বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে নিয়ে সিবিসি’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

নূরের দাবী-রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নিজ দেশ ছেড়েছেন তিনি

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : গত ২১ নভেম্বর, বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে নিয়ে ‘পাশের বাড়ির ঘাতক’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরী করে কানাডার রাষ্ট্রায়ত্ব সম্প্রচার মাধ্যম সিবিসি নিউজ এর দ্য ফিফথ এস্টেট। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নূর চৌধুরী বাংলাদেশের একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল, ভয়ংকর অপরাধী। বিচার চলাকালে তিনি পলাতক ছিলেন। বিচারে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তাঁর ১০ বছরের শিশুপুত্রসহ ওই পরিবারের ২১ জনকে হত্যার পরিকল্পনার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।’

উল্লেখ্য যে, হত্যাকান্ড ঘটার দীর্ঘ সময় পর বিচার শেষে ২০১০ সালে হত্যাকারী পাঁচজনের ফাঁসি হয়। এক হত্যাকারী জিম্বাবুয়েতে মারা যান। ছয় হত্যাকারী পলাতক। তাঁরা হলেন আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। তাঁদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী আছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

তবে দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকেও এদের মধ্যে সাজা এড়াতে পারেননি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল মাজেদ। ২০২০ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার দন্ড কার্যকর করা হয়। ঐ বছর ৭ এপ্রিল ভোরে ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৭২ বছর বয়সী মাজেদকে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা যায়, ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে এতদিন ভারতেই পালিয়ে ছিলেন তিনি।

সিবিসি’র ক্যামেরায় খুনি নূর চৌধুরী

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেনি, সে জেলহত্যায় অংশগ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা রয়েছে। খুনের পরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক সে বঙ্গভবন ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করেছে।”

সিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড থেকে ২০০৬ সালে নূর চৌধুরীর প্রতি দেশত্যাগের নির্দেশনা জারি করা হলেও ঠিক কী কারণে এখনো তাঁকে দেশটিতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না কানাডা।’

সিবিসির পক্ষে কথা বলা হয় বাংলাদেশের  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, কানাডা সব সময় মানবাধিকার প্রশ্নে সোচ্চার। তারা কীভাবে এ রকম একটা জঘন্য খুনিকে তাদের দেশে আশ্রয় দেয়? কোথায় তাহলে মানবাধিকার—এটাই আমার প্রশ্ন কানাডার জনগণ ও সরকারের কাছে।’

বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকায় তাঁর অফিসে বসে সিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে নূর চৌধুরী সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং যাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছিলেন, নূর চৌধুরী তাঁদেরই একজন।’

সিবিসির তথ্য মতে, কানাডায় আসার পর থেকে নূর চৌধুরী বাইরে খুব একটা বের হন না। অবশ্য ২০১১ সালে তিনি সিবিসি রেডিওর ‘দ্য কারেন্ট’ অনুষ্ঠানে একবার প্রকাশ্যে কথা বলেছিলেন। তখন তিনি জোরালোভাবে দাবি করেছিলেন, ১৯৭৫ সালে সংঘটিত অভ্যুত্থানে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নির্দোষ। আমি রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করিনি। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি কানাডা সরকারের কাছে ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা চাই।’

শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পেতে তিনি কানাডায় যে আবেদন করেন, তাতে দাবি করা হয়, যেদিন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়, সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য টি-শার্ট তৈরি করছিলেন তিনি।

তবে ২০০২ সালে কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড তাঁর আবেদনের বিষয়ে যে রায় দেয় তাতে বলা হয়, তিনি যে গল্প বলেছেন, সেটা কানাডা বিশ্বাস করেনি। এ ছাড়াও তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সময় নিজের অবস্থান সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, তা সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। রায়ে এ-ও বলা হয় যে, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কানাডা নিশ্চিত যে তিনি আসলেই সেই হত্যাযজ্ঞের ‘ষড়যন্ত্রকারীদের একজন’। রায়ে আরো বলা হয়েছে: ‘নূর চৌধুরী যে বিচারে দণ্ডিত হয়েছেন, তাতে অন্যায়ভাবে কিছু করা হয়েছে—এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং তিনি ন্যায়বিচার থেকে পলাতক ছাড়া আর কিছুই নন।’

কিন্তু তারপরও নূর চৌধুরী কানাডায় রয়ে যান। কানাডা সরকারও তাকে দেশ থেকে বহিস্কার করেনি। সিবিসি জানায়, ২০০৬ সালে দেশত্যাগের নির্দেশনার পর ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা বাংলাদেশে চৌধুরীর নিরাপত্তাঝুঁকির একটি মূল্যায়ন করে। কিন্তু সেটির ফলাফল বাংলাদেশকে জানতে দেয়নি তারা।

শেষে সেই মূল্যায়নের ফল জানতে কানাডা সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ফেডারেল কোর্টে মামলা করে বাংলাদেশ। এরপর নূর চৌধুরীর নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে মূল্যায়ন প্রকাশে কানাডা সরকারের অনিচ্ছার বিষয়টা পুনর্বিবেচনার আদেশ দেয় ফেডারেল কোর্ট। কানাডা সেটি করেও। কিন্তু এরপর আবারও তারা বাংলাদেশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে।

উল্লেখ্য যে, কানাডা ১৯৯৮ সালে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে।

সিবিসি’র পক্ষ থেকে নূর চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেয়ার  জন্য তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে তাঁকে বারবার অনুরোধ জানানো হয়। এরই এক পর্যায়ে তাঁর দেখা পাওয়া যায় পশ্চিম টরোন্টোতে, নিজের কনডোমিনিয়ামের বাইরে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, মুজিব হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি কানাডিয়ানদের কাছে সত্য বলেছেন কি না।

তবে এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করেন।

সিবিসি’র দ্য ফিফথ এস্টেট  এর এই প্রতিবেদনটি তৈরী করার জন্য যারা অনুসন্ধানে নেমেছিলেন তারা হলেন,  টিমোথি সাওয়া, মার্ক কেলি, ইমান বারে ও আবদুল্লাহ আল ইমরান। এছাড়াও তথ্য সহায়তায় ছিলেন লিসা এলেনউড।