প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮২

ইউরোপের পথে পথে


রীনা গুলশান


(পূর্ব প্রকাশের পর)
বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে যেন ‘ইউরো স্টার’ ট্রেনটি ঝড়ের গতিতে চলেছে। অত ভোরে কিছু খাওয়া যায় না। তাই ভোরে মাজেদা আপা প্রচুর নাস্তা দিলেও আমি শুধু চা আর ১টি বিস্কিট খেয়েছিলাম। এখন হঠাৎ পেটের ভিতরে ক্ষুধাগুলো কথা বলে উঠলো। মাজেদা আপার খাবারের প্যাকেট এবারে খুললাম। ফল, স্যান্ডউইচগুলো বের করে খেলাম। আপা কুলিপিঠা দিয়েছিল। এগুলো একটুও টাচ করলাম না। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, এগুলো মিঠুকে দিব। বেচারা কতদিন দেশী খাবার খায় না। তাছাড়া সে একজন বিখ্যাত সেফ কিন্তু বিদেশী খাবারের। দেশী খাবারের নয়। আমি কানাডা থেকে যাবার আগেই ওকে বেশ কিছু গ্রোসারীর অর্ডার করেছিলাম যেন কিনে রাখে। আমি একটি দিন কোথাও যাবো না। ওর জন্য রান্না করবো। ওকে পাশে বসিয়ে খাওয়াবো। ওর তৃপ্ত আদল অবলোকন করবো।
লন্ডন থেকে ব্রাসেলস যেতে লাগবে ১ ঘন্টা ৪৮ মিনিট। যদিও ট্রেনটি ব্রাসেলস এর আগের স্টপেজে একটু থামলো। এবং ট্রেনের চালক আবার ফ্রেন্স এবং ইংরেজীতে একটানা এ্যানাউন্স করলো। সে যেটা বললো তার সারমর্ম হলো, “ব্রাসেলস এর স্টেশনের এখানে একটু ঝামেলা আছে, তাই যদি কেউ ইচ্ছা করে, আগের স্টেশনে নেমে যেতে পারে।”
ওমা, এখন দেখি ম্যাক্সিমাম ট্রেনের যাত্রীরা পিল পিল করে নেমে গেল। এরা আসলে স্থানীয়। কেউ কেউ আছে যারা প্রতিদিনের যাত্রী। আমাদের পক্ষে এখানে নামা অসম্ভব। একে তো নতুন দেশ। তারপর স্টেশনে মিঠু আসবে আমাদের নিতে। সেভাবেই পরিকল্পনা করা আছে। আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। আরো কজন যাত্রী বসে রইল।
অতপর ট্রেনটা সময়ের থেকে প্রায় আধা ঘন্টা লেটে আসলো। আমরা বেশ তাড়াহুড়া করে নামলাম। জানি মিঠু এসে অপেক্ষায় থাকবে। স্টেশন অনেক বড়। প্যারিসের স্টেশন থেকে প্রায় ডবল। সেই হিসাবে লোক সংখ্যা অনেক কম। পরে বুঝলাম কারণটা। কারণ স্টেশনের বাইরে হরতাল এবং প্রতিবাদ সভা হচ্ছে। এবং আশ্চার্য হয়ে পরে শুনলাম, বেশ কিছু গাড়িও নাকি ভাঙচুর হয়েছে। যাক, শুনে মনে মনে বড়ই আনন্দ প্রাপ্তি হলো। কারণ, আমাদের বাঙ্গালী তথা সাউথ এশিয়ানদের বড়ই বদনাম, এই ব্যাপারে। আমরা সাউথ এশিয়ানরাই নাকি বিশৃঙ্খল বেশী। ‘আগুন জালাও’, ‘গাড়ি ভাঙচুর’, ‘মিছিল’, ‘মিটিং’ এর মাধ্যমে প্রতিবাদ বেশী করি। তবে প্যারিসেও কিঞ্চিত দেখেছিলাম। এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে জনগণ স্লোগান দিচ্ছিল। এবং সবার হাতে সাদার উপরে কালো কালিতে লেখা পোস্টার ছিল।

ব্রাসেলস এর গ্র্যান্ড প্লেস মিডল এ ঘোড়ার গাড়ি। ছবি : লেখক


তবে ব্রাসেলস এ এটা অনেক বড় আকারে হচ্ছে। যেহেতু ইউরোপের রাজধানী ‘ব্রাসেলস’ তাই এখানে প্রতিবাদের ভাষাও একটু অন্যরকম। বড় আকারে। কেমন জানি পরিবেশটা অসম্ভব রকম থমথমে। একজন পুলিশ এসে জানতে চাইলো, আমরা কোথায় যাব। আমি খুব দ্রুত মিঠুর ঠিকানাটি বললাম। একটু পরই আমার কাঙ্খিত ছায়াটি ধীরে ধীরে বৃহৎ আকার ধারণ করে, আমার ছোট ভাই মিঠু হয়ে গেল। সে এসে আমার স্বামীর হাত থেকে ব্যাগ দুটো একরম ছিনিয়ে নিয়েই হাটতে শুরু করলো। আমরাও তার পিছু পিছু। এবারে সিড়ি বেয়ে নীচে নামতেই দেখলাম সেটা ‘সাবওয়ে স্টেশন’। একদম আমাদের টরন্টোর ইউনিয়ন স্টেশনের মত। প্যারিসেও এমনই ছিলো। লন্ডনেও। কিন্তু ব্রাসেলস এর সব কিছুই দেখলাম বেশ বড়সড়। সাবওয়েতে নামার আমার আগে উপর থেকে নীচটা দেখছিলাম। প্রচুর মানুষ। রীতিমত মনে হচ্ছে, ঐ জায়গাটি একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়েছে। হতভম্ভ হয়ে দেখলাম একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। জানিনা সেটা পুলিশের গাড়ি ছিল কি না। তবে জনগণ এবং পুলিশ সকলেই সেখানে উত্তেজিত। এবং ঐ খানে অন্য জায়গা থেকে কোন গাড়ি আসছে না। অর্থাৎ স্থানীয় জনগণ জেনে গেছে ওখানে কিছু ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে।
এবারে আমরা সাবওয়েতে উঠলাম। মিঠু আগেই টিকিট কিনে পরে আমাদের নিতে এসেছিল। বেলজিয়ামের সাবওয়ে খুব সুন্দর। অন্তত লন্ডনের চেয়ে অনেক সুন্দর।
ঠিকঠাক সিটে বসে এতক্ষণে মিঠু আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করলো, এমন ভাবে যে, মাঝখানে যে ৩৩/৩৫ বছর চলে গেছ মনেই হলো না। মিঠু বললো, সে পরের স্টেশনে নেমে ওখানে গাড়ি রেখে তারপর সাবওয়ে ধরে আমাদের নিতে এসেছে। তখন বললো, প্রায় মাস তিনেক ধরেই একটু একটু করে প্রতিবাদ হচ্ছিল। মিনিমাম লেবার ওয়েজ নিয়ে। আমরা যখন গেলাম ২০১৮ এর ডিসেম্বরে, তখন ওদের মিনিমাম ওয়েজ ছিল ১০ ইউরো। ওটাই বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। ব্রাসেলস এ এই আন্দোলনের রূপটা বেশী হবার কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী বলা হয় ব্রাসেলস-কে। আবার বেলজিয়ামের রাজধানীও ব্রাসেলস। সমগ্র ইউরোপের ভাল-মন্দ সব কিছু কন্ট্রোল করে এই ‘ইউনিয়ন’। এই ইউনিয়ন শুরুই হয়েছিল ব্রাসেলস থেকে। এবং এই ইউনিয়নটি গঠন করেছিলেন ‘মসিও সিমনে’ ১৯৭৪/৭৫ সালের দিকে।
পরের স্টেশনে নেমে আমরা মিঠুর গাড়িতে উঠলাম। সারাটি পথ একটিবারের জন্যও মিঠু আমার স্বামী কাজিমকে স্যুটকেস নিতে দিল না।
যাইহোক ব্রাসেলস এর ভেতরে আমরা প্রবেশ করেছি। বেশ ছিমছাম শহরটি। মজার ব্যাপার এখানকার গাড়িগুলো বেশ ছোট ছোট। রাস্তাগুলোও খুব বেশী বড় নয়, আমাদের নর্থ আমেরিকার মত নয়। মজার ব্যাপার গোটা ইউরোপে ভ্রমণে আমার বার বার মনে হতো একটি অনুভূতি- ওমা!, এই রাস্তাটিতে আমি বহুবার এসেছি।” – কি জানি কেন। অথচ, বেলজিয়ামে আমার এটিই প্রথম সফর। রাস্তা-ঘাটগুলো থেকে একটা খুব পূরানো অতি পরিচিত গন্ধ পাচ্ছি। মানুষগুলোও যেন বড় আপন আপন। ইউরোপিয়ানদের সম্পর্কে সারাজীবন যা কিছু জেনেছি, যা কিছু শুনেছি সবই ভুল। বারবার ওরা আমাকে প্রমান করলো, আমার ধারণা কত ভুল ছিল।
মিঠুর গাড়িটা আস্তে আস্তে ওর বসত বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। একটা বেশ অভিজাত এলাকায় থাকে সে। এটা সেন্ট রুই মর্দ ওয়েগেন্স এলাকাতে। এখানকার বাড়িগুলো নর্থ আমেরিকানদের মত নয়। ঠিক আমাদের মতো বাংলো টাইপের বাড়ি নয়। বরং দেখলাম এই এলাকাতে অনেকটা বাংলাদেশের স্টাইলের ২/৩/৪ তলা টাইপের বাড়ি। মিঠুর বাড়িটা বেশ বড়সড়। তিনতলা। প্রতিতলায় ৩টি করে ২ বেডরুমের এপার্টমেন্ট। সে একটি এপার্টমেন্টে থাকে। আর ছেলে-মেয়ে দুজনেই ১৮ হয়ে গেছে, তারা আলাদা আলাদা থাকে। মিঠু একতলায় কর্নারের একটি ফ্লাটে থাকে। কারণ, কিছুটা দূরেই তার (৫/৬ মিনিট ড্রাইভে) দুটি রেস্টুরেন্ট। তাকে বার বার যাওয়া আসা করতে হয়। আগে নাকি তিনতলাতে ছিল। এখন বয়স হচ্ছে তাই বুদ্ধি করে এই ব্যবস্থা। আমরা যখন গিয়েছি তার ঘরনী তখন তার স্পেনের রিসোর্টের পরিমার্জনার কাজে ব্যস্ত ছিল। ইচ্ছা থাকা সত্বেও আসতে পারছিল না। বারবার ‘আন’ সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছিল। তবে আমরা যখন তার গৃহে প্রবেশ করলাম, দেখলাম, ঠিক বাঙ্গালী স্টাইলে তার দুই ছেলে/মেয়ে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো। ছেলে স্বাধীন। মেয়ের নাম জয়া। স্বাধীন হালকা পাতলা ইংরেজী বলতে পারে। তার মেয়ে জয়া ইংরেজীতে একেবারে ‘ব’কলম। যেমনটি আমি ফ্রেন্স এ ‘ব’ কলম। এমনিতেই বেলজিয়ামে রাষ্ট্রভাষা তিনটি। ফ্রেন্স, জার্মান এবং ডাচ। এই তিনটি ভাষাতেই সংসদীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মোটামুটি বেলজিয়ামের জনগণ কমবেশী এই তিনটি ভাষাতেই রপ্ত। তবে ওরা কথা বলে সব দেখলাম ফ্রেন্সে। আমাদের কানাডাতেও দুই ভাষা। তবে আমি শত চেষ্টা করেও ফ্রেন্সটা শিখতে পারলাম না। অবশ্য মিঠু এই তিন ভাষা এবং পাশাপাশি তাকে অহর্নিশ আমেরিকাতেও খুব যেত হয় বলে ইংরেজীটাও ভালই বলে দেখলাম। এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে তার ঘরের একটি দেয়াল আলমারি দেখলাম যেখানে থরে থরে সাজানো বাংলা বই। দারুন সব কালেকশন। কিছু মানুষ যেমন বই কিনে সাজিয়ে রাখার জন্য, তেমন নয়। রীতিমত অতি পঠনে বইগুলো বেশ মলিন। যাইহোক, খুব চেষ্টা করেছিলাম ছেলে-মেয়ের সাথে গল্প করতে। স্বাধীনের সাথে যা হোক পারছিলাম, কিন্তু জয়ার সাথে নৈব নৈব চ। শুধু দুজনেই হাসছিলাম। আর আমি
একাধিকবার বলছিলাম, ‘মার্সি বকু’। হাঁ… হাঁ… আর কোন শব্দ জানা নাই। আমার ছেলে দুটোই ইংরেজীর পাশাপাশি ভাল ফ্রেন্স বলে। আমরা বুড়ো-বুড়ি একদম পারি না।
যাইহোক আগামীকাল থেকে ভ্রমণ শুরু হবে। ভ্রমণের খসড়া তৈরী করলো মিঠু। অতএব আমাদের জন্য তৈরী করা হালকা কিছু স্ন্যাকস পরিবেশন করলো। তারপর বললো, চলেন এবারে আমার রেস্টুরেন্টে। ছেলেকে এবং তার দুই ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে
দিয়ে আমাদের নিয়ে তার বেলজিয়ামের সফর শুরু হবে।
প্রথমেই গেলাম তার মেইন বিজনেস সেন্টারে। এটা সেইন্ট রুই দ্য সোসে এলাকায়। বিশাল বড় তার রেস্টুরেন্ট। একতলা। কেমন কালচে রঙের গোটা রেস্টুরেন্টটি। পেছনের অংশে তার অফিস, রান্নাঘর, স্টোররূম ইত্যাদি। সামনের গোটা অংশটি জনগণের। এত সুন্দর করে সাজানো রেস্টুরেন্ট খুব কম দেখেছি। ওর বাসায় গিয়েই বুঝেছিলাম, তার হোম ডেকোরেশন এর টেস্ট। অসম্ভব সুন্দর।
এতক্ষণে দেখলাম তার রেস্টুরেন্টের নাম- ‘ঞড়ি ঝসধষষ উবারষং’ হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার বিস্মিত মুখ দেখে মিঠু হা হা করে হাসছিল। আমি বল্লাম, ওমা! এ আবার কি নামরে বাপু?
মিঠু তার ছেলে-মেয়ের দিকে আঙ্গুল নির্দেশনা করে বললো, “ঐ দুই শতানের নামে”। আমিও তখন খুব মজা পেয়ে হাসছিলাম। তারপর মিঠুর বেলজিয়ামের জীবনের প্রারম্ভ থেকে নানান কথার মালা গাঁথছিলো। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ের সাথে শুনছিলাম। আর অবাক বিস্ময়ে আমার ফাইটার ভাইটিকে দেখছিলাম। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com