প্রসঙ্গ পি কে হালদার : কানাডায় লুকিয়ে রাখা অর্থও দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক

অবশেষে দেশে এবং প্রবাসে আলোচিত মহা প্রতারক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার গ্রেপ্তার হলেন পশ্চিম বঙ্গের কোলকাতায়। গত ১৪ মে তাঁকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনেকদিন ধরেই অনুসন্ধান করে আসছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দেশ থেকে পালিয়ে আসার আগে পি কে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে যে, লোপাট করা অর্থর একটি বড় অংশ তিনি কানাডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর পাচার করেন।

টরন্টোর বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থে প্রবাসী বাংলাদেশীরা একাধিকবার ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে সমাবেশও করেছেন পি কে হালদারসহ অন্যান্য অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে।

এবার পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর বিপুল সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। এগুলোর মধ্যে আছে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল বাড়ি ও কয়েকশ বিঘা মূল্যবান সম্পত্তি। বিভিন্ন জেলায় বেআইনি আর্থিক লেনদেন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টেরও হদিস মিলেছে। ইডির দাবি, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকায় এসব সম্পদ গড়ে তুলেছেন পিকে হালদার।

বাংলাদেশ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কোলকাতায় বিনিয়োগ করতে গিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন নানারকম জালিয়াতিরও। ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করেছেন তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে। নিজের নামও বদল করেছেন আইনের চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তাঁর। বাংলার সেই প্রবাদ ‘চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন’ আবারও প্রমাণিত হলো তাঁর বেলায়।

গত ১৪ মে কোলকাতায় গ্রেফতার হন পি কে হালদার । ছবি : সংগৃহীত

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারে হার সাম্প্রতিক সময়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ বছরে বাংলাদেশের ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

অবশ্য জিএফআইয়ের তথ্য আস্থায় নিতে রাজি নন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থপাচারের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ।

বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন বলছে, প্রধানত ১০টি দেশ এই অর্থপাচারের বড় গন্তব্যস্থল। দেশগুলো হলো কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।

সন্দেহ নেই, পাচারকারীদের অন্যতম পছন্দের দেশ কানাডা। এই পাচারকারীদের কেউ কেউ দেশে বিপদে পড়লে কানাডায় এসে আশ্রয় নেন। সাম্প্রতিক সময়ে সর্বাধিক আলোচিত পি. কে. হালদারসহ আরো কয়েকজন কানাডায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন এমন তথ্য আগে শুনা গিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পি কে হালদার কোলকাতায়ও একটি গোপন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর অপকর্মের দোসরদের নিয়ে। 

অভিযোগ রয়েছে, টাকা পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার অবহিত থাকলেও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারণ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের অনেকেই এই অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি দেশের অনেক ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাই সরকারের প্রায় কোন উদ্যোগ, সাধারণ মানুষের কোন আন্দোলন এর কোনটাই কোন কাজে দিচ্ছে না। ফলে পাচারকারীদের প্রায় সবাই থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

আমরা মনে করি সরকারকে শক্ত হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরে সব সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নয়তো দুর্নীতির এই মহা উৎসব চলতেই থাকবে এবং জন্ম নিতে থাকবে আরো পি কে হালদার।