সাধারণ কর্মজীবী লোকেদের জন্য টরন্টো হলো দারিদ্র্যের রাজধানী

আয়-বৈষম্য এই শহরের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা

টরন্টোতে শ্রমজীবী শ্রেণির দরিদ্র মানুষের হার গত ১০ বছর ধরে বাড়ছে। ছবি: গেটিইমেজ

সীমা শাকেরি : বেশ কিছুদিন ধরেই এটি সবার জানা যে, টরন্টো হলো বসবাসের জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল একটি শহর। কিন্তু টরন্টো ফাউন্ডেশনের এক নতুন রিপোর্টে উঠে এসেছে, এই শহরে বসবাস করা কত বেশি কঠিন।
ভাইটাল সাইনস রিপোর্ট (The Vital Signs report) নামের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাজ করার বয়সী লোকদের জন্য টরন্টো হলো দরিদ্রদের রাজধানী। এর অর্থ হলো এই শহরে কাজ করতে পারার বয়সী অর্থাৎ ১৮ বছরের বেশি কিন্তু এখনও অবসরে যাননি এমন লোকদের মধ্যে এই শহরেই দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য নগারবাসীর ক্ষেত্রেও এই শহরটি অনেক ভালো কিছু করতে পারছে এমনও নয়। কানাডায় এই শহরেই তরুণ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শুধু উইনিপেগ-এ তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব টরন্টোর চেয়ে বেশি। আর বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব রয়েছে ভ্যাঙ্কুভারে। মহামারী চলাকালীন হাফপোস্ট এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।
টরন্টো ইউনিভার্সিটির সমাজকর্ম অনুষদের অধ্যাপক ডেভিড হুচানস্কির কিছু গবেষণার তথ্য রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, টরন্টোতে শ্রমজীবী শ্রেণির দরিদ্র মানুষের হার গত ১০ বছর ধরে বাড়ছে। তিনি বলেন, “(এর অর্থ হলো) পূর্ণ বা প্রায় পূর্ণ সময় কাজ করেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা দারিদ্র্যসীমা পেরিয়ে উঠে আসার মতো যথেষ্ট আয় করতে পারছেন না এবং নিজেদের বা পরিবারের জীবন যাপনের জন্য প্রযোজনীয় যথেষ্ট পরিমাণে আয় করতে পারছেন না।”
এই বিভাজনও খুব বেশি বর্ণভিত্তিক এবং বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ টরন্টোবাসী সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছে।
তিনি বলেন, “যত দিন যাচ্ছে ততই এমন লোকের সংখ্যা বাড়ছে যারা চাকরি পাচ্ছে কিন্তু বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট অর্থ তাদের দেওয়া হচ্ছে না। আর এই ব্যাপারটা খুবই বর্ণবাদী: এসব কর্মজীবী দরিদ্রদের মধ্যে টরন্টোর খুবই মুষ্ঠিমেয় শ্বেতাঙ্গ আছেন কিন্তু জাতিগত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এদের সংখ্যা অনেক বেশি, আবার কৃষ্ণাঙ্গ টরন্টোবাসীর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।”
“কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে লোকটি অভিবাসী নাকি কানাডায় জন্মগ্রহণকারী এসব কোনও বিবেচনাই কাজ করে না। কিন্তু এসব বিষয় অন্য জনগোষ্ঠীর কাছে কোনও ব্যাপারই না।”
কাজের বয়স আছে এমন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টরন্টোতে বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যদিও বেকারত্বের হার কমছে এবং ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর মোট অভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণ ৩ দশমিক ২ শতাংশ হারে বেড়েছে, তবুও আয়ের বৈষম্য অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে খারাপ। প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে টরন্টোতেই আয় বৈষম্য সবচেয়ে বেশি।
টরন্টো শহরে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন আদিবাসী, জাতিগত সম্প্রদায় এবং নবাগতদের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যা আরও বেশি।
রিপোর্টে বলা হয়, টরন্টোর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন ধরণের। গত ৩৫ বছরে এই শহরের শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দাদের আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬০ শতাংশ। অথচ জাতিগত জনগোষ্ঠীর লোকেদের ক্ষেত্রে এই প্রবৃদ্ধি মাত্র এক শতাংশ। এই পার্থক্যের একটি কারণ সম্ভবত মানহীন (চুক্তিভিত্তিক, অস্থায়ী) কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যাওয়া যা সচরাচর জাতিগত জনগোষ্ঠী ও নবাগতরা নিয়ে থাকে। এর সঙ্গে লৈঙ্গিক দিক বিবেচনায় নেওয়া হলে ওই ব্যবধান আরও বেশি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৫ সালে টরন্টোর জাতিগত জনগোষ্ঠীর একজন নারীর বার্ষিক আয় ছিলো ৩৯,৮৬১ ডলার যেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর আয় ছিলো ৮৯,১৫৭ ডলার।
সম্পদের এই ক্রমবর্ধমান পার্থক্যের কারণে টরন্টো শহরটি অন্য সব শহরের চেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, “উচ্চ আয়ের লোকেদের বসবাস যেসব মহল্লায় সেখানে ৭৩ শতাংশ বাসিন্দাই শ্বেতাঙ্গ। অন্যদিকে স্বল্প আয়ের লোকেদের মহল্লাগুলোতে শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দার সংখ্যা ৩১ শতাংশ। মধ্য আয়ের লোকেদের মহল্লাও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। কারণ ক্রমশই অধিক সংখ্যক টরন্টোবাসী হয় উচ্চ আয়ের স্তরে উঠে যাচ্ছে অথবা স্বল্প আয়ের স্তরে নেমে যাচ্ছে।
হুচানস্কি বলেন, “বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং বৈষম্যের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা এখন যতটা বলছি তার চেয়েও বেশি বেশি কথা বলা দরকার।”
টরন্টো ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও শ্যারন অ্যাভারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “আমাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি থাকলেও টরন্টো আসলে সবার স্বার্থে কাজ করে না। প্রকৃতপক্ষে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য এই শহরের জীবনের নাম হলো সংগ্রাম করে টিকে থাকা। আর যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পরিবর্তে আরও খারাপ হবে।” তিনি বলেন, “আমরা অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি তথ্য-উপাত্ত সংকলন করেছি এবং নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, মানুষে মানুষে অসাম্য এখন নতুন এক স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
টরন্টোতে গৃহায়নের বিষয়টি অনেকের জন্যই স্থিতিশীল নয়। বাড়ির মালিক হতে হলে যে ব্যয় করতে হয় সেটা আয়ের চেয়ে চারগুণ বেড়েছে, অন্যদিকে বাড়িভাড়ার পরিমাণ বেড়েছে আয় বাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ হারে। ভাড়াবাড়ির সংখ্যাও নগরীর জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে তার মিলিয়ে এগোতে পারেনি।
অন্য সব কানাডীয়র চেয়ে টরন্টোবাসীকে বাড়িভাড়া বাবদ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় অথচ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অন্য কানাডীয়র চেয়ে টরন্টোবাসী বছরে প্রায় ৪,৫০৭ ডলার কম আয় করেন। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে টরন্টোর আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থানরত গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে ৬৯ শতাংশ বেড়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, “আদিবাসী জনগণ, জাতিগত জনগোষ্ঠী, এলজিবিটিকিউ২এস+, এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের গৃহহীন হবার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।”
হাফিংটন পোস্ট কানাডা পত্রিকাকে হুচানস্কি বলেন, “শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ মানুষের আয় এবং তাদের বাসস্থানের মধ্যে বিপুল অসাম্য রয়েছে।”
টরন্টোর পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হওয়ার পেছনে অংশত কারণ হলো এই নগরী অতিশয় দ্রুতগতিতে বাড়ছে, এর জনসংখ্যা উত্তর আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততর হারে বাড়ছে। সুতরাং এই মহাদেশজুড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলো কঠিনতর।
রিপোর্টে বলা হয়, এই সবকিছু মিলিয়েই, বিশেষ করে তরুণদের জন্য টরন্টো যে কানাডার সবচেয়ে অসুখি নগরী তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।