভেনিরের দোকানের ভিড়। বাইরে সারি বেঁধে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। আমরা সেগুলিরই কয়েকটি দখল করে বসলাম। আমাদের উদগ্রীব দৃষ্টি স্বভাবতই রাস্তার উপরে। আমাদের ভুনা গোশত ও থালাবাসন এই পথেই আসবে।

আমার শালী বলতে শিলির দু’টি মামাতো বোন, যারা সুদুর ঢাকায় বসবাস করে। সীমা বয়েসে শিলির ছোট হওয়ায় এবং ছোটকালের বন্ধুত্বের সুত্রে সেই আমার শালীর ভুমিকা পালন করে থাকে। এই মুহুর্তে সে ভয়ানক বিরক্তি নিয়ে আমাকে ঝাড়ছে। – “ভাই, আপনেরে কত কইরা শিখাইয়া দিছিলাম একটু আস্তে আস্তে চালাইয়েন। আপনেরে কি এমনে এমনে

সামনে দিছিলাম। কিন্তু ফাঁকা রাস্তা দ্যাখলে আপনের কল-কব্জায় কি সমস্যাটা হয় কন দেহি? অহন কি খিঁচুড়ির হাড়িটা মাথায় নিয়া বইয়া থাকুম?”

আমি খুক খুক করে কাশি। ফ্রিওয়েতে উঠলে আমার পায়ে যে সামান্য চুলকানি হয় অস্বীকার করবার উপায় নেই।

আমি নিরীহ কন্ঠে বললাম, “চলো, আমরা না হয়, কোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেই”।

“রেস্টুরেন্টে-ই যদি খামু তাইলে একহাড়ি খিঁচুড়ি ক্যান রাইন্ধা আনছিলাম? আপনের গাঙ চিলরে খাওয়েনের জইন্য। আলতাফ ভাইয়ের গাড়ির সাইডে দুই সেকেন্ডের জইন্য খাড়াইছিলাম। আহারে গুশতোটা কি বাহারী গন্ধ যে

ছাড়তাছিলো। দিলেন তো সব মাটি কইরা। অহন হা কইরা নায়েগ্রার পানি পড়ন দেহি, আর করূম কি? পানিও পড়–ক, প্যাডের মধ্যে বোমও পড়–ক। ও মারূফার বাপ, খাড়াইয়া খাড়াইয়া আমার মুখ দ্যাহো ক্যান? যাও, খিঁচুড়ির হাড়িডা লইয়া আসো। ”

মারূফা তাদের বড় মেয়ে, বয়েস সাত। অতিশয় বুদ্ধিমতী। ছোট মেয়েটার নাম সুফিয়া, তিন ছুঁই ছুঁই। বাবার কোলে তার পাকাপোক্ত আসন। জনির পিঠাপিঠি হওয়ায় তাদের সম্পর্ক যথেষ্ট ছন্দময়। মাসুম ভাই ধর্মভীরু শান্ত— স্বভাবের মানুষ। তিনি সুফিয়াকে কোলে নিয়েই পার্কিং লটে ঢুকলেন খিঁচুড়ির হাড়ি আনতে।

আমি সীমার কটুক্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ছেলেমেয়েগুলিকে নিয়ে রেলিঙের কাছ ঘেষে দাঁড়ালাম। এখান থেকে মনে হয় হাত বাড়ালেই বুঝি জলপ্রপাতটিকে ছোঁয়া যাবে। ঘোড়ার খুরের মতো আকৃতি নিয়ে গড়ে ওঠা জলধারাটি ২০- ২২ মাইল প্রতি ঘন্ট গতিতে ছুটে এসে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ছে ১৭৩ ফুট নীচে জলধিতে। সেখানে বাষ্পের দরূন দৃষ্টি প্রায় চলেই না। চারদিকে প্রচুর গাঙচিল উড়ছে। নীচের পানিতে শুভ্র ফেনার রাশি কিলবিল করছে। একটি মাঝারি আকারের মানুষবাহী বোট বাষ্পের দেয়াল ছিন্ন করে ধীর গতিতে বেরিয়ে এলো অপেক্ষাকৃত স্বচছ পানিতে। এতো উঁচু থেকে সেটাকে খেলনা নৌকার মতো লাগে। আমি এবং শিলি একবার এই টুরটি নিয়েছিলাম। বোটের পাটাতনে দাঁড়িয়ে, শীতল জলের ঝাপ্টায় ভিজতে ভিজতে, গগনচুম্বী জলপ্রপাতটির প্রায় অদৃশ্য অবয়ব আর ভয়ানক গুরুগম্ভীর নিনাদের অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করে আমরা উদাত্ত ভাবে হেসে উঠেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।

কোথাও বেড়াতে যাবার আগে আমি চেষ্টা করি জায়গাটা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞানার্জন করতে। নায়েগ্রার উপরে অল্প বিস্তর পড়াশোনা করেছি, মস্তিস্কে সেই তথ্যভান্ডার সঞ্চিত থাকতে থাকতেই উদগীরণ করবার ব্যগ্রতা অনুভব করলাম। শিলি এবং সীমার কটাক্ষ দেখেই বুঝলাম সেখানে বিশেষ সুবিধা হবে না। নোমান ভাই তার স্ত্রী ও কন্যা দুটিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদূরে অবস্থিত রেইনবো ব্রীজের দিকে চলে গেছেন। এটি নায়েগ্রা নদীর উপর দিয়ে ওপারের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে।

শ্রোতা বলতে মারূফা, জাকি ও জনিই ভরসা। জাকি এবং জনির ভাবভঙ্গি সুবিধাজনক নয়। তারা দুই কোমরে হাত রেখে জলপ্রপাতটিকে ভস্ম করতে করতে বললো, “আমরা তো ওয়াটারফল দেখেছি। এখন কি করবো? ”

মোক্ষম প্রশ্ন। আমি বুদ্ধি করে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের নিকটেই অবস্থিত আমেরিকান জলপ্রপাতটির অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ অবয়ব নির্দেশ করে বললাম, “ঐ টা হচ্ছে  আমেরিকান ফল্স্। এটাতো তোমরা দেখনি।”

জাকির নির্বিকার উক্তি, “হ্যা দেখছি। ঐটা আরেকটা ফল্স্। অনেক ছোট।”

জনি প্রস্তাব দিলো, “জাকি আসো আমরা স্পাইডারম্যান – ব্যাটম্যান ফেলি। তুমি ব্যাটম্যান, আমি স্পাইডারম্যান।”

এই রূটিন আমার নখদর্পণে। এইবার তারা প্রথমে তর্কাতর্কি, পরে ধস্তাধস্তি এবং পরিশেষে চুল ছেঁড়াঁেছড়ি করবে। উভয়েরই স্পাইডারম্যান প্রীতি অধিক। তবে কোন এক মন্ত্রবলে শেষ পর্যন্ত তারা প্রতিবারই আপোষ মীমাংসা করে ফেলে। আমি তাদের এই রহস্যময় আনুষ্ঠানিকতায় নাক গলানো থেকে বিরত থাকি। আমি সাধারণ মানুষ, এই জাতীয় শক্তিমানদের সাথে গোলযোগে আগ্রহী নই।

আমি মারূফাকেই জ্ঞান দান করবার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু‘ দেখা গেলো তার তুলনায় নায়েগ্রা সমন্ধীয় জ্ঞান আমার নিতান্তই হাস্যকর। তার হাতে নাস্তানাবুদ হতে হলো। তবে জ্ঞানের পরিধি বাড়লো। জানা হলো, ১৮৪৮ সালে ২৯শে মার্চে নায়েগ্রা ফল্স্ শুকিয়ে গিয়েছিলো। লেক ইরির পানি নায়েগ্রা নদী বাহিত হয়ে লেক অন্টারিওতে এসে পড়ে। এক অযাচিত বাতাসের তোড়ে লেক ইরি থেকে বিশাল বরফের চাঙড় এসে নায়েগ্রা রিভারের মুখে বাধার সৃষ্টি করায় নায়েগ্রা জলপ্রপাতে পানির স্রোত এক রকম বন্ধই হয়ে যায়। পরবর্তিতে তাপমাত্রা বাড়লে বরফের চাঙড় গলে গিয়ে আবার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসে। প্রচন্ড শীতেও নায়েগ্রা জলপ্রপাত কখনো জমাটবদ্ধ হয় না। কিন্তু‘ আমেরিকান ফল্স্ ক্ষুদ্র বিধায় জানা মতে বার দুয়েক সম্পূর্ণ জমাট বেঁধেছে। এটি নায়েগ্রা জলপ্রপাতের মাত্র এক দশমাংশ।

হঠাৎ সীমার এবং শিলির তীক্ষè কন্ঠের চিৎকারে জ্ঞানের জগত থেকে শক্তিমানদের জগতে প্রবেশ করি। জাকি এবং জনি উভয়েই তাদের শার্ট প্যান্ট খুলে ফেলছে। দু’জনেরই শরীর আবৃত করে আছে স্পাইডারম্যানের বাহারী পোশাক। তারা পরষ্পরকে ধাওয়া পালটা ধাওয়া করছে। বেশ কিছু রসিক ট্যুরিস্ট ভিড় করে তাদের খেলা দেখছে। আমি প্রমাদ গুনলাম।

কিঞ্চিৎ ক্ষুদ্রতা এবং রূষ্টতা প্রদর্শনের পরে তাদেরকে জামাকাপড় পরিয়ে বগলদাবা করে তাদের মাতৃদেবীদের কাছে দিয়ে এলাম। সেখানে মৌখিকভাবে তাদেরকে যথেষ্ট উৎপীড়নের সম্মুখীন হতে হলো। দু’জনার কাউকেই অবশ্য এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হলো না। ছাড়া পাবার মুহুর্তের মধ্যেই জামা কাপড় খসিয়ে তারা পুনরায় স্পাইডারম্যানের পোশাকে

ফিরে গেলো।

মাসুম ভাই এই কাণ্ড দেখে খুবই নাখোশ হলেও সীমা উদার কন্ঠে বললো – “থাউগ গিয়া। দুইডা কংকাল চামড়ার মইধ্যে সাইট্যা থাকা লাল নীল ড্রেস পইরা একডু স ুই সু—ই আর যাডাং যাডাং করলে আর কি অইবো। কর, ভালো কইর‌্যা কর। তয় পানির মইধ্যে ফাল দিয়া পড়িস না। দুইশ ফুট নীচে পড়লে হাড্ডিগুলা কিমা অইবো। এই বেয়াক্কলের দল, শুনছসনি আমার কথা? ”

নোমান ভাইরা ক্লান্ত— ভঙ্গিতে ফিরে এলেন। তাদের মুখভাবেই বোঝা গেলো উদরে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। নোমান ভাই একটি ম্যাকডোনাল্ডসের ম্যানেজার। তিনি চারদিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ খোঁজাখুজি করে বললেন – “শুধু খিঁচুড়িতো খাওয়া যাবে না। আশে পাশে কোথাও ম্যাকডোনাল্ডস্ থাকলে খাওয়া যেতো। আমার কাছে অনেক কুপন আছে।”

তার মেয়ে দুটি সমস্বরে বললো – “হ্যাঁ, বাবা, কিড্স্ মিল (করফং সবধষ) নিলে একটি করে টয় (ঞড়ু) পাওয়া যায়।”

সীমা টাটিয়ে উঠলো – “হ, এই ধুমসীরে আপনেগো ক্যালরি বোম্ খাওয়াইয়া জীবনটা শ্যাষ করেন। আপনেগো ধইরা জেলে ঢুকানো দরকার। ফিরি কুপন দিয়া আমগো শিশুর মতো মনডারে লইয়া খ্যালা করেন, লজ্জা করে না? ”

সীমা কাশলেও মানুষ হাসে। চারদিকে হাসির রোল উঠলো। অন্যান্য কিছু বাংলাদেশী যারা আমাদের আশেপাশে ছিলেন তারাও দেখলাম সেই হাসিতে যোগ দিলেন। লক্ষণ খারাপ। একবার বাজার পেলে সীমার জিহ্বার ধার বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সে এইবার আমাকে নিয়ে পড়লো। – “ভাই, আমগো ভুনা গোশ্ত্ তো আপনের কৃপায় নায়েগ্রার পথে পথে ঘুরতাছে, আহেন আমরা হাফুস হুফুস কইরা চাইল – ডাইলের মিক্সারটারেই সাইট্যা দেই। ”

প্রস্তাবটা আদৌ গ্রহনযোগ্য নয়। চারদিকে শত শত টুরিস্ট-এর ভিড়। তার মাঝে হাড়ি থেকে সবাই মিলে খেলে জাত-ধর্ম সবকুলই যাবে।

“কি ভাই, এমন চিন্ত—ায় পইড়া গ্যালেন ক্যান? জোক করতাছি। একটু ঠাট্টা মশকরাও বুঝেন না। মারূফার বাপ যাও খিঁচুড়ির হাড়িটা রাইখ্যা আসো।”

মাসুম ভাই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খিঁচুড়ির হাড়ি নিয়ে গাড়িতে গেলেন। তিনি ফিরে আসতে আমরা একটি রেস্টুরেন্টেই ঢুকলাম। অনেকগুলি টাকার শ্রাদ্ধ হলো। একেতো খাবারের মূল্য টুরিস্ট এলাকা বিধায় বেশি, তারপরে রয়েছে ট্যাক্সের অত্যাচার।

পেটপুজা হতে সকলের ব্যবহার কিঞ্চিৎ নমনীয় হয়ে এলো। জলপ্রপাতকে সামনে রেখে কংক্রিটের উপরেই বসে পড়লাম আমরা, বড়দের হাতে কফি অথবা চা। আমাদের অস্থিসার স্পাইডারম্যান দু‘জনের পেটে কিঞ্চিৎ খাদ্য পড়ায় তাদের চঞ্চলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের দিকে এক চোখ রেখে আমি আমার স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিলাম।

ইচ্ছা, মারূফা মুখ খুলবার আগেই নায়েগ্রা সম্বন্ধে দু একটি চমৎকার তথ্য দিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়া।

নায়েগ্রা নদীর তীরে বসবাসকারী উপজাতীয়দের মধ্যে একটি ছিলো ঙহমঁরধধযৎধ (অনগুইয়াহ্রা), ধারণা করা হয় সেখান থেকেই নায়েগ্রা নামটির উৎপত্তি। অনগুইয়াহ্রা শব্দটির অর্থ জলীয় বজ্র। নায়েগ্রা জলপ্রপাত প্রতি বছর প্রায় এক ফুট করে ক্ষয়ে চলেছে। চেষ্টা চলছে বিভিন’ ধরণের পন্থা খাটিয়ে এই ক্ষয়কে প্রতি দশ বছরে এক ফুটে কমিয়ে আনতে। সেই তুলনায় আমেরিকান জলপ্রপাতটির ক্ষয় মাত্র তিন-চার ইঞ্চি প্রতি দশ বছরে। এর অর্থ কয়েক সহস্র বছর আগে এই জলপ্রপাতগুলির অবস্থান ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায়। আমার ভান্ডারে আরো কিছু তথ্য ছিলো, কিন্তু‘ মারূফার ক্রমাগত ব্যাঘাতে বাধ্য হয়ে থামতে হলো। বোঝা গেলো সেও ইতিমধ্যেই ইন্টারনেট সার্চে পটু হয়ে উঠেছে।

সীমা মুচকি হেসে বললো, “আমার কচি মাইয়াডার হাতে ভালোই জব্দ হইছেন। হের পাল্লায় তো পড়েন নাই। চবিূশ ঘণ্টা বকবক কইরা আমারে জ্ঞানের সাগরে নাকানি চুবানি খাওয়াইতেছে।”

বিশাল হাসির রোল উঠলো। সেই শব্দ স্তিমিত হতে শিলির টিপ্পনি কানে এলো – “সবজান্ত—া ভালো জব্দ হয়েছে।

সারাক্ষণ জ্ঞানের কথা শুনাচ্ছে।”

আমি রণে ভঙ্গ দিয়ে ক্ষুদে স্পাইডারম্যানদের পিছু নিলাম। মারূফাকে নিয়ে সমস্যা হবে মনে হচ্ছে । আমার জ্ঞানের তরী ভরাডুবি হবার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। উদ্বিগ্নতা অনুভব করছি।

চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে উভয় তীর থেকে জলপ্রপাত দুটির উপরে বাহারী আলো ফেলে বেশ একটা স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো। গ্রীষ্মে প্রতি শুক্রবারে শুনেছি ফায়ার ওয়ার্কস হয়ে থাকে। নিজে কখনো দেখিনি।

রাত প্রায় ন‘টা পর্যন্ত কাটিয়েও যখন হারানো পথিকদের কোন হদিস মিললো না তখন আমরা পাততাড়ি গোটানোর সিদ্ধান্ত— নিলাম। গাড়িতে উঠতেই আমাদের মহাবীরেরা নেতিয়ে পড়লেন ঘুমের অতল কোলে। শান্তি—! তাদের বকবকানির চোটে জীবনটা অতিষ্ট হচ্ছিলো ।

স্বভাবমতই ফিরতি পথে ডানে বায়ে করে ছঊড তে উঠবার পথটা সম্পূর্ণ গুলিয়ে কোন এক অজানা রাস্তায় গিয়ে হাজির হলাম। শিলির গঞ্জনায় কর্ণপাত না করে প্রচুর বুদ্ধিমত্তা ও সহিষ্ণুতার অপব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত যখন হাইওয়েতে উঠলাম ততক্ষণে আধঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। মাসুম ভাই ও নোমান ভাইরা অনেক এগিয়ে গেছেন। বাসায় ঢুকতেই আনসারিং মেশিন বিপ বিপ ধ্বনিতে জানিয়ে দিলো মেসেজের উপস্থিতি। সীমা ছাড়া আর কেউ নয়। “শিলি আপা, ভাই কি আবার পথ হারাইলো? এই মানুষটার সমস্যা কি? বেশি কইরা হাড্ডি গুড্ডি খাওয়াইয়েন। মাথার মইধ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব হইছে মনে হয়। আবার হাড্ডি খাইতে গিয়া দাঁত ভাইঙ্গা না ফালায়। মুসিবতের উপরে মুসিবত হইবো। কল দিয়েন –”

শিলি কলকলিয়ে হেসে উঠলো। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম, দিন কাল ভালো যাচ্ছে না।