টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১২
কাজী সাব্বির আহমেদ
কঠোর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে থিয়েনআনমেন চত্বরের ছাত্র আন্দোলন দমনের পর বেইজিং-এর জীবনযাত্রা এক সময় স্বাভাবিক হয়ে আসে। সেই সাথে ইউনিভার্সিটিসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও স্বাভাবিক শিক্ষাক্রম ফিরে আসে। দুই মাসেরও বেশী সময় ধরে ক্লাস বন্ধ থাকার পর এমন এক সময় ক্লাস আবার শুরু হয় যখন সেমিস্টার ফাইনালের আর বেশী বাকী নেই। ফলে শিক্ষকদেরকে বেশ তাড়াহুড়ো করে এবং সিলেবাসকে কিছুটা কাটছাঁট করে তাদের সাবজেক্টগুলি পড়ানো শেষ করতে হয়। আমরা যারা তখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র ছিলাম তাদের জন্য সবচেয়ে ভীতিপ্রদ সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স ফার্স্ট পার্ট। ফলে অন্যান্য সাবজেক্টের তুলনায় আমরা সবাই ফিজিক্স নিয়ে বেশী চিন্তিত ছিলাম। ভাষাগত দূর্বলতার কথা বিবেচনা করে চীনের প্রায় সব ইউনিভার্সিটিই তাদের ফরেন স্টুডেন্টদের জন্য প্রতিটি সাবজেক্টের জন্য আলাদা কিছু টিউটোরিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা করত। সেই বিশেষ টিউটোরিয়াল ক্লাসগুলি এই সংকটপূর্ণ সময় খুব কাজে এসেছিল বিশেষ করে সেই ভয়াবহ ফিজিক্স পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। এক সময় সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হয়ে শুরু হয় বহুল আকাঙ্ক্ষিত সামার ভ্যাকেশন। আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম যে এইবারের সামার ভ্যাকেশনে আরও কয়েকজন সিনিয়র ভাইদের সাথে দেশে বেড়াতে যাব। পাকিস্তান অ্যাম্বাসীর এক ডিপ্লোমেটের ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে বেশ কিছু ডলার হাতে এসেছিল। সাথে যোগ হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের দেয়া এককালীন বৃত্তির টাকা যা আমাদেরকে ডলারে দেয়া হয়েছিল। হিসাব করে দেখলাম জমানো এই ডলার দিয়ে শুধু দেশ থেকে বেরিয়ে আসা নয়, ফেরার পথে হংকং থেকে একটা অ্যাসেম্বলড করা পার্সোনাল কম্পিউটারও কিনে আনা যাবে। বাংলাদেশ সরকারের দেয়া এই বৃত্তির টাকা দেয়ার অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ যখন তিনি ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতন চীন সফরে আসেন।
প্রেসিডেন্ট এরশাদের সেই চীন সফর ছিল চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যদিও চীনের সাথে বাংলাদেশের কার্যকরী কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে সত্তুর দশকের শেষভাগে যা কিনা আশির দশকের মধ্যভাগে এসে বেশ জোরদার হয়ে উঠে বিভিন্ন প্রকার সামরিক চুক্তির মাধ্যমে। এই সময় দুই দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেও অনেক ধরণের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশের ছাত্ররা যেমন চীনের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া শুরু করে তেমনি অনেক চাইনিজ ছাত্ররাও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য আসা শুরু করে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের ১৯৮৭ সালের এই সফরের পরপরই চীন বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা নদীর উপর একটি সেতু তৈরি করার কাজে হাত দেয় যা কিনা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়। এই সেতুর কারণে ঢাকার সাথে মুন্সিগঞ্জের যোগাযোগ সহজ হয়ে উঠে। ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু’ নামে পরিচিত এই সেতুর মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ অবকাঠামো তৈরির কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় এবং আজ অবধি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট আটটি ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু’ তৈরি করেছে। পদ্মা সেতু অবশ্য এই আটটি সেতুর বাইরে। বাংলাদেশ চীনের এই বন্ধুত্বের প্রতিদান স্বরূপ বেইজিং-এ একটি প্রাইমারী স্কুল তৈরি করে দেয় যেখানে চীনের সিলেবাসের সাথে বাংলা ভাষাও শেখানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ভাষায় গান পরিবেশন করে দর্শকশ্রোতাদের মুগ্ধ করে থাকে।
সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরো দুইজন সিনিয়র ভাইয়ের সাথে দেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। ট্রেনে করে প্রথমে গেলাম ক্যান্টন। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টার সেই জার্নি। বেইজিং রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হয় রাত দশটায়। পরেরদিন সারাদিন এবং সারারাত চলার পর ভোর বেলায় ট্রেন গিয়ে পৌঁছে ক্যান্টন স্টেশনে। সাউথ চায়নার কুয়াংতোং প্রদেশের রাজধানী কুয়াংট্রৌ বা ক্যান্টন হচ্ছে বাণিজ্যিক দিক থেকে চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এখানকার আবহাওয়া, ভাষা এবং খাদ্যাভ্যাস বেইজিং-এর চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। ভৌগলিকভাবে বিষুবীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় ক্যান্টনের আবহাওয়ার সাথে বরং আমাদের বাংলাদেশের অনেক মিল রয়েছে। আবহাওয়াগত মিল থাকাতে ক্যান্টনে আমাদের দেশের মতন আম-কাঁঠাল পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় কাঁঠালের আকৃতির আরেকটি বিখ্যাত ফল ‘দুরিয়ান’ যা কিনা মালেয়শিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরেও প্রচুর পরিমাণে হয়। রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়ে দেখেছি এদের অনেক মাছ আমাদের দেশেও পাওয়া যায় যেমন কই, শৌল ইত্যাদি। তাছাড়া বেইজিং-এর মানুষেরা যেখানে স্ট্যাপল ফুড হিসেবে রুটি জাতীয় খাবার পছন্দ করে সেখানে বাংলাদেশের মতন ক্যান্টনের লোকেদের পছন্দ ভাত। ক্যান্টনের ভাষার সাথে চীনের জাতীয় ভাষা ম্যান্ডারিনের কোন মিল না থাকাতে আমরা তাদের ভাষা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভাষার এই অমিলের জন্য বেইজিং কিংবা নর্থ চায়নার লোকেরা সাউথ চায়নার ভাষা বুঝতে অক্ষম। তবে সাউথ চায়নার মানুষেরা ম্যান্ডারিনে কথা বলতে পারে, কিন্তু তাদের সেই কথায় একটা এক্সেন্ট থাকে। সাউথ চায়নার এই এক্সেন্টকে বেশ হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘ফু জ লাও ইয়ে ঠ্র’ বা ‘ফাদার, সন এন্ড দ্য ওল্ড কার’ নামক একটি কমেডি মুভিতে। ১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে চীনের বিখ্যাত দুই কমেডিয়ান ‘ঠ্রেন ছিয়াং’ এবং ‘ঠ্রেন পেই-স’ যারা ব্যক্তিগত জীবনে পিতা-পুত্র, তারা অভিনয় করেছেন। এই সিনেমাতেও তারা অভিনয় করেছেন পিতা-পুত্রের ভূমিকায় যাদের একটি দাদার আমলের গাড়ী আছে। সাউথ চায়নার শেনট্রেন শহরের এক ব্যবসায়ীর সাথে তাদের চুক্তি হয় যে তাদের পুরাতন গাড়িটিকে দিয়ে শেনট্রেন শহরে ট্যুরিস্ট পরিবহণের ব্যবসা করা হবে। চুক্তি মোতাবেক বেইজিং থেকে শেনট্রেন শহরে এসে ভাষা, খাদ্যাভ্যাস এবং কালচারের ভিন্নতার কারণে তারা পদে পদে নাজেহাল হতে থাকে। তাদের সেই করুণ দশা বেশ উপভোগ্যভাবে দেখানো হয়েছে এই সিনেমাতে। এই সিনেমা দেখার পর থেকে আমি এই দুই অভিনেতার বিশেষ ভক্ত হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে তাদের অভিনীত আরো কিছু কমেডি সিনেমা বেশ আগ্রহভরে দেখেছি।
ক্যান্টন স্টেশনেই নেমেই আমাদেরকে তাড়াহুড়ো করে কিনতে হয় শেনট্রেন-এ যাওয়ার ট্রেন টিকেট। ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে আমাদের জন্য টিকেটের দাম ছিল অন্যান্য চাইনিজ স্টুডেন্টদের মতন অর্ধেক। এছাড়াও অন্যান্য বিদেশীদের মতন আমাদেরকে ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ সার্টিফিকেট’ বা ‘এফইসি’ নামক স্পেশাল কারেন্সি ব্যবহার করতে হত না। সরকারীভাবে এই ‘এফইসি’-এর মুদ্রামান চীনের মূল কারেন্সি ‘রেনমিনবি’-এর সমান। কিন্তু বিদেশীরা তাদের সাথে নিয়ে আসা ডলার বা বিদেশী মুদ্রা ব্যাংক থেকেই যে ভাঙ্গিয়েছে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই ‘এফইসি’ নামক একটি পৃথক কারেন্সি চালু করেছে চীন সরকার। সাধারণ চাইনিজদের কাছে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকাতে খোলা বাজারে সরকারের নির্ধারিত হারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পরিমান ‘রেনমিনবি’ পাওয়া যেত। ডলার যাতে খোলা বাজারে বিক্রী না হয় সেই জন্যেই বিদেশীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ‘এফইসি’ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা। তবে শুধুমাত্র কিছু সরকার নিয়ন্ত্রিত শপিংমলে কেনাকাটার সময় এবং ট্রেন কিংবা প্লেনের টিকিট কাটার সময় এই বাধ্যবাধকতার প্রয়োগ ছিল। আমরা যারা চীনের বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছি তাদের জন্য এই বাধ্যবাধকতা ছিল না। চাইনিজ গভর্মেন্ট আমাদেরকে একটা সাদা রঙের কার্ড দিয়েছিল যাকে আমরা ‘হোয়াইট কার্ড’ বলতাম সেটা দেখিয়ে আমরা অনায়াসে ‘এফইসি’-এর বদলে ‘রেনমিনবি’ ব্যবহার করতে পারতাম। এই ‘হোয়াইট কার্ড’ দিয়ে আবার অনেক জিনিস ‘ডিউটি ফ্রি’-তেও পাওয়া যেত। স্টুডেন্ট কার্ড আর হোয়াইট কার্ড, এই দুইয়ের বদৌলতে আমাদের জন্য বেইজিং থেকে সরাসরি ফ্লাই না করে বরং হংকং পর্যন্ত ট্রেনে এসে তারপর প্লেনে করে দেশে যাওয়াটা ছিল আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী।
শেনট্রেন হচ্ছে চীনের শেষ শহর, তারপরই হংকং-এর শুরু। দেং শিয়াওপিং-এর ওপেন ডোর পলিসির সুবাদে চীনে যে কয়েকটি স্পেশাল ইকনোমিক জোন প্রথমে তৈরি করা হয় তার মধ্যে শেনট্রেন অন্যতম। ১৯৮০ সালে স্পেশাল ইকনোমিক জোনে রূপান্তরিত হওয়ার আগে শেনট্রেন ছিল স্বল্পবসতির একটি ছোট শহর। বর্তমানে সেখানে প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন লোকের বাস। শেনট্রেন স্টেশন থেকে হাঁটার দূরত্বে চীন-হংকং বর্ডার। বাংলাদেশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হওয়াতে বৃটিশ শাসিত হংকং-এ ঢোকার জন্য আমাদেরকে তখন অগ্রিম ভিসা নেওয়ার দরকার হতো না। আমরা চীনের ইমিগ্রেশন পার হয়ে হংকং-এর ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে যেতেই তিনি তিন মাসের ভিজিট ভিসা দিয়ে আমাদেরকে হংকং-এ ঢুকিয়ে দিলেন। মার্শাল আর্টসের গুরু ব্রুস লীর অভিনীত ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ সিনেমার মাধ্যমে সেই কিশোর বয়সেই হংকং-এর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ফলে কুংফু-কারাতের সিনেমার জন্য বিখ্যাত হ্ংকং-এ ঢুকে বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলাম। হংকং আসলে সিনেমার জন্য যত না বিখ্যাত তারচেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ তার ভৌগলিক অবস্থানের কারণে। সেই জন্যই হংকং-কে নিজেদের কলোনি বানানোর জন্য বৃটিশরা সবসময়ই তৎপর ছিল। ১৮৪১ সালে প্রথম ওপিয়াম বা অ্যাংলো-সাইনো যুদ্ধের সময় বৃটিশরা হংকং দ্বীপ দখল করে নেয়। সেই সময় চীনে ছিল ‘ছিং ডাইনেস্টি’-এর রাজত্বকাল। পরবর্তীকালে ১৮৬০ সালে দ্বিতীয় ওপিয়াম যুদ্ধের সময় বৃটিশরা চীনের সাথে যুক্ত কাউলুন পেনিনসুলাকেও দখল করে নিয়ে হংকং দ্বীপের সাথে যুক্ত করে নেয়। এরপর ১৮৯৮ সালে প্রথম সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধের সময় বৃটিশরা ‘নিউ টেরিটরি’ অঞ্চলের নিরানব্বই বছরের লিজ বা চুক্তি অর্জন করে। হংকং দ্বীপ, কাউলুন পেনিনসুলা এবং ‘নিউ টেরিটরি’, এই তিন অঞ্চলকে একত্রে বৃটিশ কলোনী হংকং বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপান যদিও ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হংকং নিজ দখলে রাখে, কিন্তু যুদ্ধ শেষে জাপানের পরাজয়ের পর হংকং-এর শাসনভার আবার বৃটিশদের হাতে ফেরৎ যায়। ১৯৪৯ সালে কম্যুনিস্ট শাসিত গণচীন প্রতিষ্ঠার পর বৃটিশরা বুঝতে পারে যে হংকং-এর লিজ আর নবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাই ১৯৮৪ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ‘আয়রন লেডী’ মার্গারেট থেচার চীনের কাছে হংকং হস্তান্তরের চুক্তিতে সই করেন। এই সময় চীনের প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং নিশ্চিত করেন যে হস্তান্তরের পর পঞ্চাশ বছরের জন্য হংকং-এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এবং ইকনোমিক ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। দেং শিয়াওপিং-এর দেয়া এই প্রতিশ্রুতি ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ হিসেবে পরিচিত। প্রায় দেড় শত বছর শাসনের পর ১৯৯৭ সালের পহেলা জুলাই বৃটিশ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে হংকং-কে চীনের কাছে হস্তান্তর করে। হংকং-এর পর ১৯৯৯ সালের ২০শে ডিসেম্বরে পর্তুগিজ কলোনী ম্যাকাউ চীনের কাছে ফেরত আসে। ম্যাকাউ চারশত বিয়াল্লিশ বছর পর্তুগিজদের অধীনে ছিল। মাদক চোরাচালানীদের স্বর্গরাজ্য এবং সেইসাথে ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত ম্যাকাউ-এর ব্যাপারেও চীনকে হংকং-এর অনুরূপ ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ নীতি গ্রহণ করতে হয়। আমি আমার চীনের ছাত্র জীবনে দুইবার ম্যাকাউ-তে গিয়েছিলাম। একবার ১৯৯০ সালে চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের ট্রুহাই শহরের সাথে লাগোয়া বর্ডার দিয়ে। অন্য বার ১৯৯১ সালে হংকং থেকে সাউথ চায়না সি-এর উপর দিয়ে হাইস্পিড ফেরীর মাধ্যমে। হংকং থেকে ম্যাকাউ যাওয়ার আরেকটি উপায় ছিল ‘জেট ফয়েল’। ‘জেট ফয়েল’ হচ্ছে এক ধরণের সামুদ্রিক যান যা অত্যন্ত দ্রুতবেগে পানির উপর দিয়ে চলাচল করতে সক্ষম। যেন ‘সুপারসনিক’ বিমানের সামুদ্রিক সংস্করণ। এই ‘জেট ফয়েল’-এ করে আধা ঘন্টার মধ্যে হংকং থেকে ম্যাকাউ-এ, কিংবা ম্যাকাউ থেকে হংকং-এ যাওয়া যায়। তবে ভাড়া অত্যন্ত বেশী হওয়াতে শুধুমাত্র বিত্তবানদের মাঝেই এই বাহন জনপ্রিয় ছিল। তবে ২০১৮ সালে প্রায় ছাপ্পান্ন কিলোমিটার লম্বা ‘হংকং-ট্রুহাই-ম্যাকাউ সি-ব্রিজ’-এর উদ্বোধনের পর এই পথেই ট্যুরিস্টরা হংকং-ম্যাকাউ করতে বেশী পছন্দ করে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে এই ব্রিজটিই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সামুদ্রিক সেতু যা কিনা চীনের সেতু তৈরি কারিগরি উৎকর্ষতার আরেকটি মাইলফলক।
হংকং এবং ম্যাকাউ-কে হাতে পাওয়ার পর চীনের সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে পড়ে তাইওয়ানের উপর। তাইওয়ান যে চীনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটাকে জাতীয় সত্ত্বার মাঝে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য প্রচার করা হলো যে, চীনের ম্যাপ দেখতে একটি মুরগীর মতন যার একটি পা হচ্ছে ‘হাইনান দ্বীপ’ এবং অপরটি ‘তাইওয়ান’। অতএব ‘তাইওয়ান’-কে না পাওয়া পর্যন্ত চীনের ম্যাপ পূর্ণ হবে না। ১৯৪৯ সালে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি তখনকার ‘রিপাবলিক অব চায়না’-এর ক্ষমতাসীন সরকার ন্যাশনালিস্ট ‘কোয়ামিনতাং’ দলকে গৃহযুদ্ধে হারিয়ে দেয়। ‘কোয়ামিনতাং’-এর দলনেতা ‘চিয়াং কাইসেক’ তার দল্বল এবং আর্মি নিয়ে দক্ষিণ চীনের তাইওয়ান প্রণালী পাড়ি দিয়ে তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেন। ১৯৫০ সালে কম্যুনিস্ট চীন কোরিয়ান যুদ্ধে জড়িয়ে যায় যা ছিল প্রকারন্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেই সময়কালটা ছিল ‘কোল্ড ওয়ার’-এর সময়, ফলে কম্যুনিস্ট পার্টির নয়াচীনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশই মেনে নিতে পারেনি। ফলে তারা তাইওয়ান দ্বীপকেই ‘রিপাবলিক অব চায়না’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করল। কিন্তু চীনের দাবী হচ্ছে ‘তাইওয়ান’ হচ্ছে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’-এর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ যা কিনা পশ্চিমা বিশ্ব মেনে নেয়নি। ফলে চীনকে ‘ওয়ান চায়না’ পলিসি গ্রহণ করতে হয় – অর্থাৎ তুমি যদি আমার সাথে কূটনৈতিক স্থাপন করতে চাও তবে তাইওয়ান বা ‘রিপাবলিক অব চায়না’-কে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবে না। ‘কোল্ড ওয়ার’ শেষ হওয়ার পর দেখা যায় যে অনেক দেশই তাইওয়ান থেকে মুখ ফিরিয়ে চায়নামুখী হয়েছে। সৌদী আরব সেই দেশগুলির মধ্য অন্যতম। থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের পর যেখানে পৃথিবীর অনেক দেশই চীনের সমালোচনায় মুখর ছিল সেখানে মার্কিন সরকারের মদদপুষ্ট সৌদী আরব ছিল নিশ্চুপ। কারণ তলে তলে তারা তখন চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। ১৯৯০ সালে সৌদী আরব তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সাথে হাত মেলায়। সৌদী আরব চীনের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে এতটাই স্পর্শকাতর যে উইঘুর মুসলিমদের উপর চীনের অত্যাচারের ব্যাপারে তারা কোন প্রতিবাদ করেনি। অতি সম্প্রতি লাটিন আমেরিকার দেশ হন্ডুরাস তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে চায়নার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। বর্তমানে মাত্র তেরোটি দেশ তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। চীন সরকারের ভাষ্যমতে তাইওয়ানের কর্তৃত্ব নেয়ার জন্য তারা কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যাবে কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরে যুদ্ধ করতে হলেও পিছপা হবে না। সেই জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-কে ‘গ্রেট ওয়াল অব স্টীল’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মনে করেন যে চীন নিকট ভবিষ্যতে তাইওয়ানে কোন রকম সামরিক অভিযান চালাবে না। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
হংকং-এর ইমিগ্রেশন পার হতেই দেখা মিলে সাবওয়ে ট্রেন স্টেশনের যা ‘এমটিআর’ নামে পরিচিত। আমাদের কাছে কোন হংকং ডলার না থাকায় এবং স্টেশনে কোন মানি এক্সচেঞ্জের সুবিধা না থাকায় বুথ থেকে আমাদেরকে কমপ্লিমেন্টারি টিকেট দেয়া হলো। চীনের সাথে হংকং-এর পার্থক্য রয়েছে প্রতিটা ক্ষেত্রে। সেটার সাথে প্রথম পরিচয় ঘটল এই ‘এমটিআর’ স্টেশনেই। ‘এমটিআর’-এর ম্যাগনেটিক স্ট্রিপের টিকেট নির্দিষ্ট জায়গাতে ঢোকাতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল স্টেশনের গেট, যেখানে বেইজিং-এর সাবওয়েতে ঢোকার সময় টিকেট কালেক্টরের কাছে টিকেট জমা দিয়ে ঢুকতে হয়। অর্থাৎ টেকনোলজির ব্যবহারের দিক থেকে হংকং চীন থেকে অনেক এগিয়ে। চীনের সাথে লাগোয়া হংকং-এর যেই অংশ তার নাম হচ্ছে কাউলুন। আমাদের গন্তব্য হচ্ছে এই কাউলুনের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ‘চুংকিং ম্যানশন’। বিশাল আকৃতির এই কমার্শিয়াল বিল্ডিং-এর প্রথম কয়েকটি তলায় রয়েছে দোকানপাঠ আর উপরের দিকে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের অফিস এবং কিছু গেস্ট হাউস। আমার সাথে আসা সিনিয়র ভাইদের পূর্বপরিচিত একটি গেস্ট হাউজে গিয়ে উঠলাম আমরা। গেস্ট হাউজের পরিচালক মাঝ বয়সী একজন মহিলা যিনি এই গেস্ট হাউজেই স্কুল পড়ুয়া তার দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। তিনি আমাদের সাথে ম্যান্ডারিনে আলাপ চালালেন। তার পরিবার সাংহাই থেকে পালিয়ে হংকং-এ আসে যখন ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’-এর ব্যর্থতার কারণে সারা চীন জুড়ে দুর্ভিক্ষ চলছিল। আমরা বেইজিং থেকে এসেছি শুনে তিনি আমাদের কাছে থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের ঘটনা জানতে চাইলেন। লক্ষ্য করে দেখলাম যে হংকং-এর চাইনিজদের ভিতর থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের ঘটনার কারণে এক ধরণের আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের কব্জায় চলে যাবে তখন তাদেরকে কম্যুনিস্ট শাসনের যাঁতাকলের মধ্যে পড়তে হবে। দেং শিয়াওপিং-এর দেয়া ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তারা খুব একটা ভরসা পাচ্ছিল না। এই সময় হংকং থেকে প্রচুর চাইনিজ কানাডাতে ইমিগ্রেশন নিয়ে পাড়ি জমায়। ‘ক্যানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল’, কানাডার একটি নামকরা থিংক ট্যাংক-এর হিসাব অনুসারে ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হংকং থেকে মোট ৩৩৫,৬৪৬ জন কানাডাতে ইমিগ্রান্ট হিসেবে পাড়ি জমায়। উল্লেখ্য যে বৃটিশ ন্যাশনালিটি ল’-এর জটিলতার কারণে হংকং-এর চাইনিজরা কানাডাতে মাইগ্রেট করতে বেশী আগ্রহী হয়েছিল কারণ কানাডা তাদের জন্য এই মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া সহজতর করে দিয়েছিল। চীন যে ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’-এর প্রতিশ্রুতি যে কোন সময় ভঙ্গ করতে পারে সেটার নমুনা দেখা যায় ২০১৯ সালে। হংকং-এর পার্লামেন্টে যখন ‘এক্সট্রাডিশন টু চায়না’ অর্থাৎ হংকং থেকে যে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চীন সরকারের হাতে তুলে দেয়ার বিল তোলা হলো তখন হংকং-এর আপামর জন সাধারণ এই বিলের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হংকং-এর আইন শৃংখলা বাহিনী যখন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছিল তখন পিপলস লিবারেশন আর্মির পক্ষ থেকে বলা হয় যে হংকং সরকার চাইলে তারা হংকং-এর এই বিক্ষোভ দমনে সহায়তা করবে। এই সময় চীন হংকং-এর লাগোয়া শেনট্রেন শহরে বিপুল পরিমাণে আর্মি ট্রাক এবং আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ারের সমাবেশ ঘটায়। সেই সব ছবি দেখে হংকং-এর জনগণ থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হংকং-এর জনগণের এই নাজুক পরিস্থিতিতে কানাডা অবশ্য ১৯৯৪ সালের মতন আবারও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় দ্রুততার সাথে তাদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে।
চুংকিং ম্যানশনের গেস্ট হাউজে আমরা দুইদিন ছিলাম। এই দুইদিনে ‘হংকং-ব্যাংকক-ঢাকা’ রিটার্ন টিকেট কাটা, দেশের জন্য টুকাটাক শপিং করা এই নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। আমার সাথে থাকা দুই সিনিয়র ভাই আগেও হংকং-এ এসেছিলেন বলে সবকিছুই তাদের জানাশোনা ছিল, ফলে আমাকে কোন ধকল পোহাতে হয়নি। এক সময় প্লেনে চড়ে দেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। ব্যাংকক হয়ে যখন ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছি তখন দেখি যে আমাদের একই ফ্লাইটে বেশ কিছু চিত্র তারকাও ব্যাংকক থেকে ঢাকা এসেছেন। তাদের ভেতর নায়ক জাফর ইকবাল এবং নায়িকা ববিতাও ছিলেন। ঢাকাতে আসার পর আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের একটি কমন প্রশ্ন ছিল – থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের কারণে চীন কি আবারও কালচারাল রেভ্যুলেশনের যুগে ফিরে যাবে? (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো