টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -২৩

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জায়ান্ট হুয়াওয়েই-এর চীফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মং ওয়ানট্রৌ-এর অ্যারেস্ট-এর প্রতিক্রিয়ায় চীন গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে কানাডার দুই নাগরিক মাইকেল কভরিগ এবং মাইকেল স্পাভর-কে আটক করে। কূটনৈতিক চালের একটি অংশ হিসেবে তাদেরকে যে আটক করা হয়েছে সেটা দিবালোকের মতন পরিস্কার বোঝা গেলেও চীন সরকার দাবী করে আসছিল যে তাদের এই আটকের সাথে মং ওয়ানট্রো-র আটকের কোন সম্পর্ক নেই। তাদেরকে আটক করা হয়েছে কারণ তাদের বিরুদ্ধে এসপিওনাজের স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। তারা চীনের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। তাদের এই আটক মিডিয়াতে ‘দুই মাইকেলের উপাখ্যান’ শিরোনামে নতুন আলোচনার সৃষ্টি করে। চীন কেন তাদেরকে আটক করেছিল সেটা বোঝার জন্য আমাদেরকে দেখতে হবে কে এই দুই মাইকেল এবং কেনই বা তারা চীনের রোষানলের শিকার হয়েছিলেন?

মাইকেল কভরিগ-এর জন্ম ১৯৭২ সালে কানাডাতে। তার বাবা-মা ১৯৫০ সালে হাঙ্গেরি থেকে কম্যুনিস্ট সরকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে চলে আসেন কানাডাতে। কানাডাতে বেড়ে উঠা এবং ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে ইংরেজী সাহিত্যে গ্রাজুয়েট মাইকেল কভরিগ নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভাগ্যান্বেষণে পিতৃভূমি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে ফেরত যান। সেখানে গিয়ে তিনি স্থানীয়দেরকে ইংরেজী শিখানোর কাজ নেন এবং সেই সাথে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে বুদাপেস্ট বিজনেস জার্নালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ‘বার্লিন ওয়াল’ পতনের পর সেই সময়টায় ইস্ট-ইউরোপীয়ান দেশগুলিতে বইছিল সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার উচ্ছল সমীরণ যা কিনা তরুণ প্রজন্মকে বদ্ধ সমাজের ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে প্রলুব্ধ করে তুলেছিল বোহেমিয়ান জীবনধারায়। ১৯৯৬ সালে মাইকেল কভরিগ সেই বোহেমিয়ান জীবনধারায় মিশে গিয়ে হয়ে উঠলেন বুদাপেস্টের একটি উঠতি পাংক ব্যান্ড দল ‘ব্যাংক্রাপ্ট’-এর লিড ভোকালিস্ট। সেই সময় তার পরনে থাকত সেই সময়কার পাংক ফ্যাশনের লেদার জ্যাকেট। কিন্তু তিনি ২০০১ সালে তিনি সেই লেদার জ্যাকেট পাল্টিয়ে স্যুট-টাই পরে অর্থাৎ নিজের ভোল পাল্টিয়ে ডিপ্লোম্যাট হিসেবে নতুন ক্যারিয়ার গঠনে মনযোগী হন। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমে তিনি নিউইয়র্কে আসেন এবং ২০০৩ সালে সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া থেকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেইয়ার্স-এ মাস্টার ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়াতে পড়াকালীন সময়ে হবু স্ত্রী ভিনা নাজিবুল্লাহ-এর সাথে তার পরিচয় হয়। মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেই তিনি মিডিয়া এন্ড কম্যুনিকেশন অফিসার হিসেবে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত কানাডার ইউএন মিশনে যোগ দেন। তিনমাস সেখানে কাজ করার পর তিনি ইউএনডিপি-এর সাথে যুক্ত হন। ২০১০ সালে তিনি কানাডা সরকারের ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড’-এ জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর পর অর্থাৎ ২০১২ সালে তিনি ‘গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স, কানাডা’-র ‘ফরেন সার্ভিস অফিসার অন ল্যাংগুয়েজ ট্রেনিং’ প্রোগ্রামে বেইজিং যান চাইনিজ ভাষা শিখতে। দুই বছরের ভাষা শিক্ষা শেষে তিনি বেইজিংস্থ কানাডিয়ান এমব্যাসিতে ফার্স্ট সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হন। দুই বছর পর ২০১৬ সালে তাকে হংকংস্থ কানাডিয়ান কনসুলেট জেনারেল অফিসে অ্যাসিস্ট্যান্ট কনসুল পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই সময় কানাডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডো তার প্রথম অফিশিয়াল ট্যুরে চীনে আসেন এবং এই ট্যুরের অংশ হিসেবে হংকং ভ্রমণ করেন। জাস্টিন ট্রুডোর ট্যুর শেষ হওয়ার পর পরই মাইকেল কভরিগ ‘লিভ অব অ্যাবসেন্স’ নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ নামক একটি এনজিও-এর হংকং শাখায় সিনিয়র অ্যাডভাইসার পদে যোগ দেন ২০১৭ সালে। যেহেতু কানাডা সরকারের চাকরীতে ইস্তফা না দিয়ে এই পদে যোগ দিয়েছেন তাই তিনি তার লিঙ্কড-ইন প্রোফাইলে এই পদটিকে ‘পার্ট টাইম’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই পদে থাকাকালীন অবস্থায় ২০১৯ সালের জানুয়ারীতে চীন সরকার তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক করে।

মাইকেল কভরিগ (বামে) এবং মাইকেল স্পাভর (ডানে) – দুই মাইকেলের উপাখ্যান (ছবিঃ ইন্টারনেট)

ম্যান্ডারিন ভাষায় পারদর্শী মাইকেল কভরিগ ক্রাইসিস গ্রুপের কাজের জন্য নিয়মিত মেইনল্যান্ড চীনে ভিজিট করা শুরু করেন। বেইজিং-এ বেশ কয়েক বছর কূটনৈতিক হিসেবে কাজ করার সূত্রে চীন সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তার বেশ জানাশোনা ছিল। তিনি সেই জানাশোনা-কে কাজে লাগিয়ে তাদের সাথে দেখা করে চীনের বিভিন্ন পলিসি নিয়ে আলাপ আলোচনা করে বুঝতে চেষ্টা করতেন চীন কিভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সে প্রভাব বিস্তার করছে। তারপর তিনি সেই তথ্যগুলিকে এনালাইসিস করে ক্রাইসিস গ্রুপের পক্ষ থেকে পাবলিক রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশ করতেন যাতে বিশ্বমঞ্চে চীনের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে অন্যান্য দেশ জানতে পারে। এটাই ছিল ক্রাইসিস গ্রুপের জন্য তার কাজের পরিধি। তিনি ক্রাইসিস গ্রুপের পক্ষ থেকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট তৈরি করেন। প্রথমটি ছিল কোরিয়ান পেনিনসুলাতে বিদ্যমান কনফ্লিট এড়ানোর উপায়ের উপর। এই রিপোর্টে তিনি আমেরিকা এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে উত্তেজনা কমানোর ব্যাপারে চাইনিজ সরকারের আইডিয়া নিয়ে আলোকপাত করেন। দ্বিতীয় রিপোর্টটি ছিল সাউথ সুদানে দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধ এবং মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ভূমিকা নিয়ে।

মং ওয়ানট্রৌ-এর গ্রেফতারের পাঁচ মাস পূর্বে উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উনের সাথে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিঙ্গাপুরে এক ঐতিহাসিক মিটিং-এ মিলিত হন। আমেরিকার জন্য এই মিটিং ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা কারণ এর পূর্বে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট সামনাসামনি বৈঠকে বসতে সক্ষম হননি। এমন কি কিম জং-উন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে ফেসটাইমে মিটিং করতে পর্যন্ত রাজী হননি। অথচ কোন এক বিচিত্র কারণে তিনি ‘রকেট ম্যান’ বলে তাকে তাচ্ছিল্য করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সামনাসামনি বৈঠকে বসতে রাজী হয়েছিলেন। আসলে কূটনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। পুরো বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল ট্রাম্প এবং কিমের মুখোমুখি সাক্ষাতের সেই ঐতিহাসিক মুহুর্তের জন্য। অবশেষে যখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি উপস্থিত হলো তখন সেটা সরাসরি সম্প্রচার করছিল বিশ্বের সব নামকরা সংবাদ সংস্থাগুলি। সেই সব লাইভ সংবাদ পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে দেখানো হচ্ছিল বিশেষজ্ঞদের আলোচনা। ট্রাম্প-কিমের মুখোমুখি সাক্ষাতের সেই উত্তেজনাকর সময়ে নয়া দিল্লীভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজ’-এর আয়োজিত এই রকম একটি আলোচনা অনুষ্ঠান ‘গ্রাভিটাস’-এ আরও দুইজন মার্কিন বিশেষজ্ঞের সাথে উপস্থিত হন মাইকেল কভরিগ। সেখানে তিনি ট্রাম্প এবং কিমের এই সামিটকে একটি পজিটিভ সামিট বলে উল্লেখ করেন। একই সাথে এই সামিটের সাফল্যের পিছনে তিনি হাইলাইট করেন কিমের সাথে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ককে। তিনি এখানে ইঙ্গিত করেন যে চার মাস পূর্বে কিম যখন শি চিনপিং-এর সাথে বৈঠক করেন তখন হয়ত শি চিনপিং-এর কাছ থেকে এমন কিছু নির্দেশনা পেয়েছিলেন যার ফলেই সম্ভব হচ্ছে আজকের কিম-ট্রাম্পের মুখোমুখি বৈঠক। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে কিম নিরাপত্তার কারণে প্লেনে চড়ে বিদেশ ভ্রমণে যান না। এছাড়াও উত্তর কোরিয়ার এমন কোন প্লেন ছিল না যেটা চড়ে তিনি সরাসরি সিঙ্গাপুরে যেতে পারেন। অবশেষে তিনি চীনের দেয়া প্লেনে করে সিঙ্গাপুরে এসেছেন এই বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য কারণ তিনি তার নিরাপত্তার ভার নিশ্চিন্তে শি চিনপিং-এর হাতে ছেড়ে দিতে পেরেছেন। মাইকেল কভরিগ প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত করেন যে কোনদিন যদি কোরিয়ান পেনিনসুলাতে শান্তি ফিরে আসে তবে সেটার সিংহভাগ কৃতিত্ব শি চিনপিং-এর পাওনা হবে। ঠিক পাঁচ মাস পর মাইকেল কভরিগ যখন ক্রাইসিস গ্রুপের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বেইজিং অবস্থান করছিলেন তখন ২০১৯ সালের জানুয়ারীর ১০ তারিখে হঠাৎ করে তিনি উধাও হয়ে যান। চীন সরকার কর্তৃক তার আটকের খরব নিশ্চিত হওয়ার পর তার এমপ্লয়ার ক্রাইসিস গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয় যে মাইকেল কভরিগ এমন কোন কাজে লিপ্ত ছিলেন না যেটা চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে বরং তার কাজ থেকে চীন বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছে। কারণ কাজের লক্ষ্য ছিল চীনের সাথে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলির বিদ্যমান উত্তেজনা লাঘব করা এবং বিশ্বমঞ্চে চীনের ইতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরা।

‘দুই মাইকেলের উপাখ্যান’-এর দ্বিতীয়জন হচ্ছেন মাইকেল স্পাভর। ১৯৭৬ সালে টরন্টোতে জন্ম তার। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন ক্যালগেরিতে। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ১৯৮৮ সালে তার সৌভাগ্য হয়েছিল ক্যালগেরিতে অনুষ্ঠিত উইন্টার অলিম্পিক দেখার। কয়েক মাস পর তিনি সামার অলিম্পিক দেখার জন্য সাউথ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে যান। সেখান থেকেই শুরু হয় তার উত্তর এবং দক্ষিণ এই দুই কোরিয়ার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ। তাই তিনি ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়াতে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে তিন মাসের এক সফরে যান। কিন্তু তিন মাসের বদলে তিনি সেইবার পার করে দেন দুই বছর। এই দুই বছরে তিনি রেডিও অনুষ্ঠানের কো-হোস্ট কিংবা কন্ঠ দেয়ার কাজ, এমন কি সিনেমাতে এক্সট্রা হিসেবে অভিনয়ের কাজ ইত্যাদি নানা ধরণের কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু মায়ের স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে আবার ক্যালগেরিতে ফিরে আসতে হয়। ফিরে এসে তিনি ২০০২ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরিতে আন্ডারগ্রেড কোর্সে ভর্তি হন এবং ২০০৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। গ্রাজুয়েশনে তার মেজর ছিল ‘কোরিয়ান পেনিনসুলা এন্ড ইস্ট এশিয়ান স্ট্যাডিজ’। ২০০৮ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার কাংওন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্স এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড-এর উপর একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেন। এরপর তিনি কোরিয়ান ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি একই সাথে রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি নামক এনজিও-এর কোরিয়ান শাখার কাউন্সিল মেম্বার হিসেবে যোগ দেন। কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার উপর তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী না থাকলেও তার লিঙ্কড-ইন প্রোফাইল অনুযায়ী এই ভাষার উপর তার দখল রয়েছে ‘ফুল প্রফেশনাল প্রফিসিয়েন্সি’ লেভেলের। তিনি উত্তর কোরিয়াতে প্রচলিত ডায়ালেক্টও সমান পারদর্শী। কোরিয়ান ভাষার উপর দক্ষতাকে পুঁজি করে তিনি ২০১০ সালে ‘পিয়ংইয়ং প্রজেক্ট’ নামক একটি এনজিও-এর এর দক্ষিণ কোরিয়ার শাখায় ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার ভিত্তিক এই ‘পিয়ংইয়ং প্রজেক্ট’-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলির ছাত্র এবং শিক্ষাবিদদের জন্য উত্তর কোরিয়াতে শিক্ষা ভ্রমণের আয়োজন করা। এই এনজিও-এর মতে এই শিক্ষা ভ্রমণের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের একটি মেলবন্ধন তৈরি হবে যা কিনা কোরিয়ান পেনিনসুলাতে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনাকে প্রমশিত করতে সাহায্য করবে।

উত্তর কোরিয়ার সাথে মাইকেল স্পাভরের প্রথম যোগাযোগ হয় ২০০১ সালে যখন তিনি সেখানে ছুটি কাটানোর জন্য যান। চার বছর পর অর্থাৎ ২০০৫ সালে আন্ডার গ্রাজুয়েট কোর্স থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে তিনি আবারও উত্তর কোরিয়াতে যান পিয়ংইয়ং-এর একটি স্কুলে ইংরেজী এবং গ্রাফিক ডিজাইন শিখানোর কাজ নিয়ে। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার ভিত্তিক একটি এনজিও-এর একটি প্রোগ্রাম ছিল সেটা। ছয়মাস মেয়াদী এই শিক্ষকতার কাজের সময় আমেরিকার দলত্যাগী সৈনিক জেমস যোসেফ ড্রেসনক-এর সাথে তার দেখা হয়। কোরিয়ান যুদ্ধের সময় যে সাতজন আমেরিকান সৈনিক উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যোগ দেন জেমস হচ্ছেন তাদের একজন। উত্তর কোরিয়া মাইকেল স্পাভরকে তাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিশ্বাস করেছিল বলেই হয়ত তার সাথে আমেরিকার দলত্যাগী সৈনিকের সাক্ষাৎ করিয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক ম্যাগাজিনের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে মাইকেল স্পাভর উল্লেখ করেন যে, অনেকে মনে করতে পারে যে আমি উত্তর কোরিয়াতে যেতে ভালোবাসি কারণ সেখানে যাওয়াটা রোমাঞ্চকর কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে আমি সেখানকার জনগণকে ভালোবাসি। তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জংউন-এর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হন। সেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় যখন তিনি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যান-এর সাথে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জংউন-এর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। রডম্যান এবং কিমের সেই সাক্ষাৎকারের সময় মাইকেল স্পাভর দোভাষীর কাজও করেন। তার কর্ম দক্ষতায় তুষ্ট হয়ে উত্তর কোরিয়ার স্পোর্টস মিনিস্ট্রি কানাডার সাথে উত্তর কোরিয়ার হকি ম্যাচের আয়োজন করার জন্য তাকে প্রস্তাব দেয়। এভাবেই মাইকেল স্পাভরের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক দৃঢ় হতে শুরু করে এবং একই সাথে উত্তর কোরিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল পশ্চিমা কম্যুনিটিতেও তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তার এই কষ্টার্জিত সুনাম এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আরও কিছু প্রজেক্টকে হাত দেয়ার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথমে তিনি ‘পিয়ংইইয়ং প্রজেক্ট’ এনজিও থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কিম জংউন-এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত উত্তর কোরিয়ার ওনসান শহরের উন্নয়ন কাজের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ২০১৪ সালে তিনি আবার ডেনিস রডম্যানের উত্তর কোরিয়া সফরের আয়োজন করেন। তিনি উত্তর কোরিয়া থেকে খুব কাছে চীনের তানতোং নামক শহরে থাকা শুরু করেন যেখান থেকে একটি সরু নদী পেরোলেই উত্তর কোরিয়াতে যাওয়া যায়। এরপর ২০১৫ সালে ‘পায়েকটু কালচারাল এক্সচেঞ্জ’ নামক একটি এনজিও গড়ে তুলেন যার লক্ষ্য হচ্ছে এমন কিছু ইভেন্টের আয়োজন করা যাতে উত্তর কোরিয়ার জনগণ বহির্বিশ্বের জনগণের সাথে মেলামেশার সুযোগ পাবে। উত্তর কোরিয়াতে বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তার ‘পায়েকটু কালচারাল এক্সচেঞ্জ’ এনজিও উত্তর কোরিয়ার যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবে। অর্থাৎ কিনা তার এই প্রতিষ্ঠান উত্তর কোরিয়ার একটি মুখপাত্র হয়ে বহির্বিশ্বের সাথে কাজ করবে। তার লিঙ্কড-ইন প্রোফাইল অনুসারে ২০১৫ থেকে আজ অবধি অর্থাৎ প্রায় নয় বছর ধরে তিনি এই সংস্থার ফাউন্ডার এবং এক্সিকিউটিভ হেড হিসেবে কর্মরত। এই নয় বছরে তাদের কোন কাজের ট্র্যাক রেকর্ড অবশ্য কোথাও উল্লেখ নেই।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে মাইকেল স্পাভর তার ফেসবুকের মাধ্যমে প্রায় পঞ্চাশজনের কাছে মেসেজ পাঠান যে আগামীকাল তিনি চীন থেকে সিউলে আসছেন। তারা যদি তার সাথে দেখা করতে চান তবে তিনি সেই মোতাবেক তাদের সাথে সাক্ষাতের সময় ঠিক করবেন। একই সাথে তিনি তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে টুইটারে মেসেজ পাঠান যে তিনি তাদের সাথে কোন একটা বারে বসে সময় কাটাতে চান। কিন্তু তিনি সিউলে আর পৌঁছাতে পারেন নি। পরদিন রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটির সিউল অফিসের নির্ধারিত মিটিং-এ তিনি অনুপস্থিত যেখানে তার উত্তর কোরিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেকচার দেয়ার কথা ছিল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনদিন পর চীন সরকার নিশ্চিত করে যে মাইকেল স্পাভরকে তারা গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে আটক করেছে। তার এই গ্রেফতারে সিকিউরিটি এক্সপার্ট আন্দ্রেই ল্যানকভ অবাক হয়ে মন্তব্য করেন যে, মাইকেল স্পাভর একজন ‘হামবল অরিজিন’-এর ব্যক্তিত্ব যিনি কিনা তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বহির্বিশ্বের কাছে উত্তর কোরিয়ার পজিটিভ ইমেজকে তুলে ধরার জন্য। তিনি অবশ্যই চীন এবং কানাডার মধ্যে চলমান ‘হোস্টেজ গেম’-এর শিকার।

আপাতদৃষ্টিতে দুই মাইকেলের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না বলে মনে হলেও কিন্তু সময়ের আবর্তনে আমরা এখন জানি যে তারা একে অপরের পরিচিত ছিলেন। চীন থেকে মুক্তি পাওয়ার দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর ২০২৩ সালের নভেম্বরে মাইকেল স্পাভর অনেকটা বোমা ফাটানোর মতন একটি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন যে মাইকেল কভরিগের কারণে তিনি এসপিওনাজের জালে আটকা পড়েছিলেন। তিনি যে সব ক্লাসিফাইড ইনফরমেশন মাইকেল কভরিগকে সাপ্লাই করতেন সেটা মাইকেল কভরিগ তার অগোচরে গোপনে কানাডিয়ান সরকারকে দিত। সেই ইনফরমেশন এক সময় কানাডার ইন্টিলেজেন্স অ্যালাই ফাইভ-আইস-এর হাতে চলে যেত। যেহেতু তিনি এই গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না এবং তার অগোচরে তাকে এই জালে ফেলা হয়েছে তাই তিনি কানাডার সরকারের বিরুদ্ধে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে কানাডা সরকার দুই মাইকেলকেই তিন মিলিয়ন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যাপারটা কোর্টের বাইরে মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু মাইকেল স্পাভর তার আইনজীবীর মাধ্যমে জানিয়েছেন যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার প্রাপ্য হচ্ছে সাড়ে দশ মিলিয়ন ডলার। সময়েই বলে দিবে কানাডা সরকার এই মামলাকে কিভাবে সামাল দিবে।

(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

‘দ্য টু মাইকেলসঃ ইননোসেন্ট কানাডিয়ান ক্যাপটিভস এন্ড হাই স্টেকস এসপিওনাজ ইন ইউএস-চায়না সাইবার ওয়ার, ফেন হ্যাম্পসন, মাইক ব্লাঞ্চফিল্ড -সুদারল্যান্ড হাউজ, টরন্টো, ২০২১

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো