ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে ক্লাস-অ্যাকশন মামলা পরিচালনার করার অনুমতি পেল এক সময়ে কারারুদ্ধ অভিবাসনপ্রত্যাশীরা

প্রবাসী কণ্ঠ নিউজ ডেস্ক, জুলাই ৬, ২০২৪ : কানাডায় প্রবেশ করা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেককেই গ্রেফতার করে অপরাধীদের মত জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল।পায়ে শিকল, হাতে হাতকড়া পরানোসহ নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল এই বন্দীদের উপর। এমনকি কাপড় খুলেও দেহ তল্লাশি করা হতো কখনো কখনো। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল চলাচলেও। কারাগারের ভিতর তাদের রাখা হতো দাগী আসামীদের সঙ্গে একই কক্ষে। গত ৫ জুলাই এক রায়ে এ কথা বলেন বিচারপতি বেঞ্জামিন গ্লুস্টেইন।খবর ব্রিজিট ব্যুরো –সিবিসি নিউজ।

এ কারণে অন্টারিও সুপরিয়র কোর্ট অফ জাস্টিস ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে একটি ক্লাস-অ্যাকশন মামলা পরিচালিত করার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। এই অনুমোদন লাভ করায় কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্স ও টেরিটরিতে অবস্থিত ৮৭ টি জেলে বিভিন্ন সময়ে বন্দী ছিলেন এমন ৮,৩৬০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী বা উদ্বাস্তু এখন ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবেন। কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সী কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে এদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ব্ন্দী করে রাখার এই ঘটনাগুলো ঘটে ২০১৬ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে।

‘ক্লাস একশন মামলা’ হলো আইনী প্রক্রিয়ার একটি রূপ যেখানে এক বা একাধিক বাদী একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর পক্ষে একজন বিবাদী বা বেশ কয়েকজন বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে ক্ষতিপূরণ দাবি করে।        

(ছবির ক্রেডিট: নোভিকভ আলেক্সি/শাটারস্টক)

গত ৫ জুলাই শুক্রবার জারি করা সিদ্ধান্তে আদালত ফেডারেল সরকারের আইনজীবীদের দ্বারা উত্থাপিত 15টি আপত্তির প্রতিটি প্রত্যাখ্যান করেছে যারা ক্লাস-অ্যাকশন মামলার পদক্ষেপটি বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছিল।

উল্লেখ্য যে, অভিবাসন এবং উদ্বাস্তু সুরক্ষা আইনের অধীনে কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সী কর্তৃক আটক বিদেশী নাগরিক এবং উদ্বাস্তুরা কোন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত নয়।

‘কানাডিয়ান এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিদেশী নাগরিক এবং উদ্বাস্তুদের আটক করার বিষয়টি প্রকৃতির দিক থেকে একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ। এটি কখনো শাস্তিমূলক হতে পারে না।

কিন্তু তা সত্বেও দেখা গেছে কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সীর লোকেরা প্রভিন্স ও টেরিটরিতে হাজার হাজার উদ্বাস্ত বা অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করার একটি প্রথা চালু রেখেছে। তাদের এই প্রক্রিয়া বন্দী হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ‘চার্টার রাইটস’ লঙ্ঘন করে। অর্থাৎ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রেফতার করে অপরাধীদের মত জেলে বন্দি করে রাখা মানবাধিকার পরিপন্থী যার মাধ্যমে কানাডার ‘চার্টার রাইটস’ এর বিধিও লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

কানাডার ফেডারেল সরকার ‘অন্টারিও সুপরিয়র কোর্ট অফ জাস্টিস’ এর এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবে কি করবে না সে বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি।  

গ্রেফতারের শিকার অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একজন ছিলেন মধ্য আমেরিকার দেশ গ্রানাডা থেকে আগত টাইরন রিচার্ড। তিনি ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অন্টারিও’র তিনটি বিভিন্ন সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে ১৮ মাস বন্দী ছিলেন। কর্তৃপক্ষ যদিও তাকে বিপজ্জন ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করেনি কিন্তু তারপরও তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল তিনি পালিয়ে যেতে পারেন এই আশঙ্কায়। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে রাখা হয় দাগী আসামীদের।  

সিবিসি নিউজকে রিচার্ড জানান কারাগারে থাকা অবস্থায় বহুবার তার কাপর খুলে দেহ তল্লাশী করা হয়েছিল। তিনি আরো জানান তাকে জামাকাপড় খুলে বিভিন্ন এংগেলে ঘুরে দাঁড়াতে হতো, উপুর হয়ে অবস্থান নিতে হতো, এই সময় কারারক্ষীরা ফ্লাশলাইট হাতে নিয়ে তার পশ্চাদদেশ এবং মলদ্বার পরিদর্শন করতো, যৌনাঙ্গের আশপাশও পরিদর্শন করতো। আদালতের হলফনামায় তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হতো কারাগারে আটক অবস্থায় আমি বাস্তবিক অর্থে নরকবাসে ছিলাম। প্রতিদিনই আমি কান্না করতাম আমার এই নারকীয় কারাবাসের কারণে।

রিচার্ড জানান কারাবাসে তার কোন প্রাইভেসী ছিল না অন্য কারাবাসী বা কারারক্ষীদের সামনে। টয়লেট ছিল দরজার পাশে উন্মুক্ত অবস্থায়। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। অনেক অনুনয়-বিনয় করে কারোর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিললেও সেটি ছিল স্পর্শহীন সাক্ষাৎ। কাচের দেয়াল থাকতো মাঝখানে। টেলিফোনে কথা বলতে হতো। এবং ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশী কথা বলতে দেওয়া হতো না।

কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে পরবর্তীতে তিনি পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট এর কাগজপত্র পেয়েছেন। বর্তমানে তার কানাডিয়ান সিটিজেনশীপের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

পালিয়ে যেতে পারে এরকম আশংকা থেকে গ্রেফতার

কানাডায়  স্থায়ীভাবে থাকার জন্য উদ্বাস্তু বা অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যে আবেদন পত্র জামা দিত সেটি বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য কোর্টে ডাকা হলে তারা হাজির নাও হতে পারে এবং পালিয়েও যেতে পারে এরকম আশংকা থেকে গ্রেফতার করা হতো অনেককে। অথবা আবেদন নাকচ হয়ে গেলে তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সময় খুঁজে পাওয়া যাবে না এরকম আশংকা থেকেও আগে থেকেই অনেককে আটকে রাখা হতো কারাগারে। সব মিলিয়ে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০%।

কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সী কর্তৃপক্ষ এরকম আশংকা থেকে সন্দেহভাজন লোকদেরকে গ্রেফতার করে তাদের নিজস্ব আটক কেন্দ্রে বন্দী করে রাখতে পারে। এর বাইরে গ্রেফতারকৃতদেরকে বিভিন্ন প্রভিন্সের কারাগারগুলোতে পাঠানো যেতে পারে এরকম একটি চুক্তিও ছিল প্রভিন্সিয়াল সরকারগুলোর সঙ্গে কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সী কর্তপক্ষের। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে অধিকাংশ প্রভিন্স এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। কারণ তারা মনে করছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরকে এভাবে গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখার প্রক্রিয়াটি কানাডার মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ইমিগ্রেশন আইনজীবী সুবোধ ভারতী অন্টারিও সুপরিয়র কোর্ট অফ জাস্টিস এর রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন যা ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে ক্লাস-অ্যাকশন মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে। ভারতী ভুক্তভোগীদের পক্ষে ক্লাস-অ্যাকশন মামলা পরিচালনা করছেন। তবে তিনি মনে করেন ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে মামলায় কে জয়ী হবে। 

ক্লাস-অ্যাকশন মামলায় এক শত মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা জয়ী হলে এই অর্থ তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে।