অপ্রত্যাশিত

শিরীন আহমেদ

“মম, আমি ফিরে এসেছি। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।” এলিচ ঘরে ঢুকেই তার মা’কে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বললো। মা পাপিয়া কিছুই বললেন না, শুধু মেয়ের মাথার তালুতে হাত বুলাতে লাগলেন। হাত বুলাতে বুলাতে তার বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলেন। সেখানে এলিচ খুঁজে পেলে একটা ভরাট ভালোবাসা। সে ধরেই নিল তার মম খুব খুশি হয়েছে। তবুও মা’র মুখ থেকে শুনবে বলে জিজ্ঞাসা করলো, “মম, তুমি খুশি হওনি?” একথা শুনেই মা’র চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো।

“ক্ষুধা পেয়েছে, চলোনা, কিছু খেতে দিবে,” বলে এলিচ নিজ রুমের দিকে পা বাড়ালো। কাজের বুয়াটা বাথরুমে, এখনও বের হওয়ার নামগন্ধ নেই। পাপিয়া আস্তে আস্তে ডাইনিং রুমে এসে টেবিলে খাবার রেডি করতে লাগলেন। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করেছেন গরম করবে বলে। গত সপ্তাহে ওভেনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এখনও ঠিক হয়নি। এলিচ ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললো, “মম, আমি আসছি। তুমি কিন্তু একদম চুলার কাছে যাবে না।” মা তবুও চুলা ধরাতে গেলেন। মেয়ে সোজা কিচেনে গিয়ে মা’র হাত থেকে মাংসের পাত্রটি নিজ হাতে নিয়ে বললো, “যদি তোমার কিছু হয়! আমাকে দাও।” এলিচের কথা বলার ভাবখানি এমন যেন এলিচ হচ্ছে মা আর পাপিয়া তার বাচ্চা। মাংস গরম করে ডাইনিং টেবিলে রাখতে রাখতে বললো, “মম, তুমিও আসো না, এক সঙ্গে খাবো।” মা চলে আসলেন, এসেই মেয়ের সাথে খেতে বসে গেলেন। এলিচ খেয়াল করলো, সে আকস্মিক ফিরে এসেছে। সেটাতে তার মা’র বিন্দু মাত্র পরিবর্তন নেই। মা খাচ্ছেন, মা’র দিকে তাকিয়েই রইলো। দেখছে ওর মা কি সুন্দর করে নাইফ ধরেছে। ফর্কটা কি সুন্দর করে ধরে এক এক টুকরো খাবার মুখের ভিতর দিচেছন, কোন ভুল হচ্ছে না। এলিচের মাঝে মাঝে ভুল হলেও, মা’র কোন দিনও ভুল হয় না। এলিচ ভাবছে, এই মাকে কে বলবে পাগল, তার মা তো ভাল মা, লক্ষ্মী মা। অন্য দশ জনের মা’র থেকে তার মা অনেক ভাল। তার মনের ভিতর প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো, আসলেই কি তার মা পাগল? এসব ভাবতে ভাবতে এলিচের খাওয়া শেষ হল। খাওয়া শেষে এলিচ তার রুমে, আর মা-তার লাইব্রেরী রুমে চলে গেলেন। এলিচ তার রুমে গিয়ে পড়াশোনা না করে ভাবতে লাগলো তার মা’তো অন্যান্য দিনের মতই আছে। তাহলে এই প্ল্যান করে কোন লাভ হল না। বাবা বাড়ীতে আসলে সে নতুন কোন প্ল্যান করতে বলবে। তবে কি বলবে, কি বললে বা কি ঘটলে এলিচের মা ঠিক আগের মত হয়ে যাবে।

এলিচ ক্লাস এইটে পড়ে। যদিও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তবুও সে প্রায় সব সময় বাংলাতেই কথা বলে। তারপরও সে অনেক সুন্দর ইংলিশ বলে। পড়াশুনায়ও অনেক ভাল। বয়স তার ১৩। বয়সের  তুলনায় গ্রোথটা একটু বেশি, সেটা শুধু শারিরীক নয়, মানসিকও। বাবা ড. সাবিদ রেহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শুধু তাই নয়, দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ। মাসে দুই তিন বার তাকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা যায়। বড় ব্যস্ত মানুষ। বেশ সাদা সিদে, বড় মনের মানুষ। বাবা মেয়ের মধ্যে খুব ভাব। মেয়ের ধারনা তার বাবা সমাজের একজন আদর্শ মানুষ। সবার উচিত তার বাবাকে অনুসরণ করা। বাবাকে সে খুব ভালবাসে। বাবার প্রতি এত ভালবাসার পিছনে আরও একটি কারণ আছে, সেটা হল মা পাঁচ বছর ধরে পাগল, তবুও তাকে  নিয়েই সংসার করে যাচ্ছে, কোন আফসোস নেই। মা পাপিয়া রেহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে অনার্স সহ এম,এ, পাশ। আগে ইউএনডিপিতে কাজ করতেন। বর্তমানে কিছু করেন না। তার মানসিক সমস্যার কারণে বাসাতেই থাকেন। নিজের করা ঘরোয়া একটি লাইব্রেরী আছে। সেই লাইব্রেরীতে সর্বদা সময় কাটান। স্বামী মি. রেহমানের কাজ প্রতি মাসে কিছু না কিছু  নতুন বই এনে ঐ লাইব্রেরীতে জমা করা। নতুন নতুন বই পেলে পাপিয়ার সময়টা দারুন কাটে। এলিচ জানে তার মমের মানসিক সমস্যার কথা। তবুও সে তার মাকে খুব ভালবাসে। তার মমের সাথে বেশি বেশি কথা বলে, গল্প করতে চায়। কিন্তু মমের দিক থেকে তেমন কোন সাড়া না পেয়ে খুব মন খারাপ করে, একা একা রুমে বসে কাঁদেও। তবে বাবা মি. রেহমান মেয়ের সাথে এতটাই গল্প করেন যে, এলিচের সে কষ্ট কোথায় পালিয়ে যায়। শত ব্যস্ততার ভিতর স্ত্রী কন্যার সাথে তিনি অলস সময় কাটাতে খুব পছন্দ করেন। পরিবারের লোক বলতে এই তিন জন। কাজের বুয়া আছে। সে দিনের প্রথম ভাগে এসে শেষ ভাগ পর্যন্ত কাজ গুছিয়ে রেখে তার বাড়ীতে চলে যায়। মি. রেহমানের নিজস্ব এক খন্ড জমি আছে তার বাসার পাশেই। আপাতত ঘর করার ইচ্ছা নেই, সেখানেই কাজের বুয়া কোন রকম একটা কুঁড়ে ঘর করে তার পরিবার নিয়ে থাকে। বুয়া তাদের খুবই বিশ্বস্ত লোক।

এলিচের বাবা মি.  রেহমান যখন আমেরিকাতে পি,এইচ,ডি করতেন তখনই এলিচের জন্ম। জন্মসূত্রে এলিচ ঐ দেশেরই নাগরিক। বাবার পি এইচ ডি করা হয়ে গেলে বাবা মা’র সাথে দেশে চলে এসেছে। এই মুহুর্তে এলিচের কোন ইচ্ছাই নেই অ্যামেরিকাতে গিয়ে থাকার। তার ইচ্ছা দেশে বাবা মা’র কাছে থেকেই পড়াশোনা করবে। যদি কখনও অ্যামেরিকায় যেতে হয়, বড় হবার পরেই যাবে। মি. রেহমান মেয়ের মতেই মত। মা পাপিয়ার মানসিক সমস্যা আছে, মানসিক সমস্যা বলতে তিনি সব সময় ঘরের ভিতর থাকতে চান, ঘর থেকে বের হতে চান না। বেশি একটা  হাসেন না, আবার কাঁদেনও না। সব সময় চুপচাপ থাকতে ভালবাসেন। নিজের কাজ নিজে করেন। কাউকে কোন কাজে হুকুম করেন না। নিজের লাইব্রেরীটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখেন। নিজের রুমের কোন জিনিস অগোছালো রাখেন না। কখনও নোংরা কথা বলেন না। সমস্যা একটাই সব সময় চুপচাপ থাকেন। মা’র এই সমস্যাটা এলিচকে খুব ভাবায়। এলিচ তার বাবার কাছে গল্প শুনেছে তার মম কখনও এরকম ছিলেন না। কেন এ রকম হল তার জবাবে বাবা বলেছেন হঠাৎ  একদিন  ওরকম হয়ে গিয়েছে। মা’র এই চুপচাপ স্বভাবটা এলিচ দূর করতে চায়, তাই বাবার সাথে গত রাতে প্ল্যান করেছিল এলিচ অ্যামেরিকাতে চলে যেতে চাইবে। তারপর বাধ্য হয়ে মি.  রেহমান প্লেনের টিকিট কাটবে। এলিচ চলে যাবে বলতেই মা পাপিয়াকে হয়ত কিছুটা হলেও নাড়া দিবে। হয়ত অনেক অনুরোধ করবে না যাওয়ার জন্য। হয়ত যেতেই দিবে না, আটকাবে। কিন্তু সকালে যখন এলিচ রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মা পাপিয়া সে রকমই চুপচাপ ছিলেন। মেয়েকে লক্ষ্য করে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, “ভাল থেকো।” তার এই মিথ্যা অভিনয়ের পরে যখন ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলো তিনি খুশি হয়েছেন কি না? পাপিয়া সেই চুপচাপ থেকেই উত্তর দিয়েছেন, তিনি খুশি হয়েছেন। কিন্তু এলিচ এরকমটা চায়নি। সে চেয়েছিল তার মম আনন্দে চিৎকার করে বলবে “আমি খুব খুশি।” আনন্দে চিৎকার করে রুম মাতিয়ে রাখবেন। কিন্তু তা সব কিচছুটি হল না। মি. রেহমান ইচ্ছা করেই দেরী করে ফিরলেন যেন মেয়ের আবেগ প্রবণ অভিনয়তে তিনি যেন কোন বাধা হয়ে না দাঁড়ান। কিন্তু কোন কিছুতে কিছুই হল না। মা পাপিয়া সেই  একই ভাবে চুপচাপ রয়ে গেলেন।

বিকেল পড়লেই এলিচের বাবা মি. রেহমান বাসায় আসলেন। এসে দেখলেন স্ত্রী পাপিয়া ঘুমুচ্ছে। সোজা মেয়ের রুমে চলে গেলেন। যেয়ে দেখেন মেয়ে পড়ছে। মেয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে সামনের দিক মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “এই মা, কি কোন পরিবর্তন দেখলে?”

              -“না বাবা, যে মম সেই মমই রয়ে গেল,” এলিচ মুখে খানিকটা হাতাশা নিয়ে বললো।

              -“আমার মনে হয়  তোমার মম সত্যি সত্যি আর আগের মত হবে না।” মি. রেহমানের চোখে জল এসে গেল। এলিচ বাবার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, “ বাবা, তুমি মোটেই চিন্তা করো না তো। আমার মনে হয় আমার মম পাগল নয়। রাস্তায় কত পাগলকে দেখি। এই তো আজও গাড়ীর ভিতর থেকে তোমাকে একটা পাগলকে দেখালাম। ওরা কেমন বিশ্রী। অথচ আমার মম! কত লক্ষী। বাজে কথা বলে না, সারাক্ষণ বই পড়ে, কোন পার্টিতে যাওয়ার সময় আমাকে কত সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। তুমি খেয়াল করেছো, বাবা?”

মি. রেহমান মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর করলো, “আমি সব জানি, কিন্তু ……”

– কিন্তু কি বাবা? থামলে কেন? বল না।

-আমি তো সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় থেকে তোমার মমকে চিনি। তোমার মম ওরকম চুপচাপ স্বভাবের কখনো ছিল না। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তোমার মম কতই না চটপটে ছিল। তুমি যদি সে ছবির অ্যালবাম আর সেই ভিডিও ডিস্ক গুলো দেখো, আমি নিশ্চিত তুমি অবাক বনে যাবে। তুমি ভাবতেই পারবে না।” বাবার এ ধরণের কথা শোনার পর এলিচের কৌতূহল বেড়ে গেল। সে দেখবে তার সেই চঞ্চল মাকে, বায়না ধরলো। মি.  রেহমান একটু চিন্তিত ভাবে বললেন, “কিন্তু তোমার মম তো সেগুলো দেখতে চায় না। কাউকে দেখাতেও চায় না। শুধু নিজে নিজে দেখে। আর সেগুলো তোমার মমের ড্রয়ারে।”

-“বাবা, মম একটু আগে ঘুমালো। ঘুম ভাঙতে অনেকক্ষণ লাগবে, আমি দেখব।” বলেই এলিচ তার মায়ের ড্রয়ার  খুলে সব অ্যালবাম আর ভিডিও ডিস্ক বের করে আনল। প্রথমে কম্পিউটারে সেই ডিস্ক থেকে সবকিছু কপি করে রাখলো। তারপর ছবির অ্যালবাম দেখতে লাগলো। সে সত্যিই অবাক বনে গেল। তার মম কতই না আধুনিক ছিল সেই সময়। কি অদ্ভূত সুন্দর প্রত্যেকটি ছবি। কত সুন্দর করে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছে তার বাবার সাথে। ক্যাম্পাসে আড্ডা দিচ্ছে। ছবিতে সবাই চুপচাপ শুধু তার মম’ই দুই হাত উঁচু করে চিৎকার করছে। এলিচ এক এক করে সব ছবিগুলো দেখতে লাগলো। একটা ছবিতে পাপিয়া মি. রেহমানের কান মলে দিচ্ছেন। এই ছবিটি দেখে এলিচ খুব মজা পেল। সে তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা কিউট হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি বাবা, তোমার খুব লেগেছিল বুঝি?” মি. রেহমান ছবির দিকে তাকিয়ে সেই সময়ে চলে গেলেন। তিনি যেন ঠিক সেই অনুভূতিটা এখনও পাচ্ছিলেন। মেয়ের প্রশ্নের জবাবে তিনি হতচকিত হয়ে নিজ কানে হাত দিয়ে অভিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, “এখনও লাগে।” আর একটা ছবিতে বাবা আর মা পিঠে পিঠ লাগিয়ে অন্য দিক ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি ছবি দেখছে আর ভাবছে তার মম কতইনা সুন্দর, কতই না কিউট! এলিচ এই ছবির মমকে চাই। এই চুপচাপ মমকে না। অ্যামেরিকাতে তোলা ছবিগুলো দেখে এলিচের চোখে জল এসে গেল। লেক মিশিগানের ধারে এক বছর বয়সী এলিচকে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে পোজ দিয়েছেন। মেয়েকে দু’হাতে নিয়ে উঁচু করে আকাশের দিকে  তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মি. রেহমান বললেন, “এই যে, ছবিটা দেখছো। তোমাকে আকাশের দিকে তুলে ধরে দাড়িয়ে আছে। ঐ সময় তোমার মম কি বলেছিল জানো?”

-কী?

-বলেছিল আমাদের এলিচ সোনাকে মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিলাম। আমি চাইনা মেয়ে বলে তার ভিতর কোন জড়তা থাকুক। আমি চাই আকাশের বিশালতা তার মাঝে স্থান পাক।

এলিচ অবাক হয়ে বাবার কথা শুনছিলো, আবার ছবির দিকে মনোযোগ দিল। কতই না সুন্দর তার মম আকাশী রঙের শাড়ীতে, গোলাপী রঙের শাড়ীতে। কি সুন্দর ভাবে দাড়িয়ে আছে নীল রঙের শাড়ী পরে লেক মিশিগানের নীলাভ জল ধারার পাশের বড় একটি পাথরের উপর খালি পায়ে। মমের চুল গুলো ধমকা হাওয়াই উড়ছে। এলিচ আনমনে ছবির সে চুলগুলোর উপর হাত বুলিয়ে দিল। এলিচ তার সেই ছোট বেলার জীবনটাকে খুব মিস্ করতে লাগলো। তার মম তখন লক্ষ্মী মম ছিল কেন এমন হল। সে আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ডুকরে বলে উঠলো, “প্লিজ বাবা, তুমি আমাকে আমার সেই ছোট বেলার মমকে ফিরিয়ে দাও। আমি আর কিছুই চাই না তোমার কাছে।” মেয়ের এ ধরনের আবদারে মি. রেহমানের ভিতরের কষ্টটা আরও জীবন্ত হয়ে উঠলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “মামনি, তুমিতো ছোট ছিলে, কিছুই বুঝতে না। আর আমি? তোমার মমকে বিয়ের ৫ বছর আগে থেকেই চিনতাম। একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তারপর প্রেম করেছি। তারপর বিয়ে। কেন যে ওরকম হল। আমার ভেতরটা পুড়ে শূন্য হতে বসেছে। আমি তোমার মমের চুপচাপ থাকাটা মানতে পারি না; কিছুতেই না।” বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। প্রায় দশ মিনিট পর মি. রেহমান চোখ মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “মামনি, যাও তুমি ওগুলো যেখানে ছিল সেখানে রেখে আসো, নইলে তোমার মম ঘুম থেকে উঠে দেখলে কষ্ট পাবে।”

-আচ্ছা, বাবা, এগুলো এখানে থাকুক না, দেখি মম কি করে।

-“না, না, কিছুতেই ওরকমটা করবে না। সেটাতে যদি তোমার মমের আরও বেশি সমস্যা হয়।” কথাটি উনি খুব ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এমন ভাবে বললেন যেন এ রকম কোন একটা কারণেই পাপিয়া আজ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এলিচ কোন কিছু দ্বিতীয়বার না ভেবে মা’র ড্রয়ারে সেগুলো রেখে আসলো। মি. রেহমান তাদের বেডরুমে যাবেন এমন সময় মেয়ে বলে উঠলো, “বাবা, মমকে একজন বড় ডাক্তার দেখালে কেমন হয়।”

-অনেক দিন চেষ্টা করেছি, লাভ হয় নি।

-“কেন?” এলিচ অবাক ভাবে জানতে চায়।

-ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো শুনলে তোমার মম আরও বেশী চুপচাপ হয়ে বসে থাকে। রেডি হয় না বাইরে যাওয়ার জন্য। জোর করতে পারি না, যদি তার মনের অবস্থা আরও বেশী খারাপ হয়।

-আচ্ছা, কোন বড় ডাক্তারকে তো বাসায় এনে দেখানো যেতে পারে?

-সেটাও করার চেষ্টা করেছি। তোমার মম কিছুতেই সেই ডাক্তারের সামনে আসেনি। বরং ডাক্তারকে দেখে তোমার মম আতংকে চিৎকার করতে থাকত।

এলিচ চিন্তায় পড়ে গেল। তার মমকে সে কিভাবে আগের মত করবে। এরই মধ্যে সে কম্পিউটারে কপি করে রাখা ভিডিও দেখতে ভুলে গেল। সেগুলো ওপেন করতে করতে বললো, “বাবা, তুমিও আসো না! এক সাথে দেখি।”

-আমার ওগুলো দেখলে খুব কষ্ট হয়, থাকতে পারি না; নিজেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়।

-ছি বাবা! ওরকম বলে না। তুমি কি এর জন্য দায়ী নাকি। মমতো হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। দেখবে হঠাৎ একদিন আবার ঠিক হয়ে উঠেছে। মেয়ের কথা শুধু শুনলেন, কোন উত্তর দিলেন না, এর উত্তর যে মি. রেহমানের জানা নেই।

মি.  রেহমান ক¤িপউটারের স্ক্রিনে চোখ রাখলেন, সাথে সাথেই সে চোখ ভর্তি জল এসে গেল। চোখের জলতো চোখে থাকতে চায় না, গড়িয়ে পড়তে চায়। মেয়ে এলিচকে একটু বলে বলে দিবে কোথায় এই ভিডিওটি করা। সেটুকুও বলতে পারলেন না, একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার মাঝখানটিতে এমন ভাবে আটকে গেল যে, তিনি একটা শব্দ পর্যন্ত  উচ্চারণ করতে পারলেন না; নীরবে কাঁদলেন। এলিচ ভিডিওটি দেখতে দেখতে বললো, “বাবা মম হাতে ঘুড়ি নিয়ে ছুটছে কেন?”

মি. রেহমান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চেপে আসা কন্ঠে বললেন, “এটা কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে করা। তোমার মম আর আমি বিকেলে সমুদ্র সৈকতে হাটতে বেরিয়েছি, দেখি ১০-১২ বছরের ছেলে মেয়েরা, ঐ তো ঐ দ্যাখো, ওই সব বাচ্চারা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। তোমার মম বায়না ধরলো। তাকেও একটি ঘুড়ি কিনে দেওয়া হল; সত্যিই তোমার মম চমৎকার ঘুড়ি উড়ায়। সবার চেয়ে উপরে উঠলো তোমার মমেরটা, হঠাৎ একটু নিচুতে নেমে আসতে চায়ছে। সেই তোমর মম ছুটতে শুরু করলো। দেখো দেখো শাড়ী পরে তোমার মম বাচ্চা ছেলের মত কত দ্রুত ছুটছে; তোমার মমের এ খুশির মুহুর্ত আমি তখনই ভিডিও করে রেখেছিলাম। জানো আমি খুব মজা পাচ্ছিলাম। তোমার মমের এসব কান্ড আমি খুব উপভোগ করেছিলাম।”

এলিচ বুঝতে পারছে তার বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে এসব ভিডিও দেখে। তাই সে আর তার বাবাকে দেখাতে চায় না। ক¤িপউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বাবাকে বললো, “যাও বাবা, তুমি একটু রেস্ট নাও। আমি বরং একাই দেখি।” মি.  রেহমানের সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। বাধ্য হয়েই দেখছিল। মেয়ের কথা শুনে তিনি বেডরুমে চলে আসলেন। এসেই দেখলেন তার সেই চাঞ্চল্য বউ চুপটি করে পাশ বালিশটি জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। খুব মিস্ করতে লাগলো তার সেই ডানপিটে বউকে। চুপচাপ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তার পাশেই বসে রইলেন। পাপিয়ার ঘুমন্ত মুখখানাটিতে তিনি খুজতে লাগলেন তার অতীতকে। হঠাৎ পুরাতন একটা নেশার উদ্রেক হল তার ভিতর। অনেকদিন এ রকম হয়নি,মেয়ের সাথে ওইসব ছবি, ভিডিও দেখেই মনে হয় ওরকম হচ্ছে। মনে পড়তে লাগলো তার প্রথম জীবনের সকল স্মৃতি, প্রথম পাপিয়াকে পাওয়া! কতইনা মধুর সে সব স্মৃতি! কি চঞ্চলই না ছিল মেয়েটি। মি.  রেহমানকে কখনো স্থির থাকতে দিত না। মেয়েকে তো আর বলা যায় না তার মায়ের সকল চাঞ্চল্য স্বভাবের কথা। সে রাতের কথা, তার মম যে তার বাবার জীবনটাকে কতটা কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছে, এমন ভাবে পরিপূর্ণ এ জীবন, যে গত ৫ বছরপরেও কোন কিছুর অভাব দেখা যায়নি। সে রকম পরিপূর্ণ ভাবেই আছে। পাপিয়া হঠাৎ ঘুমের ভিতর নড়ে উঠলেন। নড়েচড়ে পাশ বালিশটাকে আরও শক্ত করে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। মি. রেহমানের ভিতর পুরাতন সে নেশা আবার জেগে উঠতে শুরু করলো, মাংশাসী প্রাণী যদি তৃণভোজী হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ আবার কোন দিন মাংসের ডিস সামনে পায় তখন তার যে অবস্থাটা হয়। মি. রেহমানের তেমন অবস্থা হল। তার পাপিয়ার ওষ্ঠ দেখে কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলেন না। সেই গোলাপী ওষ্ঠে আলতো আদর করে দিলেন। চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। আলতো ভাবে আদর করে যেন হচ্ছেনা। তাই আরও একটু শক্ত করে পাপিয়ার ঠোঁট দু’টি তুলে নিলেন নিজ মুখের ভিতর। মিনিট খানেক এরকমটা করার পর পাপিয়া জড়িয়ে ধরলেন তাকে শক্ত করে। মি. রেহমান ভাবলেন তার স্ত্রী তো সেই আগের মতই করছে। তার মানে সে ভালো হয়ে গিয়েছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনাও করলেন, তাই যেন হয়। কিন্তু না,  ১০ মিনিট এভাবে থাকার পর  যেই চোখ মেলে দেখলো তাকে সেই দ্রুত ছেড়ে দিলেন। তারপর পাশ বালিশটাকে জড়িয়ে ধরে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে রইলেন। মি. রেহমান বললেন, “পিয়া, প্লিজ তুমি আর একটি বার আমাকে তোমার বুকে নাও। আমি কথা দিচ্ছি সব কষ্ট চলে যাবে।” পাপিয়া কোন কথা বললেন না; চুপচাপ শুয়ে রইলেন। মি. রেহমানের একবার মনে হল তার অধিকার সে কাটায় কাটায় আদায় করে নিবেন, জোর করেই নিবেন। তার মনে হল এক্ষুণি দরজার ছিটকিনি দিয়ে এই অবর বিকেলটিতে তিনি আবার একুশ বছরের যুবকের মত তার স্ত্রীকে নিয়ে সুখ খেলা করবেন, যে খেলার শেষে কোন প্রেমিক শুধু তার প্রেমিকার বক্ষস্থলের উপর পড়ে থাকে। তার আর ধৈর্যশীল হতে মন চাইল না। তার বার বারই মনে হতে লাগলো, কেন তার পিয়া অষ্টাদশী যুবতীর মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না আজ; তিনি তো তাকে কথা দিয়েছিলেন বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তার উপর অষ্টাদশী যুবতীর মতই ঝাঁপিয়ে পড়বেন, নির্লজ্জের মত। পাপিয়া তার দেওয়া কথা যে রাখতে ভুলে গিয়েছেন, কারণ মি. রেহমানও তো তার দেওয়া কথা রাখেন নি। তাইতো আজ তাকে তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে। তারই ভুলের কারণে আজ পাপিয়ার এ অবস্থা। তাছাড়া, যদি জোর করে কিছু আদায় করতে গিয়ে সব কিছু হারাতে হয়। দরকার কি? তার চেয়ে ওই চুপচাপ ঘুমন্ত মুখ খানার উপর মাঝে মাঝে এ রকম নীল চুম্বন দিয়েও একটা শান্তি আছে।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মি. রেহমান মেয়ে এলিচের রুমে গেলেন, সে কি করছে দেখার জন্য। মেয়ের পিছনে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “মা মনি কি করো?”

-“একটি বিষয় নিয়ে ভাবছি।” মেয়ে চিন্তিত ভাবে উত্তর দিল।

-কি ভাবছো?

-আচ্ছা বাবা, এমন যদি হয় কোন ডাক্তারকে ছদ্মবেশী ভাবে বাড়ীতে আনা হয় তাহলে কেমন হবে।

মেয়ের এ কথা শুনে মি.  রেহমান  অবাক হলেন। মেয়েটি তার মা’র বিষয়টি নিয়ে সেই থেকে ভেবেই চলেছে, তিনি প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেন নি। বোঝার জন্য বললেন “মানে?”

-মানে, মমতো কোন গেস্ট অথবা তোমার কোন বন্ধুকে দেখলে রাগ ও করে না, বেশি কথাও বলে না, চুপচাপ থাকে তাই না? তো আমি বলছিলাম কি তুমি যদি একজন ডাক্তারকে তোমার বন্ধু সাজিয়ে বাসায় আনো। তারপর উনি মমকে দেখলেন, তারপর তুমি তার সাথে বললে বিস্তারিত ভাবে মমের সম্পর্কে, কেমন হয় সেটা?

-হ্যাঁ! ভাল হয়।

 কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব, কোন ডাক্তার কি রাজী হবেন?

-হতেও তো পারেন। আমরা বেশী ফি দিব, প্লিজ তুমি কথা বলে দেখো না, আমি আমার সেই মমকে পেতে চাই।

মি. রেহমান বিষয়টি ভাবলেন। মনে মনে বললেন, তার ছোট্ট মেয়েটি এই বিষয়টি কত সিরিয়াসলি ভেবেছে। ভেবে চিন্তে কত প্ল্যানই না করছে। মা’কে আগের মত পাওয়ার জন্য হঠাৎ ভিতরে ভিতরে তার একটা কষ্ট হতে লাগলো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আগামী কালই তিনি একজন সাইকোলজিস্ট এর সাথে কথা বলবেন।

পরদিনই দেশের একজন নামকরা সাইকোলজিস্ট আবিদ হোসাইনের সঙ্গে আলাপ করলেন। পুরা বিষয়টি শুনে তিনি রাজী হলেন। এই খুশির সংবাদটি মেয়ে এলিচকে দেওয়া হয়। মেয়ে শুনে খুব খুশি যে তার প্ল্যান অনুসারে কাজ করা হচ্ছে। আগামীকাল সকালেই আসবেন ডাক্তার, রাতে তাই এলিচ কয়েকবার তার মমকে শোনালো, “মম, জানো কাল সকালে বাবার এক বন্ধু আসবেন, বাসায়। উনি দীর্ঘদিন ইতালিতে ছিলেন। তুমি হয়ত চিনলেও  চিনতে পারো। হঠাৎ দেশে এসেছেন কয়েকদিনের জন্য। আগামীকাল ছুটির দিন, তাই বাবা লাঞ্চ করাবেন, বাসায়।” তার মম একটু নরম করে হাসি দিয়ে বললেন,“তাই?” মেয়ে বললো, “হ্যাঁ, তুমি খুশি হওনি?”

-“হ্যাঁ” তার মম ছোট্ট এই উত্তরটি দিয়ে আর কোনই কথা বললেন না, চলে গেলেন নিজ রুমে।

সকালেই চলে আসলেন ডা. আবিদ হোসাইন। এসেই এলিচকে দেখে বললেন, “কেমন আছো মা মনি?”

-“ভাল? আঙ্কেল আপনি কেমন আছেন?” এলিচ কথাগুলোএমন ভাবে বলছে যেন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই মি.  হোসাইন তার বাবার বন্ধু। মি. হোসাইন এলিচকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমার বাবা কোথায়? তোমার মা কোথায়, ডাকো।” এলিচ তার বাবা মা’র কাছে গিয়ে ডাকলো। বাবা বেরিয়ে এসেই মি. হোসাইনকে জড়িয়ে ধরলেন, কোলাকুলি করলেন। পাপিয়া দেরীতে আসলেন মি. হোসাইনের সামনে। এসেই সালাম দিয়ে বললেন, “কবে এসেছেন দেশে?”

– “কবে এসেছি, মানে ঠিক বুঝতে পারলাম না” মি.  হোসাইন একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন।

-“মানে আপনিতো ইতালিতে থাকেন, তাই না? তো দেশে ……..”

পাপিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই মি. হোসাইন হাসতে হাসতে বললন, “হ্যাঁ, গত পরশু এসেছি। ভাবলাম অনেককাল আপনাদের সাথে দেখা হয়নি, তাই দেখা করি। রেহমান আবার ঝামেলা করলো, নাছোড়বান্দার মত বললো তার সাথে লাঞ্চ করতেই হবে। আমি আবার হোমমেইড  খাবার ছাড়া খাই না।”

পাপিয়ার যেন আর কথা বলতে ভাল লাগলো না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“ঠিক আছে, বসুন, আপনারা কথা বলুন।” -বলেই তার লাইব্রেরী রুমের দিকে চলে আসলেন।

মি. হোসাইন পাপিয়াকে খেয়াল করে বললেন, “মি.  রেহমান আপনার স্ত্রীর সাথে কি আর একটু বেশী কথা বলতে পারবো?”

মি. রেহমান তার দুই হাত ধরে বললেন “প্লিজ সেটা করবেন না, ও বুঝে ফেলবে। সে কোন ডাক্তাকেই সহ্য করতে পারে না।”

-আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যা যা জিজ্ঞাসা করব আপনিতো বলতে পারবেন। একদম সত্যটাই বলবেন।

-“হ্যাঁ অবশ্যই” এমন ভাবে বললেন যেন তিনি যেকোন কিছুর বিনিময়ে পাপিয়াকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চান। এর মধ্যে বুয়া এসে নাস্তা রেখে গেল তাদের সামনে।

এলিচ তার রুমে পড়ছে, যদিও তার মনে মনে ইচ্ছে আাছে পড়ার কোন এক ফাকে সে তার বাবা আর এই ডাক্তারের কথা চুরি করে শুনবে। বুয়া বিভিন্ন মেন্যু ঠিক ঠিক হিসাব করে সাবধানে রান্না করছে। পাপিয়া তার লাইব্রেররীতে পড়ছেন। আর মি. রেহমান, আর মি. হোসাইন দু’জনই ড্রইংরুমে কথা বলছেন। মি.  হোসাইন গরম কফিতে মুখ লাগাতে লাগাতে বললেন, “বর্তমানে কি আপনারা একই বেডরুমে থাকেন?”

-হা্যাঁ, প্রথম থেকেই।

-আচ্ছা, আগের দিনের, চেয়ে এখনকার পার্থক্যটা কি?

-“আগে যেমন আমাকে পাওয়ার জন্য সে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ত আমার উপর। আর এখন কিছুই বলে না, চুপচাপ। যদি আমি কখনও ওকে পেতে চাই, তাহলে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে অনেক আদর করে। যখনই চোখ মেলে আমাকে দেখে সেই শান্ত হয়ে যায়। পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমি ওর চোখে জল দেখি। চোখের সে জল অনেক কষ্টের কথা বলে। আমি ভাবি তার খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই কখনো জোর করি না।” কথাগুলো বলতে একটু লজ্জা, আবার কষ্টও হচ্ছিল মি. রেহমানের। তবুও বললেন স্ত্রীর ভাল’র জন্য। মি. হোসাইন এবার বললেন, “আপনার স্ত্রীতো এরকম ছিলেন না, হঠাৎ হলেন, তাই না?”

-হ্যাঁ, হঠাৎ একদিন এ রকম হয়ে গেল?

-আচ্ছা দেখুন, হঠাৎ করে এ রকম হলেও তার পিছনে কোন না কোন কারণ ছিল। আপনার কি মনে পড়ে সেদিনকার কোন ঘটনা যার কারণে উনি হঠাৎ এ রকম হয়ে গেলেন।

মি. রেহমানের চোখমুখ ছলছল করে উঠলো। উনি অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন; তবুও যে তাকে বলতে হবে। কারণ তার পাপিয়াকে তাকে ভাল করে তুলতেই হবে। মি.  রেহমান বলা শুরু করলেন।

“এখন থেকে ঠিক পাঁচ বছর  আগে। তখন আমি এই ফ্ল্যাটটি কিনে পারিনি। গুলশানে ভাড়া বাসায় থাকতাম। আমেরিকা থেকে আমার কিছু বন্ধু আসে ঢাকাতে, বেড়াতে। ওরা আমাকে ডিনারের দাওয়াত দেয়। সংগে পাপিয়া ও এলিচকেও নিয়ে যেতে বলে। এলিচের জন্ম যেহেতু অ্যামেরিকাতে তাই ওদের সকলে এলিচকে চিনত ভালওবাসত। পাপিয়াকে বলতেই ও রাজি হয়ে গেল, ঠিক করা হল আমরা এক সংগে যাব। কিন্তু ঐদিন সকাল থেকে মেয়ের খুব জ্বর, পাপিয়া মনস্থির করল সে যাবে না। এলিচ আর সে বাসায় থাকবে। আমাকে যেতে বলল।” মি. রহমানের চোখে জল এসে গেল। একটু থেমে বললেন,“আমি বোকার মত চলে গেলাম! কেন যে গিয়ে ছিলাম ওদেরকে রেখে; না স্ত্রীর কথা ভাবলাম, না অসুস্থ’ মেয়ের কথা। অসুস্থ মেয়েকে রেখে আমি চলে গেলাম পুরাতন বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। এখন নিজের উপর খুব রাগ হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু পারি না। আমি না থাকলে পাপিয়ার কি হবে? আমার মেয়েটিরই বা কি হবে?” খাণিক্ষণ চুপ থেকে মি. রেহমান আবার বলতে শুরু করলেন,“ আমি যখন পুরাতন বন্ধুদের সাথে মজা করছি। আমার মেয়েটা কথন জ্বরে কাতরাচ্ছে আর ওর মা মেয়েটির মাথার কাছে রাত জেগে পট্টি দিচ্ছে। জ্বর পড়ছে না, আমাকে কয়েকবার ফোনও করেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। পরে বুঝতে পেরে যখন ফোন করলাম তখন পাপিয়া মেয়েকে নিয়ে একা একা ডাক্তারের কাছে চলে গিয়েছে। ডাক্তারের রুমে ছিল তাই আমার ফোন রিসিভ করতে পারেনি। আমি বুঝতে পারি আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বাসায় চলে আসি। এসে দেখি বাসা লক করা। ও দিকে ওদের খোজ নেওয়ার জন্য বারবার ফোন করছি, কিন্তু পাচ্ছিনা। এভাবে আধা ঘন্টা বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকলাম। পাপিয়া যখন মেয়েকে নিয়ে বাসায় আসল তখন রাত ১১টা বাজে। বাসায় এসেই মেয়ে এলিচ ঘুমিয়ে পড়লো। পাপিয়া তখনও আমার প্রতি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তারপর ……..” বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আর যেন কথা বলতে পারছেন না।

-“তারপর?” মি. হোসাইন যেন থামতে দিতে চান না। তিনি পুরোটায় শুনতে চান এ রকম ভাবে বললেন।

-“তারপর এলিচকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে পাপিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার সমস্ত মুখে আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো, খুব মিস করছিলাম তোমাকে। যে কথাটি আমার বলা উচিত ছিল সেটি ওই বলে দিল। আমি বলতে যাবো আমিও খুব মিস করছিলাম। কিন্তু আমাকে সে সুযোগ দিল না, আমার ঠোট শক্তকরে আকড়ে ধরলো ওর ঠোঁট দিয়ে। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত সে আর আমার ঠোঁট তার মুখের ভিতর নিল না। শুধু বললো তোমার মুখে কিসের একটা গন্ধ পাচ্ছি। আমি ঐ দিন ড্রিংক করেছিলাম, যেটা আমার স্ত্রীর খুবই অপছন্দ ছিল। এমনকি আমি তাকে কথাও দিয়েছিলাম যে, আমি কখনও ড্রিংক করব না। কিন্তু সে দিন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কি করেছিলাম জানি না। আমার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল তার সাথে আমাকেও আবার ডিনার করতে হবে। আমি সব সময় তাই করতাম। বাইরে থেকে যতই খেয়ে  আসিনা কেন ওর সাথে বসে আবার খাবো। তবে ঐ দিন আমার কি হয়েছিল বলতে পারবো না, আমি বললাম, আমি খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়ে নাও। আমার স্ত্রী ডিনার করছে অথচ তার চোখে জল। আমি বুঝতে পারলাম যে, সে খুব কষ্ট পেয়েছে অথবা পাচ্ছে। এই মুহুর্তে আমাকে ঠিক কি করতে হবে বুঝতে পারলাম না। ও খাচ্ছিল, ওর পাশে বসে বলেছিলাম, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। ও তখন কোন কথা বলেনি, পুরা এক প্লেট খাবার থেকে সে মাত্র ২ বার মুখে দিল বাকি সব খাবার নষ্ট করলো। আমি চুপচাপ বসে থাকি ওর পাশে, একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। এর মধ্যে প্রচন্ড টায়ার্ড ফিল করতে লাগলাম, ঘুম আসতে লাগলো। এক সঙ্গে ঘুমাবো তাই বেডে গিয়ে বসে থাকলাম ওর জন্য। এর মধ্যে আমার অন্য রুমে রাখা অন্য একটা মোবাইলে কল আসল। একটি মেয়ে যাকে আমি ঠিক চিনি না, মাত্র ২ দিন কথা বলেছি। সে ২ দিন পাপিয়া বাসায় ছিল না। বিশ্বাস করুন জাস্ট কৌতূহল বশবর্তী হয়ে ঐ অপরিচিত মেয়েটির সাথে কথা বলেছিলাম।”

মি. হোসাইন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কেন আপনি অপরিচিত মেয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলেছিলেন?”

-বিশ্বাস করুন, জাস্ট কৌতূহল। দেশে মোবাইল বিপ্লব হওয়ার পর থেকে পত্রিকায় বিভিন্ন মজার মজার ঘটনা পড়ি। পাপিয়া এবং মেয়েটি বাসায় নেই। ভাবলাম দেখিনা ভুল পরিচয় দিয়ে একটু কথা বলি কেমন লাগে। এই ভেবে কথা বলি। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, মেয়েটি আমার কথাতে মজা পেয়ে নিয়মিত ফোন করবে। তার পর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই মিসকল আসত সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে। এক দিক থেকে সুবিধে ছিল আমার অফিসিয়াল নাম্বারটা মেয়েটি জানত না সে শুধু আমি যে নাম্বারটা ব্যবহার করতাম না, সব সময় বাসার টেবিলের উপর পড়ে থাকত, সেইটা জানত। ঐ রাতে সেই মেয়েটি ফোন করলো। পাপিয়া রিসিভ করলো। আমি বেডরুম থেকে শুনতে পাচিছ পাপিয়া অন্য রুমে ফোন রিসিভ করে কথা বলছে। মেয়েটির সাথে বলেছিলাম আমার নাম সুনীল। তাই সে বারবার সুনীলকে চায়তে লাগলো। তাই পাপিয়া বলে দিল এখানে সুনীল নামে কেউ থাকে না। আমি সব কথা শোনার পর পাপিয়াকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম কার সাথে কথা বলছিলে এতক্ষণ? পাপিয়া যে আমার ব্যবহারে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিল সেটা আমি ভাল করেই বুঝছিলাম। তারপরও ঐ দিন আমার কি হয়েছিলো জানি। পাপিয়াকে উপযাচক হয়ে সব সত্যটা বলে দিলাম। পাপিয়া শুধু নীরবে শুনল, কোন কথা বললো না, সোজা রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে গেল। এলিচ ঘুমিয়ে আছে। কিছুই টের পেল না, আমিও পাপিয়ার পিছু নিয়েছিলাম, ভাগ্যিস আমি সেদিন ছাদে গিয়েছিলাম। আর ১ টি সেকেন্ড দেরী হলেই আমি পাপিয়কে চিরদিনের জন্য হারাতাম। আর আমার মেয়েটি হারাতো তার মমকে। পাপিয়া ঐ রাতে ছাদ থেকে লাফ দিতে চেয়েছিল। আমি পিছন থেকে ওকে ঝাপটে ধরে রুমে নিয়ে আসি। তারপর ………….. ” মি.  রেহমানের কণ্ঠ চেপে আসলো।

-তারপর কি? প্লিজ থামবেন না। আমাকে সবটা শুনতে হবে।

-“তারপর পাপিয়া নিস্তেজ হয়ে বেডরুমে আসল। কিন্তু কোন কথাই বললো না আমার সাথে। চুপচাপ হয়ে বসে থাকলো। আমার দিকে কয়েকবার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো, যেন আমাকে সে চিনে না, আমি এক অপরিচিত লোক, কি অসহায়ত্ব তার চোখে মুখে! জানেন আমি অনেক অসহায় মানুষকে দেখেছি। বাস্তবে বলেন আর সিনেমাতে বলেন,তবে আমার স্ত্রীর মুখে সে দিন যে অসহায়ত্বের ছাপ আমি দেখেছিলাম, সেটা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবনা। আমি কোন দিনও ভুলতে পারবো না। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। অনেকবার আমার ভুলের কথা স্বীকার করেছিলাম। কিন্তু ও তবুও কোন কথা বলিনি? চুপচাপ ছিল। ঠিক আজকের মতো। তারপর থেকে কারো সাথে কখনও বেশী কথা বলে না। নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে গুটিয়ে রেখেছে। সেই থেকে আমার স্ত্রীকে দিয়ে আমি কিছুই করাই না, যদি বড় ধরনের কোন দূর্ঘটনা ঘটে। সব সময় ছোট্ট বাচ্চাটির মত আগলে রাখি। ওর মনে আমি আর কোন রকম কষ্ট দিতে চাইনা। কখনও কোন বিষয়ে আমি ওর সাথে জোর করি না, জিদ খাটাই না। ঐ যে বুয়াটাকে দেখছেন, উনি আমাদের পূর্ব পরিচিত, আমার অনুপস্থিতিতে উনি সব সময় থাকেন বাসাতে পাপিয়াকে দেখা শোনার জন্য। আর মেয়েটি ওর মমকে যে কত ভালবাসে, সেটা কেউ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। এতটুকু মেয়ে আল্লাহ ওর মাথায় যে কত বুদ্ধি দিয়েছেন, সব বুঝে সে। ওই-ই তো আপনাকে ঠিক এভাবে আনার জন্য আমাকে পরামর্শ দিয়েছে।”

মি. রেহমান যেন তার ভিতরে আটকে থাকা ভারী পাথরটি আজ বহু কষ্ট করে সরিয়ে ফেললেন, বড় হালকা হয়ে গেলেন এমনভাবে মি. হোসাইনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

মি. হোসাইন সব শুনে বুঝে খানিক্ষণ চুপ থেকে টি-টেবিলের উপর রাখা সিরামিকের কেটলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আচ্ছা, আপনার স্ত্রী কি লাইব্রেরীতে শুধুই পড়েন, না ডায়েরী জাতীয় কিছু লেখেনও, জানেন?

আমি জানি না সঠিক সে লেখালেখি করে কি না তবে তার লাইব্রেরীতে অধিকাংশ সময় কাটায়। মাঝে মাঝে আমি তার লাইব্রেরীতে গেলেও তার কোন কিছু সে আমাকে দেখায় না, আমিও জোর করে দেখি না। ওই যে একটা ভয়, পাপিয়ার অবস্থা যদি আর ও বেশি খারাপ হয়।

মি. হোসাইন বললেন, ‘‘না, সেটা ঠিক আছে। তবে একটা বিষয় কি জানেন? যারা বেশি চঞ্চল থাকে, পরে যদি এরকম হয় তবে তারা অনেক কিছু লেখেন, লিখে লিখে প্রকাশ করেন; যদি কিনা লেখা পড়া জানেন। তারপর সেই লেখা হয় ছিড়ে ফেলেন, নতুবা যত্ন করে রেখে দেন।” মি. হোসাইন থামলেন না বলতে লাগলেন, ‘‘আপনার স্ত্রী বড় একটা আঘাত পেয়েছেন যেটা উনি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। যদি কখনও পারেন তাহলে দেখবেন আপনাকে ঠিক সেই আগের মতই কাছে টেনে নিবেন। আর একটি কথা কি জানেন? আপনার স্ত্রী আপনাকে অনেক বিশ্বাস করতেন, আর সেই বিশ্বাসের মূল্য আপনি তাকে সঠিকভাবে দিতে পারেননি। আপনি আপানার স্ত্রীকে দেওয়া কথা রাখেননি। তারপর ঐ অপরিচিত মেয়ের ফোন। আপনার স্ত্রী ঐ রাতে আপনার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকলেন, অথচ আপনি তার সাথে খেলেন না এই প্রত্যেকটি ঘটনাই আপনার স্ত্রীকে আপনার উপর যে বিশ্বাস তার উপর আঘাত করেছে। এজন্য আপনাকে তার বড্ড অচেনা মনে হয় যখন তিনি চোখ মেলে আপনাকে দেখেন। তাছাড়া একটি কথা আছে সম্ভবত শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘‘কল্পনা মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু।” ঐ মেয়েটির সাথে আপনি জাস্ট ২মিনিট কথা বলেছেন, আপনার স্ত্রী বাসায় ছিল না, স্রেফ ২মিনিট কথা বলেছেন; অথচ আপনার স্ত্রী কল্পনাতে অনেক কিছু দেখে ফেলেছেন, ঐ কল্পনা শত্রুটিই তাকে আপনার প্রতি বিতৃষ্ণা জাগাচ্ছে। মানুষের সাইকোলজিটা এরকম যে সে হঠাৎ কিছু একটা করে ফেলে। দেখুন, আমরা সব সময় সব কাজ অথবা সকল ব্যবহার কিন্তু পূর্ব পরিকল্পিত ভাবেই করতে পারি না। হঠাৎ বড় একটা ভুল করে ফেলি। দেখবেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনেও অনেক বড় বড় ভুল ছিল; সেটা বিশ্বাস করা যায় না এত বড় ভুল। যে ভুল সাধারণ মানুষকে অবাক করে দেয়।” মি. হোসাইন আরও বললেন, ‘‘আমরা মানব জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, তারপরও আমরা কিন্তু সব সময় সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারিনা। সেদিন রাতে ঐ পার্টিতে যাওয়াটা আপনার জন্য সঠিক ছিল না। এটা কিন্তু আপনি বুঝছেন, কিন্তু ঐ সময় আপনার মাথায় এ যুক্তিটা আসেনি, আর আসেনি বিধায় আপনি আপনার স্ত্রী কন্যার উপর এতটা কেয়ারিং থাকা সত্ত্বেও পার্টিতে গেলেন। আপনার স্ত্রী চুপচাপ আছে উনার মনে হচ্ছে  ওটাই ঠিক আছে। উনার ভিতর এই যুক্তিটা কাজ করছে না যে, তার ওই অবস্থা আপনাকে আপনাদের সন্তান এলিচকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। যখনই এই যুক্তিটা চলে আসবে তখন তিনি আর ওরকম থাকতে পারবেন না, ইচ্ছা করলেও পারবেন না। আমিতো উনার সাথে বেশীক্ষণ কথা বলতে পারলাম না, আমার মনে হয় যদি আর একটু কথা বলতে পারতাম তাহলে আমার পক্ষে একটা বেটার সাজেশান দেওয়া সম্ভব হত। তবে যেটা বলেছিলাম, আপনি  এবং আপনার কন্যা এলিচ যে, তার এই অবস্থার জন্য ভাল নেই, কষ্ট পাচ্ছেন- এইটা তাকে বারবার জানান। আমার মনে হয় সেটাতে উপকার হতেও পারে। তবে সব সময় মনে রাখবেন, ঐ রাতে কিন্তু একটির পর একটি ঘটনা ঘটেছিল। যেটা আপনার স্ত্রীর পছন্দ নয় অথবা আপনার কাছ থেকে তিনি কখনও এক্সপেক্ট করেন নি; সবই কাকতালীয় ভাবে ঘটেছে। এতগুলো আঘাত তিনি সহজে কাটিয়ে উঠতে পারেননি অথবা পারছেন না। এ জন্যই কিন্তু এতো সমস্যা। আপনাকে তাই বেশ সতর্কই থাকতে হবে। স্ত্রীর পছন্দ নয় অথবা তিনি আপনার কাছ থেকে যেটা কখনও এক্সপেক্ট করেননি; সেটার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।”

মি. হোসাইন কথা বলছেন আর মি. রেহমান সবই মনোযোগ সহকারে শুনছেন। এমন সময় পাপিয়া খুব দ্রুত পায়ে এমন ভাবে সে ঘরে ঢুকে পড়লেন যেন তিনি এতক্ষণ ধরে সকল কথা শুনেছেন। মি. হোসাইনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তার, কেন এসেছেন, এখানে কেন এসেছেন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে, প্লিজ বেরিয়ে যান। আমার স্বামীর কোন দোষ নেই, ও খুব ভাল। মি. হোসাইন আর মি. রেহমান অবাক হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। পাপিয়া বিদ্যুৎ গতিতে মি. রেহমানের বুকে আছড়ে পড়লেন তার হাতে থাকা কয়েকটি ডায়েরী রুমের মেঝেতে পড়ে গেল। পাপিয়া মি. রেহমানের বুকের ভিতর লুকাতে চায় এরকম একটা ভাব করতে লাগলেন, তার মুখে খুব স্বাভাবিক হাসি আর কান্নার মাঝামাঝি একটা প্রতিচ্ছবি। আর সে প্রতিচ্ছবি যেন অনেক কিছুই বলছে। মি. রেহমানকে বলছে, “কেন বললে তুমি সে রাতের কথা, কেন বললে ঐ লোকটির সাথে, আমাকে কি তোমার পাগল বলে মনে হয়, যদি তাই মনে হয় আমি না হয় তোমার পাগল হয়েই থাকতাম। সেটাতে কি খুব বেশী ক্ষতি ছিল।  আজ সকল ঘটনা বলার পর তুমি যে সবার কাছে খারাপ হয়ে গেলে। শুধু এটার জন্যই আমি কোন ডাক্তারের কাছে যেতে চায়নি। শুধু এটার কারণেই এভাবে বাকিটা জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম।  তুমি আমাকে সে রাতে কষ্ট দিয়েছো, তাই আমিও এরকম চুপচাপ থেকেই তোমাকে কষ্ট দিচ্ছিলাম, বিশ্বাসকর আমার কিছুই হয়নি, আমি পাগল নই, আমার সকল কথা মেঝেতে পড়ে থাকা ডায়েরীতে লেখা আছে। তুমি পড়লেই সব বুঝতে পারবে।” মি. রেহমান বুঝতে পারলেন তার পাপিয়ার ভিতরকার পরিবর্তন কারণ এভাবে বুকে আসা পাঁচ বছর পর এটাই প্রথম। তিনি খুশি ও আবেগে আপ্লুত হয়ে ছোট্ট শিশুটির মত করে স্ত্রীর মাথায় বারবার চুমু খেতে লাগলেন। নিজে কাঁদছেন আবার স্ত্রীকেও বলছেন, “কাঁদো সোনা, কেদে একটু হালকা হও, আমি যে অমানুষের মত তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।” এ ঘটনা দেখে মি. হোসাইন অবাক হলেন। তার কাছে সব কিছুই অপ্রত্যাশিত বলে মনে হচ্ছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না এটা কি হচ্ছে। মিসেস রেহমানের হঠাৎ এই পরিবর্তন হল, হঠাৎই তিনি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন তার পিছনে কোনটা দায়ী আমাদের কথোপকথন উনি কি সব শুনেছেন? শুনে বুঝে নিজে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন? না, উনি আসলে কখনই অস্বাভাবিক ছিলেন না, অস্বাভাবিকের মত অভিনয় করতেন। কোনটা সত্য উনি বুঝতে পারলেন না। ২৫ বছরের পেশা জীবনের অভিজ্ঞতায় এই ঘটনা তার কাছে বড়ই দূর্বোধ্য বলে মনে হতে লাগলো। মেঝেতে পড়ে থাকা লাল, নীল, মেরুন রঙের ডায়েরী গুলির দিকে তাকিয়ে তার খুব ইচ্ছে হতে লাগল, সে গুলো যদি তিনি পড়তে পারতেন! তার কাছে মিসেস রেহমানকে বড়ই নিখুঁত মনের মানুষ বলে মনে হল। অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন পাঁচ বছর পরে কোন কাপল একে অপরকে কাছে পেলে যে আলিঙ্গন সেটি দেখে তার চোখের কোনে জল এসে গেলে। মেয়ে এলিচ সব শুনেছিল এতক্ষণ ধরে। বাবার উপর তার খুব রাগও হয়েছিলো। তবে এখন বাবা-মা’র গভীর আলিঙ্গন দেখে এলিচের সে রাগ গলে পানি হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়ে এই পৃথিবীর বাতাসে মিশে গেল। তার চোখের জলকে সে বাধা দিতে পারলোনা বাবা মা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেতো কাঁদছেই; মেয়ে এলিচ সে দৃশ্য দেখে মুগ্ধ। নিজেকে তার খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে হল। এলিচ আস্তে আস্তে বাবা মা’র পাশে গিয়ে দাড়ালো, কিন্তু তার বাবা মা একে অপরের সাথে এমন নিবিষ্ট ভাবে আলিঙ্গন করতে লাগলেন যেন তাদের পৃথিবীতে অন্য কোন প্রাণী নেই, সেখানে শুধুই দুটি প্রাণী। 

শিরীন আহমেদ

লেখক পরিচিতি : গল্পটি লিখেছেন

কানাডার ভেঙ্গুভার প্রবাসী শিরীন আহমেদ।

বর্তমানে তিনি RECE Advisor at College of ECE

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *