কানাডার ‘ফল্’

জুলাই ৯, ২০১৬

গুলফাম জান্নাত চমক

ইংরেজি শব্দ ‘ফল্’ এর প্রতিশব্দ টা কি হবে? হেমন্ত? দেশের হেমন্তে তো এক অন্য  ধরণের আনন্দ মিশে আছে। কানাডা তে এই ‘ফল্’ নিয়ে কিছুটা হৈচৈ চোখে পরে। আমার মনেই পড়ে না দেশ এ আমরা হেমন্ত নিয়ে কতোটা উৎসবী ছিলাম। বরং আমাদের বর্ষা , বসন্ত অনেক বেশী উৎসবী। আমাদের এক বৈশাখী আয়োজোনই তো পুরা পৃথিবীটাকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। পৃথিবীর আর কোন দেশ তার নিজস্ব সংস্কৃতিতে এত ধূমধাম করে বর্ষ বরন করে বলে আমার জানা নেই ।

আমার ‘ফল্’ দেখায় ফিরে আসি। বন্ধুরা মিলে একবার টরণ্টো শহর থেকে বেশ উত্তর এ মাশকোকা নামের এক জায়গায়  কটেজ এ চলে গেলাম। আয়োজন করে কানাডার ‘ফল্’ দেখার পালা। শুক্রবার কাজ শেষে পাঁচ বন্ধু-যুগল এর যাত্রা। অনেক আগে থেকেই অনলাইন এ কটেজ ভাঁড়া করে রাখা ছিল। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় গভীর রাত। কারণ  অন্ধকার  গহীন বনের ভিতরে গাড়ীর হেড লাইট চারদিককে কেমন ঘুটঘুটে করে দিচ্ছিল। অনেক নাটকীয় যাত্রা শেষ এ কটেজ এর দেখা মিলল ।

ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখি লাল টুকটুকে রঙ্গের দোতলা  কাঠের বাড়িটি সবুজ পানির বিশাল লেক এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর চারদিকে ধরে যাওয়া গাছের রঙ বনের মাঝে পুরো আবহকে  কেমন যেন স্বপ্নপূরী মনে হচ্ছিলো। রাতে ভুলেও ধারণা হয়নি এই গহীন বনে কেউ এত মুগ্ধকর  আয়জন করে রাখতে পারে।

আশেপাশে ঘুরে ফিরে ঘরে এসে টেবিলে খাবারের  আয়োজন দেখে স্বপ্নপূরীর আবহটা একেবারেই উধাও। খাবাররের বাড়াবাড়ি আয়োজন যাত্রার উদ্দেশ্য কে অনেকটাই হার মানিয়ে দেয়। এক বন্ধু তো (যার কী না রান্নায় তার স্ত্রীর সাথে হাত দেয়ার খূব বেশী  সুনাম নেই ! )  মহা আয়োজন করে সবাইকে  ‘ সি  ফূড’ রান্না  করে খাওয়ালো। আরেক  বন্ধুবর এর বাড়বীকিউ ও গ্রিল করার প্রস্তুতি দেখে আমি রীতিমত ভড়কে গেলাম। তার বাড়বীকিউ করার জন্য স্পেশাল এপ্রন এর পকেটে সব দরকারি চামচ জাতীয় জিনিস রাখা! বিশ্ববিখ্যাত ‘শেফ’ দের আয়জন হয়তো এমনি হয় (যদিও এই ভদ্রলোক এর সেই সম্ভাবনা নেই, উনি এখনো পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার)।

বেলা বাড়ার সাথেই শুরু হল ঘরের নিচের পানিতে মাছ ধড়ার প্রস্তুতি। আমার ধারনাই ছিল না মাছ ধরার জন্য লাইসেন্স লাগতে পারে! ভাগ্যিস আমাদের দেশে এমন নিয়ম নাই! তাহলে ছোট ছোট ছেলেরা খালে বিল এ যখন তখন মাছ ধরত কি করে ? মাছ ধরার ছিপ ও যে এত ধরনের হতে পারে! সবচাইতে অবাক হলাম প্লাস্টিক এর কেঁচো থেকে শুরু করে সব ধরণের পোকা মাকড় ও ছোট মাছ দেখে। কোনটিতে কি মাছ ধরা পড়বে তা রীতি মত গবেষণা করে তৈরি করা। যা হোক, এত আয়জনের পরও দিন শেষে এই আধুনিক জেলেদের বরফ দিয়ে সাজানো কুলার বক্স এ তেমন মাছের দেখা পাওয়া গেল না!

এখানেই শেষ নয়। আমার এক বন্ধুবর নিজেকে গ্রামের ছেলে দাবী করে কটেজের ডক এ সাজিয়ে রাখা ছোট প্লাস্টিকের  বোট (এইগুলি কে আমার কখনই নৌকা মনে হয় না) নিয়ে বেরিয়ে পরল। সম্ভবত পারদর্শিতা দেখানোর লোভেই বেচারা সাধ্যমত দূরে চলে গেল। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় কিছুক্ষণ পর। ধরা পরল বেচারা  স্রোতের বিপরীতে পেরে উঠছেন না, বিশাল লেক এর মাঝে আটকে গেছেন। আরেক বন্ধু বোট নিয়ে  তাকে উদ্ধারএ যাত্রা শুরু করল। কিন্তু  আটককে পরা বোট থেকে অন্য  বোট এ

উঠতে যেয়ে ঠান্ডা (রীতিমত হিমশিতল) পানিতে বেচারার পতন ! কিছুটা হাসাহাসির পরই (এমন দৃশ্যে না হেসে পারা যায় ?) সবার মুখে এক ভয়ের ছায়া ! এখানে নাকি বেশি  ঠান্ডায় ‘হাইপোথারমিয়া’ হয়ে যায়!  মুখে  কেউ কিছু না বললেও ‘হাইপোথারমিয়া’ র ভয় থেকেও বুয়েট  স্টুডেন্ট এর সাথে পানির বৈরিতা’র অজানা ভয়টা আরও বেশী তাড়া করেছিলো সেদিন !  আমাদের সেই বন্ধুবর (বাড়বীকিউ ‘শেফ’)  কিভাবে যেন বোটের সাথে বোট বেঁধে সে যাত্রায় তাকে উদ্ধার করলো। কোন দুর্ঘটনা বা মাছ ছাড়াই এ ‘মাছ ধরা  উৎসব’ শেষ হল ।

সন্ধা হতেই শুরু হল গেইম এর  প্রস্তুতি। কেন জানি এই ধরণের বড়দের বসে বসে বুদ্ধির  খেলা গুলি কে  আমার ‘খেলা’ মনে হয় না। ‘গেইমস’ ই মনে হয়। আমাদের এক বন্ধু যুগল নতুন সব ‘গেইম’ নিয়ে রীতিমত  এস এস সি পরীক্ষা এর প্রস্তুতি থেকেও

বেশী সিরিয়াস ।  এইসব  গেইমস আমার গুরুগম্ভীর অধ্যাপক বরটি কেও   কি করে যেন ছেলেমানুস বানিয়ে আমাকে অবাক করে  দেয়! বন্ধুবর (সেই বাড়বীকিউ ‘শেফ’) মাঝরাতে এই  গহীন বনের মাঝে তার গানের সব  আধুনিক  ইন্সট্রুমেনট  নিয়ে  নিখুঁত আয়জোন করেও কেন জানি  চুপচাপ বসে থাকে। কোন এক অজানা কারনে তার আর গান গাওয়া হয় না।

পরের দিন ভোরে এইবার আমরা ফল্ দেখতে বের হই এলগনকুইন ন্যাশনাল পার্কে। শুধু চোখ ভরে দেখার জন্য  একটা উঁচু  টাওয়ার  তৈরি আছে পাহাড়ের চূড়ায়। উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে  বনের সব গাছের পাতায় শুধু  হলুদ আর লাল রঙ এর খেলা দেখে চোখ  কি ভীষণ ভাবেই  না চমকে  যায়। আমার ধারনাই ছিল না গাছের সবুজ পাতা  শুধু নিজের রঙ পরিবর্তন  করে প্রকৃতিকে এমন  বিচিত্র রূপ  ধরাতে পারে। আমি বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারি না, চোখ ধরে যায়।  চুপিসারে নীচে নেমে আসি। মাটির ছোট পথ  (হাইকিং লেন) ধরে রঙিন বনের মাঝে একা একা  হাটতে থাকি । এত উৎসব এর মাঝে  ও কেন জানি আমি  আরও বেশী পরিচিত আনন্দ এর সৃতি খুজে বেড়াই। আমার পরিবার এর সবার সাথে দেশের রাঙ্গামাটি তে বেড়ানোর আনন্দ কোত্থেকে যেন  উকি ঝুকি দেয়। তাকে পাত্তা না দিয়ে ইংরেজি শব্ধ  ‘ফল্’  এর প্রতিশব্দ টা খুজতে থাকি। হেমন্ত? হেমন্ত এর আকাশ কী এতটাই বিষন্ন ?  ঝরে যাওয়া লাল পাতাগুলি  মন উদাস করে আমার  হাটার সমান্তরালে কীভাবে যেন উড়ে ঊড়ে চলে ।  ‘ফল্’ এর রঙ্গিন ঝরা পাতার এই  আনমনে উড়ে চলা, গুমট বাতাসের  এই আবহ কি আসলে দেশ থেকে, প্রিয়জনদের থেকে অনেক দূর এ থাকা এক প্রবাসীর  অতি যতনে লালিত সেই  গভীর দীর্ঘশ্বাস?

গুলফাম জান্নাত চমক

টরণ্টো, কানাডা