কানাডায় বৈষম্যমূলক শ্রম নীতি ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, সেই সাথে মৃত্যুও


খুরশিদ আলম

কানাডার শ্রমবাজারে নতুন ইমিগ্রেন্টদের প্রতি বৈষম্য যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এখানকার শ্রম নীতি মোটেও ইমিগ্রেন্টবান্ধব নয়। ফলে দারিদ্রতা ছায়ার মত ইমিগ্রেন্টদের পিছনে লেগেই থাকে। আর দারিদ্রতার অবসম্ভাবী পরিণতি হলো নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক ও মানসিক রোগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো অপুষ্টি, হৃদরোগ, নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি। এই রোগগুলো মানুষের শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। মানসিক রোগও শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। আর করোনায় খুব সহজেই আক্রান্ত হওয়ার জন্য এর যে কোন একটিই যথেষ্ট।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার নতুন এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনার প্রথম ধাক্কায় প্রধানত অশ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত কমিউনিটিগুলিতে মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। রিপোর্ট প্রণেতারা বলেছেন, এই মহামারী দৃশ্যমান সংখ্যালঘু তথা ইমিগ্রেন্টদেরকে অসমানুপাতিক হারে আক্রমণ করেছে। অশ্বেতাঙ্গদের অতিরিক্ত জনবহুল আবাসনে বসবাসের সম্ভাবনা যেমন বেশি তেমনই তাঁরা এমন সব কাজের সঙ্গে জড়িত যা তাঁদেরকে কোভিড-১৯ এর অধিকতর সংস্পর্শে আসার আশঙ্কার মধ্যে ঠেলে দেয়।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার গবেষণায় দেখা গেছে কভিড-১৯ এর প্রদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর দেশটিতে বয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে মৃত্যুর হারও ছিল বেশী। অর্থাৎ শে^তাঙ্গ কানাডিয়ানদের তুলনা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বা ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশী লক্ষ্য করা গেছে। গত বছর করোনার প্রাদুর্ভব দেখা দেয়ার পর কানাডায় যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন (মার্চ ২০২০ থেকে শুরু করে জুলাই ৪, ২০২০ সময়ের মধ্যে) তাঁদের মধ্যে ২৫% ছিলেন ইমিগ্রেন্ট। কিন্তু কানাডার মোট জনসংখ্যার মধ্যে তাঁদের হার হলো ২২%। আর কানাডায় যাঁদের বয়স ৬৫ এর নিচে তাঁদের মধ্যে ২০% হলো ইমিগ্রেন্ট। কিন্তু কভিড-১৯ এর কারণে এই বয়স গ্রুপের মধ্য যাঁরা মৃত্যু বরণ করেছন তাঁদের মধ্যে ৩০% হলো ইমিগ্রেন্ট।
আবার এটিও দেখা গেছে যে, কভিড-১৯ এর কারণে ইমিগ্রেন্ট পুরুষদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশী। অন্টারিও, কুইবেক এবং বিশেষ করে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় মোট জনসংখ্যার ২৮% ইমিগ্রেন্ট, কিন্তু কভিড-১৯ এর কারণে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৪১% ইমিগ্রেন্ট।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার গবেষণায় আরো দেখা গেছে কভিড-১৯ এর কারণে যে সকল ইমিগ্রেন্ট মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের বেশীর ভাগই ছিলেন বয়স্ক এবং এরা কানাডায় এসেছিলেন ১৯৮০ সালের আগে। আর ৯% কানাডায় এসেছিলেন ২০০০ – ২০১৮ সালের মধ্যে।

টরন্টোতে করোনার হটস্পট এলাকায় ভ্যাকসিনের লাইন। ছবি : কানাডিয়ান প্রেস


ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে করোনার বিস্তার বেশী হওয়ার পিছনে আরো কিছু কারণ বিদ্যমান যেগুলো দারিদ্রতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম হলো গাদাগাদি করে এক বাড়িতে অনেক লোকের বসবাস। সেটা হতে পারে শেয়ার লিভিং অথবা দুই বা তিন প্রজন্ম মিলে এক বাড়িতে বাস করা। স্বল্প আয়ের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠি বাধ্য হয় এরকম পরিস্থিতিতে বাস করার জন্য। আর অধিকাংশ ইমিগ্রেন্টই এই স্বল্প আয়ের লোকদের কাতারে। করোনা যেহেতু অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে এবং বাতাসে এর জীবানু উড়ে বেড়ায় তাই একসাথে গাদাগাদি করে এক বাড়িতে থাকাটা সংক্রমণের ঝুঁকিকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
অন্যান্য সমীক্ষায় দেখা গেছে, অশ্বেতাঙ্গদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মত সমস্যা থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর এগুলো একজন ব্যক্তিকে গুরুতর অসুস্থতা এবং কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর উচ্চতর ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয় বলে ধারণা করা হয়।
এদিকে সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, টরন্টোতে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ৮৩% হলো কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর লোকজন। অথচ নগরীর মোট জনসংখ্যার মধ্যে তাঁদের সংখ্যা মাত্র অর্ধেক। টরন্টোর প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: এইলিন ডি ভিলা সম্প্রতি এ তথ্য তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন, নগরীর বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর এবং স্বল্পআয়ের মানুষেরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন অসমানুপাতিক হারে। ডি ভিলা আরো বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে টরন্টোতে যাঁরা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বৃহত্তর অসাম্যের শিকার তাঁদের ওপরেই কোভিড-১৯-এর বড় ধরণের প্রভাব পড়েছে। একইভাবে, নগরীতে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশীয় জনগোষ্ঠীর ১১% মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ এদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪%। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে এমন অশ্বেতাঙ্গ মানুষের সংখ্যা ৭১%।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা গেছে, টরন্টোতে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ৫১% স্বল্প আয়ের পরিবারের। যদিও নগরীর মাত্র ৩০% মানুষকে স্বল্প আয়ের বলে মনে করা হয়। পাঁচজন বা তারও বেশি সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের যেসব লোক আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের সংখ্যা মোট আক্রান্তের ২৭ শতাংশ। যদিও মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০% ওই ধরণের বড় পরিবারের সদস্য।
ওয়েলেসলি ইন্সটিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্বের অধ্যাপক কেওয়ামে ম্যাকেঞ্জি সিবিসি নিউজকে বলেন, মহামারী প্রান্তিক মানুষের বিদ্যমান সঙ্কট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তিনি বলেন, টরন্টোতে অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসের, মানসম্মত নয় এমন আবাসনে বসবাসের সম্ভাবনা বেশি। তাঁদের অপরাধ ও বৈষম্যের শিকার হবার এবং অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যথেষ্ট পুষ্টিসম্পন্ন খাবার পেতেও তাঁদেরই বেশি সমস্যা হয়।
মন্ট্রিয়লেও প্রায় একই অবস্থা। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কভিড-১৯ এ সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়েছেন মন্ট্রিয়লের দরিদ্র এলাকাগুলোর অধিবাসীরা। এর মধ্যে আছে Montréal-Nord, Mercier–Hochelaga-Maisonneuve and Ahuntsic-Cartierville. আর এই দরিদ্র এলাকাগুলোতে বেশীরভাগ অধিবাসীই ইমিগ্রেন্ট সম্প্রদায়ের যাঁরা এসেছেন এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। তাঁরা প্রধানত কাজ করেন ফ্রন্টলাইনে এবং কম বেতনে। এই ফ্রন্টলাইনের কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মী যাঁরা কাজ করেন সাধারণত ক্লিনার হিসাবে। হাসপাতালের অন্যন্য সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যেও এই এথনিক সম্প্রদায়ের সদস্যই বেশী। আর দেখা গেছে মন্ট্রিলে যাঁরা কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ১৯%ই স্বাস্থ্যকর্মী। এই স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই থাকেন ঐ দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে।
আর স্বল্প আয়ের মানুষেরা শুধু যে করোনায় বেশী মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করছেন তা নয়। অন্যান্য রোগেও তাঁদের মধ্যে দেখা যায় যা অনেক সময় প্রাণঘাতি হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এই রোগগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। সম্প্রতি নতুন এক বিশ্লেষণে এমন এক তথ্য উঠে এসেছে। কানাডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গরীব কানাডীয়দের অকাল মৃত্যুর আশঙ্কা ধনীদের চেয়ে অনেক বেশি এবং গত কয়েক দশক ধরেই তা বেড়ে চলেছে। ঐ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫ বছর বয়স হবার আগেই মারা যাওয়ার যেসব কারণ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব সেগুলো প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই কমে আসছে। তবে এই হ্রাসের গতি গরীবদের চেয়ে ধনীদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দ্রুততর এবং একটি প্রজন্মের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডালা লানা জনস্বাস্থ্য স্কুল’ এর ফারাজ শাহিদী দি কানাডিয়ান প্রেসকে বলেন, ‘জণগণের মধ্যে স্বাস্থ্যগত যে সার্বিক বৈষম্য বিদ্যমান তা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমরা কোনও অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। মৃত্যুর হারের দিক থেকে এই বৈষম্য আমরা আগে যতটা ভাবতাম এখন তার চেয়েও বড়।’
সমীক্ষায় দেখা যায়, আয়ভিত্তিক গ্রুপের শীর্ষে অবস্থানকারী উচ্চ আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে ৭৫ বছরের আগে মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৯৯১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। আর সবচেয়ে নিচে অবস্থানকারী গ্রুপের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা কমেছে ৩৪ শতাংশ।
শাহিদী বলেন, আয় ও শিক্ষাগত বৈষম্য কমাতে না পারলে অকাল মৃত্যুর ক্ষেত্রে যে ব্যবধান তা নির্মূল করা ‘কার্যত অসম্ভব’। কারণ আয় ও শিক্ষার বৈষম্যই অকাল মৃত্যুর হারের পার্থক্য তৈরি করে।
এবারের মহামারীও সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। প্রফেশনাল বা স্কিল্ড ক্যাটাগরীতে কানাডায় আসা ইমিগ্রেন্টরা উচ্চ শিক্ষিত, কিন্তু অধিকাংশই স্বল্প আয়ের মানুষ। স্বল্প আয়ের কারণে তাঁদেরকে অনেক কিছুর সাথেই আপোষ করে চলতে হয়। এর মধ্যে আছে বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা, চাকরী, বিনোদনসহ আরো কিছু বিষয়।
অর্থাভাবে স্বল্প আয়ের মানুষদেরকে গাদাগাদি করে থাকতে হয় অল্পপরিসরের বাসস্থানে। পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয়ে চলে রেশনিং।
কানাডায় ডাক্তার ফ্রি হলেও ওষুধ ফ্রি নয় যদি কর্মক্ষেত্রে ড্রাগ-ইন্সুরেন্স এর ব্যবস্থা না থাকে। আর সাধারণত স্বল্প আয়ের চাকরীতে ড্রাগ-ইন্সুরেন্স এর ব্যবস্থা থাকে না। অন্টারিওতে অবশ্য ট্রিলিয়াম ড্রাগ প্লান (সরকারী) বলে একটি বিষয় চালু আছে স্বল্প আয়ের লোকদের জন্য। তবে সেটিও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নয়। ক্রয়কৃত ওষুধের কিছুটা ব্যয়ভার নিজেকে বহন করতে হয়। টানাটানির সংসারে সেটিও একটি উদ্বেগের বিষয়। তাছাড়া দাতের বা চোখের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেকে বহন করতে হয় ইন্সুরেন্স না থাকলে।
অন্যদিকে স্বল্প আয়ের চাকরী গুলো থাকে খুবই নড়বড়ে। সকালে চাকরী থাকলেও বিকেলে থাকবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। অসুস্থ হলে ছুটি নেয়া যায় না সহজে। আর কোনক্রমে ছুটি পেলেও সেটি হয় বিনা বেতনে ছুটি। ফলে অনেক সময় গুরুতর অসুস্থতা নিয়েও অনেককে কর্মক্ষেত্রে আসতে হয়। নয়তো সঠিক সময় বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, ক্রেডিড কার্ডের পেমেন্ট ইত্যাদি দেওয়া সম্ভব হয় না। কখনো কখনো আরো বেশী ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। যেমন এবার মহামারী শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে কয়েক মাস স্বল্প আয়ের অনেক ফ্রণ্টলাইন কর্মজীবীকে পার্সনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট ছাড়া কর্মক্ষেত্রে আসতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সে কারণে অনেকেই তখন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
মূলত: কানাডায় নতুন বা প্রথম প্রজন্মের সিংহভাগ ইমিগ্রেন্টদের স্বল্প আয়ের পিছনে এখানকার শ্রম নীতি অন্যতম এক কারণ। এই শ্রম নীতি বিদেশ থেকে ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসা দক্ষ শ্রমিকদেরকে তাঁদের নিজ নিজ পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রে মোটেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে বাধ্য হয়েই এই ইমিগ্রেন্টরা এমন সব স্বল্প বেতনের চাকরীতে প্রবেশ করতে বাধ্য হন যার জন্য কোন ডিগ্রির প্রয়োজন পড়ে না। পিজ্জা ডেলিভারী ম্যান, সিকিউরিটি গার্ড, টেক্সি ড্রাইভার, ক্লিনার, ফ্যাক্টরী ওয়ার্কার, দোকানের সেলস পার্সন এ সব চাকরীতে হাই স্কুল পাশের সার্টিফিকেটেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কনোরকমে প্রাইমারী স্কুল পাশ করে লিখতে ও পড়তে পারলেই যথেষ্ট হওয়ার কথা। অথচ এই কাজগুলোই করতে বাধ্য হচ্ছেন সিংহভাগ নতুন বা প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরা যাঁরা উচ্চ শিক্ষিত এবং যাঁদের রয়েছে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের দীর্ঘদিনের কর্ম অভিজ্ঞতা। আর এই কাজ করে যে বেতন পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়। এমন কি স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে চাকরী করলেও দারিদ্রতার সীমা অতিক্রম করা সম্ভব হয় না এদের অধিকাংশের পক্ষে। ফলে যে কোন সংকট মুহুর্তে তাঁরা থাকেন উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে। আর সেটি নতুন করে প্রমাণিত হয়ে গেল এবারের করোনা মহামারী কালে।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার নতুন এক সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর আগে ইমিগ্রেন্ট তথা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বা অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোকের মধ্যে বেশ উঁচু হারে দারিদ্র্যতা বিদ্যমান ছিলো এবং মহামারীর কারণে তাঁদের অনেকেরই চাকরি চলে যায় বা কর্ম ঘন্টা কমে যায়। এই অর্থনৈতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা আরও বেশি নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। সিটিভি নিউজের এক খবরে এ কথা বলা হয়।
কানাডা একটি ইমিগ্রেন্ট নির্ভর দেশ। এর অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হলে দক্ষ ইমিগ্রেন্ট ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। আজ যদি কোন কারণে সব ইমিগ্রেন্ট নিজ নিজ মাতৃভূমিতে চলে যান তবে কানাডা রাতারাতি কানা হয়ে যাবে। ভেঙ্গে পড়বে অর্থনীতি, দেউলিয়া হয়ে পড়বে সব বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ভেঙ্গে পড়বে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি। চারিদিকে দেখা দিবে চরম বিশৃংখলা।
অথচ ইমিগ্রেন্টদের ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তাঁরাই দেশটিতে বেশী বৈষম্যের শিকার। বৈষম্যমূলক শ্রম নীতির কারণে তাঁদের সিংহভাগই থেকে যান দরিদ্র জনগোষ্ঠির কাতারে। বর্ণ বৈষম্যেরও শিকার হন তাঁরা বেশী।
আর এই সকল কারণে করোনা মহামারীতে তাঁরাই বেশী মাত্রায় আক্রান্ত হয়েছেন। মহামারীতে মৃত্যুর হারও তাঁদের মধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে বেশী। এ অবস্থার পরিবর্তন কে ঘটাবে?
অন্টারিওতে বিগত লিবারেল সরকার আইন করে গিয়েছিল শ্রমজীবী মানুষের জন্য নূন্যতম মজুরী ১৫ ডলার হবে। কিন্তু বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় এসে সেই আইন বাতিল করে দেয়। বিগত সরকার অন্টারিওতে ‘বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি’ নামে পরীক্ষামূলক একটি পাইলট প্রজেক্ট চালু করে গিয়েছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠির আয় বৃদ্ধি করার জন্য। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সেটি বন্ধ করে দেয় এর ফলাফল কি দাঁড়ায় তা পর্যবেক্ষণ না করেই।
ইমিগ্রেন্টরা কানাডার অর্থনীতি সচল রাখার জন্য এক অপরিহার্য অংশ এ কথা আজ সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই অপরিহার্য অংশকে দরিদ্র রাখলেও দেশ এগুবে এরকম চিন্তা করা অদূরদর্শিতারই নামান্তর। যাঁরা দেশটির নীতিনির্ধারক, যাঁরা দেশের শ্রম নীতি নির্ধারণ করেন তাঁদের উচিৎ হবে ইমিগ্রেন্টদের দারিদ্রতা দূর করার বিষয়ে অধিকতর বাস্তবমূখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সেটি দেশের সার্বিক স্বার্থেই করা উচিৎ। আগামী মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হওয়া উচিৎ।

খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ