কানাডায় কুসংস্কার
খুরশিদ আলম
বর্তমান বিশে^ কানাডা নিঃসন্দেহে অতি আধুনিক একটি দেশ। চিন্তাভাবনায়, কাজে কর্মে বিজ্ঞানমনস্কতার ছাপ রয়েছে দেশটির প্রায় সবখানেই। ডিজিটালাইজেশনের কারণে ঘরে বসেই এখন অনেক সেবা পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চত এই দেশটিতে। চিন্তার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্যতম একটি দেশ এটি। উচ্চ শিক্ষিতের হারও অনেক বেশী এই দেশটিতে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও অনেক এগিয়ে কানাডা। ইতিপূর্বে ‘অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভলাপমেন্ট’ বিশ্বে উচ্চ শিক্ষিতের দেশ হিসাবে কানাডাকে দ্বিতীয় স্থানের মর্যাদা দিয়েছিল। ঐ টপ টেন লিস্টে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল দশ নম্বরে।
এখন কানাডার মত এরকম একটি দেশে মানুষজন বিজ্ঞানমনস্ক হবেন, যুক্তিবাদী হবেন এমনটা আশা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। তাছাড়া উচ্চ শিক্ষিত হলেই একজন মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হবেন, যুক্তিবাদী হবেন এমন গ্যারান্টিও নেই। তার প্রমাণ মিলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদন থেকেও।
ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডায় নাকি এখনো এমন লোকও আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন পৃথিবী সমতল! শুধু তাই নয়। তাঁদের আরো বিশ্বাস, ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণিরা গোপনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং এলিয়েনদের সংযোগ স্থাপনের আলামত জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
কানাডায় কিছুসংখ্যক মানুষের এরকম উদ্ভট বিশ্বাসের কথা শুনে অনেকেই অবাক হয়ে যেতে পারেন বা হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা হতে পারে কারো কারো। কিন্তু জরিপ প্রতিষ্ঠান Legerএর নতুন এক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, কানাডার পাঁচ শতাংশ মানুষ নাকি বিশ্বাস করেন পৃথিবী গোলাকার নয়, সমতল! আর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিশ্বাস করেন ভিনগ্রহের প্রাণিদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে।
চার কোটি মানুষের দেশ কানাডায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মানে তো সুবিশাল একটি সংখ্যা। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন ভিন গ্রহের প্রাণিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে!
অনেকে নাকি আবার বিশ্বাস করেন নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন ১৯৬৯ সালে চাঁদে অবতরণ করেননি। কেউ কেউ আবার দাবী করেন, বৈশি^ক উষ্ণতার আদৌ অস্তিত্ব নেই। ১৬ শতাংশ কানাডিয়ান এই বিশ্বাস পোষণ করেন। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ কানাডিয়ান বলেন, তাঁদের বিশ্বাস, বিজ্ঞানীরা ও সরকারগুলো ক্যান্সার নিরাময়ের উপায় জেনেও তা চাপা দিয়ে রেখেছে।
কিছুদিন আগে এক ঘরোয়া আড্ডায় যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার এক পারিবারিক বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন ষাটোর্ধ অতিথিও। প্রবাসে এই বয়সের বেশীরভাগ বাঙ্গালীই ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে ভোগেন। ফলে তাঁদের আড্ডায় প্রায়ই এই শারীরিক অসুস্থতার বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। আলোচনায় তাঁরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। অন্যের অভিজ্ঞতার কথাও শুনেন। সেদিনের আড্ডায় তাঁদেরই একজন দাবী করছিলেন এই বলে যে, একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে সেটি আর কোনদিন ভাল হয় না এ কথাটা ঠিক নয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অবশ্যই আবিস্কার করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা। কিন্তু ওষুধ কোম্পানীগুলো সেই আবিস্কারকে নানা কুটকৌশল প্রয়োগ করে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। কারণ ডায়াবেটিস রোগ ভাল হয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী ওষুধ কোম্পানীগুলো বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ডলারের মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে প্রতি বছর। অবশ্য তিনি এ কথাও বলেন যে, এই দাবীর পিছনে তাঁর হাতে কোন সুষ্পষ্ট প্রমাণ নেই।
তবে তিনি প্রায় পঁচিশ বছর আগের একটি সংবাদের কথা উল্লেখ করেন যেটি কানাডার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ওতে বলা হয়েছিল, ডায়াবেটিস রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার চিকিৎসা আবিস্কার করেছেন কানাডার চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তবে সেটি বাজারে আসতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে এমন কথাও বলা হয়েছিল ঐ সংবাদে। ইতিমধ্যে পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু কেন আলোর মুখ দেখলো না? তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানীগুলোর কোন কারসাজি হয়তো রয়েছে এর পিছনে।
আড্ডায় আরো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেটি হলো করোনা মহামারীর ভ্যাকসিন। আলোচকদের একজন দাবী করছিলেন এই বলে যে, এই মহামারীর পুরো বিষয়টি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। কয়েকটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী তাঁদের পূর্ব পরিকল্পিত নকশা অনুযায়ী এই ভাইরাস মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে। আর দোষ চাপিয়েছে চীনের উপর। চীনের এক ল্যাবরেটরি থেকে নাকি এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। করোনা ভাইরাস কোন ‘বায়ো-উইপন’ ছিল না। এটি ছিল আসলে একটি ‘বাণিজ্যিক-উইপন’। কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের মুনাফা লুটার জন্য কয়েকটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী এই ভাইরাস মানুষের দেহে ছড়িয়েছিল। তারা এই ভাইরাসের ভ্যাকসিনও আগেই তৈরী করে রেখেছিল বাণিজ্য করার জন্য। কারণ আগের এমন কোন রেকর্ড নেই যে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে মারাত্মক ও অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে রোগের ভ্যাকসিন তৈরী হয়ে গেছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা বিশ্বব্যাপী গণহারে ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। আড্ডায় আলোচক সেই ব্যক্তি প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানীর কোন মালিক বা প্রধান নির্বাহী মারা গেছেন এমন কথা শুনেছেন কেউ? কোন দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানও মারা যাননি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে। আমেরিকার অতি বুড়ো প্রেসিডেন্ট বাইডেনও মারা যাননি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর। মারা যাননি বৃটেনের তৎকালীন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও। তাঁর বয়স ছিল তখন প্রায় ৯৬ এর মত। তাহলে বিষয়টি কি পরিষ্কার নয় যে, সবই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল? পরিকল্পনাটি এমনভাবে করা হয়েছিল যে, সাধারণ মানুষ মরবে আর মহা আতঙ্ক সৃষ্টি হবে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু বিশেষ মানুষেরা বিশেষ চিকিৎসা পাবেন যাতে করে করোনায় আক্রান্ত হলেও তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
আড্ডায় আলোচক সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর হাতে কোন প্রমাণ আছে কি না এই বিষয়ে। নাকি কেবল বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি এ কথাগুলো বলছেন। উত্তরে তিনিও স্বীকার করেছিলেন যে, এটি তাঁর বিশ্বাস।
উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারী যখন তুঙ্গে তখন কানাডার রাজধানী অটোয়ায় ভয়াবহ এক অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই অবরোধের কথা মনে আছে নিশ্চই সকলের। পার্লামেন্ট ভবনসহ আশপাশ এলাকায় ভয়াবহ এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল একদল অবিশ্বাসী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক। তাঁদের দাবী ছিল করোনা প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি কোন ভাইরাস নয়। এটি মানবসৃষ্ট জৈব অস্ত্র।
এই ভ্যাকসিন বিরোধিদের সিংহভাগই শে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠির সদস্য এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদে বিশ্বাসী। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে তাঁরা নানারকম কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে ভুগছিলেন সেই সময়। বিক্ষোভের পাশাপাশি এই গোষ্ঠির লোকেরা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিন বিরোধী অপপ্রচার চালিয়েছিলেন। আজগুবি সব তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন জনগণকে। তাঁরা বলার চেষ্টা করেছিলেন ভ্যাকসিন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি নিতে বাধ্য করার অর্থ হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন। এমনকি তাঁরা চিকিৎসকদের ফাঁসিতে ঝুলানোর আহ্বানও জানিয়েছিলেন এবং গণ-ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
আগেই উল্লেখ করেছি যে কানাডা একটি আধুনিক ও মুক্তচিন্তার দেশ। কিন্তু পাশাপাশি আমরা এটিও লক্ষ্য করছি যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের অভাব নেই এখানে। এ কথাটি বেশ জোরালো ভাবেই প্রামাণ করে গেছেন ট্রাক ও লরি চালকদের একটি অংশ করোনার ভ্যাকসিন বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। শুধু লরি চালকরাই নয়, অন্যান্য আরো কিছু পেশার বা সম্প্রদায়ের লোকও আছেন এখানে যাঁরা ভ্যাকসিন বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে প্রামাণ করে গেছেন কানাডা কুসংস্কারমুক্ত দেশ নয়।
কানাডায় অদ্ভূত প্রকৃতির আরো কিছু কুসংস্কার রয়েছে যা শুনলে অনেকেই আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে বহুতল ভবনের ১৩ তলার বিষটি। এখানে অধিকাংশ বহুতল ভবনে ১৩ তলার কোন অস্তিত্ব নেই। আপনি এলিভেটরে বা পায়ে হেটে ১২ তলা পর্যন্ত উঠলেন। এর পরের তলাটি ১৩ হওয়ার কথা। কিন্তু উঠে দেখবেন সেটি ১৪ তলা। ১৩ তলা গায়েব! আজব কান্ড নয় কি? ভবনের কাগজে কলমেও কিন্তু ঐ ১৩ তলার অস্তিত্ব নেই। ১৩ তলার এপার্টমেন্টগুলো ১৪ তলা হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়।
কিন্তু এর কারণটা কি? কারণ তো নিশ্চই একটি আছে। এটি নিছক তামাশা সেটিও বলা যাবে না। স্মরণ করা যেতে পারে যে বাংলাদেশেও আমরা সবাই সেই শৈশব থেকেই, ‘আনলাকি থার্টিন’ শব্দ দুটির সঙ্গে কম বেশী পরিচিত ছিলাম। তবে সেই বয়সে আমরা অনেকেই জানতাম না থার্টিন নম্বরটি কেন আনলাকি। এই আনলাকি থার্টিন এর সংস্কৃতি বা সংস্কার অথবা কুসংস্কার যেটাই বলি না কেন এর উৎপত্তি মূলত খ্রিস্ট ধর্মালম্বীদের মাঝ থেকে।
বলা হয়ে থাকে যে, যিশু খ্রিস্টের ‘দ্যা লাস্ট সাপার’ অর্থাৎ তাঁর শেষ ভোজের আসরে তিনি নাকি উল্লেখ করেছিলেন উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। পরে সত্যিই দেখা গেল সেই অতিথিদেরই একজন জুডাস ইস্ক্যারিওট রোমানদের হাতে যিশু খ্রিস্টকে ধরিয়ে দেন এবং তাঁরা যিশুকে ক্রশবিদ্ধ করেন। কথিত আছে যে লাস্ট সাপারের ১৩তম চেয়ারে জুডাস ইস্ক্যারিওট বসেছিলেন। এখান থেকেই নাকি খ্রিস্ট সমাজে ১৩ সংখ্যাটিতে অশুভ বলে ধরে নেওয়া হয়। এবং এই কানাডায়ও ‘১৩’ সংখ্যাটিকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর তার প্রভাব আমরা দেখতে পাই বহুতল ভবনগুলোয়।
কিন্তু কেন? কাগজে কলমে কোন একটি বহুতল ভবনের ১৩ নম্বর ফ্লোরটি গায়েব করে দিলে কি কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না সেখানে? কই, সেরকম কোন প্রমাণ তো দেখা যায় না? কাগজে কলমে ১৩ তলার অস্তিত্ব নেই এমন ভবনেও তো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে কানাডায়। মানুষও মরেছে সেই আগুনে পুড়ে। তাহলে ‘১৩ তলা’ বিহীন বহুতল ভবনের নিরাপত্তাটা কোথায়? ‘আনলাকি থার্টিন’ মুছে দিয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে কি?
আনলাকি থার্টিনের এই কুসংস্কারটির বিস্তৃতি এই কানাডায় অনকে গভীরে প্রবেশ করে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই অবস্থা। লিফ্ট ও এস্কেলেটর প্রস্তুকারী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানী Otis Elevators এর প্রতিনিধি দিলীপ রাংনেকার এর মতে কানাডায় ৮৫% বহুতল ভবনে ১৩ তলার অস্তিত্ব নেই কাগজে কলমে। ফলে এই সব ভবনে ব্যবহৃত লিফটেও ১৩ তলার কোন বাটন নেই। এইসব লিফটে ১২ তলার পরই রয়েছে ১৪ তলার বাটন।
কিরকম হাস্যকর একটি বিষয়। ১২ সংখ্যার পর ১৩ হওয়ার কথা। কিন্তু ১৩ গায়েব! বিরক্তিকরও বটে এটি। যাঁরা বহুতল ভবনে থাকেন তাঁরা প্রতিনিয়তই এই বিষয়টির মুখমুখি হন। আর শুধু হাস্যকর বা বিরক্তিকরই নয় বিষয়টি। বিপজ্জনকও এটি।
ভেঙ্গুভার সিটির চীফ বিল্ডিং অফিসার প্যাট রায়ান এর মতে বহুতল ভবনে ফ্লোর নম্বর নির্ধারণের বেলায় এই জাতীয় কুসংস্কার মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে প্যারামেডিকস এবং অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যদের বেলায় এ বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি বিভ্রান্তকর এবং একই সঙ্গে বিপজ্জনক এই কারণে যে, যখন জরুরী কোন প্রয়োজনে প্যারামেডিকস, পুলিশ বা অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যদেরকে কোন ভবনে প্রবেশ করতে হয় তখন তাঁদের চেষ্টা থাকে যত দ্রুত সম্ভব নির্দিষ্ট তলায় নির্দিষ্ট এপার্টমেন্টে পৌঁছার। ঐ বিশেষ জরুরী অবস্থায় নম্বররের এই গড়বড় তাঁদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। এ কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে তাঁদের দেরী হতে পারে। আর জরুরী পরিস্থিতিতে এক দুই মিনিটের দেরীও বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে হৃদ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেলায় প্রতিটা সেকেন্ড কাউন্টএ্যাবল। অন্যদিকে এই সামান্য দেরীর কারণে এপার্টমেন্টে লাগা আগুনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ঘটতে পারে প্রাণহানী।
এই সব বিবেচনায় এনে ২০১৫ সালে ভেঙ্গুভার সিটি কর্তৃপক্ষ একটি নতুন আইন জারী করে। ঐ আইনে বলা হয়, নতুনভাবে নির্মিত বহুতল ভবনে ১৩ তলার কথা উল্লেখ থাকতে হবে। অর্থাৎ কাগজে কলমে এবং ফ্লোরের নাম্বারিং এর সময় ১৩ শব্দটি বাদ দেওয়া যাবে না। লিফটেও ১৩ নম্বর বাটন থাকতে হবে। তবে যে সকল বহুতল ভবন ইতিমধ্যেই তৈরী করা হয়ে গেছে সেগুলো নতুন এই আইনের আওতায় পড়বে না।
আসলে এই আনলাকি থার্টিন এর ব্যাপারে শুধু ভবন মালিকদের এককভাবে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কারণ অনেক ক্রেতা আছেন যাঁদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে আছে আনলাকি থার্টিনের কুসংস্কারটি। তাঁরা কন্ডোর এপার্টমেন্ট কিনতে গিয়ে ১৩ নম্বরটি (যদি থাকে) এড়িয়ে চলেন। ভাড়াটিয়াদের মধ্যে যাঁরা আনলাকি থার্টিন এর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তাঁরাও এপার্টমেন্ট ভাড়া করার সময় ১৩ নম্বরটি এড়িয়ে চলেন।
কানাডায় বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে ‘৪’ সংখ্যাটিকে ঘিরেও রয়েছে এক কুসংস্কার। এই কুসংস্কারটি চাইনিজ বংশোদ্ভূতদের মধ্যে প্রচলিত। চীনের ম্যান্ডারিন ও কেন্টোনিজ ভাষায় ‘৪’ শব্দটির যে উচ্চারণ তার সাথে মিল রয়েছে ‘মৃত্যু’ শব্দটির উচ্চারণ। এ কারণে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা ৪ সংখ্যাটি এড়িয়ে চলেন। এমনকি ১৪, ২৪, ৩৪ এই সংখ্যাগুলোও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন তাঁরা। কারণ এগুলোর সাথেও ৪ সংখ্যাটি যুক্ত রয়েছে। ভ্যাঙ্কুভারে এই কুসংস্কারের চলটা বেশ লক্ষণীয়। সেখানে যাঁরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাঁরাও বেশ ভাল করেই জানেন যে চার সংখ্যা যুক্ত এপার্টমেন্টগুলো বিক্রি করতে অনেক সময় নেয়। কারণ ঐ কুসংস্কার।
ভেঙ্গুভারে চাইনিজ কমিউনিটি বেশ বড়। দি কানাডিয়ান প্রেস-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্থানীয় এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ম্যাক বলেন, তাঁর অনেক ক্লায়েন্টই এই চাইনিজ কমিউনিটির লোক এবং তাঁদের অনেকেই এই সংস্কারে বিশ্বাসী। এপার্টমেন্ট কিনার সময় তাঁদের এই সংস্কার একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের বড় শহরগুলোতেও কমবেশী একই অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে অনেক সিটি কর্তৃপক্ষই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে।
আর শুধু বহুতল ভবনই নয়, কোন কোন এলাকায় ১৩ নম্বরের কোন বাড়িও নেই। আমার আবাসস্থল স্কারবরোর ডার্লিংসাইড ড্রাইভে। খোঁজ নিয়ে দেখি সেখানে ১৩ নম্বরের কোন বাড়ি নেই। আমাদের পাশের গলি ডোনাকোনা ক্রিসেন্ট। সেখানেও ১৩ নম্বরের কোন বাড়ি নেই। গুগুল ম্যাপে চেক করে দেখলাম টরন্টোর অনেক রোডেই ১৩ নম্বরের কোন বাড়ি নেই।
ভুতুরে সব কান্ডকারখানা। এখন মনে হচ্ছে কানাডাকে আধুনিক দেশ না বলে তথাকথিত আধুনিক দেশ বলা উচিত। কুসংস্কার আর ভ্রান্ত বিশ্বাস যে দেশে বিদ্যমান সে দেশ আধুনিক হয় কি করে?
কানাডায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আরো কিছু কুসংস্কার বা ভ্রান্ত বিশ্বাস রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘ঘরের ভিতর ছাতা খুললে বিপদ হতে পারে’। এই কুসংস্কারটির উৎপত্তি কোথায় তা কেউ বলতে পারে না। তবে এ নিয়ে যে দুটি গল্প প্রচলিত আছে যার একটি হলো, প্রাচীনকালে কোন এক রোমান মহিলার বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি তাঁর ছাতাটি খুলেছিলেন ঘরের ভিতর। অন্য গল্পটি হলো- একজন ব্রিটিশ রাজপুত্র তাঁর কাছে আসা কোন এক রাজার কাছ থেকে দুটি ছাতা গ্রহণ করেছিলেন এবং তার কয়েক মাস পরেই সেই রাজপুত্র মারা যান। এ নিয়ে আরো যে কথা প্রচলিত আছে তা হলো, ঘরের মধ্যে ছাতা খুললে সূর্যদেব অপমানিত বোধ করেন এবং দুর্ভাগ্যের অভিশাপ দেন।
কানাডার প্রেইরি অঞ্চলের একটি ‘শিষ্টাচার’ হলো, প্রতিবেশীদের কেউ যদি প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসেন আপনার বাড়িতে তবে সেই খাবার রেখে প্লেটটি ফেরত দিতে হবে অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়ই। যদি ধুয়ে মুছে সেই প্লেট ফেরত দিতে যান তবে আপনার কপালে দুর্ভোগ আসতে পারে।
এটি কি ভাবে শিষ্টাচার হয় তা আমার বোধগম্য নয়। অলস প্রকৃতির লোকেরা বা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকেরা এই জাতীয় ‘শিষ্টাচার’ তৈরী করেছেন বলে আমার ধারণা। আর এটাকে শিষ্টাচার না বলে কুসংস্কার বলাই ভাল।
কিছু মজার কুসংস্কারও আছে কানাডায়। যেমন,
– গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড অথবা স্বামী বা স্ত্রীকে জুতা উপহার দেওয়া উচিৎ নয়। এতে করে আপনার সঙ্গী উৎসাহিত হবেন সেই জুতা পরে সম্পর্ক থেকে হেটে বের হয়ে যেতে।
– পারফিউম-ও উপহার দেওয়া উচিত নয় গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড অথবা স্বামী বা স্ত্রীকে। কারণ সেই পারফিউমের সুগন্ধে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে আপনাদের মধুর সম্পর্কের মধ্যে। সেই পরিস্থিতিতে আপনাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে পারে।
– ব্যাগও উপহার দেওয়া উচিত নয় গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড অথবা স্বামী বা স্ত্রীকে। কারণ উপহারের সেই ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ভরে আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী আপনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে বাই বাই বলে চলে যেতে পারেন।
কানাডায় কুসংস্কার আরো আছে যেগুলো একশ্রেণীর মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। যেমন চার পাতার ক্লোভার (ঈষড়াবৎং)। বাগানে বা বনে গিয়ে চার পাতার ক্লোভার খুঁজে পেলে নাকি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। তাই অনেকে জীবন সঙ্গী বাছাই করার আগে চার পাতার ক্লোভার খুঁজে বের করেন এবং সেই পাতা গিলে খান। এরপর সেদিন প্রথম তিনি যে সুন্দর বা সুন্দরীর দেখা পান তাকেই জীবন সঙ্গী হিসাবে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
চলার পথে কালো বিড়াল চোখে পড়াটাও নাকি দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। কানাডায় কিছু লোক আছেন যাঁরা এটি বিশ্বাস করেন। এই কুসংস্কারটি অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। আছে বাংলাদেশেও। ‘জঙঅজ’ মিডিয়াতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর উৎপত্তি মধ্যযুগীয় এক ভুল ধারণা থেকে। সেই সময়কার মানুষ নাকি মনে করতেন যেসব অবিবাহিত নারী বিড়াল নিয়ে মেতে থাকেন তাঁরা আসলে ডাইনী। চাইলে এই ডাইনী নারীরা বিড়ালে রূপান্তরিত হতে পারেন। কালো বিড়ালকে নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা উৎপত্তির আরো কারণ হলো, অনেকে বিশ্বাস করেন এর রয়েছে শয়তানের আত্মা ধারণ করে রাখার ক্ষমতা।
কানাডায় আয়না নিয়েও আছে কুসংস্কার। বলা হয়ে থাকে যে, একটি আয়না ভাঙ্গলে নাকি সাত বছরের দুর্ভাগ্য জুটতে পারে কপালে। আয়না নিয়ে এক গল্প প্রচলিত আছে জার্মানীতে। গল্পটা এরকম -সেখানে আদিকালে এক দুষ্টু রানী ছিলেন যিনি এমন এক আয়না ব্যবহার করতেন যার মধ্যে বন্দি ছিল এক আত্মা। আর সেই আত্মা নাকি তাঁর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিত। রানী সেই আয়নাকে ব্যবহার করে তাঁর প্রতিপক্ষের লোকদের বিভিন্ন ক্ষতি করতে পারতেন। আবার এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, ভাঙ্গা আয়নায় নিজের চেহারা দেখা ঠিক নয়, কারণ তাতে নাকি অমঙ্গল হয় এবং চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
কানাডায় আরেকটি কুসংস্কার প্রচলিত আছে যেটি মই বিষয়ক। খাড়া বা হেলানো মইয়ের নিচ দিয়ে হাঁটলে দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটতে পারে এমন কথা বলা হয়ে থাকে। তবে আমি এটিকে কুসংস্কার বলতে রাজী নই। কেউ দেওয়ালে মই ঠেকিয়ে উপরে উঠে কাজ করলে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে এবং ঘটেও কখনো কখনো। সে কারণে মইয়ের নিচ দিয়ে হাঁটা ঝুঁকিপূর্ণ এ কথাতো দিনের আলোর মতই সত্য। তাই এটি কুসংস্কার হয় কি করে?
কানাডা হচ্ছে একটি বহু সংস্কৃতির দেশ। বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের বিভিন্ন সংস্কৃতি। তাঁদের বিভিন্ন সংস্কারগুলো তাঁদের সংস্কৃতিরই অংশ। এই সংস্কার তাঁরা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসেন নতুন দেশে। মোট কথা, পৃথিবীতে সংস্কার ছাড়া কোন জাতি বা সম্প্রদায় নেই। আর সেই সব অগুনিত সংস্কারের মধ্যে দু-একটি কুসংস্কার থাকতেই পারে। থাকতে পারে ভ্রান্ত বিশ্বাসও। তবে সেই সব কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস যতক্ষণ পর্যন্ত না কারো কোন ক্ষতি করছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই।
কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন তা সাধারণ মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, করোনা মহামারীর সময় একটি ভ্রান্ত তথ্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ভ্রান্ত তথ্য বা গুজবটি ছিল এই যে, মুসলিমরা কখনো করোনায় আক্রান্ত হবেন না। সে কারণে তাঁদেরকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বন্ধ করা উচিৎ নয়। করোনা তৈরী করেছে বিধর্মীরা। তাই মুসলিমদের কাছে আসবে না এই ভাইরাস। ইহুদীরা চায় মুসলিমদের নামাজ পড়া বন্ধ হোক। তাই তাঁরা করোনার ভয় দেখাচ্ছে।
আবার এমন তথ্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, বিধর্মীরা করোনার ভয়ে নামাজ পড়ছেন। এইসব ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার বিপদটা ছিল-সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের কেউ কেউ এগুলো বিশ্বাস করেছিলেন এবং সরকারী নিষেধাজ্ঞা থাকায় মসজিদে না গিয়ে কারো বাড়ির ছাদে বা বৈঠকখানায় একত্রে মিলিত হয়ে নামাজ আদায় করছিলেন। করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পিছনে এই সব গুজব বা ভ্রান্ত তথ্যও ভূমিকা রেখেছে কিছুটা।
করোনা নিয়ে ক্ষতিকর ও ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়েছিল ভারতের অতিরক্ষণশীল গোষ্ঠির লোকেরাও। তাঁরা বলে বেড়াচ্ছিল যে, ‘গোমূত্র পান করলে করোনা ভাইরাস ঠেকানো যায়’। তাঁদের সেই প্রচারণায় বিশ্বাস করে সেই সময় গোমূত্র পান করেছেনও অনেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মেইনন্ট্রিম মিডিয়াতে সেই খবর ছবিসহ প্রচারও হয়েছে অনেক।
বলা হয়ে থাকে যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ইত্যাদি মানুষের মনের মধ্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস বা কুসংস্কারের
জন্ম দেয়। এই গোমূত্র পান, মুসলিমরা কখনো করোনায় আক্রান্ত হবেন না, ১৩ নম্বর ফ্লোরে থাকলে বিপদ হতে পারে, পৃথিবী সমতল, ভিন গ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে ইত্যাদি ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের জন্ম হয়েছে কিছু মানুষের অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারণেই।
এখানে আরেকটি কুসংস্কারের কথা উল্লেখ করতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগে এক বিকেলে হাটতে বেড়িয়ে দেখেছিলাম এক বাড়িতে লাউ গাছের মাচায় পুরাতন একজোড়া স্যান্ডেল টানিয়ে রাখা হয়েছে! বাড়িটি কোন বাঙ্গালীর ছিল হয়তো। ভারতীয় বা শ্রীলংকানেরও হতে পারে।
স্যান্ডেল টানিয়ে রাখার এই দৃশ্যটি দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। লাউ গাছের প্রতি যেন কারো কুদৃষ্টি (বাংলাদেশে ‘মুখ লাগা’ বলা হয়) না পড়ে সেই জন্য এই ব্যবস্থা। মুখ লাগলে ফলন ভাল হবে না বা গাছ নষ্ট হয়ে যাবে এরকম একটি ভ্রান্ত ধারণা বাংলাদেশে অনেকেরই রয়েছে। সেই ভ্রান্ত ধারণা এখন দেখছি এই কানাডায়ও আমদানী হয়েছে।
কুসংস্কারের আরো অনেক নজীর আছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে কতগুলো আছে বেশ অদ্ভূত ধরণের। যেমন,
– ওষুধ সেবন করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বললে রোগ ভাল হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তা আরো বেড়ে যায়।
– ঘর থেকে বের হবার সময় কোন বিধবা নারীর চোখে পড়লে যাত্রা শুভ হয় না।
– শুকর শব্দটি উচ্চারণ করলে পরবর্তী ৪০ দিন মুখ নাপাক থাকে।
– বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানীর নাম বিনা অজুতে মুখে নিলে গায়ের পশম পড়ে যায়।
– স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই স্ত্রীদের। যদি কেউ নেন তবে তাঁর স্বামীর অমঙ্গল হতে পারে।
– কারো কবর দেখানোর জন্য সেদিকে আঙ্গুল দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হলে সেই আঙ্গুল পঁচে যায়।
এরকম আরো অনেক অদ্ভূত রকমের কুসংস্কার রয়েছে বাংলাদেশে। আবার কিছু কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস বা কুসংস্কারে কথা শুনলে গা শিউরে উঠে। উদাহরণ হিসাবে এখানে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যা প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল নরসিংদীর মনোহরদীতে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গত বছর জুন মাসের দিকে স্থানীয় একটি বাড়ি থেকে কয়েকদিন ধরে দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। ওই বাড়ির সদস্যরাও দরজা-জানালা বন্ধ রেখে রহস্যজনক আচরণ করছিলেন। তখন প্রতিবেশীরা বাধ্য হয়ে থানায় খবর দেন। এরপর পুলিশ এসে ওই বাড়ির গেটের তালা ও ঘরের দরজা ভেঙে এক নারীর পচে-গলে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অন্তত এক সপ্তাহ আগে ঐ নারীর মৃত্যু হয়। ঐ বাড়ির সব সদস্য ফরিদপুরের এক পীরের মুরিদ। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, লাশ এভাবে ছয় থেকে সাত দিন রেখে দিলে মৃত ঐ নারী জীবিত হয়ে উঠবেন। পুলিশ আরো জানায় ঐ বাড়ির লোকজন দাবি করছিলেন যে তাঁরা দুর্গন্ধ টের পাননি। লাশ উদ্ধারের সময় তাঁদের খাবারের টেবিলে রান্না করা খাবার ছিল। তাঁদের আচরণও স্বাভাবিক ছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে রাজধানী ঢাকার পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে। ঐ সময় ‘অলৌকিক শক্তি’ লাভের আশায় গভীর রাতে সদ্য মৃত এক নবজাতকের লাশ মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছিল পাঁচ কিশোর। তারা লাশটির মাথা বিচ্ছিন্ন করে সিঁদুর ও চন্দন দিয়ে তন্ত্র সাধনা শুরু করেছিল। স্থানীয় লোকজনের নজরে এলে তাঁরা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে তখন ঐ পাঁচ কিশোরকে গ্রেফতার করে।
শিশুটি জন্মের পরই মারা গিয়েছিল। পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারে শ্মশানঘাটে শিশুটিকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু ঐ রাতেই পুরানো ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকা থেকে আসা পাঁচ কিশোর মৃত শিশুটিকে কবর থেকে তুলে ফেলে এবং জবাই করে সিঁদুর ও চন্দন দিয়ে পূজা শুরু করে।
উল্লেখ যে, হিন্দুধর্মের বেশ কয়েকটি সম্প্রদায় মৃতদের সমাধি দেওয়ার রীতি অনুসরণ করে। কিছু সম্প্রদায়ে গুরুত্বপূর্ণ সাধুদের সমাধিস্থ করা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারের যুগেও এই কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস মানুষের পিছন ছাড়ছে না। এক দল মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন পৃথিবী সমতল, লাশ ছয় থেকে সাত দিন ঘরে রেখে দিলে সেটি আবার জীবিত হয়ে উঠবে, কবর থেকে মৃত নবজাতকের লাশ তুলে মাথা বিচ্ছিন্ন করে তন্ত্র সাধনা করলে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হওয়া যাবে। এই অবস্থার পরিবর্তন কি কোন দিন হবে?
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ