মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদ : প্রবাসে একজন সফল ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী মানুষের বিদায়

প্রবাসী কন্ঠ : টরন্টোতে বাঙ্গালীদের প্রাণকেন্দ্র ড্যানফোর্থে অবস্থিত প্রসিদ্ধ ‘মারহাবা সুপারমার্কেট’ এর স্বত্তাধিকারী সত্তরোর্ধ্ব মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদ আর নেই। দীর্ঘদিন অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে গত ৩ ডিসেম্বর টরন্টোর সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহে…রাজেউন)। তার মৃত্যুতে কমিউনিটিতে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া।

উল্লখ্য যে, কয়েক বছর আগে মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদের ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছিল। সম্প্রতি তিনি কিডনি রোগেও ভুগছিলেন। সপ্তাহে তিনদিন কিডনি ডায়ালিসিস এর জন্য তাকে হাপাতালে যেতে হচ্ছিল।

সিলেটের হবিগঞ্জ এর সন্তান মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদ কানাডায় আসেন ২০০০ সালে। তার আগে দীর্ঘদিন ছিলেন সৌদী আরবে। কানাডায় আসার পর ব্যবসা শুরু করেন ২০০২ সালে। শুরুতে তিনি ৩৫০ ডজ রোডে একটি গ্রোসারী স্টোর খুলেছিলেন মারহাবা নাম দিয়েই। কিছুদিন পর ড্যানফোর্থে আরো বড় পরিসরে নিয়ে আসেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি।

মারহাবা’র পাশাপাশি তিনি রেডরোজ নামে আরেকটি সুপারমার্কেট গড়ে তুলেছিলেন স্কারবরোতে।

মারহাবা ও রেডরোজ সুপারমার্কেট এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদ। ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

টরন্টোর বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থের প্রাণকেন্দ্রে বায়তুল আমান মসজিদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তিনি ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

২০১৩ সালে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘আমি কানাডা এসেছিলাম মার্কেটিং কনসালটেন্ট হিসাবে। কিন্তু চাকরী না পেয়ে তখন একটি বেগতিক অবস্থার মধ্যে পড়ে যাই। ঐ অবস্থায় কানাডায় টিকে থাকার জন্য ব্যবসা শুরু করি।’

পরবর্তীতে শুধু টিকে থাকা নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। কেমন চলছে আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি ভাল আছি।’

কানাডায় ইমিগ্রেন্ট হয়েও তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন প্রায় ডজন খানেক লোকের এম্প্লয়মেন্ট।

কানাডায় রাজনৈতিকভাবেও সচেতন ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনের সময় প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি এবারের জাতীয় নির্বাচনে লিবারেল পার্টি জয়ী হবে। আর জয়ী হলে সেটি হবে রিজনএবল।’

বাঙ্গালী অধ্যুষিত বিচেস ইস্ট ইয়র্ক ও স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট রাইডিং থেকে কনজারভেটিভ পার্টির সম্ভাবনা একেবারেই নেই বলেও

জানিয়েছিলেন তিনি। সেদিন উনার ভবিষ্যতবাণী সত্যি হয়েছিল। সে বছর জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে লিবারেল পার্টি জয়ী হয়। বিচেস ইস্ট ইয়র্ক ও স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট রাইডিং দুটিতেও লিবারেল পার্টি জয়ী হয়।

উল্লেখ্য যে, বর্তমান লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে কনজার্ভেটিভ পার্টি একটি আইন করেছিল যেখানে বলা হয়ছিল কানাডায় যে কোন দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল কারা যাবে যদি সে কানাডাসহ বিশ্বের যে কোন দেশে সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত ও কমপক্ষে পাঁচ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোন আদালতের প্রয়োজন হবে না। সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই আইনটি নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, কেউ সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত হলে কানাডার মাটিতে তার বিচার না করে কেন তার নাগরিকত্ব হরণ করা হবে? এ বিষয়ে মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদ এর প্রতিক্রিয়া কি তা জানতে চাইলে সেদিন তিনি প্রবাসী কণ্ঠকে বলেছিলেন, ‘তারা আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে ফেলেছে। এটা আমাদের উপর জুলুম এবং একই সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আমরাতো বৈধ পথেই এ দেশে এসেছি। ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করার পর তারা বলেছিল এ দেশে আমরা সব সুযোগসুবিধা অন্যান্য কানিডিয়ানদের মতো সমানভাবে পাবো। মর্যাদাও থাকবে সমান। এক বছর আগেও যারা কানাডায় এসেছেন ইমিগ্রেশন নিয়ে, তাদেরকেও বলা হয়নি যে তারা এ দেশে এসে দ্বিতীয় শ্রেণীর নগরিক হয়ে যাবে। এতদিন তো সবই ঠিকই ছিল। তা হলে এখন কেন হঠাৎ করে বিল সি-২৪ নামে এই নতুন আইন করা হলো? এই আইনের মাধ্যমে সরকার আমাদেরকে একেবারে চুড়মার করে দিয়েছে।’

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘কানাডার মাটিতে একটি দুটি বিচ্ছিন জঙ্গী ঘটনা নিয়ে এ জাতীয় আইন কারার কোন যৌক্তিকতা নেই। অপরাধীর অপরাধ বিচার করার জন্য এদেশে প্রয়োজনীয় আইন আগে থেকেই ছিল। নতুন করে  এমন আইনের কি প্রয়োজন যেই আইনে নাগরিকদেরকে বহিস্কার করা যাবে?’

উল্লেখ্য যে, পরবর্তীতে লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এসে সেই আইনে সংশোধন আনে। সংশোধিত আইনে বলা হয়, কেউ অপরাধী হলে কানাডার বিদ্যমান আইনেই তার বিচার করা  হবে। কিন্তু কারও নাগরিকত্ব হরণ করা যাবে না। মোহাম্মদ এ. ওয়াহেদ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তবে তার সৃষ্ট সুপারস্টোর দুটি রয়ে গেছে যা প্রবাসীদের সেবা দিয়ে যাবে। সেবার মনোভাব নিয়ে বাইতুল আমান মসজিদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও জড়িত হয়েছিলেন তিনি। তার অবদান প্রবাসীরা মনে রাখবেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।