কানাডায় বৃদ্ধ বাঙ্গালীদের নিঃসঙ্গ জীবন
খুরশিদ আলম
কানাডায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বৃদ্ধ বাঙ্গালীদের সংখ্যা। গত পঁচিশ, তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ বছর আগে যাঁরা যুবক বয়সে বা চল্লিশের কোঠায় পৌঁছে কানাডায় এসেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই আজ এই বৃদ্ধদের দলে।
প্রকৃতির নিয়মেই তাঁরা যুবক থেকে মধ্য বয়সী এবং পরে বৃদ্ধদের কাতারে সামিল হয়েছেন। আবার প্রকৃতির নিয়মেই এর সাথে আরো যে বিষয়টি যোগ হয় তা হলো বার্ধক্যজনিত রোগ। কেউ কেউ কৌতুক করে বলেন বার্ধক্যজনিত রোগগুলো মানবদেহে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসে। আসার পর আর যাবার নামটি করেনা। স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং বংশ বিস্তার করে। কৌতুক হলেও এটি মানব জীবনে এক কঠিন বাস্তবতা।
আর এই কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে আরো একটি প্রায় অপ্রতিরোধ্য বিষয় যোগ হয় যাকে আমরা বলি ‘নিঃসঙ্গতা’। দেখা গেছে, যে সকল ইমিগ্রেন্টদের আত্মীয়স্বজন থাকে না প্রবাসে তাঁরা আরো বেশী মাাত্রায় নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বে ভোগার সম্ভাবনার মধ্যে থাকেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্যও তাই বলছে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডা পরিচালিত ঐ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এই বৃদ্ধদের মধ্যে অনেকেরই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে এর হার কানাডায় জন্ম নেয়া ব্যক্তিদের চেয়ে বেশী।
আর বৃদ্ধদের এই নিঃসঙ্গতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই জন্য যে, এটি স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যার মধ্যে আছে অক্ষমতা, দুর্বলতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। অকাল মৃত্যুও হতে পারে এই নিঃসঙ্গতা থেকে।
৬৫ বছর বা তার বেশী বয়সী উত্তরদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে যে কানাডায় ১১ লক্ষ বয়স্ক মানুষ ২০১৯ এবং ২০২০ এর মধ্যে নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব অনুভব করেছেন। নারীদের মধ্যে এই নিঃসঙ্গতার হার বেশী। আর যারা বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা নিয়ে বাস করছেন তাঁদের মধ্যেও নিঃসঙ্গতার হার বেশী।
গত বছর ১৯ জুলাই এই গবেষণা তথ্যটি প্রকাশ করে স্ট্যাটিসটিকস কানাডা। গবেষণাটি পরিচালনা করেন মো. কামরুল ইসলাম ও হিদার গিলমোর।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার ঐ গবেষণায় আরো বলা হয়, নারীদের মধ্যে কানাডায় জন্মানোদের চেয়ে ইউরোপীয় ইমিগ্রেন্টদের একাকীত্ব বোধ করার সম্ভাবনা বেশি ছিল। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে, যারা প্রাপ্তবয়সে (১৮ থেকে ৪৪ বছর) ইমিগ্রেন্ট হয়েছেন এবং দীর্ঘমেয়াদে এদেশে আছেন (২০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে কানাডায় বসবাসকারী) তাঁদের নৈঃসঙ্গে ভোগার সম্ভাবনা কানাডায় জন্মগ্রহণকারী মানুষের তুলনায় বেশি ছিল। একাধিক পুরনো রোগ আছে (যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ অথবা একইসঙ্গে বিষণ্নতা) এমন বয়স্কদের এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে বাধা আছে এমন বয়স্কদের একাকীত্বে ভোগার সম্ভাবনাও বেশি।
বিশেষ করে ইমিগ্রেন্টরা একাকীত্ব বোধের কাছে নাজুক হয়ে পড়তে পারেন, তাঁদের সামাজিক যোগাযোগ ব্যাহত হওয়া, ভাষার বাধা এবং স্বাগতিক দেশে থিতু হবার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চাপের কারণে। বিদ্যমান গবেষণায় আভাস মেলে যে, ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে একাকীত্বের বোধ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে বর্ণ ও জাতীয়তা, স্বাগতিক দেশে অবস্থানের মেয়াদ, অভিবাসনের সময় বয়স এবং মাতৃভাষার ভিত্তিতে।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণায় আরো বলা হয়, সামগ্রিকভাবে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর তুলনায় ইউরোপীয় এবং ইউরোপের বাইরের উভয় ধরণের ইমিগ্রেন্টদের একাকীত্বে ভোগার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। একই রকম প্রবণতা দেখা যায় প্রাপ্ত বয়সে কানাডায় আসা এবং দীর্ঘকাল ধরে এখানে বসবাসকারী ইমিগ্রেন্টদের মধ্যেও। নির্দিষ্ট করে লিঙ্গভিত্তিক হিসাবে দেখা যায় যে, পুরুষদের মধ্যে ইউরোপের বাইরের ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে একাকীত্বের প্রবণতা কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। বিপরীতে, নারীদের মধ্যে, কানাডায় জন্মানো নারীদের তুলনায় ইউরোপ থেকে আসা ইমিগ্রেন্ট নারীদের একাকীত্বের প্রবণতার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা যায়।
উপরের জরিপ তথ্যে আমরা বয়স্ক ইমিগ্রেন্ট ও কানাডায় জন্ম নেয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের নিঃসঙ্গতার একটি সামগ্রিক চিত্র দেখতে পেলাম। কিন্তু আলাদাভাবে প্রবাসী বয়স্ক বাঙ্গালীদের মধ্যে এই চিত্রটা কেমন?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কোন জরিপ তথ্য আমাদের কাছে নেই। কানাডিয়ান কোন প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে আলাদা কোন জরিপ পরিচালনা করেনি। আর সার্বিকভাবে বৃদ্ধ ইমিগ্রেন্টদের বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন, এমন অভিমত প্রকাশ করেছে খোদ স্টাটিসটিকস কানাডা নিজেই। সে ক্ষেত্রে হয়তো বৃদ্ধ ইমিগ্রেন্টদের বিষয়ে আরো বিশদ তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
তবে বিভিন্ন সময় টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিটির কয়েকজন সদস্যের কাছে শুনা কিছু কাহিনী থেকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রবাসী বাঙ্গালী বৃদ্ধদের মধ্যে অনেকেই নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। কেউ কেউ আবার খুব করুণ অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করছেন। টরন্টোর একজন বাঙ্গালী রিয়েলটরের মুখে শুনা এক বৃদ্ধের কাহিনীটা ছিল এরকম- ভদ্রলোকের স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন হলো। ছেলে-মেয়েরাও বিয়ে করে যে যারমত আলাদা বাসায় সংসার পেতেছেন। বাবা’র খোঁজখবর তেমন একটা নেন না। কালে ভদ্রে হয়তো এসে দেখা করেন। সেটাও অতি অল্প সময়ের জন্য। নিজেদের চাকরী, সংসার, বাচ্চা এগুলো নিয়ে তাঁদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। স্কারবরোতে একটি নির্জন এপার্টমেন্টে একা বাস করেন ঐ ভদ্রলোক। বয়স হয়ে গেছে অনেক। ড্রাইভ করতে পারেন না বয়সের কারণে। বাজার-সদাই বা ডাক্তারের কাছে যেতে হলে একমাত্র ভরসা টিটিসি’র Wheel-Trans. ছেলে মেয়ে ছাড়া অন্য কোন আত্মীয়-স্বজনও নেই। সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। কারণ, তাঁরাও কমবেশী তাঁর মতই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। হয়তো অসুস্থতার কারণে যোগাযোগ তাঁদেরও বন্ধ। এরকম পরিস্থিতিতে এই ভদ্রলোক একা একা বাসায় বসে শুধু কাদেন। সেই কান্নার সুর ঘরের চার দেয়াল ছাড়া আর কেউ শুনে না।
নাম উল্লেখ না করে অন্য এক নবতিপর বৃদ্ধ বাঙ্গালীর কথা উল্লেখ করা যায় এখানে। চাকরী থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি একসময় ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী কমিউনিটিতে খুবই সক্রিয় ছিলেন। বয়স এখন ৯৫ এর মত হবে। অবসরে যাওয়ার আগে অন্টারিও’র একটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যপনা করতেন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী এই বাঙ্গালী ভদ্রলোক। বাঙ্গালী কমিউনিটিতে তাঁর অবদানও রয়েছে অনেক। তাঁকে শ্রদ্ধা করেন সবাই। কিন্তু নিরহঙ্কারী, মিশুক ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী এই ব্যক্তিটি আজ এক বৃদ্ধশ্রমে একেবারেই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। চলাচল করতে হয় হুইল চেয়ারে বসে। উনার স্ত্রী গত হয়েছেন বহু বছর আগে। একটি ছেলে আছে। কিন্তু সেটিও না থাকার মতই। শুনেছি সেই ছেলে নাকি বাবার কোন খোঁজ রাখেন না। যোগাযোগও নেই। অথচ থাকেন গ্রেটার টরন্টো এলাকাতেই। নিজের সংসার নিয়েই সে ব্যস্ত।
খুঁজলে এরকম আরো অনেক বৃদ্ধ বাঙ্গালীর সন্ধান পাওয়া যাবে টরন্টো, মন্ট্রিয়লসহ আরো কয়েকটি শহরে যেখানে বাঙ্গালীরা বাস করেন। আর তাঁদের সবার কাহিনী প্রায় একই রকম হবে সেটিও বলা যায়।
প্রবাস জীবনে বৃদ্ধদের এই যে নিঃসঙ্গতা তা বেশ বেদনাদায়ক। উপরে যে অধ্যাপক বাঙ্গালীর কথা উল্লেখ করলাম তাঁর সঙ্গে একসময় অনেক লোকের পরিচয় ছিল, ছিল বন্ধুত্বও। আজ তাঁর পাশে কেউ নেই, নেই কারো সাথে যোগাযোগও। পরিবারেরও কেউ নেই পাশে।
এই যে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব এটি কি কেউ স্বেচ্ছায় বরণ করে নেন? অবশ্যই নয়। মানুষ সামাজিক প্রাণী। মানুষ মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে না। অবশ্য দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা মাঝে মধ্যে শোনা যায়। যেমন ভূমধ্যসাগরীয় মাদ্দালিনা দ্বীপপুঞ্জের সাতটি দ্বীপের মধ্যে একটি বুদেল্লি আইল্যান্ড। অনন্যসুন্দর এই দ্বীপটির প্রেমে পড়ে সেখানে জীবনের ২৮ বছর একাকী কাটিয়ে দিয়েছিলেন মওরো মোরান্ডি নামের এক ব্যক্তি। তবে এরকম কাহিনী মানব সমাজে অতি বিরল।
অন্যদিকে যাঁরা বিষণ্নতায় ভুগেন তাঁদের অনেকে একাকী জীবন বেছে নেন। অবশ্য সময়মত উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে এরা আবার সামাজিক জীবনে ফিরে আসেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যাঁরা একাকী বা নিঃসঙ্গ হয়ে যান তাঁদের বেশীর ভাগের ক্ষেত্রেই সাধারণত আর কোন উপায় থাকে না। তখন তাঁরা একাকী হওয়ার কারণেই বিষণ্নতায় ভুগেন। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময়ে এসে তাঁরা নানান রোগে ভুগতে থাকেন। সেটা শারীরিক ও মানসিক দুটোই হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’ এর বরাত দিয়ে বিবিসি নিউজ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, এখন বেশ শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণাদি রয়েছে যে একাকীত্ব নানান অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষত হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে ২৯ শতাশং এবং মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে ৩২ শতাংশ। তাছাড়া দীর্ঘদিনের নিঃসঙ্গতা মস্তিষ্কের কিছু মনে রাখতে না পারার মারাত্মক অসুখ ডিমেনশিয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের মধ্যে বিষাদ, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী থাকে। আর এসব কারণে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
একদিন অনেক স্বপ্ন নিয়ে আজকের এই বৃদ্ধ বাঙ্গালীরা কানাডায় এসেছিলেন। তখন তাদের বয়স ছিল কম, চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁদেরকে যে চরম নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে তা হয়তো অনেকের চিন্তায় ছিল না তখন। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পার হবার পর যখন এরা অবসরে যান এবং তারও পরে যখন আস্তে আস্তে আরো বৃদ্ধ হয়ে উঠেন তখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখমুখি হন সবাই। আর সেটি হলো এই নিঃসঙ্গতা।
বৃদ্ধ বয়সে যে সকল নারী-পুরুষ বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে ঠাই নেন, দুর্ভাগ্যজনভাবে তাঁরাও নিঃসঙ্গতাকে কাটিয়ে উঠতে পারেন না নানান কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভাষা। এরপর রয়েছে সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি। আজকে কানাডায় যাঁরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা বাঙ্গালী তাঁদের অনেকেই ইংরেজীতে বাক্পটু বা সাবলীল নন। কেউ কেউ আবার ইংরেজীতে অনেক দুর্বল। ফলে মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে প্রথম সমস্যা শুরু হয় সেখান থেকেই। ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক কারেন কোবাইশীর মতে, “যখন কেউ নতুন একটি পরিবেশে যান এবং সেই পরিবেশের ভাষার সঙ্গে তাঁর কোন ঘনিষ্ঠতা বা নৈকট্য থাকে না তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থের অবনতি ঘটে। মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমে এথনিক বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
কানাডায় আমরা যাঁরা প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্ট, সত্যিকার অর্থে তাঁদের অনেকেরই রয়েছে ভাষার সমস্যা। ইংরেজীতে আমরা যোগাযোগটা ষোলআনা করে উঠতে পারি না। ফলে যোগযোগটা সঠিক ভাবে করা না গেলে বৃদ্ধাশ্রমে সেবাটাও সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। কারণ যিনি সেবা দিবেন তাঁকে বুঝতে হবে সেবাগ্রহণকারী কি চাচ্ছেন। আর সেবা যিনি নিবেন তাঁকেও সঠিকভাবে বুঝাতে হবে সেবাপ্রদানকারীকে যে তিনি কি চাচ্ছেন।
মূলত নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য বৃদ্ধাশ্রমে কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে গেলে ভাষার উপর দখলটা থাকতে হবে ভাল করে। নয়তো দুর্বল ভাষাজ্ঞান নিয়ে কতক্ষণইবা অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতা চালানো যায়? ফলে বন্ধুত্বটাও তেমন জমে উঠে না। অন্তরঙ্গতা তো পরের কথা।
ভাষা ছাড়াও রয়েছে সাংস্কৃতিক সমস্যা। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী যদি দুই সাংস্কৃতিক পটভূমির হন তবে সেক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। যেমন এশিয়দের মধ্যে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একধরনের ম্যান্ডেটরী বা বাধ্যতামূলক বিষয়। প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরা সেই সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ধরে রাখেন। কিন্তু এই সংস্কৃতি মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমে সবসময় পাওয়া যাবে তার কোন গ্যারন্টি নেই। কারণ সেখানে নানান সাংস্কৃতিক পটভূমির লোকেরা কাজ করেন। ফলে সেখানে বৃদ্ধরা সহজ হতে পারেন না অধিকাংশ সময়। এর পর রয়েছে ধর্ম, খাদ্য, পোষাকসহ আরো নানা বিষয়। বাঙ্গালীর প্রিয় ভাত মাছ। সেই ভাত মাছ কি নিয়মিত পাওয়া যাবে মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে? শুক্রবার জুম্মার দিন। মসজিদে না যেতে পারুক, মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে কি আলাদা কোন ব্যবস্থা থাকবে একসাথে জুম্মার নামাজ আদায় করার? একজন লুঙ্গি বা ধুতি পরা বৃদ্ধের সংগে আরেকজন লুঙ্গি বা ধুতি পরা বৃদ্ধ, অথবা একজন শাড়ি পরা বৃদ্ধা আরেক জন শাড়ি পরা বৃদ্ধার সঙ্গে যতটা সহজভাবে মিশতে পারবেন, নিজের দুঃখ বেদনা ভাগাভাগি করতে পারবেন তা কি অন্য পোষাক পরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সঙ্গে সম্ভব? ফলে এইসব বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে গিয়েও বাঙ্গালী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগণ একপ্রকার নিঃসঙ্গ জীবনযাপনই করেন। স্বামী-স্ত্রী এক সাথে থাকলে নিঃসঙ্গতা হয়তো কিছুটা কম থাকে। কিন্তু যাঁরা সিঙ্গেল তাঁদের জন্য নিঃসঙ্গতার সমস্যা থেকেই যায় বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে।
অবশ্য বৃদ্ধাশ্রম যদি ভাষাবান্ধব হয়, সংস্কৃতিবান্ধব হয় তবে ভিন্ন কথা। আমরা জানি অন্টারিতে বৃদ্ধদের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরীর বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এথনিক বৃদ্ধাশ্রমে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা পাওয়া যায় তা হলো, এখানে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভাল থাকে মেইনস্ট্রিমের বৃদ্ধাশ্রমের তুলনায়! কারণ, এই এথনিক বৃদ্ধাশ্রমে যাঁরা থাকেন তাঁরা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মনে করেন না, শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে তাঁরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন, বিষন্নতা বা মনমরা ভাব তাঁদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এবং সর্বপোরি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও কম এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে। কানাডার ওয়েলেসলি ইনস্টিটিউট সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা গেছে মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার ২৫.১%। অন্যদিকে এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে এই বিষণ্নতার হার মাত্র ৩.৩৫%! গ্রেটার টরন্টোর ই হং নামের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এরকম চিত্রই দেখা গেছে। ই হং এর চারটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে জিটিএ’তে। এগুলো চাইনিজ বংশোদ্ভূতদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ এই সকল বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যাঁরা থাকেন তাঁরা তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকেন। তাঁদের চারপাশে সবাই তাঁদের নিজেদের সংস্কৃতিরই লোক। তাঁরা স্টাফদের সঙ্গেও নিজের ভাষায় কথা বলতে পারেন। ফলে যোগাযোগটা হয় ষোলআনা। কোথাও কোন ফাঁক থাকে না। এখানকার অধিবাসীদের অভিমত হলো, “আমরা এখানে একটি পরিবারের মতই বাস করি”। কিন্তু মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এথনিক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাগণ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নিজেরদেরকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন মনে করেন যার যুক্তিসংগত কারণও রয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোর সংখ্যা অন্টারিওতে খুবই কম। এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে জায়গা পেতে হলে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। ওয়েটিং লিস্টে নাম পড়ে থাকে বছরের পর বছর। অন্টারিওতে মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় তিন থেকে চার মাস। আর চাইনিজ কমিউনিটির ই হং এ জায়গা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় গড়ে পাঁচ বছর! ই হং বৃদ্ধাশ্রমের স্কারবরো-ম্যাকনিকল শাখায় জায়গা পাওয়ার জন্য কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন দশ বছর ধরে!
টরন্টোতে বাঙ্গালীদের উদ্যোগে এখন পর্যন্ত কোন বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেনি। অদূর ভবিষ্যতে কেন দূর ভবিষ্যতেও হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবাসন ব্যয় যে ভাবে আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে তাতে করে বাঙ্গালীদের জন্য আলাদা বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা এখন দিবাস্বপ্নের মতই।
বাঙ্গালী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কেউ কেউ অবশ্য চিন্তা করেন অবসর জীবনটা বাংলাদেশে কাটাবেন। তাহলে নিঃসঙ্গতা এড়ানো যাবে। কারণ সেখানে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আছেন। আছেন কাছের ও দূরের আত্মীয়-স্বজনেরা। আরো আছেন শৈশবের বন্ধুরা। সুতরাং নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্বের সমস্যা কাটানো সহজ হবে। কিন্তু সেটিও অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতই। কারণ, বয়স যত বাড়ে, মেডিক্যাল ডিপেন্ডেন্সীও ততটা বাড়ে। কানাডায় আমরা চিকিৎসা সেবার যে সুবিধাটা পাই সেটা বাংলাদেশে কোনভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। আবার সমস্যা রয়েছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান নিয়েও। অন্যদিকে রয়েছে ভেজাল ওষুধের আতঙ্ক। তাছাড়া বাংলাদেশে গিয়ে বেশীদিন থাকাও যায় না। থাকতে গেলে ওল্ড এজ বেনিফিট, গ্যারান্টিড ইনকাম সাপ্লিমেন্ট এগুলো নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। অবশ্য যাঁরা অনেক ধনী তাঁদের কথা আলাদা। কারণ তাঁদেরকে এই সুবিধাগুলোর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর না করলেও চলে।
তারপরও প্রবাসী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অনেকেই দেখেছি নিঃসঙ্গতা এড়াতে বাংলাদেশ গিয়ে থাকেন বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময়। পরে আবার ফিরে আসেন কানাডায়। এভাবে যাওয়া আসার মধ্যেই থাকেন তাঁরা। কিন্তু বয়স যখন অনেক বেড়ে যায় তখন এই যাওয়া আসাও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দূরের ভ্রমণ তখন শরীর আর সইতে পারে না। তাছাড়া ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয় বা হাসপাতালে যেতে হয়। এই অবস্থায় প্রবাসে নিঃসঙ্গতাই হয়ে উঠে চরম বাস্তবতা জীবনের এই গোধূলি লগ্নের দিনগুলোতে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ