কানাডায় দক্ষিণ এশীয় বিভিন্ন কমিউনিটিতে মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যু যেভাবে ছড়িয়ে গেলো

নাওয়াল মোস্তফা

দক্ষিণ এশীয়দের বিভিন্ন কমিউনিটিতে নীরব মানসিক স্বাস্থ্য সঙ্কট বিদ্যমান। অনেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যে উচ্চহারে মানসিক রোগ রয়েছে, যা অনেক সময় অন্য অভিবাসীদের চেয়েও বেশি। এর কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে আন্তঃপ্রজন্মের দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমা সমাজে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চাপ।

কিন্তু অনেক দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটিতেই মানসিক স্বাস্থ্য গভীরভাবে প্রবল রূপ পেয়েছে এবং এর উপসর্গগুলিকে প্রায়শ গুরুত্বহীন মনে করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দক্ষিণ এশীয় পরিবারগুলোকে মানসিক স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টির বিভিন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে হবে। এই জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ চিহ্নিত করতে পারবেন।

উইন্ডসর ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল নিউরোসাইকোলজি বিষয়ে পিএইচডি গবেষক হিসাবে আমার এই সময়ের কিছু গবেষণা উর্দু ও হিন্দিভাষী লোকেদের ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমি বিজ্ঞান-ভিত্তিক জ্ঞান সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে @ব্রেইনকোচ (@Braincoach) নামে ইন্সটাগ্রামে স্ট্রিমিংও শুরু করেছি।

আলাদা আলাদা বিশ্বে অবস্থান

দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের সন্তানেরা একইসঙ্গে দুটি আলাদা বিশ্বে বিচরণের চাপজনিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। তারা যখন একটি পাশ্চাত্য সমাজে নিজেকে স্থাপনের চেষ্টা করছে যা ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথাবার্তায় গর্বের বিষয় হিসাবে প্রতিভাত, তখন একইসঙ্গে তারা হয়তো ঘরে এমন একটি সংস্কৃতি লালন করে, যেখানে তার ব্যক্তিগত সীমানা ঝাপসা এবং তার স্বকীয় পরিচিতি নির্ধারিত হয় তার পরিবার ও সমাজের বৈধতার ভিত্তিতে।   

ভ্যাঙ্কুভারে সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ মেন্টাল হেলথ এ্যাম্বাসেডর প্রোগ্রামে অংগ্রহণকারী কয়েকজন তরুণ। ছবি : ডেইলিহাইভ.কম

দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির সমষ্টিবাদী বৈশিষ্ট্য পরিতুষ্ট ও সমর্থিত হয় ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধন এবং নিজের চেয়ে বৃহত্তর কোনও কিছুর সঙ্গে একাত্ম হবার উপলব্ধি থেকে। তারপরও দক্ষিণ এশীয় পরিবারের ব্যক্তিবিশেষ তার পরিবারের প্রত্যাশার কাছে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোরবানি দেওয়ার ঘটনায় চাপের মধ্যে থাকতেও পারে।

তাদের পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার বিপরীত কোনও লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা স্বার্থপরতা হিসাবে দেখা হয়। এটি আত্মপরিচয় গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে যখন তারা প্রভাবশালী পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে অপেক্ষাকৃত জোরালো সংশ্লিষ্টতা অনুভব করে, তাদের ওপর বড় ধরণের মানসিক চাপ ও হস্তক্ষেপ হিসাবে দেখা দেয়।

ক্যারিয়ার অথবা ডেটিং নিয়ে লড়াই

দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্বের দুটি প্রধান কারণ ঘটে তখনই যখন তাদের বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছা বা তরুণ বয়সের কেউ বন্ধুর সঙ্গে ডেটিং শুরু করতে চায় অথবা ক্যারিয়ার হিসাবে এমন কোনও বিষয় বেছে নেয় যা তার বাবা-মার কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। এটা দক্ষিণ এশীয় পরিবারে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সূচনা করে কারণ তারা সমাজের সঙ্গে এমনভাবে বেড়ে ওঠে যেখানে পরিবারের প্রতি আনুগত্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

এরপরও কেউ কেউ গোপনে নিজের আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যায় আর কখন ধরা পড়ে যাবে সারাক্ষণ সেই ভয়ে তটস্থ থাকে। অন্যরা তাদের কাছে যে প্রত্যাশা করা হয় সেটাই মেনে নেয়, কিন্তু সেটি ঘটে তার আত্মবোধ ও নিজস্ব ধ্যানধারণা হারানোর মূল্যে। উভয় পরিস্থিতিতেই দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্য ও স্থিতির বিষয়ে তাদেরকে আপোষ করতে হয়।

দক্ষিণ এশীয় তরুণরা যখন নিজের পছন্দের পরিবর্তে পরিবারের অনুমোদিত কোন ক্যারিয়ার বেছে নেয় তখন তারা পরিবারের আশাবাদ রক্ষা করতে পেরে গর্বিত বোধ করতে পারে। কিন্তু এই গর্ব কতদিন টিকে থাকে?

গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে যে, পছন্দের ক্যারিয়ার একটি চমৎকার সন্তুষ্ট জীবনের দিকে নিয়ে যায় যার ফলে মনস্তÍাত্ত্বিক সমস্যা হ্রাস পায়। দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের অনেক সন্তানের জীবন থেকে তার নিজের পছন্দটা কেড়ে নেয়া হয়। শেষপর্যন্ত সে এমন কোনও ক্যারিয়ারে বন্দি হয়ে পড়েছে বলে অনুভব করে যেটি তার কাছে অর্থবহ মনে হয় না, ফলে কার্যত তার সার্বিক মানসিক সুস্থতা ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

ডেটিং প্রসঙ্গে বলা যায়, দক্ষিণ এশীয় পরিবারের সাংস্কৃতিক আশা-আকাক্সক্ষা পাশ্চাত্যের প্রচলিত রীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। অনেক তরুণের ক্ষেত্রেই বিয়ের আগে কোনও সম্পর্কে জড়ানোর বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা হয়। সেজন্যে অনেক দক্ষিণ এশীয় তরুণ-তরুণী পারিবারিকভাবে লজ্জায় পড়া বা প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়ে নিজের সম্পর্কের কথা গোপন রাখে। এটি হলো বিষন্নতা ও উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার আরেকটি কারণ। এটি বিশেষভাবে সত্যি মেয়েদের ক্ষেত্রে যারা মনে করতে

থাকে যে, ডেটিংয়ের মধ্য দিয়ে তারা হয়তো নিজ পরিবারের সম্মান হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক থেরাপি দরকার

মনস্তাত্ত্বিক পরিষেবা নিতে আসা দক্ষিণ এশীয়রা অনেক সময় এমন অনুভব করে যে, স্বাস্থ্যসেবা দানকারীরা তাদের ভুল বুঝছে। ফলে তারা সেবা নেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। প্রচলিত সাইকোথেরাপির ভিত্তি হলো পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাভাবিক সংস্করণ। থেরাপির  এই পদ্ধতির যথাযথ সংস্কার না করা পর্যন্ত তা বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে তরজমা করা কঠিন।

এর অর্থ হলো, পাশ্চাত্যে প্রশিক্ষণ নেয়া অনেক থেরাপিস্টের পক্ষে দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা বুঝে ওঠা কঠিন হয়। এজন্যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে যথাযথ থেরাপির একটি পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরী।

সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল থেরাপির প্রবর্তনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা পেশাজীবীদেরকে তাদের রোগীদের সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপট ও ধ্যান-ধারণার রকম বোঝার জন্য অবশ্যই সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। আর সেটা করতে হবে একইরকম সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপট রয়েছে এমন সহকর্মীদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে আলোচনা ও পড়াশোনার মাধ্যমে।

দক্ষিণ এশীয় তরুণ সমাজ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জটিলতা ও এর নিরাময়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি উপায় হতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরকে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটিতে এ বিষয়ে সামাজিক কর্মশালার আয়োজন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো। এর ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও বেশি সচেতনতা সৃষ্টি হবে এবং নিজেদের কমিউনিটিতেই এ বিষয়ে কোথায় কীভাবে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে জানাশোনা বাড়তে পারে।   -সৈজন্যে : কানাডাইমিগ্রান্ট.সিএ