সমাজ পরিবর্তনে সচেতনতা

রোজানা নাসরীন

সমাজ মানুষেরাই বানায়  এবং  সেই  মানুষেরাই  সমাজকে পরিবর্তন করে। মানুষই দায়বদ্ধ সমাজকে নতুন করে গড়বার এবং মানুষই স্বপ্ন দেখে, কী করে সমাজের সব ব্যক্তিদের সুখী করা যায়। আর সেইমত সে চিন্তা করে। সমাজের সকল মানুষ অসম্ভব সুখী হবে এমন রাষ্ট্র যদিও এখনও তৈরি হয় নি, তাই বলে মানুষের চিন্তাশক্তি থেমে থাকছে না, সে সকল সমাধানের দিকে যেতে থাকে। এক এক সমাজ  অঞ্চল ভেদে এক এক রকম হয় কিন্তু মাইনাস-প্লাস মনুষ্যত্বের উপলব্ধি ও মূল্যবোধ একই থাকে। মানুষ মানেই সচেতন প্রাণী। এটা মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠার একটা লক্ষণ। বেঁচে থাকার জন্য এক এক সম্প্রদায় এক এক নিয়ম চালু করে এবং সেই নিয়মের ভিত্তিতে তারা আইন তৈরি করে। যা এক এক জাতির বৈশিষ্টের রূপায়ন মাত্র। কিন্তু সবার পরিনতি এক হয়, মানে একসময় সে মৃত্যু বরন করে। এটা মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে। কিন্তু মানুষ সমাজ পরিবর্তন করে নতুন করে বেঁচে থাকার লক্ষে। এতেই প্রমান হয় মানুষ দিন দিন সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়, সে কখনও পিছনের দিকে যায় না, যা মহাবিশ্বের নিয়ম। যে জাতি পেছনের দিকে যায় সে জাতি আধুনিকত্বের সাথে আর চলতে পারে না। তাইতো নতুন পদ্ধতিতে মানুষ বাঁচার জন্য কত কি নিয়ম বানায়, এর মধ্যে যা ভুল হয় তাকে সংশোধন করে নেয়। মানুষ যখন নতুন কিছু তৈরি করে তখন খুব কম লোকে তা মেনে নেয়, কারণ পুরাতন চর্চিত অভ্যাস সে ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে পারে না। কিন্তু  তবু তাই-ই সমাজে চালু হয়, তাইতো সমাজ শ্লথ গতিতে অগ্রসর হয় সামনের দিকে, কখনো পিছনের দিকে নয়। সে পুরাতন বেঁচে থাকার নিয়মকে নতুন সময়ের সাথে নতুন করে যদিও পেতে চায় তবু সেখানে থেকে যায় মানুষের ভালোলাগার বিষয়টি, যাকে অতিক্রম করে সে আসতে পারে না। তাই মানুষের এক জীবনে অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্তেও পরিবর্তন সহজ নয়।  আর তাই সমাজের এমন শ্লথ গতি। তবু সমাজ সামনের দিকেই যাচ্ছে। অতিক্রমণ মানুষের স্বভাব, কিন্তু সে যে পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছে অনেক সময় তা ভাবতে একটু সময় লাগে। এর সাথে অনেকের জীবনও শেষ হয়ে যায়। নতুন আসবেই তাকে কেউ কোনদিন থামাতে পারে না। ঠেকাবেই বা কেন? পুরাতনের নিয়মে যার জীবন বাঁধা সেই  দুর্গভাগ্যবান ব্যক্তি। যে নিয়মকে মানুষ ভাবে এতি পালন করলে সমাজে চলতে নতুন সমাজে চলতে তার তেমন কোন অসুবিধা হবে না যে ইচ্ছা হয় সে পালন করে, এভাবে নতুন নিয়ম প্রবর্তন হতে সময় লাগে। নতুনের আগমন সবসময় যুগ-কালের ভিত্তিতেই  আসে। যদি নতুন নিয়মে কোন ভুল হয়ে থাকে নতুনভাবে তা মানুষই শুধরে নেয় বিধায় পুরাতনকে মানুষের চর্চার কোন মুল্য থাকে না বা পুরানের দিকে তাকানো যায় না। নতুন সবসময় সময়ের সাথে চলা একটি নিয়ম, যাকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না। তাই সমাজ পরিবর্তনই নতুন প্রজন্মের নিকট একমাত্র কামনা হয়ে ওঠে। সে প্রাচীন যুগের নিয়মকে অতিক্রম করে শুধু মনুষ্যত্বের দাবি নিয়ে সামনের দিকে যাত্রা শুরু করে। পুরাতনকে ভেঙ্গেচুরে সে বের হয়ে আসে নতুনের বুকে। নতুন আছে বলেই পৃথিবীর রূপ এত মধুর হয়।

এক এক সমাজ এক একভাবে সমাজকে দেখে ও বোঝে, সব সমাজ আজো নতুনের প্রতি সমানভাবে আগ্রহী নয়। যে সমাজ বোঝে নতুন ছাড়া তার আর কোন গতি নেই,  সে সমাজ নতুন নিয়ম কানুনকে তাদের গবেষণা দ্বারা যে নিয়মটি মানুষের জন্য কল্যাণকর নয় তাকে পরিবর্তন করে নেয় বা বাদ দিয়ে চলে। আমরা সেই সমাজকে অনুকরণ করি। তাই পিছনে যাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। এক সম্প্রদায়ের নিয়ম অন্য সম্প্রদায় মেনে নিতে পারে না বলেই পৃথিবী ব্যাপী এত ঝামেলা হয়। তাই সমাজের দরকার পরিবর্তনের, সবাই পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চায় এবং সেই অধিকার নিয়ে জন্মায়। কেউ কারো আদর্শকে অনুভাব করতে পারে না বলে এত ঝামেলা বাড়ে। মানুষের আদর্শ তার অনুভবের বিষয়, কখনো তা জাহির করার বিষয় নয়। মানুষ যুক্তি দিয়ে বোঝে নিয়মগুলির আদ্যপান্ত। সে যুক্তির বাইরে কোনকিছু বোঝে না বুঝতে চায় না। এক সম্প্রদায়ের ভাবনার সাথে অন্য সম্প্রদায়ের ভাবনার মিল খুব একটা থাকে না বিধায় মানুষকে সকল সম্প্রদায়ের ভাবনাই মেনে নেওয়া শ্রেয়।  আজকে মনুষ্যত্বের দাবীতে মানুষের আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার লক্ষে কতগুলি নিয়ম তৈরি হয়েছে যা পূর্বে ছিল না। যেমন পৃথিবীকে আজ গ্লোবাল ভিলেজ মানুষ বলছে। এক দেশের আর্থিক উন্নতির জন্য আর একদেশ বানিজ্যিক সুযোগ নিচ্ছে। মানুষ মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ম চালু করে অর্থনীতিকে অনেক চাঙ্গা করে তুলছে। এসব মানুষেরই দান। এই প্রেক্ষিতে সব সমাজে কতগুলি সর্বজনগ্রাহ্য নিয়ম চালু আছে, যেমন মনুষ্যত্ব এবং যুক্তি। যার সাথে মানুষের অস্তিত্ব জড়িত। এবং এগুলিই সব সময় মানুষের অগ্রসরের পথযাত্রাকে গতি দিয়েছে।  কোন জাতি যদি এসবের বাইরে থেকে যায় তাহলে সে জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে সকলেই নিজ নিজ ভাষা এবং সংস্কৃতি দিকে ঝুকে পড়েছে। এটা পুরাতন নিয়ম থেকে বের হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। যদিও কোন কোন জাতি পুরাতনকে সাথে নিয়ে চলছে। কিছু নতুন নিয়মের উপরে মানুষ ভরসা করতে পারে না বলে সে পুরাতনের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে। নতুনকে সংশোধন করার যেখানে সুযোগ রয়েছে তাকে মানুষের গ্রহন করা উচিত বলে আমি মনে করি। সমাজ নতুন করে পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে, এটা অবশ্যই শুভ লক্ষণ। মানুষই স্বপ্ন দেখেছিল একদিন মনুষ্য সমাজে কোনো শ্রেনি থাকবে না। এটা সেই স্বপ্ন পূরণের একটি প্রক্রিয়া। সমজের সকল ইতিবাচক পরিবর্তনকে আগে মানুষ স্বপ্ন দেখে তারপর তা পূরণের পথে সে এগিয়ে যায়।  আমাদেরকে সেই পদ্ধতির সাথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। সমাজ যদি অবাধ গতিতে অগ্রসর হত তাহলে মানুষ কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ বিচার করতে অনেকেই পারত না। তাই সমাজ অগ্রসরে অনেক বাঁধা বিপত্তি থাকে, সেগুলি মেনে নিয়েই মানুষকে অগ্রসর হতে হয় সামনের দিকে। এই বাঁধাকে সাহসের সঙ্গে যে অনেক শক্তি নিয়ে যে মোকাবেলা করে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তার নাম ধ্বনিত চিরদিন হতে থাকে। এবং সে ব্যক্তিই সমাজের অন্যায় নিয়ম থেকে বের হয়ে নতুন নিয়ম চালু করে।

আমাদের পাঠ্য পুস্তকে ইতিহাস অর্থ কে কোন দেশ জয় করেছে তাদের বীরত্বের কথা, তার পাশাপাশি কে সমাজ পরিবর্তনে কতটা ভূমিকা রেখেছে তা যতটা লেখা থাকে তা পড়ে আমাদের তেমন কোন উপকার হয় না। সমাজ পরিবর্তনের কথা সকলে ছোট থেকে জানলে কেউ কেউ এ পরিবর্তনে অধিক সবাক হয়ে উঠবে। তাই শুধু বড় ক্লাসের সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে স্কুলের ইতিহাস বইয়ের মধ্যে যুক্ত করা উচিত।  ইতিহাস পড়ে যেটুকু আমাদের লাভ হয় তার চেয়ে বেশি সমাজ লাভবান হবে যদি সমাজ পরিবর্তনের কথাগুলো সবাই জানে তাহলে। বাধ্যতামূলকভাবে পড়লে স্কুলে বিষয়টা সম্পর্কে ছোট বেলা থেকে সবাই জানে।  সমাজ পরিবর্তনের জন্য কে কীভাবে সমাজকে পরিবর্তন করেছে সেইসব মানুষের কথা লেখা থাকবে। আমরা এ বিষয়ে ইতিহাস পড়ে তা জানব। এবং মানুষ অনেক উৎসাহ পাবে। কে কীভাবে মানুষ মেরেছে মানে মারামারি খুনাখুনি করেছে তার ইতিহাস আমরা ভক্তি সহকারে পড়ছি কিন্তু সমাজ পরিবর্তনে যারা এগিয়ে এসেছে তাদের কথা এত বিস্তারিতভাবে পড়ছি না, তাই তাদের কথা খুব কমসংখ্যক মানুষই জানতে পারছে। মানুষের জানার আগ্রহ প্রবল থাকলেও সমাজের বাস্তবতার কারণে সে জানতে পারছে না। সমাজে এতদিন যাকে ছোট করে দেখা হত তাকে গুরুত্ব বুঝে মানুষের সামনে নিয়ে আসতে হবে। সব ছোট কিন্তু ছোট নয় এ বিষয় মানুষকেই বুঝে নিতে হবে।

যদি সকলের সুখ নিশ্চিত করতে পারে তাকে আমরা বলি সফল রাষ্ট্র। আর যে রাষ্ট্র সমাজের সুখ নিশ্চিত করতে যদি কোন ভাবে ব্যর্থ হয়, তাকে বলি আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র। তাহলে রাষ্ট্রের সকল বিষয়েই দৃষ্টি দেওয়াই সমীচীন। কোথায় সমস্যা রয়েছে কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে এটা রাষ্ট্রকেই বুঝতে হবে, নাহলে রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কোন ধর্মের জন্য রাষ্ট্র হয় না, রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম থাকতে পারে না, ধর্ম হয় মানুষের। কোন রাষ্ট্র যদি কোন ধর্মের ভিত্তিতে অসংখ্য সংখ্যাগুরু মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যদি সংখ্যালঘু মানুষের ক্ষতি মেনে নেয়, সে হবে ব্যর্থ রাষ্ট্র। কোন মানুষ কীভাবে হাজার বছর আগে তার নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে যে ধর্ম প্রচলন করেছিল, তার অনুসারী যদি অনেক লোকও থাকে তা কখনই রাষ্ট্রের দায় নয় সবকিছু মানুষের দায়। তবু রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। এভাবে সমাজের পরিবর্তন হবে। আমরা সমাজের পরিবর্তনগুলি সর্বদা ইতিবাচক হোক সেই আশা করি। সমজের পরিবর্তনগুলি যদিও প্রথমে অনেক মানুষ মেনে নিতে পারে না পুরান অভ্যাসের কারণে, কিন্তু পরিবর্তনগুলি একসময় তাদের মানতেই হয়। আর যারা মানতে পারেনা তাদের দুর্গতির কোন সীমা থাকে না। তাই সমাজ পরিবর্তন সব সময় নৈতিক মানদণ্ডে করতে হয়। 

রোজানা নাসরীন

টরন্টো