মনের আয়নাতে
সাইদুল হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কয়েকজন নারী ও পুরুষ
(১)
স্কুল টীচার
মহিলার বয়স ৪০-৪৫ বছর হতে পারে। সাদা। আমাদের স্কুল সাপ্লাইজ স্টোরে বাচ্চাদের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছেন অনেক্ষণ ধরে দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : ম্যাডাম কোন সাহায্য করতে পারি কি? তিনি বললেন: নো, থ্যাঙ্ক ইউ। জাস্ট ব্রাউজিং।
কয়েক মিনিট পর এগিয়ে এসে আমার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন যে তিনি একজন স্কুল টীচার। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ইংল্যান্ডে, বর্তমানে ক্যানাডাতে তিনি শিক্ষকতা করছেন। তবে যতই দিন যাচ্ছে তিনি লক্ষ্য করছেন যে স্কুলে, বিশেষতঃ টরন্টো এবং গ্রেটার টরন্টোর স্কুলগুলোতে, তুলনামূলক হারে সাদা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে নন-হোয়াইটদের সংখ্যা বিভিন্ন স্কুলে। পলিটিকাল কারেক্টনেস্ বজায় রাখতে গিয়ে আমাদের এই খৃষ্টানদের দেশ ক্যানাডাতেও ক্রিসমাসের সময় আগের মত সবাইকে মন খুলে ‘মেরী ক্রিসমাস’ বলা যায় না, বলতে হয় হ্যাপী হলিডেজ্। হোয়াইট টীচারদের মাঝে এসব একটা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তারা ক্রমেই মাইনরিটি হয়ে পড়ছেন, ‘নিজ দেশে পরবাসী’ হয়ে যাচ্ছেন; নিজেদের ফিজিক্যালি অ্যান্ড সাইকোলজিক্যালি খাপ খাওয়াতে বেশ কষ্ট লাগছে। তাঁর মতে সরকারী ইমিগ্রেশন পলিসিই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অদূর ভবিষ্যতে আরো বিপুল পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে সেই লক্ষণ তাঁদের চোখে সুস্পষ্ট। কথা শেষ করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন সেই টীচার মহিলা।
আমার মত নন-হোয়াইট একজনের সামনে মহিলা তাঁর এই গভীর দুঃখের কথাগুলো কেন বললেন সেটা এক রহস্য বটে।
(দুই)
সোমালী মেয়েদের কথা
What else is better than being a mother? (মা হওয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর কি আছে? এক সোমালী মহিলা প্রশ্ন করলেন আমাকে। তিনি ছিলেন আমাদের স্টোরের একজন কাস্টমার, তাঁর ছোট বাচ্চার জন্যে বই কিনতে এসেছিলেন। মহিলা প্রেগন্যান্ট। আরো চারটি ছেলেমেয়ে আছে তাঁর, তিনি নিজেই আমাকে জানালেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম এত বেশী সন্তানের প্রয়োজন কি? জবাবে তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন : মা হওয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর কিছু আছে কি?
আমাদের স্টোরের কাস্টমারদের মাঝে কালোরই আধিক্য – গায়ানীজ, জামাইকান, সোমালী ও অন্যান্য আফ্রিকান কান্ট্রির লোক। বেশ কিছু আছে সাউথ আমেরিকান, ওরা সবাই স্প্যানিশ বলে। সোমালীদের সবাই মুসলিম এবং প্রায় সবারই ৬-১০টা করে সন্তান। কি করে এদের জীবন কাটে সে- এক রহস্য আমার কাছে। অতি দরিদ্র চেহারা ও পোষাক-আশাক, অধিকাংশই ওয়েলফেয়ার খেয়ে বেঁচে আছে, অথচ নির্দ্বিধায় একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর।
অন্য এক মহিলা তিনিও প্রেগন্যান্ট এবং তাঁরও চারটি সন্তান। তিনি ‘এতগুলো সন্তানের প্রয়োজন কি?’ আমার এই প্রশ্নের জবাবে বললেন : আমি জানি না, আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন।
বইখাতা-পেন্সিল কিনতে এসে অপর এক সোমালী মহিলা কথাপ্রসঙ্গে আমাকে জানালেন যে তিনি ৮টি সন্তানের মা (১৬-২ বছর বয়স ওদের) এবং সেজন্যে তিনি গর্বিত বোধ করেন; তিনি আরো সন্তান চান। আমি হাসতে হাসতে মন্তব্য করলাম : এত বেশী সংখ্যক সন্তানের গর্ভধারণ, প্রসব, লালনপালন তো খুবই কষ্টের ব্যাপার। কি করে সহ্য করেন?
তিনি বললেন : মা হওয়ার আগ্রহ থাকলে এগুলো মোটেই কোন কষ্টের কাজ নয়। তাছাড়া মা হতে রাজী না হলে আমার স্বামী আমাকে তালাক দেবে, আবার বিয়ে করবে। সেটা আমি চাই না।
(তিন)
সন্তানের জন্যে
পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের একজন হোয়াইট ক্যানাডিয়ান কাস্টমার আমার কাউন্টারে এসে কিছু জিনিসের মূল্য পরিশোধ করছিলেন। মনে হলো তাঁর খুব তাড়া আছে অন্য কোথাও যাবার। বললাম : খুব তাড়া আছে বলে মনে হচ্ছে?
তিনি বললেন : তাড়া বলতে তাড়া! এইমাত্র ডে-শিফ্ট্ শেষ করে বের হয়েছি, একটু পরেই গিয়ে নাইট শিফ্ট্ শুরু করতে হবে – এমনি করেই চলছে আমার জীবন। শুনে বললাম : আপনার নিজেরও তো একটা জীবন আছে, আরাম বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।
শুকনো হাসি হেসে তিনি বললেন তা আছে বৈকি, তবে এখন সময় নেই সেজন্যে, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে দেখবো। ছেলেমেয়েরা কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, তাদের খরচের ধাক্কাটা সামলাতে হবে আগে। আমি তো তাদের প্রোভাইডার, আমার নিজের কথাত ভাবলে কি চলে? আচ্ছা চলি, বা-ই!
(চার)
জেসাস ক্রাইস্টের আহ্বান (১)
অনেক দরকাষাকষির পর একজন কাস্টমার একটা ব্যাগ কিনলেন। তাতে তাঁর বিরাটাকারের বাইবেলটা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সহজ হবে, বললেন তিনি।
আমারই মত ময়লা তার গায়ের রং, ইংলিশে ইন্ডিয়ান অ্যাকসেন্ট। পকেট থেকে ডলার বের করতে গিয়ে বের করলেন তার পাসপোর্ট, তারপর সেটা আমার সামনে খুলে ধরলেন। পাকিস্তানী পাসপোর্ট, ভদ্রলোকের নাম আলী আরশাদ। বয়স ৪৮ বছর। তাঁর বক্তব্য অনুসারে :
ছিলাম আমি একজন মুসলিম। বাবার সঙ্গে মসজিদে গিয়ে নিয়মিত নামাজ পড়তাম, রমজানে রোজা রাখতাম, কুরআন শরীফ পড়তাম। সবই চলছিল গতানুগতিক ধারায়। হঠাৎ একদিন জেসাস ক্রাইস্ট আমাকে ডাক দিলেন – এই আপনি-আমি এখন যেমন মুখোমুখি কথা বলছি, ঠিক তেমনি – আমি তাঁর কণ্ঠস্বর অতি স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। জেসাস আমাকে ডেকে বললেন : আরশাদ, তুমি আমার কাছে আস, আমার ব্লেসিং নাও, মানুষের মাঝে আমার বাণী প্রচার কর, তোমার স্যাল্ভেশন নিশ্চিত। কাজে লেগে পড়।
আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম, ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলাম। ধর্ম প্রচারই এখন আমার একমাত্র কাজ। আমি প্রতিদিনই আমার চারদিকে ক্রাইস্টের অগনিত সব মিরাকেল্স্ দেখি। আই অ্যাম ব্লেস্ট্! আই অ্যাম ব্লেস্ট্! আমি ধন্য!
তারপর ব্যাগের দাম মিটিয়ে দিয়ে স্টোর থেকে বের হয়ে গেলেন।
জেসাস ক্রাইস্টের আহ্বান (২)
টরন্টোর এক হাসপাতালের ফ্র্যাকচার ক্লিনিকে একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করি। আমার কাজ ইনফর্মেশন ডেস্কে। রোগী অথবা তাঁদের অ্যাটেন্ডেন্টরা কে কোথায় যাবে সেই নির্দেশ দিই। অনেকের সঙ্গে তাঁদের ডাক্তারের কাছে যাবার আগের সময়টাতে গল্পসল্পও করি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের লোকেরই দেখা পাওয়া যায় সেই ক্লিনিকে। বহু রোগী সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে চিকিৎসার জন্য আসে, ফলে পরিচয়ের গভীরতা বেড়ে চলে। তেমনি এক ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের কাহিনী বলছি।
তিনি শিখদের মত দাড়ি-পাগড়িওয়ালা নন, সামান্য একটু দাড়ি আছে যদিও। প্রতি সপ্তাহেই আসেন স্ত্রীকে নিয়ে, সঙ্গে থাকে আড়াই-তিন বছরের একটি ছেলে। স্ত্রী চিকিৎসার জন্যে ক্লিনিকের ভেতরে যান, ভদ্রলোক ছেলেটিকে সামলান। পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলেন।
একদিন ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার নাম কি? আমার প্রশ্ন শুনে সে তার বাবার কোলে মুখ লুকালো।
ভদ্রলোক তখন বললেন : ওর নাম পল থ্রী।
শুনে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম : আপনারা শিখ নন? তিনি বললেন : থে, আভি নেহী। ধরম বদল লিয়া বহুত মুদ্দৎ পেহ্লে। আভি ঈসাঈ হুঁ, অর্থাৎ শিখ ছিলাম তবে বর্তমানে নই। বহুদিন আগেই ধর্ম বদলে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছি। আমরা এখন খৃষ্টান। জেসাসের ডাক শুনে মুক্তির পথ বেছে নিয়েছি। আমার তিন ছেলে, তিনজনেরই নাম রেখেছি জন পল – জন পল ওয়ান, জন পল টু অ্যান্ড জন পল থ্রী। খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করাই আমার একমাত্র কাজ এখন।
কিছু সংলাপ
রিটায়ার্ড লাইফ, হাতে প্রচুর সময়, তাই ঘরে অলস বসে না থেকে একটা হাসপাতালে এবং একটা সোশ্যাল অ্যাসিস্টেন্ট এজেন্সীতে সপ্তাহে একদিন করে কাজ করি। সময়টাও ভাল কাটে। মনে বেশ একটা তৃপ্তি অনুভব করি এই ভেবে যে সমাজের একটু ঋণ পরিশোধ করছি, সারা জীবন তো শুধু দু’হাত ভরে গ্রহণই করে গেলাম। আমার এই কাজের মাঝে বহু অভিজ্ঞতা লাভ করি, প্রায় প্রতিদিনই নতুন একটা কিছুর সম্মুখীন হই।
জানুয়ারী মাস, খুব ঠান্ডা সেদিন। হাসপাতালে এক রোগীকে ভর্তি করতে নিয়ে এসে ডাক পরার অপেক্ষায় আছে তেমনি এক ক্যানাডিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে আবহাওয়া নিয়ে কথা বলছিলাম : খুব ঠান্ডা। আগামী এপ্রিলের আগে তো এই ঠান্ডা কমার কোনও আশা নেই।
শুনে সে বলল : ঠিক তা নয়। গড- এর সঙ্গে আমার একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে, গড- এর সঙ্গে আমি প্রায়ই কথা বলে থাকি। তুমি যদি চাও তাহলে গডকে অনুরোধ করে আমি সামার সীজনটাকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে আসতে পারি।
তার কথা শেষ হলে আমি বললাম : না, তা চাই না। গড-এর কাছে চাইবার মতো আরো মূল্যবান বস্তু রয়েছে।
– কি সেটা? উইনিং লটারী? বিউটিফুল উম্যান? জানতে চাইলো সে।
বললাম : না, ওসব নয়।
– কি সেটা, জানতে পারি কি? আবার প্রশ্ন।
বললাম : Peace of mind, contentment, a pious life free from greed and anxiety, good health.
আমার কথা শুনে লোকটা বলল : Oh, you are so old-fashioned. You don’t know to enjoy life. তারপর ‘বা-ই’ বলে হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
* * *
আর একদিন। তীব্র ঠান্ডা সেদিনও। হাসপাতালের মেন্ এন্ট্রেন্সের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে রোগী ও তাদের সঙ্গীদের গন্তব্যস্থলের দিক নির্দেশ দিচ্ছি, এমন সময় এক বৃদ্ধ জ্যামাইকান লাঠি হাতে দরজা দিয়ে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লো এবং অনেক্ষণ ধরে তার কোটের প্যান্টের এ-পকেট ও -পকেট হাতড়াতে লাগলো। একটু এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : কোনও সাহায্য করতে পারি কি?
আমার প্রশ্ন শুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে থ্যাঙ্ক ইউ’ জানিয়ে বলল : নো, নট ইয়েট। আমি আমার পকেটগুলো হাতড়িয়ে দেখছি, যদি প্রয়োজনীয় কাগজগুলো খুঁজে না পাই তাহলে তোমার সাহায্যের দরকার হতে পারে। তবে কি জানো? Depend on God. He helps. Always.
তারপর একটু থেমে লাঠিতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার বলল : Trust in God. Any time you doubt Him, you lose.
শুনে গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকালাম বৃদ্ধের মুখের দিকে। কি গভীর বিশ্বাস গড-এর উপর।
মনে পড়লো Jim Noonan এর বলা দুটো লাইন :
NO GOD, NO PEACE.
KNOW GOD, KNOW PEACE.
* * *
যে সোশ্যাল অ্যাসিস্টেন্স এজেন্সীতে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করি সেখানে একদিন সাউথ আমেরিকান এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি সেই অফিসে স্প্যানিশ স্পীকিং অন্য এক সাউথ আমেরিকান স্টাফের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেই ভদ্রলোক খুব ব্যস্ত থাকার কারণে মহিলা ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ইংরেজিতে আমার সঙ্গে আলাপ জমালেন।
তিনি বললেন : আমার বয়স এখন ৬৫ বছর, সিনিয়র হয়েছি তবে এখনও ওল্ড এজ্ পেনশন পেতে শুরু করিনি। পঁচিশ বছর ধরে ক্যানাডায় আছি, তিন ছেলে মেয়ে, ওদের বিয়েশাদী হয়ে গেছে, নানী হয়ে গেছি ইতিমধ্যে। বর্তমানে একাই থাকি। একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাই এই অফিসে এসেছি সাহায্যের আশায়।
মহিলার স্বাস্থ্য বেশ ভাল, ৬৫ বছর বয়সের কোনই ছাপ পড়েনি তাঁর দেহে। দেখতেও বেশ সুন্দরী। বয়স ৬৫-র অনেক নীচে বলেই চোখে লাগে।
জিজ্ঞাসা করলাম : একা থাকেন কেন? আপনার স্বামী কোথায়?
তিনি বললেন : বিয়ের পাঁচ বছর পরই স্বামী মারা গেছেন তিনটি সন্তান রেখে, তারপর আর বিয়ে করিনি। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ক্যানাডায় আসার ব্যবস্থা করা এবং এদেশে এসে সন্তানগুলোকে মানুষ করা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তার ওপর চাকরি ঝামেলা। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা আর মনেই স্থান দিইনি। এক স্বামীর সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে ঘর করেই বুঝে গিয়েছিলাম পুরুষ মানুষগুলো কত নিষ্ঠুর, কত অমানুষ হতে পারে, স্ত্রীর প্রতি কতটা দুর্ব্যবহার করতে পারে। বিয়ের সাধ মিটে গিয়েছিল। এত দায়িত্ব, এত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পাইনি। এত সবের মাঝে পুরুষ মানুষ খোঁজার সময়ই বা কোথায়?
হেসে দিয়ে বললাম : আপনি তো এই ৬৫ বছর বয়সেও বেশ স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী, যৌবনে তো অবশ্যই আরো বেশী সুন্দরী ছিলেন, ইচ্ছে করলেই তো মনের মত সুপুরুষ স্বামী বেছে নিতে পারতেন। সব পুরুষই তো আর নিষ্ঠুর হয় না।
আমার কথা শেষ হলে তিনি বললেন : আমার স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের প্রশংসা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তবে একটু আগেই আপনাকে বলেছি যে আমার স্বামীর দুর্ব্যবহারে এবং অত্যাচারে আমি পুরুষ জাতিটার উপরই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, মনটা ওদের প্রতি বিষিয়ে গেছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মন ভুলিয়ে বিয়ে করার পরই নিজেদের কুৎসিত চেহারাটা দেখাতে শুরু করে। অত্যাচারী, নিষ্ঠুর সব। কিছু মনে করবেন না আমার এই পুরুষ-বিরোধী কথাগুলোর জন্যে, প্লীজ।
তবে আমার বর্তমান স্বাস্থ্যের জন্যে আমার আজীবন স্বাস্থ্য সচেতনতাই ধন্যবাদ পেতে পারে। তাছাড়া আমি একজন স্বাধীনচেতা নারী, তাই সন্তানদের অনুরোধ সত্ত্বেও আমি ওদের উপর নির্ভরশীল হতে রাজী নই। আমি আমার সংগ্রামী জীবনটাকেই ভালবাসি।
একজন সংগ্রামী নারী
প্রতি বছরই গ্রীষ্মে সন্ধ্যার আগে এক ঘন্টা হেঁটে বেড়াই আমাদেরই সুন্দর ফুলে-ফলে ভরা আকর্ষণীয় পাড়াটির ভেতরে। সময়টা সুন্দর ভাবে কেটে যায়। ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যরক্ষা তো উপরি পাওনা।
তেমনি হাঁটার শেষে ২০০৪ সনের গ্রীষ্মে প্রায় প্রতিদিন একই রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরতাম। প্রতিনিই দেখতাম এক বৃদ্ধাকে তাঁর বেশ বড়সড় বাড়িটির সামনের লনে ঘাস কাটছেন বা বাগানের ফুলগাছগুলির পরিচর্যা করছেন, অথবা ঘাসের উপর পানি ছিটাচ্ছেন। মহিলা সমস্ত পরিবেশটাকে সুুন্দর ঝকঝকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছেন। দেখতে খুব ভাল লাগত। কিন্তু কোনদিন কোন পুরুষ বা নারী অথবা ছোট বাচ্চা আমার নজরে পড়েনি। মহিলাকে প্রতিদিনই দেখি কিন্তু কোনদিন কথা বলিনি।
একদিন মহিলাকে তাঁর ড্রইভওয়ে পরিস্কার করতে দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম : গুড ইভনিং, ম্যাম। হাউ আর ইউ টুডে?
– বাই দ্য গ্রেস অব্ গড আমি ভাল আছি। থ্যাঙ্কস্। আপনি কেমন আছেন?
বললাম : আমিও ভাল আছি, ধন্যবাদ। তারপর বললাম : প্রতিদিনই আপনাকে একাগ্রমনে কাজ করতে দেখি, বড় ভাল লাগে আমার। এই পাড়াতেই থাকি, আমার নাম সাইদ। আনার সাথে পরিচয় করতে এলাম।
– খুশী হলাম আপনার কথা শুনে। হ্যাঁ, কাজ তো করতেই হবে। আমি তো একা, তাই সব কাজ আমিই করি। গড হেল্প্স্ মি।
বললাম : গড তো আপনাকে হাতে হাতে সাহায্য করেন না, অন্য কেউ আপনাকে করছে তাও তো দেখি না কোনদিন।
– গড সরাসরি সাহায্য করেন না ঠিক, তবে তিনি আমাকে কাজ করার উৎসাহ ও শারীরিক শক্তি জোগান। আমার কর্ম সম্পাদনে তাই কোন অসুবিধা হয় না।
– আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে গড আপনাকে শক্তি জোগান, উৎসাহ দেন? জানতে চাইলাম।
-শুধু মনেই করি না, আমার সমস্ত হৃদয় মন দিয়ে অনুভব করি যে তিনি প্রতি মুহূর্তে আমাকে দয়া করে যাচ্ছেন, নাহলে এই এত বছর ধরে আমি টিকে আছি কি করে? এই ঘরবাড়ি করলাম কি করে? পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়েকে একা একা মানুষ করলাম কি করে?
– কেন আপনার স্বামী কোন সাহায্য করেন না? জানতে চাইলাম আমি।
আমার প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মহিলা বললেন : শুনুন তাহলে আমার কাহিনী। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে পাঁচটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে জ্যামাইকা থেকে আমার স্বামীর সঙ্গে ক্যানাডায় আসি। আমার বয়স তখন ২৩ বছর। এদেশে আসার কিছুদিন পর আমার স্বামীর স্বভাব-চরিত্র-ব্যবহার ক্রমশ বদলে যেতে লাগলো। শুরু হলো আমার প্রতি অবহেলা। অশান্তি সয়ে নিয়েই কিছুদিন ধৈর্য ধরলাম, তাকে বোঝালাম যদি ভালর দিকে আবার ফিরে আসে। কিন্তু না, সবই বৃথা। তাই একদিন সেপারেশন নিয়ে তাকে তার পথ দেখতে বললাম। সন্তানগুলির দায়িত্ব গ্রহণ করলাম আমি নিজে। সে আজ আঠারো বছর আগেকার কথা। সতেরো বছর ধরে একটা ফুল-টাইম কাজ করি আমি। গডই শক্তি দিলেন, সাহস দিলেন, বুদ্ধি জোগালেন। বাড়ি কিনলাম, সন্তানগুলোকে যথাসাধ্য শিক্ষা দিলাম। ওরা আজ স্বাধীন, নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
এতটা বলে দম নিতে থামলেন বৃদ্ধা।
জানতে চাইলাম : এত যে কষ্ট করলেন, স্যাক্রিফাইস করলেন ওদের জন্য, আপনার সন্তানেরা কি তা অনুভব করে? আপনার খোঁজখবর নেয় কি ওরা?
– হ্যাঁ, তা করে বৈকি। কিন্তু আমি ওদের কোন সাহায্য নিই না বা প্রত্যাশাও করি না। ওদের বলি, অর্থ নয়, ওদের শ্রদ্ধা-ভালবাসাটুকু পেলেই আমি খুশি। এক মেয়ে থাকে ক্যালিফোর্নিয়াতে। বছরে অন্ততঃ একবার হলেও আমার এখানে এসে কয়েকদিন কাটিয়ে যায়। অন্যরাও নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। আমার সকল ভরসা, সকল প্রার্থনা, একমাত্র গড-এর কাছে। তিনি আমাকে ভালবাসেন, আমার সমস্ত চাহিদা পূরণ করেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এই যে ১৮ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমি অন্য কোন পুরুষের দিকে ফিরে তাকাইনি। কাউকে আমার ঘরে ঢুকতে দিইনি। এই মনের বল, চরিত্রের দৃঢ়তা দিয়েছেন আমার গড। হি অল্ওয়েজ ওয়াচেস্ ওভার মি। আই অ্যাম অল্ওয়েজ আন্ডার হিজ প্রটেকশন। আই অ্যাম ব্লেসেড্, আই অ্যাম রিয়েলী ব্লেসড্।
এই বলে তিনি বুকে ক্রস আঁকলেন এবং আমাকে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন : ছেলেমেয়েগুলো সবাই তো আর বাইবেলের কথা মেনে চলে না, গড-এর প্রতি ওদের শ্রদ্ধা-ভক্তি কম। দু’জন তো বিয়ে না করেই সন্তানের মা-বাবা হয়ে গেছে, এদেশের ধর্মবিহীন কমন ল’ই ওদের ধর্ম যা আমি সমর্থন করি না। বলি, এটা ঠিক নয়, আইনসম্মতভাবে বিবাহ কর, গেট্ ব্লেস্ড্ বাই গড। কিন্তু এ-যুগের ছেলেমেয়ে এরা, আমার নীতিকথা মানতে নারাজ। সুবিধাবাদী সব। বলি আমাকে দেখেও তো শিক্ষাগ্রহণ করতে পারিস। তারা কথা বলে না, চুপ করে থাকে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মাম্মী, আই লাভ ইউ’।
তাঁর সুন্দর ফুলের বাগানের প্রশংসা করলাম। খুশি হয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ কাঁচি হাতে নিয়ে সুন্দর সুন্দর অনেকধরনের ফুল ডালপাতাসহ কেটে এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন : আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ পেলাম। আবার আসবেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম : অবশ্যই আসব এবং আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিবো।
শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন : আমার নাম ম্যাগলিন। আপনারা দু’জনে এলে আমি খুবই আনন্দিত বোধ করব। গড ব্লেস ইউ, বলে ডানহাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। আমিও গুডনাইট জানিয়ে বিদায় নিলাম। (চলবে)
সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা