মহামারীকালেও থেমে নেই কানাডার হোয়াইট সুপ্রেমেসিষ্টদের অপতৎপরতা

নভেম্বর ৩, ২০২০

খুরশিদ আলম

করোনার মহামারীকালেও থেমে নেই কানাডার হোয়াইট সুপ্রেমেসি বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী দলের সদস্যদের অপতৎপরতা। গত ১০ অক্টোবর টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত একটি মসজিদে এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা নানরকম হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক হুমকি দিয়ে একাধিক ইমেইল পাঠিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এর ঘটনা উল্লেখ করে তারা সকল মুসলমানকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছেন। তাদের দাবী, পুলিশ তাদের পক্ষ নিবে এবং তাদের অধিকার আছে টেররিস্টদের কবল থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার। তারা আরো বলেন, ইসলাম তাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। তাদের দলে এমন সব সৈন্য রয়েছে যারা স্নিপার (sniper) হিসাবে অভিজ্ঞ। CP24 এর এক খবরে এ কথা বলা হয়।

এই ঘটনার পর মসজিদটি বন্ধ রাখা হয়েছে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। তবে নির্দিষ্ট কোন মসজিদটি এই হুমকির চিঠি পেয়েছে তা প্রকাশ করেননি কানাডার ন্যাশনাল কাউন্সিল অব মুসলিম এর কর্মকর্তারা। টরন্টোর পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।

এদিকে ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, তিনি এই সংবাদে গভীরভাবে বিচলিত। তার সরকার বিদ্বেষ মোকাবেলায় জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ট্রুডো আরো বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হিংস্র মতাদর্শ এবং বিশেষ করে শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদ ও অসহিষ্ণুতা থেকে কানাডিয়ানদের সুরক্ষার জন্য সদা সতর্ক রয়েছে।

টরন্টোর মেয়র জন টরী বলেছেন, এই হুমকিগুলো সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে রয়েছেন।

ন্যাশনাল কাউন্সিল অব মুসলিম এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা ফারুকী সিবিসি নিউজকে বলেন, ইমেইলে পাঠানো হুমকিগুলো অতিমাত্রায় হিংসাত্মক। আমরা যখন এই হুমকিগুলো পাই তখন এগুলোকে মোটেও হালকাভাবে নেইনি। এ কারণেই মসজিদটি আমরা অবিলম্বে বন্ধ করে দেই। বিভিন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ অনুয়াযী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ মসজিদটি আবার খুলে দেওয়া হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

উল্লেখ্য যে, টরন্টো নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মসজিদ টরন্টোতে গত তিন মাসে ছয় দফা হামলা চালানো হয়েছে। দুটি মসজিদে তিন বার করে হামলার ঘটনা ঘটে। হাফিংটন পোস্ট এর এক খবরে এ কথা বলা হয়। এসব হামলার মধ্যে আছে মসজিদের ভেতরে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা, জানালা ভেঙ্গে ফেলা এবং জানালা ও দেয়ালে বর্ণবাদী চিত্র এঁকে রাখা। সম্প্রতি কে বা কারা মসজিদের জানালা ভেঙ্গে ফেলে। জানালাগুলো সদ্যই মেরামত করা হয়েছিলো। এখন মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে এগুলো তৃতীয়বারের মত মেরামত করতে হবে। মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা (এএমসি) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে। সংগঠনটি বলেছে, “এখন এসব ঘটনা ঘটছে ভীতিকর হারে। আমরা পুলিশি তৎপরতার জন্য অপেক্ষার বিষয়টি আর মেনে নিতে পারি না।”

এএমসি মুসলিমদেরকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে কর্তৃপক্ষকে এখনই “পদক্ষেপ নেওয়ার” আহবান জানিয়ে বলেছে, টরন্টোর সবচেয়ে বেশি মানুষ আসা এই মসজিদে মুসলমানদের ভীতি প্রদর্শনের জন্যই এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে মনে হয়।

গত ১০ অক্টোবর টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত একটি মসজিদে শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা নানারকম হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক হুমকি দিয়ে একাধিক ইমেইল পাঠিয়েছেন। ছবি: এষড়নধষ ঘবংি

টরন্টোর পুলিশের মুখপাত্র জেনিফারজিৎ সিধু নিশ্চিত করেছেন যে, জুন মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত টরন্টোর দুটি মসজিদে চার দফা হামলার যে রিপোর্ট করা হয়েছে সে সম্পর্কে পুলিশ সচেতন আছে। তবে তিনি জানান, এসব হামলার সব ক’টিরই তদন্ত হয়েছে এবং কোনওটিই ঘৃণাপ্রসূত হামলা বলে বিশ্বাস করার কারণ নেই।

সিধু বলেন, ২৯ জুলাই একটি মসজিদের জানালা দিয়ে পাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনায় এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এএমসি জানায়, তারা অতি সাম্প্রতিক হামলার ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, তারা এমন কোনও রিপোর্ট পায়নি।

ন্যাশনাল কাউন্সিল অব মুসলিম এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা ফারুকী হাফপোস্ট কানাডাকে বলেন, “হামলার ঘটনাগুলোর তদন্তে পুলিশ যে প্রক্রিয়ায় তদন্ত করে তা “পুরোপুরি অর্থবহ নয়।”

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যেমনটা বোঝা যাচ্ছে সেটি হলো, প্রথম সন্দেহভাজন চিহ্নিত হবার কয়েক দিন পরই পুলিশ ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ নাকচ করে দেয়। এটাই “সমস্যা।”

ফারুকী আরো বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে এবং আমাদেরকে এখন পর্যন্ত কোনওরকম ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি যে অব্যাহত হামলা থেকে সুরক্ষা দিতে এবং নিরাপত্তার জন্য কী করা হচ্ছে।”

ফারুকী বলেন,“আমি বলছি না যে, টরন্টোর পুলিশ সার্ভিস মসজিদ টরন্টোর ব্যাপারে কম যত্নবান। কিন্তু আমি বলতে চাই, বর্তমানে পুলিশের ভূমিকা যথেষ্ট নয়- বরং তা নাটকীয়ভাবে অপর্যাপ্ত।” তিনি বলেন, মুসলিমদের রক্ষা এবং হামলা বন্ধে তিনি পুলিশের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা দেখতে চান।

অন্টারিওর প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড বলেন, এই হামলার ঘটনায় ন্যায্য বিচার হবে। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, “এসব জঘন্য কাজ ও আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। এসব হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আমরা খুঁজে বের করবো এবং ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে।”

উল্লেখ্য যে, ইমেইলের মাধ্যমে টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত মসজিদে হামলার যে হুমকি দেওয়া হয় তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ইটবিকোকে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম অর্গানাইজেশন অব টরন্টো’র মসজিদের সামনে ঘটে এক নৃশংস হত্যার ঘটনা। ঐ মসজিদের স্বেচ্ছাসেবক এক মুসল্লিকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমর্থক Guilherme ‘William’ Von Neutegem নামের এক ব্যক্তি। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আসলিম জাফিস। ৫৮ বছর বয়স্ক আসলিম জাফিস গত ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রেক্সডেল এবং কিপলিং এ্যাভিনিউর (৬৫ রেক্সডেল) নিকটবর্তী ঐ মসজিদের সামনে একটি চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি ঐ সময় লক্ষ্য রাখছিলেন মুসল্লিগণ সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে প্রবেশ করছেন কি না। করোনার কারণে মসজিদে এমনিতেই লোকজনের আসাযাওয়া অনেক কমে গিয়েছিল। ফলে মসজিদের আশপাশ এলাকাও ছিল খুব নিরিবিলি। আর এই সময়টাকেই বেছে নেয় খুনী। ভিডিওতে দেখা গেছে খুনী Von Neutegem চেয়ারে বসে থাকা আসলিম জাফিস এর পিছন দিক থেকে এসে সহসা আক্রমণ করে। আসলিম জাফিস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেই অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়।

Von Neutegem কে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তার বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এর অভিযোগ আনা হয়। কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, Von Neutegem ব্রিটেনের একটি বিদ্বেষী গ্রুপের অনুসারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপেরও অনুসারী সে।

উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার পর কানাডার মাল্টিফেইথ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একটি জোট প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে দেশজুড়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গোষ্ঠিগুলো নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়।

অন্যদিকে ইটোবিকোকের মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল মোহাম্মদ আসলিম জাফিসের হত্যাকান্ডকে ঘৃণাজনিত অপরাধ হিসাবে তদন্ত করার জন্য। কিন্তু টরন্টো পুলিশের হোমিসাইড স্কোয়াড এর প্রধান কর্মকর্তা বলেছিলেন তদন্তকরীদের কাছে কোন তাৎক্ষণিক প্রমাণ নেই যে এটি ঘৃণাজনিত অপরাধ। তবে এর সম্ভাবনাকে তারা উড়িয়েও দিচ্ছেন না।

মাল্টিফেইথ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, “আদিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম, ইহুদি, শিখ, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্ম ও জাতিগত সম্প্রদায়ের কানাডিয়ানদের বাড়ি, উপাসনালয় এবং ধর্মীয় জামায়েত শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদী সংগঠনগুলো কর্তৃক হামলার শিকার হয়েছে।”

মাল্টিফেইথ এই সংগঠনগুলোর মধ্যে আছে, কানাডিয়ান মুসলমানদের জাতীয় কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড শিখ সংস্থা, ইস্রায়েল ও ইহুদি বিষয়ক কেন্দ্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং কানাডিয়ান অ্যান্টি-হেট নেটওয়ার্ক।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় বর্ণবাদ বা ঘৃণাজনিত অপরাধ এবং শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের অপতৎপরতা নতুন কোন উপদ্রব নয়। প্রায়ই তাদের কর্মকান্ড জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এইতো গত জুন মাসে সিটিভি নিউজে সম্প্রচারিত এক খবরে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে চরম দক্ষিণপন্থী কানাডিয়ানরা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ (ISD)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ও গত ১২ জুন প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আয়রন মার্চ, ফেসিস্ট ফোর্জ, ফোরচ্যান ও গ্যাব (4chan and Gab) এর মত বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কানাডার বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী উগ্র সম্প্রদায় সক্রিয়।

সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়, এইসব চ্যানেল, দল ও অ্যাকাউন্ট থেকে তারা বিভিন্ন প্লাটফর্মের এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি সংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে পারছে।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গবেষকরা দেখেছেন, প্রান্তিক সাইট ফোরচ্যান-এর “পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট” নামের একটি বিশেষ মেসেজ বোর্ডে রক্ষণশীল ডানপন্থী কানাডিয়ানরা ১৬ লাখেরও বেশি পোস্ট দিয়েছেন। এই বোর্ডে অন্য সব দেশ থেকে যত পোস্ট দেয়া হয়েছে কানাডিয়ানদের পোস্টের সংখ্যা তার ছয় শতাংশ।

রিপোর্টে আরো বলা হয়, “আমরা দেখেছি যে, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামে রক্ষণশীল কানাডিয়ানরা অত্যন্ত সক্রিয়। ফোরচ্যান-এর ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ প্লাটফর্ম ব্যবহারের দিক থেকে কানাডিয়ানরা হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পরেই তাদের অবস্থান। আবার ‘আয়রন মার্চ’ প্লাটফর্মটি যখন সক্রিয় ছিলো তখন সেটিতেও কানাডিয়ানরা ছিলো তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবহারকারী সম্প্রদায়।

আইএসডির সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টের অন্যতম লেখক জ্যাকব ডাভে সিটিভিনিউজ.সিএ-কে বলেন, জনসংখ্যার দিকটি বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, আসলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় চরমপন্থী ব্যবহারকারীর আনুপাতিক হার বৃহত্তর।

ডাভে আরো বলেন, “আমরা এটা ধারাবাহিকভাবেই দেখতে পেয়েছি যে, ওইসব প্লাটফর্মে মুসলিমবিরোধী আবেগ এবং মুসলিমবিরোধী ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। টুইটারের এবং ফোরচ্যান-এ ব্যবহারকারীদের কথোপকথন অনুসরণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, অনেক কানাডিয়ান আছেন যারা নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলা সমর্থন করেন, এ নিয়ে উল্লাস করেন, ওই হামলাকে যৌক্তিক বলে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর আহবান জানান।”

উল্লেখ্য যে, গত বছর ১৫ মার্চ শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে অবস্থিত দুটি মসজিদে জুম্মার নামাজ এর সময় এক সন্ত্রাসীর অতর্কিত বন্দুক হমলায় ৫০ জন মুসল্লি নিহত হন। এদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশীও রয়েছেন। সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন আরো প্রায় ৪৮ জন।

এবার ঐ ক্রাইস্টচার্চ এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কানাডার শ্বেতাঙ্গবাদীরা টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি মসজিদে হামলার হুমকি প্রদান করেছেন ইমেইলের মাধ্যমে। আমরা দেখেছি, কানাডায় মুসলমানদের উপর হামলার ঘটনা ইতিপূর্বেও ঘটেছে বেশ কিছু। এর মধ্যে আছে মসজিদ ভাঙ্গচূড়, আগুন লাগিয়ে দেয়া, আপত্তিকর দেয়ালচিত্র অঙ্কণ, মসজিদের দেয়ালের গায়ে বর্ণবাদী স্লোগান লিখে রাখা, মসজিদ প্রাঙ্গণে শুকরের কাটা মাথা নিক্ষেপ, হিজাব/নিকাব পরিহিতা মুসলমান মহিলাদের উপর হামলা, বর্ণবাদী মন্তব্য করা ইত্যাদি। তবে ঐ সমস্ত হামলায় কোন প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু প্রাণহানি ঘটেছিল কুইবেক সিটিতে মুসল্লিদের উপর হামলার ঘটনায়। ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী আলেকজেন্ডার বিসোনেট (২৯) নামের এক ব্যক্তি কুইবেক সিটি ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে নামাজের সময় নির্বিচারে গুলি ছোড়েন। এতে ছয়জন নিহত ও আটজন আহত হন। গোটা কানাডা সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়।

কানাডায় প্রকৃত অর্থে কট্টর ডানপন্থী জঙ্গী গ্রুপ ও হিংসাত্মক অপরাধের হার বাড়ছে। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। ঐ প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলা হয়, কানাডায়ও হিংসাশ্রয়ী গ্রুপের ক্রমবিকাশ নিয়ে দেশবাসীর সচেতন হওয়া দরকার। হিংসাত্মক অপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং একজন প্রফেসর বারবারা পেরির বক্তব্য অনুযায়ী, সারা কানাডায় কমপক্ষে ১৩০টি চরম ডানপন্থী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, এই সংখ্যাটি ২০১৫ সালের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে কানাডার ‘এন্টি-হেইট নেটওয়ার্কের’ নির্বাহী পরিচালক ইভান ব্যালগর্ড সিবিসি নিউজকে বলেন, হিংসাশ্রয়ী গ্রুপগুলোর ইন্টারনেটে তথ্য ছড়ানো বন্ধ করাটা জরুরী। ২০১৮ সালে সূচিত এই নেটওয়ার্ক কানাডার বৃহত্তম নব্য-নাৎসী গ্রুপের পডকাস্ট বা ইন্টারনেট সাইট বন্ধ করার কাজে অংশ নিয়েছে।

কিছু হিংসাশ্রয়ী গ্রুপ অবশ্য নিজেদের বার্তা প্রচারের জন্য অধিকতর প্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। সম্প্রতি ব্যালগর্ড একটি চরম-দক্ষিণপন্থী গ্রুপের নতুন সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যে টরন্টোর ব্যাথার্স্ট ও সেন্ট ক্লেয়ার এলাকায় নব্য-নাৎসি চিত্র সংবলিত পোস্টার সাঁটার খবর পান।

তিনি বলেন, মানুষের চরমপন্থী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ঘটছে এবং লোকেরা সংগঠিত হবার জন্য অভিন্ন কায়দায় অনলাইনে গিয়ে হিংসাশ্রয়ী প্রচারণামূলক লেখালেখি খুঁজে নিচ্ছে। তিনি বলেন, ওইসব লোকেরা ক্রমশই বেশি করে মূল ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত হচ্ছে। “আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাস্তব জীবনে সক্রিয় সাংগঠনিক ধারায় তারা ইতিপূর্বে টরন্টোর মেয়র পদে ফেইথ গোল্ডির প্রচারণায় সমর্থন জানাতে এগিয়ে এসেছিল। তারা চরম বর্ণবাদী ম্যাক্সিম বার্নিয়েরের পার্টির ব্যাপারেও উৎসাহী।”

এই ম্যাক্সিম বার্নিয়ের একটি চরম দক্ষিণপন্থী ও ইমিগ্রেন্ট এবং মুসলিম বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা। তার দলের নাম ‘পিপলস পার্টি’।

ব্যালগর্ড বলেন, কানাডার হেইট গ্রুপের সদস্যরা আমেরিকার মত নন। তারা জনমতের ব্যাপারে সচেতন, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের বাইরে থাকেন এবং নিজেদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সোচ্চার নন।

তিনি নব্য-নাৎসি গ্রুপের আরেকটি সাম্প্রতিক প্রবণতার উল্লেখ করেন, সেটা হলো, তারা নিজেদেরকে তথাকথিত ফ্রি স্পিচ বা “পুরুষের অধিকার” সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদির অনুকূলে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ অঙ্গনে এ ধরনের অনুষ্ঠানাদি ক্রমবর্ধমান হারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, কুইবেক সিটিতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ৬ জন মুসল্লিকে হত্যা করার পরপরই সেদিন কানাডার শোকার্ত প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বলেছিলেন, “কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে পরিচালিত হামলায় যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে তা সন্ত্রাসী ঘটনা। এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানো হয়েছে কানাডার বিরুদ্ধে, কানাডিয়ানদের বিরুদ্ধে।” তিনি কানাডায় বসবাসরত ১০ লাখ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কানাডার ৩৬ মিলিয়ন হৃদয় আপনাদের সঙ্গে সহমর্মী।” প্রধানমন্ত্রী কানাডিয়ানদেরকে ভীত না হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। কুইবেক সিটির ঐ নৃশংস ঘটনার পর ইতিমধ্যে প্রায় চার বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতী কতটা ঘটেছে? এর মধেই আমরা দেখলাম টরন্টোর কেন্দ্রস্থলের আরেক মসজিদে মুসলিমদেরকে উদ্দেশ্য করে অতিমাত্রায় হিংসাত্মক হুমকি প্রদান করেছে শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। অন্যদিকে ইটোবিককে মসজিদ প্রাঙ্গণে একজন মুসল্লিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে কানাডায় এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত জনাথন মন্টপেটিট এর এক প্রতিবেদনে উল্ল্লেখ করা হয় “৯/১১ এর পর থেকে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগের অধিকাংশ মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইসলামী জঙ্গীদের উপর। কিন্তু আইএস বা আল-কায়দার মত জঙ্গী গোষ্ঠির উপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়ে আসছে, ততটা গুরুত্ব কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উপর।”

ভ্যাঙ্কুভারে বসবাসকারী সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীদের উপর গবেষণাকারী জেমস এলিস বলেন, কানাডায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা নিরাপত্তার বিষয়ে হুমকী সৃষ্টির জন্য তেমনভাবে সংগঠিত নয় এরকম ধারণা খুবই বিপজ্জনক।

আমরা দেখেছি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা অতীতেও ভয়াবহসব নৃসংশতা চালিয়েছেন কানাডায়। সেই সময় তাদের টার্গেট ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠি। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে গুলি করে হত্যা করার পাশাপাশি ঘরের ভিতর আটকে রেখে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটিয়েছেন এরা। আজকে তাদেরই উত্তরসুরীরা মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সাউথ এশিয়ান, মিডল ইস্টর্ন ও আফ্রিকান অঞ্চল থেকে আসা ইমিগ্রেন্ট এবং রিফিউজিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন এবং সমাবেশ ও মিছিল করছেন। এসবই দুর্বিত্তপনা এবং সন্ত্রাসী কার্মকান্ড। কোন সভ্য সমাজে এগুলো স্থান পেতে পারে না। মুসলিম নামধারী এক দল জঙ্গীর বিরুদ্ধে কানাডার আইন-শৃংখলা বাহিনী যেমন তৎপর তেমনি তৎপর হওয়া উচিৎ এই শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অশুভ কার্মকান্ডের বেলায়ও। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশে যে কোন ধরণের সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কর্মকান্ড কঠোর হস্তে দমন করা সরকারের দায়িত্ব।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ