কোভিড নিয়ে ভুল তথ্যে কানাডায় মারা গেছেন অন্তত ২,৮০০ জন, আর্থিক ক্ষতি ৩০ কোটি ডলার
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সবার অগোচরে ভুল তথ্য ছড়িয়ে না পড়লে কানাডায় কোভিড-১৯ মহামারিতে কমপক্ষে ২,৮০০ জনের জীবন বাঁচানো যেতো, হাজার হাজার মানুষের হাসপাতালে ভর্তির দুর্ভোগ এড়ানো যেতো এবং হাসপাতালগুলোতে ৩০ কোটি ডলারের ব্যয় সাশ্রয় করা যেতো। নতুন এক রিপোর্টে এমনই তথ্য জানা গেছে। তেরেসা রাইট – গ্লোবাল নিউজ।
কাউন্সিল অব কানাডিয়ান অ্যাকাডেমিস (CCA) নামের স্বতন্ত্র বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত রিপোর্টে বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভুল তথ্যের আর্থ-সামাজিক প্রভাব এবং এটি ২০২১ সালের মার্চ ও নভেম্বর মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ এর দুটি তরঙ্গের সময় কানাডীয়দের আচরণ কীভাবে প্রভাবিত করে তা পরীক্ষা করা হয়।
এতে দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়া ভুল তথ্য – যা অসত্য অথবা বিভ্রান্তিকর হিসাবে চিহ্নিত – অন্তত ২৩ লাখ কানাডীয়কে টিকা নেয়ার ব্যাপারে সংশয়ের মধ্যে ফেলেছিল।
রিপোর্টে বলা হয়, এসব কানাডীয়র মধ্যে অনেকে মনে করেন যে কোভিড-১৯ এক “ধাপ্পবাজি” অথবা হয়তো এটি “অতিরঞ্জিত”। অন্যদিকে অন্যরা ধারণা করেন, কোভিডের টিকা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে যা “চেপে রাখা হচ্ছে”।
রিপোর্টে হিসাব করে দেখা হয় যে, টিকা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত কানাডীয়দের সবাই যদি ভাইরাসের টিকা নিতেন তাহলে কানাডায় মৃত্যুর সংখ্যা ২,৮০০ কম হতে পারতো, আইসিইউর সাড়ে তিন হাজার রোগীসহ অন্তত ১৩,০০০ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো না, কানাডায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৯৮ হাজার কম হতো এবং হাসপাতালগুলোতে ৩০ কোটি ডলারের ব্যয় সাশ্রয় হতো।
রিপোর্টে বলা হয়, এই হিসাব অনেকটাই রক্ষণশীলতার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছে, কারণ এতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে অন্য যেসব প্রত্যক্ষ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে সেটা ধরা হয়নি, যেমন চিকিৎসকের ফি। আবার এতে বৃহত্তর সামাজিক মূল্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি- যেমন, উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস বা কর্মচ্যুতি এবং কানাডার স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর সৃষ্ট চাপ।
এই সমীক্ষা চালানোর জন্য সিসিএ ১৩ জন বিশেষজ্ঞের একটি প্যানেল তৈরি করে। প্যানেলের চেয়ারম্যান একজন সাবেক কূটনীতিক অ্যালেক্স হিমেলফার্ব বলেন, ভুল তথ্য ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়, কিন্তু এর প্রভাবের কাছে কানাডা অনেক বেশি নাজুক হয়ে পড়েছিল।
রিপোর্টে তিনি বলেন, “ব্যক্তির ওপর প্রভাব নথিবদ্ধ করা সহজ: যেমন হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যু ও অর্থনৈতিক মূল্য ইত্যাদি। সম্মিলিতভাবে যে মূল্য দিতে হয় তা হিসাব করা অনেক বেশি কঠিন, কিন্তু তা জনস্বাস্থ্য, জনগণের আর্থিক অবস্থা, সামাজিক কাঠামো এবং গোটা গ্রহের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
“আমাদের কেউই ভুল তথ্য ও তার পরিণতি থেকে মুক্ত নই, যদিও সব সময়ের মত যারা সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে তাদেরকেই সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয়।”
স্বাস্থ্য বিষয়ক ভুল তথ্য কীভাবে ছড়ায়?
বিশেষজ্ঞ দল দেখতে পেয়েছেন যে, স্বাস্থ্য বিষয়ক ভুল তথ্য বহু বিচিত্র কারণে ও নানা উপায়ে তৈরি হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে।
রিপোর্টে বলা হয়, ভুল তথ্যের কিছু উৎস অর্থাৎ অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দেয়া কিছু লোক ভাইরাস বা এর টিকা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ঐকমত্য বিষয়ে নিছক অসচেতনতা অথবা অবিশ^াস থেকে এটা করে। অন্যদিকে অনেকে আছে যারা এ বিষয়ে মানুষের আস্থা সক্রিয়ভাবে বিনষ্ট করতে চায়।
উদ্দেশ্য যাই হোক, সামাজিক মিডিয়ার বিভিন্ন প্লাটফরম এবং ব্যক্তিগত মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনের বিস্তার কানাডায় ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি ও ত্বরান্বিতকরণে বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণ এটি যে কোনও ব্যক্তির কনটেন্ট তৈরি ও পোস্ট করার সক্ষমতা বাড়িয়েছে।
এছাড়াও, কতিপয় সামাজিক মিডিয়া কোম্পানি যখন ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কিছু পদক্ষেপ নিতে যায় তখন তাদের অ্যালগরিদমে বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রণোদনার বিষয়টি মিথ্যা বিবরণী বা কনটেন্ট তৈরি ও ছড়িয়ে দেয়ার বাহন হিসাবে কাজ করে।
রিপোর্টে বলা হয়, “সামাজিক মিডিয়া কোম্পানিগুলির অর্থ আয়ের প্রাথমিক উৎস বিজ্ঞাপনের জায়গা বিক্রি, আর এর মূল্য বাড়ে মিডিয়াটির ব্যবহারকারী বা ইউজারদের সক্রিয়তার ভিত্তিতে।”
“সামাজিক মিডিয়ার সদস্যদের উদ্দেশ করে তৈরি করা ভুল তথ্য এর নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট প্লাটফরম উভয়ের জন্যই রাজস্ব সৃষ্টি করতে পারে। দেখা গেছে, আরও কিছু ফ্যাক্টর যেমন, সামাজিক মিডিয়ায় রবোটের ব্যবহার এবং এর অ্যালগরিদমে রেকমেন্ডেশনের বা সুপারিশ করার যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রয়েছে সেটি অনলাইনে ভুল তথ্যভিত্তিক কনটেন্ট তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।”
রিপোর্টে আরও বলা হয়, অতি সরলীকৃত বা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী সাংবাদিকতা এবং সেইসব বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা, যাতে সন্দেহজনক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেগুলিও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই কীভাবে সম্ভব?
ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য রিপোর্টের লেখকরা বৈধ বৈজ্ঞানিক তথ্য গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এর মানোন্নয়ন এবং এর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ানোসহ বেশ কিছু কর্মকৌশলের সুপারিশ করেন।
এসব কর্মকৌশলের মধ্যে রয়েছে, তথ্যের সত্যতা নিরূপণের স্বাধীন ব্যবস্থা এবং অনলাইনের যে কোন ভুল তথ্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিতকরণ; ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করা হয় সে বিষয়ে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা এবং আস্থাশীল অ্যাকাডেমিক গবেষণার সুযোগ বাড়ানো।
রিপোর্টে যথাযথ ও স্পষ্ট তথ্য পৌঁছানোর জন্য ব্যাপকভিত্তিক শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে সক্ষম যথাযথ বার্তাবাহক (মেসেঞ্জার) ও মাধ্যম সতর্কতার সঙ্গে বেছে নেয়াসহ বিজ্ঞান অঙ্গনে অধিকতর কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলে সুপারিশ করা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, “ভুল তথ্যের মোকাবেলা করা ও তার প্রভাব খর্ব করার কাজ সুবিশাল এবং অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার মত অবস্থা আমাদের নেই।”
“কানাডা ও সারা বিশ্বের জনগণের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নির্ভর করছে আজকের দুনিয়ার বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ভ্রান্ত তথ্যের বিষয়ে আমাদের স্বীকৃতি ও প্রতিক্রিয়ার ওপর।”
কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ও অর্থে সম্পাদিত এই রিপোর্টের ১৩১ পৃষ্ঠার একটি খসড়া বিভিন্ন শাখার ১১ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পর্যালোচনা করে। সেই বিশেষজ্ঞ দলের অনেক পরামর্শও এই রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।