কানাডায় নবাগত? তাহলে সাংস্কৃতিক অভিঘাত হজম করতে শিখুন!
ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাজরিনা আনোয়ার-ট্রাভাস সাংস্কৃতিক অভিঘাত সম্পর্কিত তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
নভেম্বর ৪, ২০১৮
নাজরিনা আনোয়ার-ট্রাভাস
কানাডায় নবাগত অভিবাসীদের জন্য কেবল যে একটি নতুন দেশ বা নতুন মুদ্রা অথবা নতুন খাবার-দাবারই ভিন্ন আবহ বয়ে আনে তা নয়। আপনি যখন এদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই হয়তো কোনও বন্ধুর মুখে শুনে থাকবেন, “সংস্কৃতির অভিঘাত বরণ করে নিতে প্রস্তুত থাকো।” ওখানকার সংস্কৃতি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন!
সংস্কৃতির অভিঘাত জিনিসটা আসলে কী?
হঠাৎ করে কোন অচেনা সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা বা মন-মানসিকতার মুখোমুখি হলে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষের মানসিক স্থিতি যে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে সেটাকেই সাংস্কৃতিক অভিঘাতের সংজ্ঞা বলা যেতে পারে। এটি কাটিয়ে ওঠা কারও কারও জন্যে সবচেয়ে কঠিন হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যখন কেউ তার জাতিগত ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত এবং বিশেষ ধরণের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত থাকে।
সাংস্কৃতিক অভিঘাত মোকাবিলার বিষয়টি কেবল একটি ভিন্ন সামাজিক পরিবেশ, সাধারণ মনোভাব বা খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়া বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। এর মধ্যে ভাষাগত বাধা বা প্রযুক্তিগত ব্যবধান থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি গ্রহণ করা এবং সামাজিক আচরণবিধি অথবা শারীরিক ভাষা রপ্ত করা পর্যন্ত সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
কিছু লোক খুব দ্রুততার সঙ্গে এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেও অনেকের ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় এমনকি মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে। অনেকের কাছে এটিকেই তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন পর্যায় বলেও মনে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে এটা মোটেও বিরল নয় যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার সময় সে এমন আচরণ করছে যা মূলত মানসিক চাপ ও বিষণœতা থেকে উদ্ভূত, যেমন মানসিক দোদুল্যমানতা।
তার মধ্যে আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে তার মধ্যে রয়েছে অসহায়ত্ব, নিজের বাড়ির জন্য আকুতি, খাওয়া-দাওয়ায় খেয়ালিপনা এবং অপরাধবোধে ভোগা। হ্যাঁ, আপনি কোত্থেকে আসছেন তার ওপর নির্ভর করতে পারে কানাডায় আপনার জন্য যা অপেক্ষা করছে সেটা অভিনব কিছু হবে নাকি অভিঘাত হয়ে আসবে। প্রশ্ন হচ্ছে Ñ আপনি এই অভিঘাত হজম করতে প্রস্তুত কি না।
একজন অভিবাসী হিসাবে আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এখানে পাঁচ ধরণের সাংস্কৃতিক অভিঘাতের বিষয় তুলে ধরছি যা আপনাকে কাটিয়ে উঠতে হবে:
১. বেশিরভাগ নবাগতকে যেসব বাধার মুখোমুখি হতে হয় তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো ভাষাগত বা যোগাযোগের বাধা। এমনকি যারা ইংরেজি বলতে পারেন তাদের জন্যও সর্বসমক্ষে কথা বলার প্রয়োজন হলে স্বল্পবাক হয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। অনেক সময় এটা কেবল ইংরেজি জানার বিষয় নয় বরং কীভাবে বলতে হবে বা উচ্চারণ করতে হবে সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
২. নতুন ধরণের পোশাক পরতে অভ্যস্ত হওয়াও অনেকের জন্য আঘাতের মতো হয়ে ওঠে। আজীবন শাড়ি পরতে অভ্যস্ত আমার এক প্রতিবেশির জন্য পাজামা বা জিন্সের প্যান্ট পরা প্রাথমিকভাবে একেবারেই অসম্ভব মনে হয়েছিলো। কিন্তু কানাডার প্রবল বাতাসের মধ্যে হাঁটাহাটির কয়েক দিন পর তিনি খুবই লাজুক ভঙ্গিতে একজোড়া নীল জিন্সের প্যান্ট কিনে নিয়ে আসেন। তিনি হেসে বলেন, “এগুলি যদি আমার পাদুটোকে উষ্ণ রাখে তাহলে কেন পরবো না?” আমি তাকে বললাম, “অভিনন্দন বন্ধু, আপনি এইমাত্র আপনার প্রথম সমন্বয় কোর্স সম্পন্ন করলেন।”
৩. প্রযুক্তির ব্যবধান হলো আরেকটি বিষয় যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া কিছু নবাগতের জন্যে খুব কষ্টকর। এটা বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা কমপিউটারে বা বিভিন্ন টেকনলজির বিভিন্ন ধঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ এ কাজ করতে অভ্যস্ত নন। আমার একজন খুব ভালো বন্ধু দেশে থাকতে যে চাকরি করতেন সেখানে তার খসড়া রিপোর্ট ও চিটিপত্র লেখার জন্য সহকারী ছিলো। কিন্তু কানাডায় নতুন চাকরিতে যোগ দেওযার পর যখন “সবকিছুই” তাকে এককভাবে করতে হচ্ছিলো তখন তিনি খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফোন করে কথা বলার জীবনযাত্রায় আমিও এতটাই অভ্যস্ত ছিলাম যে, এদেশে আসার পর যখন দেখলাম সবাই আগে লিখিত ভাষ্য পাওয়াটাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং তারপর শুধু বিস্তারিত আলোচনা, পরিকল্পনা ও সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে কলব্যাক করছে তখন এই ব্যাপারটা মেনে নিতে আমাকেও অনেক কঠিন সময় পেরুতে হয়েছে।
৪. অনুশীলনের আরেকটি বাঁক হলো সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু অভিব্যক্তির প্রকাশ এবং শারীরিক ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ রপ্ত করা। এখনও কেন বিয়ে করেননি বা আপনার কয়টি সন্তান আছে এমন প্রশ্ন করা কোনও কোনও সংস্কৃতিতে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার প্রকাশ বলে মনে হলেও কানাডায় এগুলোকে অতিরিক্ত কৌতুহল এবং খুব বেশি ব্যক্তিগত প্রশ্ন বলে ব্যাখ্যা করা হবে।
৫. আমার নিজের কাছে এটা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি আঘাত: জলবায়ুর আঘাত। হ্যাঁ, সাত বছর দুবাইতে থাকার পর কানাডায় এসে সবকিছুই ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়া আমার কাছে ছিলো হাড়কাঁপানো শীতের মতো। আমি ২০১১ সালের জুন মাসে ক্যালগেরিতে এসেছি। আর জুলাই মাস চলে এলে যখন এখানকার সবাই টি-শার্ট ও হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় তখনও আমি কালো জ্যাকেট পরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটছি। বলা বাহুল্য, আমাকে একটা উজবুকের মতো লাগছিলো।
একটি নতুন সংস্কৃতির মধ্যে দিশেহারা বোধ করলেও কখনই নিজেকে অসহায় ভাববেন না। সাংস্কৃতিক ব্যবধান কাটিয়ে উঠতে সহায়তার জন্য নবাগতদের জন্য বিভিন্ন বন্দোবস্তকারী সংস্থা ও লাইব্রেরিতে নানা ধরনের কর্মসূচি রয়েছে যেমন, স্পোকেন ইংলিশ কোর্স, আপনার চারপাশে যা কিছু অভিনব সেগুলোর সঙ্গে কীভাবে পরিচিত হয়ে উঠবেন সে সম্পর্কিত কোর্স এবং আরও অনেক কর্মসূচি যা আপনার নতুন আবাসে স্বাগত জানানোর অনুভূতি এনে দিতে সাহায্য করবে।
মনে রাখবেন, সাংস্কৃতিক অভিঘাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনি নিঃসঙ্গ নন। এক্ষেত্রে আপনিই প্রথম বা শেষ ব্যক্তিও নন।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শেষ পরামর্শ: খোলামেলা এবং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মোকাবিলা করলে সাংস্কৃতিক অভিঘাতের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। কারো জাতিগত সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা খুবই স্বাভাবিক হলেও চেষ্টা করুন যাতে গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে না পড়েন। নিজের জাতির লোকেদের মধ্যে বিচরণ করা এবং এক ধরণের অনানুষ্ঠানিক জাতিগত সম্প্রদায় গড়ে তোলা অবশ্যই সাচ্ছন্দ্যের, কিন্তু এটা মনে রাখা ভালো যে, একটি নতুন দেশে অভিবাসনের সিদ্ধান্তআপনিই নিয়েছেন। আপনি যদি কানাডাকে মেনে নিতে না পারেন তাহলে কানাডা আপনাকে মেনে নেবে এমনটা আশা করাও ন্যায়সঙ্গত নয়। সুতরাং আপনার পরিচিতের জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন এবং কানাডার সমাজের সঙ্গে মিশে যান। হয়ে উঠুন একজন সাংস্কৃতিক অভিঘাত-প্রশমক!
– কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ