প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৩
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আইফেল টাওয়ার আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। আর আমার কাছে এর প্রাণ যেন আরো ফিরে পাচ্ছে। দূর থেকে এত বেশী সুন্দর লাগে। এর স্ট্রাকচারটা যেন সত্যিকার অর্থে উদ্ভাসিত হয়।
এবারে আমাদের টার্গেট কোথায় আমি জানি। Musée d’Orsay আর্ট গ্যালারী। কিন্তু আমাদের সঙ্গী কাপল, জেমিমা-রা একদম রাজীনা আবারো কোন আর্ট গ্যালারীতে যাবার। তারা কোন একটা মল বা শপিং সেন্টারে যেতে চাইছে। জেমিমা’র বয়ফ্রেন্ড বললো, একবার ঘুরে আসা যাক। কিন্তু জেমিমা মুখ বাঁকা করে বললো – না আর্ট গ্যালারী আবারো দেখার কি আছে। খুবই বোরিং ব্যাপার।
অতএব, সাব্যস্ত হলো, ওদেরকে পথিমধ্যে একটা ‘আউটলেট মল’ এ নামিয়ে দেয়া হবে। সেই কথা অনুযায়ী ওদেরকে আর একটা শপিং সেন্টারে নামিয়ে দেয়া হলো। আমরাও আধঘন্টার মতো ঘোরাঘুরি করলাম। তারপর ওদেরকে বলা হলো ২ ঘন্টা পর কোথায় থাকতে হবে। এবারে আমাদের নিয়ে চললো আমাদের আনন্দের গন্তব্যে। কানাডায় বসেই আমি প্যারিসের আর্ট গ্যালারী সম্পর্কে মোটামুটি পড়াশুনা করে এসেছিলাম। কোনটা ভাল, কোনটা কোন বিষয়ের উপর বিখ্যাত, ইত্যাদি। তখনই দেখেছিলাম প্রচুর মন্তব্য ‘ Louvre Museum’ এবং Musée d’Orsay নিয়ে। সত্যিকারের তুলি শিল্পী বিশারদগণ Musée d’Orsay-র ব্যাপারেই খুব আগ্রাহ প্রকাশ করেছে। পরে অবশ্য আমি এর কারণটা অনুধাবন করতে পেরেছি।
বেশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল। যখনি কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল ড্রাইভার কাম গাইড আমাদের বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিচ্ছিলো। হয়তো যেখানে যেতে ৫ মিনিট ড্রাইভ। আমাদের নিচ্ছিল অন্তত ৩০/৪০ মিনিট ড্রাইভ করে। আর নিকোল অনর্গল বলে যাচ্ছিল আমরা এবারে কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছি। অথবা এখানে দেখার কি কি আছে। এই দুটো ছাড়াও প্যারিসে আরো ৯/১০টা আর্ট গ্যালারী আছে। তবে এই দুটোই পৃথিবীতে বিখ্যাত অথবা বহুল আলোচিত। অবশেষে আমাদের কাঙ্খিত জায়গাতে নিয়ে এলো। The Musée d’Orsay এর সামনে। এটা Louvre Museum মিউজিয়ামের থেকে একদমই আলাদা। দেখতে প্যারিসের অন্য দশটা বিল্ডিং এর মত। তবে এর বৈশিষ্ট্য একদম বিল্ডিং এর উপরে বিশাল আকারের একটা ঘড়ি। লন্ডনের ‘ক্লক’ টাওয়ারের মত। খুব বিশাল একটা বাড়ি। কত বড় বলতে পারবো না। খানিকটা ট আকৃতির। তবে ঊ বললে আরো ভালো হতো। কারণ মাঝখানটা ফ্লাট। অনেক লম্বা। আর মাথার উপর সেই বিশাল সাইজ ঘড়ি খানা। দূরে থেকে দেখলে মনে হবে, ঘড়িটা সাদা, কালো। তবে দূরবীন দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এর কাঁটাগুলো ইউরোপের ঐতিহ্য বহন করছে। অর্থাৎ সোনার কাঁটা। এমনিতে বিল্ডিংটা বেজ রঙের। Louvre Museum’র কাছে খুবই সিম্পল। কোনই সন্দেহ নাই। Louvre মিউজিয়ামের যেমন বাইরেই আপনি ঘন্টা অতিক্রম করবেন দেখতে দেখতে। এখানে সেটা নয়। যা হোক, আমরা ভেতরে চলে গেলাম। তবে এবারে অবশ্যই নিকোল গেল না। কারণ এখানে নিকোলের দরকার নাই। আমার হাসবেন্ড বলো, “আমি ওকে ধরতে পারবো”। টিকিটেরও একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া ‘আর্ট গ্যালারী’তে মনের সুখে ঘুরবো, মনের আনন্দে দেখবো। পাশে নিকোল থাকলে মনে হবে, আমার সময়ের বন্দী দশা। ওহ! আগে কি জানতাম, সময়ের অভাব কাকে বলে। এই আর্ট মিউজিয়াম দেখতে গেলেই সময়ের স্বল্পতা মনে পড়ে যাচ্ছে।
আর্ট গ্যালারীতে ঢুকলেই আর একটা জিনিশের অভাব বোধ করছিলাম। আমার হুইল চেয়ার। কারণ খুব বেশীক্ষণ আমি দাঁড়াতে পারিনা এখনও। তবু প্রিয় সান্নিধ্যে আছি বলেই সেটা ভুলে আছি।
ভেতরে ঢুকলেই, প্রথমেই একটা ধাক্কার মত লাগবে। কারণ ঐ দিনেই Louvre আর্ট গ্যালারী দেখে এসেছি, তাই বোধ হয়। Louvre আর্ট গ্যালারী এত বেশী চমকিত যে তার কাছে এটা বড় বেশী নিষ্প্রভ মনে হবে। ভেতোরটা একেবারেই সাদা মাটা। দেয়ালে কোন পেইন্ট করা নাই। এটা একেবারেই ফকফকা সাদা টাইপ দেয়াল । ভেতোরে ঢুকলেই একটা চওড়া চাতাল। তারপর ৪/৫টা সিঁড়ি। সিঁড়ির পরে একটা লম্বা এবং যথেষ্ট চওড়া পরিসর। আর তার দুপাশেই গোল করে বিল্ডিংটা করা। এটা একজন খুব বড়মাপের মানুষের নিজস্ব বাড়ি ছিল। একজন আর্টের ভক্ত। তার নাম ছিল ‘গ্যারি ডি অসসে’। তাঁর বাড়িটাই এখন Musée d’Orsay করা হয়েছে। এটা ‘লা-সেন’ নদীর বাম দিকে অবস্থিত। এই আর্ট মিউজিয়ামটা স্থাপিত হয় ১৮৯৮ থেকে ১৯০০ এর মধ্যে। এটা স্থাপন করা হয়েছিল মূলত, শুধুমাত্র ফ্রান্সের আর্টিস্টদের আর্ট এখানে থাকবে বিধায়। এবং সেটাই তারা করেছে।
এই আর্ট গ্যালারীর ভেতরে ঢুকলেই যে ধাক্কাটা খেয়েছিলাম সেটা এই কারণে যে, আমি Louvre থেকে সদ্য এসেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে যখন এর ঐ কম্পাউন্ডে দাঁড়ালাম, তখন অবশ্যই আমার ভুল ভেঙ্গে গেল। তখন একটু একটু করে আমার চোখ দুটো গ্রাস করলো এর অসাধারণ আর্কিটেক্ট নৈপুণ্য। ঐ কাম্পাউন্ডের মাথার উপরিভাগেও রাউন্ড টাওয়ারের মত। এবং সেখানে অসাধারণ কাজ করা। এবং প্রতিটি দেয়ালে সাদা এবং বেজ নির্ভর বলে, আপনার প্রতিটি পেইন্ট দারুন ভাবে উজ্জল মনে হবে। আর প্রতিটি দেয়াল এর রেলিং আলাদা আলাদা কারুকাজের নৈপুন্য। প্রথমেই আমার যেটা খুবই সাদা মাটা মনে হয়েছিল, পরবর্তীতে এর আর্কিটেক্টদের উপর, তাদের চমৎকার আইডিয়ার উপর আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম মনে মনে। এঁরা হলেন, গায়ে অলেনটি, ভিক্টর লালোকè এবং এমিলি বেনার্ড। এঁরা চেয়েছিলেন বিল্ডিং নয়, এর পেইন্ট গুলি যেন, দর্শকদের চিত্তাকর্ষণ করে।
এবারে সোজা, পেইন্টারের চার্টে গেলাম। দেখলাম প্রায় সবই খুব বাছা বাছা পেইন্টারদের তালিকা।
মনেট, ডি গাস, ম্যানেট, রেনিওর, সেজান, সিউর্যাট, সিসলী, জর্জ হেনড্রিক, গাওগুইন, মারিসট, গ্রে হারমনি এবং ভিনসেট ভ্যান গগ। শেষ নামটি যার, আমি তাঁর শুধু ভক্তই নই। অতি ভক্ত। ছোল বেলায় মামা একটা পেইন্টিং এর বই উপহার দিয়েছিলেন, আমার অতিরিক্ত পেইন্টিং প্রীতি দেখে। আমার মনে আছে, তখন থেকেই আমি এঁদের ভক্ত। ওহ! আগস্টা রেনিওর। আমার মাজে মধ্যে মনে হয় একজন পেশাদার আর্টিস্টের থেকেও আমি অনেক বেশী ভক্ত। শুধু আম্মার জন্য আমার আর্টিস্ট হওয়া হলোনা। যদিও তা নিয়ে আজ আর কোন ক্ষোভ নাই। এক জীবনে সব কিছু হয় না। আর্টিস্ট বা গায়িকা হওয়া হলো না। তাতে কি? যা হয়েছি, সেটাই বা কম কি? এই ভাবনা আমাকে শান্ত রাখে। সন্তুষ্ট রাখে। আবার মাঝে মধ্যে ভাবি, যারা গান বা আর্ট এর প্রকৃত সমঝদার, তারাইতো প্রকৃত শিল্পী।
আমি এঁদের পেইন্ট দেখতে দেখতে এতটাই বিস্মৃত হয়ে যাই যে, সমস্ত পৃথিবী ভুলে যাই। এক গভীর তম্ময়তার ভালবাসা আমাকে নিবিড়ভাবে গ্রাস করে রাখে বহুক্ষণ। পৃথিবীর যাবতীয় কষ্টের পাখীরা ডানা মেলে উড়ে যায়।
“ এখন তোমার কাছে যাবো –
তোমার ভেতরে এক সবলীল শুশ্রুষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো –
আমি আঁধার রাখবো না।”
পেইন্টারদের চার্ট পড়তে পড়তে আবুল হাসানের কবিতার শব্দগুলি ভাবতে ভাবতে আর্টের সমুদ্রের দিকে পা বাড়ালাম। (চলবে)
রীনা গুলশান।
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com