টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১১
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রক্তক্ষয়ী সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে থিয়েনআনমেন স্কয়ারের ছাত্র আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়ার পর প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং-এর কঠোর নেতৃত্বে চীনের কম্যুনিস্ট সরকার দ্রুততম সময়ে বেইজিং-এর অবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলিতে এবং একই সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফটকগুলিতে নিরাপত্তা জোরদার করার মাধ্যমে সরকার জনগণ কিংবা ছাত্ররা যাতে পুনরায় জোট বেঁধে আন্দোলন করতে না পারে সেই ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠে। সমস্ত কলকারখানা এবং অফিস আদালতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষকদেরকে ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনা হয়। ফলে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশী ছাত্ররা যারা সপ্তাহখানেক ধরে বাংলাদেশ দূতাবাসের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বাসায় অবস্থান করছিলাম তারা একে একে ফিরে গেলাম আমাদের নিজেদের ডরমেটরীতে। দীর্ঘ বিরতির পর আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হলো বটে কিন্তু ছাত্র কিংবা শিক্ষক কারো মাঝেই আগের সেই প্রাণচঞ্চলতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবার চেহারাতেই এক ধরণের নীরব বিষণ্ণতা। যে বিষণ্ণতা সহজেই আমার নজরে পড়ত, কিন্তু সেটার গভীরতা বোঝা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। কারণ সেই বিষণ্ণতার মাঝে মিশে রয়েছে কয়েক জেনারেশনের যে নিষ্পেষণ ও বঞ্চনার প্রতিফলন সেটার সংগে আমি তখন মোটেও পরিচিত ছিলাম না ।
তবে আজ পরিণত বয়সে এসে হয়ত সেই বিষণ্ণতার গভীরতাকে কিছুটা হলেও এখন উপলব্ধি করতে পারি। কারণ ইদানীং কালে ‘ওয়াইল্ড সোয়ানস – থ্রি ডটারস অব চায়না’ নামক বইটি পড়ে জানতে পারি কিভাবে চীনের জনগণ তিন জেনারেশন ধরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যাঁতাকলে পড়ে নিষ্পেষিত হয়েছে। আত্মজীবনীমূলক এই বইটিতে লেখিকা যুং চ্যাং তার নানী, তার মা এবং তার নিজের জীবন কাহিনী বর্ণনা করেছেন তাদের নিজ নিজ সময়কার চীনের সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে। ছোট একটি শহরের বাসিন্দা লেখিকার নানীকে তার বাবা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভে বেইজিং-এর একজন প্রভাবশালী উচ্চ পদস্থ পুলিশ অফিসারের সাথে বিয়ে দেন। আসলে সেই পুলিশ অফিসার তার নানীকে উপপত্নী বা ‘কঙ্কুবাইন’ হিসেবে গ্রহণ করে যা কিনা সেই সময়ের চাইনিজ সমাজের চোখে দোষনীয় কোন ব্যাপার ছিল না। কারণ সেই সময়ে চাইনিজ সমাজে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল তবে প্রথম স্ত্রী বাদে অন্য সবাইকে ‘কঙ্কুবাইন’ হিসেবে গণ্য করা হত। অন্যান্য স্ত্রীদেরকে অর্থাৎ কঙ্কুবাইনদেরকে প্রথম স্ত্রীর অনুগত থাকতে হত। প্রথম স্ত্রীই ঠিক করে দিত সংসার কিভাবে পরিচালিত হবে। সমস্ত দাসদাসী চলত তারই অঙ্গুলিহেলনে। ফলে অন্যান্য কঙ্কুবাইনদেরকে শুধু প্রথম স্ত্রীকেই নয়, দাসদাসীদেরকেও সমঝে চলতে হত। সেই উচ্চ পদস্থ পুলিশ অফিসারের ঔরসে জন্ম নেয়া লেখিকার মাকে নিয়ে তার নানী প্রথম স্ত্রীর কোপানলে পড়েন এক সময়। অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে তার নানী এক সময় পালিয়ে চলে যান তার বাবা মায়ের শহরে যেখানে তার জন্য তার স্বামী আগেই একটা বাড়ী কিনে দিয়েছিল। এক সময় খবর আসে যে তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। লেখিকার নানীকে তখন সেই বাড়ী ছেড়ে তার বাবার বাড়ীতে উঠতে হয় লেখিকার মাকে সংগে নিয়ে। কিন্তু সেখানে তাকে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। সেই লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেন একজন বৃদ্ধ প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে বিয়ে করার মাধ্যমে। কিন্তু যৌথ পরিবারের কর্তা সেই বৃদ্ধ ডাক্তারের পুত্ররা এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। কারণ স্ত্রী হিসেবে লেখিকার নানী ডাক্তারের যৌথ পরিবারের কর্তী হয়ে উঠেন যা কিনা পুত্রদের বৌদের পক্ষে হজম করা কঠিন ছিল। ফলে প্রতি পদে পদে লেখিকার নানীকে অবজ্ঞা এবং অপমানের শিকার হতে হত। এছাড়া চাইনিজ বিশ্বাসমতে কোন নারীর যদি দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় তবে মৃত্যুর পর সেই নারীকে দ্বিখণ্ডিত করে তার দুই স্বামীর মাঝে ভাগ করে দেয়া হবে। এই পাপবোধও লেখিকার নানীকে সব সময় কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। অর্থাৎ মনের ভিতর এক ধরণের অতৃপ্তি তার থেকেই যেত। পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এক সময় সেই বৃদ্ধ ডাক্তার লেখিকার নানী ও লেখিকার মাকে নিয়ে চলে যান নতুন এক শহরে। সেখানে তিনি আবার নতুন করে তার ডাক্তারী প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং সেই সাথে একটি ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনের একটি দোকান দেন। কিন্তু সুখ যেন তাদের কপালে লেখা নেই। সেই সময় মাঞ্চুরিয়ান সম্রাট পু-ঈ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়ে যায় জাপানী আগ্রাসন। প্রাইমারি স্কুল থেকেই জাপানী শিক্ষক এবং জাপানী সহপাঠীদের বুলিইং-এর শিকার হতে হয় লেখিকার মাকে। এই সময় একদিকে চিয়াং কাই-শেক-এর নেতৃত্বে কুয়ামিংটাং দল এবং অপরদিকে মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি উভয়েই জাপানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। অত্যন্ত মেধাবী এবং বহু গুণে গুণান্বিতা লেখিকার মাকে দলে টানার জন্য কুয়ামিংটাং-এর গোয়েন্দারা সচেষ্ট হয়। জাপানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয় থেকে তিনি তখন বেশ কয়েকজন কুয়ামিংটাং-এর গোয়েন্দার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন জাপানীদের পতন ঘটে তখন কুয়ামিংটাং সরকার গঠন করে। কিন্তু তাদের নেতা এবং কর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতির ফলে জনগণের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দশা। সেই সময়ে আশীর্বাদ হয়ে দেখা মিলে কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মীদের। লেখিকার টিন এজার মা তখন কম্যুনিস্ট পার্টির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই দলে যোগ দেন। সেখানেই তার হবু বর অর্থাৎ লেখিকার বাবার সাথে পরিচয় হয়। কুয়ামিংটাং-এর দলনেতা চিয়াং কাই-শেক এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদেরকে তাইওয়ানে বিতাড়িত করে ১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবরে কম্যুনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং নয়াচীনের ঘোষণা দেন। কম্যুনিস্ট পার্টির আদর্শ দ্বারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত এবং পার্টির জন্য নিবেদিত প্রাণ লেখিকার বাবা খুব অল্প বয়সেই পার্টির বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই সময় লেখিকার জন্ম হয়। লেখিকার বাবা এবং মা উভয়েই পার্টির কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে তাদের পক্ষে বাচ্চাকে লালন পালন করা সম্ভবপর হয়ে উঠত না। যদিও পার্টি থেকে একজন কাজের মানুষ রাখার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হয়, তবুও লেখিকার নানীকে নিয়ে আসা হয় বাচ্চাকে দেখাশুনা করার জন্য। এইভাবেই তিন জেনারেশনের তিন কন্যা একই বাড়ীতে থাকা শুরু করেন এবং একই সাথে নয়াচীনের সবচেয়ে কঠিন সময় অর্থাৎ দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড এবং কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় পাড়ি দেন।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে লেখিকা দেখতে পান যে মাও সেতুং ইতিমধ্যেই দেবতার আসনে আসীন। প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সারা চীনব্যাপী ‘মাও-বন্দনা’ নীতির কারণে সেই শিশুবেলা থেকেই লেখিকার ভেতর চেয়ারম্যান মাও-এর প্রতি একটি অকৃত্রিম লয়ালিটি তৈরি হয়। আর সেই কারণেই যখন তার মতন বাচ্চাদেরকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ইস্পাত তৈরির জন্য চুল্লির উপর রাখা বিরাট কড়াইতে ফেলার জন্য পরিত্যক্ত লোহার টুকরা তন্নতন্ন করে খুঁজে নিয়ে আসার কাজ করতে হত তখন তার শিশুমন ভরে উঠত এক পরম পরিতৃপ্তির অনুভূতিতে। কম্যুনিস্ট পার্টি কিংবা মাও-এর কারণে তার শৈশব যে চুরি হয়ে যাচ্ছে সেটা তিনি তখন বুঝতেই পারেন নি। তিনি শুধু একা নন, তার জেনারেশনের কেউই তখন তা বুঝতে পারেন নি। অবশ্য তখন তাদের সেটা বোঝার বয়সও নয়। কিন্তু পরবর্তীতে লেখিকার সেই জেনারেশন এক সময় টের পায় তাদের শৈশব হারানোর বেদনা। সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে গভীর এক হাহাকার যে হাহাকারের সাথে আমরা মোটেই পরিচিত নই।
দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের ব্যর্থতার ফলে সারা চীনে দেখা দেয় এক চরম দুর্ভিক্ষের। সেই কঠিন সময়েও চেয়ারম্যান মাও-এর প্রতি সদ্য শৈশব উত্তীর্ণ লেখিকার লয়ালিটির কোন পরিবর্তন হয়নি। দুর্ভিক্ষের সেই দিনগুলিতে তার বাবা কম্যুনিস্ট পার্টির বিভিন্ন কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রতিকারের আশায় উপরের মহলের কাছে চিঠি লিখলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটা তার একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য যা কিনা পার্টির মেনিফেস্টোতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন নি যে দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের ব্যর্থতার দায়ভার যাতে নিজ কাঁধে নিতে না হয় সেই কারণে দলের নেতা এবং কর্মীদেরকে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য বিচক্ষণ মাও ইতিমধ্যেই নতুন এক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি প্রচার করা শুরু করেছেন যে এখনও দলের মধ্যে ‘প্রতিবিপ্লবী’রা লুকিয়ে আছে, সাপ যেমন গর্তে লুকিয়ে থাকে সেভাবে এবং তাদের সংখ্যা শতকরা দশভাগ। আর লুকিয়ে থাকা সেই সব প্রতিবিপ্লবীদের কারণেই দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড কর্মসূচী ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে পার্টিতে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য মাও সেতুং তার স্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘গ্যাং অব ফোর’-কে অনেকখানি ক্ষমতা ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন। সেই ‘গ্যাং অব ফোর’-এর ছত্রছায়ায় একদল দুর্নীতি পরায়ণ নেতা পার্টির ভিতর এমন এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছেন যে কোন অবস্থাতেই চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না, ধর্মের বিধানকে যেমন চ্যালেঞ্জ করা যায় না অনেকটা সেই রকম। চেয়ারম্যান মাও যেহেতু বলেছেন লুকিয়ে থাকা প্রতিবিপ্লবীদের সংখ্যা শতকরা দশ ভাগ – ফলে সেটাই বেদবাক্য। একেক ডিপার্টমেন্টের হেডকে দায়িত্ব দেয়া হলো যে তার অধীনে থাকা কর্মচারীদের ভেতর থেকে লুকিয়ে থাকা সেই শতকরা দশভাগ ‘প্রতিবিপ্লবী’-দের চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করতে। যদি সে তালিকা দিতে ব্যর্থ হয় তবে তাকেই প্রতিবিপ্লবী হিসেবে গণ্য করা হবে। ফলে শুরু হলো ‘উইচ হান্ট’ – দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই সব ‘প্রতিবিপ্লবী’-কে খুঁজে বের করার অভিযান। যেখানে সামান্যতম অসংগতি ধরা পড়লেই ‘প্রতিবিপ্লবী’-র তকমা গায়ে এঁটে যাচ্ছে, সেখানে খোদ মাও সেতুং-এর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে চিঠি। ফলে লেখিকার বাবার সেই চিঠিগুলোই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল, তিনি ‘গ্যাং অব ফোর’-এর মদদপুষ্ট পার্টির শীর্ষনেতাদের কোপানলে পড়লেন। এই সময় শুরু হয়ে গেল কালচারাল রেভ্যুলেশন।
কালচারাল রেভ্যুলেশনের প্রথম ভিজিবল ভিক্টিম ছিল মিডল স্কুল এবং হাই স্কুলের শিক্ষকেরা আর ইনভিজিবল ভিক্টম ছিল তাদের ছাত্রছাত্রীসহ গোটা চীন জাতি। এই সময় প্রচার করা হলো যে, শ্রেণীকক্ষে যে পাঠদান করা হয় তাতে সমাজে শুধু বুর্জোয়া শ্রেণীই তৈরি হয়। হাতেকলমে কিংবা ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমেই শুধু সমাজের শ্রেণীগত পার্থক্য ঘোচানো সম্ভব। আর সেই ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য যেতে হবে কৃষক এবং শ্রমিকদের কাছে। যেহেতু শিক্ষকেরা এতদিন ধরে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করে বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি করেছেন, এখন তাদেরকে আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে শুদ্ধ হতে হবে। এই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা কিশোর-কিশোরীদের দ্বারা গঠিত রেডগার্ডদের উস্কে দেয়। ফলে তারা প্রকাশ্যে তাদের নিজেদের শিক্ষকদেরকেই লাঞ্ছিত করা শুরু করে। পার্টির দ্বারা নির্ধারিত কিছু বই ছাড়া বাকী সমস্ত বইকে বুর্জোয়াদের বই হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রেডগার্ডেরা মহোৎসাহে সেই সব ‘বুর্জোয়া বই’ পোড়ানোর বহ্ন্যুৎসবে মেতে উঠে। সাধারণ জনগণ ‘বুর্জোয়া’ কিংবা শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত পাঠাগারের বইগুলি নিজেরাই পুড়িয়ে ফেলতে শুরু করে। কারণ রেডগার্ডদের বলা-কওয়া ছাড়াই যে কোন সময় যে কারোর বাড়ীতে হানা দেয়ার অধিকার ছিল এবং প্রতিদিন তারা কারো ন কারো বাড়ীতে রেইড দিয়ে এলাকায় ত্রাসের সঞ্চার করত। এহেন পরিস্থিতিতে লেখিকার বাবাও তার তিলেতিলে করে গড়া ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর দুষ্প্রাপ্য বইগুলিকে পুড়িয়ে দিতে বাধ্য হন। এই বইগুলি ছিল তার প্রাণের চাইতেও প্রিয়। বইগুলি হারিয়ে তিনি যেন তার অর্ধেক প্রাণশক্তিই হারিয়ে ফেললেন।
কালচারাল রেভ্যুলেশনের প্রাথমিক পর্যায়ে লেখিকার বাবাকে প্রথমে গৃহবন্দী এবং পরবর্তীতে অজ্ঞাতস্থানে বন্দী করে রাখা হয়। কারণ তিনি পার্টির হাই কমান্ডের সমালোচনা করে চিঠি দিয়েছিলেন। এই পর্যায়ে এসে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি প্রথম লেখিকার মোহ ভঙ্গ হওয়া শুরু করে। যদিও লেখিকা তখন রেডগার্ডে যোগ দেন কিন্তু তার বাবা মার গায়ে ‘প্রতিবিপ্লবী’-এর তকমা এঁটে থাকার কারণে তাকেও রেডগার্ডের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নাজেহাল হতে হয়। লেখিকার মা ছিলেন অসম্ভব সাহসী এবং প্রত্যুৎপন্নমতি একজন নারী। লেখিকার বাবাকে যখন অজ্ঞাতস্থানে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি পার্টির স্থানীয় নেতাদের চোখ এড়িয়ে ট্রেনে চেপে চলে যান বেইজিং-এ। বেইজিং রেল স্টেশনে তিনি দেখতে পান তার এলাকার রেডগার্ডের একটি দল অপেক্ষা করছে চেয়ারম্যান মাও-এর সাথে দেখা করার জন্য। তিনি কৌশলে তাদের সাথে মিশে গিয়ে প্রিমিয়ার ট্রো এনলাই-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কালচারাল রেভ্যুলেশনের চরম হট্টগোলের ভিতর তখন একজনকেই শুধু ধরা হত যিনি তার কমনসেন্স হারান নি, তিনি হচ্ছেন প্রিমিয়ার ট্রো এনলাই। লেখিকার মা প্রিমিয়ার ট্রো এনলাই-কে তার স্বামীর ঘটনা খুলে বলেন। ট্রো এনলাই তখন তাকে তার নিজ হাতে স্বাক্ষর এক চিঠি দেন যেখানে লেখিকার বাবাকে একজন সৎ এবং একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে সত্যায়িত করা হয়। এই চিঠিটি লেখিকার মা যজ্ঞের ধনের মতন লুকিয়ে রাখেন উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়। কালক্রমে এই চিঠিটিই একদিন তাদের পুরো পরিবারকে রক্ষা করে চিরতরে দাগী ‘প্রতিবিপ্লবী’ পরিবার হতে চিহ্নিত হতে। কোন পরিবারের উপর যদি সেই দাগ এসে পড়ে তবে সেই পরিবারের কেউই আর সরকারের ‘গুড বুক’-এ প্রবেশ করতে পারবে না। অর্থাৎ চীন হয়ে উঠবে তাদের জন্য একটি জীবন্ত নরক। কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় লেখিকার মাকেও কুয়ামিংটাং-এর গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ থাকার কারণে পার্টির ভিতর সমালোচিত হতে হয়। এমন কি পরিবার থেকে দূরে অনেকটা নির্বাসিত অবস্থায় বেশ অনেকদিন কাটাতে হয়। এই সময় কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা লেখিকার বাবা এবং মা উভয়কেই প্রতিবিপ্লবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় অথচ তারা দুজনেই সারা জীবন এই কম্যুনিস্ট পার্টির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। মাও-এর কৌশল ছিল চিহ্নিত প্রতিবিপ্লবীদেরকে জেলে বা নির্বাসনে না পাঠিয়ে সমাজের অন্য সবার সাথে সহাবস্থান করানো এবং তাদেরকে প্রতি পদে পদে নাজেহাল করার মাধ্যমে বিপ্লবকে উজ্জীবিত রাখা। এই পলিসির কারণে কম্যুনিস্ট পার্টির অনেক লয়াল সদস্যকেও অন্যায্যভাবে ‘প্রতিবিপ্লবী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেমন লেখিকার বাবা এবং মা।
কালচারাল রেভ্যুলেশনের এক পর্যায়ে চীনের সবাইকে গ্রামমুখী করা হয় কৃষক এবং শ্রমিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে এবং কলকারখানায় কাজ করার জন্য। বিভিন্ন কৃষি কমিউনের অধীনে গোটা চীনের অধিবাসীদেরকে আনার ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজ করতে গিয়ে বহু পরিবারের সদস্যরা হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন, ভেঙে যায় বহু পরিবারের বন্ধন। কিন্তু কম্যুনিস্ট সরকারের প্রোপাগান্ডার কারণে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে যে চেয়ারম্যান মাও শোষণ-বঞ্চনাহীন এবং শ্রেণীহীন এক আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো তৈরি করে চীনে গড়ে তুলেছেন এমন এক ভূস্বর্গ যার কথাই এতদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো প্রচার করে আসছিল। চীন সরকারের এই প্রোপাগান্ডাকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিলেন তদানীন্তন ডাকসাইটে বাম ঘরানার রাজনৈতিকবিদ কিংবা সমাজ সচেতন কর্মীগণ। ফলে মওলানা ভাসানী যখন চীন সরকারের বিশেষ মেহমান হয়ে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেরিয়েছেন তখন তিনি শুধু কম্যুনিস্ট সরকারের সাফল্যগাঁথাই দেখতে পেয়েছেন এবং পুরোপুরি বিশ্বাস করেছেন। সেটাই তিনি পরবর্তীতে ‘মাও সেতুঙ-এর দেশে’ নামক বইটিতে বিশদভাবে লিখেছেন। একইভাবে ওপার বাংলার মৈত্রয়ী দেবী তার ‘অচেনা চীন’ গ্রন্থে চীনা সরকারের পরিবেশিত কম্যুনিস্ট পার্টির সাফল্যের চিত্রটি বিশ্বাস করেছেন এবং সেটারই বর্ণনা দিয়েছেন অকপটে। চীনের প্রোপাগান্ডাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুদূর কানাডার মন্ট্রিয়াল শহর থেকে ১৯৭২ সালে পিকিং ইউনিভার্সিটিতে ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে পড়তে আসেন চাইনিজ বংশোদ্ভূত আঠারো বছরের তরুণী জেন ওং। তিনিই ছিলেন কম্যুনিস্ট চায়নার প্রথম ফরেন স্টুডেন্ট যাকে কিনা নেয়া হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। চীন সরকারের সেই পরীক্ষা হয়ত সফল হয়েছিল, কারণ তারই ধারাবাহিকতায় আমরা ১৯৮৭ সালে চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে সেখানে পড়তে যেতে পেরেছি। কিন্তু তরুণী জেন ওং-এর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। যে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে তিনি চীনে এসেছিলেন সেই সমাজকে তিনি খুঁজে পাননি চীনের কোথাও। যে মহান মাও সেতুং-এর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে তিনি চীনে এসেছিলেন, সেই মাও সেতুং-এর দেখা তিনি কোথাও পাননি। এক সময় তার মোহমুক্তি ঘটে এবং পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেটের বদলে তিনি যে সেখানকার সমস্ত কোর্স শেষ করেছেন সেই সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি চীন ত্যাগ করেন ১৯৮০ সালে।
কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় মাও সেতুং-এর একটি বাণী ছিল যে একমাত্র শারীরিক পরিশ্রমের দ্বারা একজন মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধি আনা সম্ভব। ফলে যাদের চিন্তা চেতনাতে প্রতিবিপ্লবীর বীজ লুকিয়ে আছে তাদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হতো লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত লেবার ক্যাম্পে। লেখিকার বাবাকেও এক সময় পাঠানো হয় দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত এক লেবার ক্যাম্পে যা কিনা চাইনিজ গুলাগ হিসেবে কুখ্যাত ছিল। লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন সেই ক্যাম্পে তাকে দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রম করতে হত। মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর যখন গ্যাং অব ফোরের পতন ঘটে, তখন সারা দেশে কালচারাল রেভ্যুলেশনেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে লেখিকার বাবা সেই কুখ্যাত লেবার ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে পরিবারের সাথে মিলিত হন। কিন্তু অমানুষিক সেই পরিবেশে দীর্ঘদিন থাকার কারণে এক সময় তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। শহরের পরিবেশের সাথে তিনি আর খাপ খাওয়াতে পারেননি। তার কথাবার্তাতে নানান ধরণের অসংলগ্নতা দেখা দিল। যেমন রাস্তা পার হওয়াকে তিনি নদী পার হওয়া বলতেন। সেই সময় তাকে নার্ভাস ব্রেকডাউনের হাত রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত মাত্রায় ট্রাংকুলাইজার ট্যাবলেট খেতে হত। অতিরিক্ত ঔষধ সেবনের কারণে এক সময় তার হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যু হয়। তবে লেখিকার মায়ের বক্তব্য অনুসারে চিকিৎসকের অবহেলাও তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। লেখিকার নানীও ইতিমধ্যে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করেছেন। কারণ লেখিকার বাবার গায়ে ‘প্রতিবিপ্লবী’র তকমা এঁটে যাওয়ায় তাদের পুরো পরিবারই কম্যুনিস্ট সরকারের কুনজরে ছিল। লেখিকার মা তার স্বামীর মৃত্যুর পর সচেষ্ট হন সেই কালো দাগ মুছে ফেলতে যাতে অন্তত তার কন্যার ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও কন্টকমুক্ত হয়। এই সময় দেং শিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে যারা কালচারাল রেভ্যুলেশনের কারণে অত্যাচারিত হয়েছিল তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়, ফলে লেখিকার বাবার অনেক পুরানো কলিগ আবার ক্ষমতা ফেরত পায়। তাদের সহযোগিতায় এবং প্রিমিয়ার ট্রো এনলাই-এর দেয়া সেই টেস্টিমোনিয়ালের কারণে লেখিকার বাবার নাম কালো তালিকা থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয় লেখিকার মা। তারই সুবাদে ১৯৭৮ সালে লেখিকা চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে পড়ার সুযোগ পান। সেখানে বসেই তিনি এই ‘ওয়াইল্ড সোয়ানস – থ্রি ডটারস অব চায়না’ লিখা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি তার মাকে দেখার জন্য চীনের সেই ছোট শহরে আসেন যেখানে তার মা একটি পুরানো অন্ধকার এ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। দেং শিয়াওপিং-এর ওপেন ডোর পলিসির কারণে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা ততদিনে বেশ ভালো। তার মায়ের অন্ধকার এ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকেই হয়েছে আলোকোজ্জ্বল বড় হোটেল যেখানে প্রতিদিনই বিদেশী ইনভেস্টরদের আনাগোনা। লেখিকার মা একদিন লক্ষ্য করলেন যে তাইওয়ান থেকে আগত এক প্রতাপশালী ইনভেস্টরকে ঘিরে সবাই ছবি তুলছে। একটু নজর করে দেখতেই তিনি চিনতে পারলেন তাকে। কুয়ামিংটাং-এর সদস্য এই লোকটার সাথে চল্লিশ বছর আগে তার যোগাযোগ ছিল জাপানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কাজ করার সময় যার রিপোর্ট কম্যুনিস্ট পার্টির কাছে ছিল। এই রিপোর্টের কারণে যে কম্যুনিস্ট পার্টি তাকে কখনই বিশ্বাস করতে পারেনি, অথচ সেই কম্যুনিস্ট পার্টিই এখন কুয়ামিংটাং-এর লোকটাকে ভিআইপি-এর মর্যাদা দিচ্ছে। গভীর হতাশায় লেখিকার মায়ের মনটা বিষিয়ে উঠে। এখানেই শেষ হয়েছে চীনের তিন জেনারেশনের তিন কন্যার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কাহিনী। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো