জাস্টিন ট্রুডো ও সোফি গ্রেগোয়ারের সেপারেশন
পরকীয়াই কি নেপথ্য কারণ?
খুরশিদ আলম
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ারের সেপারেশনের সংবাদ শুনে গোটা কানাডার মানুষ বিস্ময়াভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন এ মাসের গোড়াতে। কেউ ভাবতেও পারেননি এরকম একটি সংবাদ তাঁদের শুনতে হবে। একে তো প্রেমের বিয়ে, তার উপর সুপার হাই প্রোফাইল দম্পতি। বিভিন্ন সময় তাঁদের যুগল ছবি দেখে মনে হতো সুখের স্বর্গলোকে বাস করছেন তাঁরা।
কিন্তু সুখের সেই স্বর্গলোকে হঠাৎ আগুন ধরিয়ে দিল কে? অথবা কি এমন ঘটনা ঘটলো যে তাঁদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হবে? সবার মুখে মুখে এই একই প্রশ্ন। কিন্তু কোন উত্তর নেই। কেউ জানে না কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যার কারণে তাঁদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হলো। তবে সেপারেশনের ঘোষণা আসার পরপরই পরকীয়ার একটি গুজব সামনে চলে আসে। গুজবটি হলো, কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানিয়া জোলির সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডোর পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে। আর সে কারণেই সোফি ট্রুডোর কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।
গুজবের শাখা-প্রশাখা আরো বেশী করে গজিয়েছে এই কারণে যে, জাস্টিন ট্রুডো বা সোফি গ্রেগোয়ার কেউই এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করে কিছুই বলছেন না কেন তাঁরা সেপারেশনে গিয়েছেন। তাঁদের সেপারেশনের খবরটি প্রথমে প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে। গত ২ আগস্ট বুধবার তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ইনস্টাগ্রাম পেজে সেপারেশনের অভিন্ন তথ্যটি প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা বলেন, ‘সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, অনেক অর্থবহ, খোলামেলা ও দুরূহ আলোচনার পর আমরা আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সবসময়ের মত আমরা পরষ্পরকে গভীরভাবে ভালবাসবো এবং একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো। এবং আমরা ঘনিষ্ঠ পরিবার হিসাবেই থাকবো। আমরা উভয়ে এ যাবতকাল যা কিছু গড়ে তুলেছি এবং আগামীতে যা কিছু গড়ব তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকবে। আর আপনাদের সবার প্রতি অনুরোধ, আমাদের সন্তানদের মঙ্গলের কথা ভেবে আপনারা আমাদের এবং তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন।’
উল্লেখ্য যে, ট্রডো ও সোফি এই ঘোষণা দেয়ার আগেই সেপারেশন সংক্রান্ত আইনি কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে ইতি ঘটলো তাদের ২০ বছরের সম্পর্ক। সোফি ইতিমধ্যেই স্বামী ও সন্তানদের রেখে অটোয়াতে অন্য একটি বাড়িতে উঠেছেন।
ট্রুডো ও সোফি যুগলের প্রথম দুই বছর ছিল প্রেমের সম্পর্ক এবং পরের আঠারো বছর বিবাহিত জীবন। তাঁদের বিবাহিত জীবনে জন্ম নেয় তিনটি সন্তান। এদের নাম ও বয়স জ্যাভিয়ার (১৫), এলা গ্রেইস (১৪) এবং হার্ডিন (৯)।
জাস্ট্রিন ট্রুডো ও সোফি থাকতেন প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত সরকারী বাসভবন ২৪ স্যাসেক্স ড্রাইভের পাশেই অবস্থিত রিডো কটেজে। কারণ স্যাসেক্স ড্রাইভের বিশাল ঐ ভবনটি বহুদিনের পুরানো। ১৮৬৮ নির্মান কাজ শেষ হওয়া ঐ ভবনটিতে এখন বসবাস করাটা নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন অনেকে। কেউ কেউ এই ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ আবার বলছেন এটি সংস্কার করা যেতে পারে।
বিবিসি জানায় ৫১ বছর বয়সী ট্রুডো ও ৪৮ বয়সী সোফিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একত্রে খুব কমই দেখা গেছে বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে। তবে রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক এবং গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কানাডায় স্বাগত জানানোর সময় তাঁদেরকে একত্রে দেখা গেছে।
কিন্তু এখন থেকে আর কোন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে সোফিকে দেখা যাবে না ট্রুডোর পাশে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও সোফির কোন অনুষ্ঠানিক উপস্থিতি দেখা যাবে না। থাকবে না কোন অধিকারও। কানাডার আইন অনুযায়ী দাপ্তরিক কোন উপাধিও বহন করতে পারবেন না সোফি। কোন সরকারী অনুষ্ঠানে সরকারের হয়ে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তৃতা দিতে পারবে না জনসাধারণের সামনে। কোন রাষ্ট্রিয় নৈশভোজে ট্রুডোর সাথে যোগ দিতে পারবেন না বা প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময় রাষ্ট্রিয়ভাবে তার সঙ্গী হতে পারবেন না। সোফিকে নিরাপত্তা দিতে সরকারীভাবে আর কোন সহযোগিতাও প্রদান করা হবে না। তাঁকে এখন থেকে অন্যান্য সাধারণ নাগরিকের মতই জীবন যাপন করতে হবে।
অবশ্য ট্রুডো ও সন্তানদের বাসভবনে নিয়মিত উপস্থিত হতে পারবেন সোফি। সন্তানদের অভিভাবক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।
এদিকে সেপারেশনের সংবাদ প্রকাশের দিন কয়েক পরই ট্রুডো ও সোফি সন্তানদের নিয়ে ভেকেশনেও গিয়েছিলেন ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে। সেখানে সন্তানদের নিয়ে তাঁরা কয়েকদিন সময় কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন রাজধানী অটোয়ায় ।
উল্লেখ্য যে, ট্রুডো আর সোফির সেপারেশন হয়েছে সত্যি, কিন্তু ডিভোর্স হয়নি। কানাডায় সেপারেশন আর ডিভোর্স এক বিষয় নয়। কোন দম্পতির মধ্যে যখন সম্পর্কের অবনতি ঘটে বা ভেঙ্গে যায় তখন তাঁরা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আলাদা থাকার জন্য আলাদা বাড়িতে অবস্থান করতে হবে এমন নয়। চাইলে তাঁরা একই বাড়িতে অবস্থান করেও আলাদাভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। অথবা কেউ কারো মুখ দেখতে না চাইলে আলাদা বাড়িতেও থাকতে পারেন। সোফি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আলাদা বাড়িতে থাকার জন্য।
আর ডিভোর্স হলো যখন একটি আদালত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দম্পতির বিয়ে ভেঙ্গে দেয় বা শেষ করে দেয়। তবে এটি করতেও সময় লাগে। সাধারণত সেপারেশনের এক বছর পর ডিভোর্সের জন্য আবেদন করা যায় আদালতে। এর মধ্যে আরো অনেক আইনী প্রক্রিয়া আছে। বিশেষ করে যদি সন্তান থাকে তবে তাদের দেখভালের বিষয়টি বেশী গুরুত্ব পায় এখানে।
ট্রুডো আর সোফির সেপারেশনের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সে গড়াবে এমনটাই ধারণা করা যায়। আর তাঁরা এমন এক সময় এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিলেন যখন কানাডায় ডিভোর্সের সংখ্যা অনেক কমেছে, রেকর্ড ভেঙ্গেছে গত অর্ধ শতাব্দীর। গত বছর এপ্রিলে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, ২০২০ সালে এই ডিভোর্সের সংখ্যা ছিল ৪২,৯৩৩ টি। ১৯৭৩ সালের পর এটি ছিল সবচেয়ে কম সংখ্যক ডিভোর্সের ঘটনা। অবশ্য করোনার সময়ে আদালতের কার্যক্রম হ্রাস পাওয়াতে এরকমটা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়।
২০১৯ সালে কানাডায় ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে ৫৬,৯৩৭ টি। রিপোর্টে বল হয়, সেই তুলনায় ২০২০ সালের সংখ্যাটি ছিল উল্লেখযোগ্য হ্রাস। দেশটিতে বিয়ে ডিভোর্সের ঘটনা অবশ্য ক্রমশ হ্রাস পেয়ে আসছিল বিগত অনেক বছর ধরেই। তবে গত ২০২০ সালে হ্রাসের ঘটনাটি ছিল নাটকীয়।
উপরে ডিভোর্সের সংখ্যাটির সঙ্গে ‘সেপারেশন’ এর হিসাব যোগ করা হয়নি। কানাডায় সেপারেশন এর বিষয়টি ঘটে ডিভোর্সের আগে। তবে কানাডায় এমন অনেক দম্পতি আছেন যারা সেপারেশনে চলে যান কিন্তু ডিভোর্সের আবেদন করেন না আদালতে।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডা জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে যারা আদালতে ডিভোর্সের আবেদন করেন তারা সাধারণত পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই করে থাকেন। প্রায় একতৃতীয়াংশ ডিভোর্সের আবেদন উভয়ের সম্মতিতেই করা হয়ে থাকে।
পারস্পরিক সম্মতিতে ডিভোর্সের আবেদন করার বিষয়টি কানাডার আইনে যোগ করা হয় ১৯৮৬ সালে। সেই থেকে ডিভোর্সে জন্য যৌথ আবেদনের সংখ্যা ৪% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ৩১% এ দাড়ায়।
আর কানাডার সিংহভাগ মানুষ মনে করেন বিয়ে একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়! এই তথ্য উঠে এসেছে Angus Reid Institute এর এক জরীপে। ঐ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৩ শতাংশ বলেছেন, কোনও দম্পতি সারাজীবন একসঙ্গে কাটাতে চাইলে তাঁদের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াটা জরুরী নয়। আর প্রতি ছয়জনে একজন বলেছেন, তাঁরা বিয়ের ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী নন।
জোলির সঙ্গে ট্রুডোর কি সত্যিই পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে?
গুজবের শাখা-প্রশাখা দ্রুত বিস্তার লাভ করে যখন আসল সত্যটা কোন কারণে চাপা পড়ে। ট্রুডো ও সোফির বেলায়ও তাই ঘটেছে। সেপারেশনের আসল কারণটা তাঁরা বলেননি। ফলে গুজবের শাখা-প্রশাখা দ্রুতই ছড়িয়েছে। এমনকি ট্রুডো একজন সমকামী বা উভয়কামী এমন গুজবও উঠেছে। তিনি প্রায় প্রতি বছরই কানাডায় সমকামীদের বার্ষিক মিছিলে অংশ নেন। গুজব রটনাকারীরা বলছেন,সমকামীদের প্রতি তাঁর সমর্থন রয়েছে কারণ তিনি নিজেও সমকামী। গুজব রটনাকারীদের দাবী, এ কারণেই নাকি তাঁর ঘর ভেঙ্গেছে।
উল্লেখ্য যে, সমকামীদের মিছিলে সোফিকেও বার কয়েক দেখা গেছে ট্রুডোর পাশে। গুজব রটনাকারীরা কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কিছু বলেনি।
তবে গুজবে সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলির সঙ্গে ট্রুডোর পরকীয়া সম্পর্ক। সন্দেহ নেই জোলি একজন সুন্দরী মহিলা। ২০১৭ সালে অটোয়ায় অনুষ্ঠিত ‘জুনো এওয়ার্ড’ প্রদানের এক অনুষ্ঠানে কৌতুক অভিনেতা রাসেল পিটার্স মেলানিয়া জোলিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘I don’t know why, but she’s hot’
মেলানিয়া জোলি তখন হেরিটেজ (Heritage) মন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি এই মন্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলন, রাসেল পিটার্স এর এরকম মন্তব্য অনুপযুক্ত ছিল। এই ধরনের হাস্যরস ‘জুনো এওয়ার্ড’ প্রদানের মত একটি অনুষ্ঠানে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়।
uksnackattack.com এর এক খবরে বলা হয় সেই মেলানিয়া জোলির সঙ্গে ট্রুডোর পরকীয়া সম্পর্ক আছে এমন গুজবের কথা আগেও শুনা গিয়েছিল। তবে ট্রুডো – সোফির সেপারেশনের পর সেই গুজব আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ট্রুডো আর জোলির কয়েকটি ঘনিষ্ঠ ছবি সেই গুজবকে এবার আরো বেশী উস্কে দেয়।
মেলানিয়া জোলি অবশ্য ট্রুডোর সঙ্গে রোমান্টিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন এসবই গুজব ও ভিত্তিহীন।
উল্লখ্য যে, মেলানিয়া জোলির বিরুদ্ধে আগেও পরকীয়ার গুজব উঠেছিল। ২০১৪ সালে কুইবেকের এক রাজনীতিবিদ Pierre-Karl Péladeau এর সাথে তাঁর পরকীয়ার সম্পর্ক রয়েছে এমন গুজবের কথা তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তখন তিনি সেই গুজবকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তবে মেলানিয়ার সঙ্গে ট্রুডোর সম্পর্কের বিষয়টি গুজব হলেও ট্রুডো-সোফির বিবাহিত জীবন যে মসৃন ছিল না তার ইঙ্গিত আগেই কিছুটা পাওয়া গিয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গত বছর তাঁদের বিয়ে বার্ষিকীতে ট্রুডো ইন্সটাগ্রামে দেয়া এক পোস্টে বলেছিলেন, ‘আমার স্ত্রী সোফি আর আমি রৌদ্রজ্জ্বল দিনের ভেতর দিয়ে যেমন গিয়েছি, তেমনি গিয়েছি ঝড়ের ভেতর দিয়েও আবার গিয়েছি এ দুটোর মাঝখান দিয়েও।’
এ ছাড়াও ট্রুডো তাঁর আত্মজীবনীতে বৈবাহিক জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেছিলেন, ‘সোফি আর আমার বিয়ে পুরোপুরি ঠিক ছিল না। আমরা নানা রকম উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গিয়েছি। তারপরেও সে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে আছে। আঘাত আসলেও আমরা একজন আরেকজনের প্রতি সৎ ও আন্তরিক থেকেছি।’ আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে।
অন্যদিকে সোফিও বিচ্ছেদের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অনেক আগেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমি মনে করি, প্রতিটি নারীর ভেতরে একেকটি সিংহী রয়েছে। আমরা মুক্ত হতে চাই। বুঝতে চাই, আমরা আসলে কারা। ঐ সাক্ষাৎকারে সোফি আরো বলেছিলেন, যুগ যুগ ধরে চলে আসা বিবাহিত নারীদের গৃহস্থালী ভূমিকা থেকে বের হয়ে আসতে চান তিনি। সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচার হয়েছিল গত বছর নভেম্বরে। বৃটেনের প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেলের ‘গুড ওয়াইফ, ব্যাড ওয়াইফ; গুড মাম, ব্যাড মাম’ শীর্ষক পডকাস্টে অংশ নিয়ে সোফি ঐ কথাগুলো বলেছিলেন।
অন্য এক সাক্ষাৎকারে সোফি বলেছিলেন, ‘কোনো বৈবাহিক সম্পর্কই শান্তিপূর্ণ নয়। আমি একরকম গর্ববোধই করি যে আমাদের মধ্যেও বেদনা আছে, যন্ত্রণা আছে। তবে আমরা পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা চাই। সত্য জানতে চাই। আজীবন একে অপরের পাশে থাকতে চাই। আমরা দুজনই স্বপ্নদ্রষ্টা এবং আমরা যতদিন পারি এক সাথে থাকতে চাই।’
ট্রুডো যখন রাজনীতিতে আসেন সোফি তখন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনসঙ্গী হিসাবে তিনি সবসময়ই তাঁর পাশে আছেন।
কিন্তু আজ তাঁদের দাম্পত্য জীবনের সুর পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে অনেক নিয়মও। শুধু সন্তানদের ভবিষ্যত নির্মানের জন্য যতটুকু দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন ততটুকুই তাঁরা করবেন একসাথে। বাকিটা আলাদাভাবে।
ট্রুডো ও সোফির জীবনটা শুরু হয়েছিল রোমান্টিকতার মধ্য দিয়ে। প্রেম করেই বিয়ে করেছেন তাঁরা। সোফি গ্রেগওয়ার জন্ম ১৯৭৫ সালের ২৪ এপ্রিল। সোফিকে জাস্টিন চিনতেন সেই শৈশব থেকেই। কারণ তিনি ছিলেন জাস্টিনের ছোট ভাই মিশেল ট্রুডোর সহপাঠীনি। তবে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে আরো অনেক পরে। সেটি ছিল ২০০৩ সালের ঘটনা যখন দুজনে একটি চ্যারিটি প্রগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই একজন আরেকজনের প্রতি কৌতুহলী হয়ে উঠেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা গভীর প্রণয়ে পরিণত হয়। ২০০৪ সালের অক্টোবরে এঙ্গেজমেন্ট এবং ২০০৫ সালের মে মাসে বিয়ে। বর্তমানে তাঁরা তিন সন্তানের বাবা-মা।
সোফি তার শাশুড়ির মতোই টিভি হোস্ট ছিলেন। বিভিন্ন চ্যারিটি কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তার মা হাসপাতালের সেবিকা। বাবা স্টকব্রোকার। মন্ট্রিয়লেই জন্ম এবং সেখানেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। ম্যাক্গিল ইউনিভারসিটিতে পড়েছেন কামার্সে। উদ্দেশ্য ছিল বাবার পেশায় যোগ দিবেন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে কমিউনিকেশন বিষয়ে ভর্তি হন এবং মন্ট্রিয়ল ইউনিভারসিটি থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার রিসেপশনিস্ট কাম এ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন। পরে একাউন্ট ম্যানেজার পদে উন্নীত হন। কিন্তু সেই পেশা বেশীদিন ভাল লাগেনি। বছর তিনেকের মাথায় তিনি মিডিয়া জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠেন। রেডিও টেলিভিশনের সাংবাদিকতা জগতের সঙ্গে নিজেকে ক্রমশ জড়িয়ে ফেলেন। পাশাপাশি টিভি অনুষ্ঠানের হোস্ট হিসেবেও কাজ করেন।
অন্যদিকে স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর শৈশব জীবনে কিছুটা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলাও দেখা দিয়েছিল। কারণ তার বাবা পিয়ের ট্রুডো এবং মা মার্গারেটের সংসার জীবন খুব মসৃণ ছিল না যদিও তারা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন একজন আরেকজনকে। দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল অনেক বেশী। তারা যখন বিয়ে করেন তখন পিয়ের ট্রুডোর বয়স ছিল ৫২ এবং মার্গারেটের বয়স মাত্র ২২। ৩০ বছরের ব্যবধান।
শুরুতে এই দম্পত্তির মধ্যে কোন সমস্যা ছিল না। ভালই চলছিল সবকিছু। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই মার্গারেটের বিরক্ত হবার পালা শুরু হয়ে যায়। কারণ, পিয়ের ট্রুডো সরকারী কাজ ও রাজনীতি নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকতেন। সন্তানদের দেখাশুনার পুরো দায়িত্বই তখন মার্গারেটকে করতে হচ্ছিল। একপর্যায়ে কিছুটা বিষন্ন ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হয়ে পড়েন মাদকাশক্তও। প্রধানমন্ত্রীর লাগেজে করে মাদক আনার দায়ে একবার নিজউ হেডলাইনও হন মার্গারেট। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টেড কেনেডির সঙ্গে সম্পর্কেও জড়িয়ে পরেন। এক পর্যায়ে ট্রুডোর সঙ্গে মার্গারেটের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সময়টা ছিল ১৯৭৭। ছাড়াছাড়ি হলেও আনুষ্ঠানিক ডিভোর্স হয়নি তখনো। মার্গারেট তখন বেপোরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় আদালতের মাধ্যমে তিন সন্তানের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পান ট্রুডো। ছাড়াছাড়ির পর মার্গারেটকে ট্রুডো কোনরকম স্পাউজাল সাপোর্ট দেননি। বছর দুই পরে যখন ট্রুডো নির্বাচনে পরাজিত হন তখন সেই খবর পেয়ে মার্গরেট নিউয়র্কের একটি নাইটক্লাবে নৃত্য করছিলেন। সেই নৃত্যের ছবি তখন অনেক পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে ছাপা হয়েছিল ফলাও করে। তাঁদের আনুষ্ঠানিক ডিভোর্স হয় ১৯৮৪ সালে। এর কিছুদিন পরই মার্গারেট বিয়ে করেন অটোয়ার রিয়েল এস্টেড ডেভলাপার ফ্রেইড কেম্পারকে। এই ঘরে মার্গারেটের দুই সন্তানের জন্ম হয়।
মার্গারেট অবশ্য পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন যে পিয়ের ট্রুডোর সঙ্গে ডিভোর্স হলেও তাঁর প্রতি ভালবাসার কমতি ছিল না। ২০০০ সালে তাঁর সাবেক স্বামী ট্রুডোর মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর শয্যাপাশেই ছিলেন দুই ছেলে জাস্টিন ও আলেজান্দারকে সাথে নিয়ে।
এখন সোফি যদি তাঁর শাশুড়ির মত একই পথ ধরেন অর্থাৎ নতুন সম্পর্কে জড়ান তবে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আশ্চর্য হবার কোন কারণ নেই জাস্টিন ট্রুডোও যদি নতুন কোন সম্পর্কে জড়ান। তার বাবাও তাই করেছিলেন।
তাছাড়া ট্রুডো ও সোফি এখনো ইয়ং। জীবন তো কারো জন্য বসে থাকে না। আর জীবন চলার পথে মানুষের সঙ্গী দরকার। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। এখন সেপারেশন হয়েছে। কানাডা সমাজ ব্যবস্থায় এটি একেবারেই স্বাভাবিক। সেপারেশনের পরও বন্ধুত্ব টিকে আছে এমন ঘটনার বহু নজির আছে সেলিব্রিটি জগতেও।
ট্রুডো আর সোফির জীবন থেমে থাকবে না। পরবর্তীতে তাঁরা তাঁদের নতুন জীবন সঙ্গী বেছে নিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করবেন। এটা আশা করা যায়।
সন্তানদের উপর বাবা মায়ের এই সেপারেশন কতটা প্রভাব ফেলবে তা জানি না। তবে আমরা জানি বাবা মায়ের সেপারেশন ও ডিভোর্স এর বিরুপ প্রভাব পড়েছিল জাস্টিন ট্রুডোর উপর। ২০১৪ সালে স্মৃতিকথামূলক ‘কমন গ্রাউন্ড’ বইয়ে জাস্টিন ট্রুডো লিখেছিলেন, তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হওয়ার কারণে তিনি কতটা যন্ত্রণা পেয়েছেন। তবে জাস্টিন ট্রুডো কিন্তু পারিবারিক এই উত্থান-পতন বা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিক্রান্ত করলেও বিপথগামী হননি কখনো যেটি সাধারণত দেখা যায় ভঙ্গুর পরিবারের ক্ষেত্রে। বরং কঠিন মনোবল ও স্বতঃস্ফূর্ত মন নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন বরাবরই। আশা করি তার সন্তানেরাও কষ্ট বা যন্ত্রণা পেলেও সামলে নিবে সব কিছু। বাবার মত কঠিন মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ