বর্ণবাদ অবসান হওয়া জরুরী

জুন ১৬, ২০২০

বর্ণবাদ আর যুক্তরাষ্ট্র এ দুটি শব্দ যেন একেবারে অবিচ্ছেদ্য এবং একে অন্যের পরিপূরক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শত শত বছর ধরে বর্ণবাদ নামের যে মহামারি চলছে, তা করোনা ভাইরাস মহামারির কাছে যেন কিছুই না; তা যেন আরো ভয়াবহ। গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে গ্রেপ্তারের পর তাকে প্রকাশ্যে রাজপথে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ যেভাবে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে, তা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহুবার দেশটিতে এমন ঘটনা দেখা গেছে। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশটির বিভিন্ন শহরে কারফিউ উপেক্ষা করে চলছে বিক্ষোভ। আর সেই বিক্ষোভের ঢেউ এসে লেগেছে কানাডাতেও। কানাডায় বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ যাদের মধ্যে ছিলেন সাদা-কালো ও বাদামী সবাই। এমনকি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো-ও নিহত জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণে মাটিতে হাঁটু গেড়ে ৮:৪৬ মিনিট নিরবতা পালন করেন অটোয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে।

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি জর্জ ফ্লয়েড এর গ্রাফিটি। ছবি : পিবিএস.অরর্গ

আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের গোড়া অনেক গভীরে। শুধু পুলিশি নির্যাতনে তা সীমাবদ্ধ নেই। এক গবেষণায় জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৬৬৬ জন। এই হতভাগ্যদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গই বেশি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যেই তাদের বসতি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আফ্রিকান-আমেরিকানরা সব সময় পুলিশ কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। পুলিশ ছাড়া অন্যান্যদের হাতেও নির্যাতনের শিকার হন আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা। কয়েক বছর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে সাউথ ক্যারোলিনায় অবস্থিত একটি চার্চে যেখানে গণহত্যার শিকার হন ৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসী। চরম বর্ণবাদী এক শ্বেতাঙ্গ যুবক ছিলেন ঐ গণহত্যার নায়ক।

বর্ণবাদ থেকে কানাডাও মুক্ত নয়। অতীতে কানাডায় বর্ণবাদী আচরণ প্রকাশ্যেই করা হতো। বর্ণবাদ তখন অলিখিত বৈধতা পেয়েছিল। এই ধরণের আচরণকে সেই সময় অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হতো না। কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড নিজেই একজন প্রচন্ড বর্ণবাদী শাসক ছিলেন। বর্ণবাদকে সমর্থন করার পিছনে তার যুক্তি ছিল এই রকম- ‘আমি এরকম একটি দেশ চালাচ্ছি যে দেশটি বর্ণবাদী মানুষে ভরা। এ কারণেই আমি বর্ণবাদকে সমর্থন করে গেছি।’

জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর শাসনামল গত হয়েছে বহু বছর আগে। কিন্তু কানাডায় এখনো কিছু সংখ্যক লোক আছেন যারা বর্ণবাদী। কেউ কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ কেউ অপ্রকাশ্যে। যারা রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন তাদের বেশীরভাগই বর্ণবাদী। কানাডায় মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে সুনজরে দেখেন না এই রক্ষণশীলদের সিংহভাগ। আরো যাদেরকে সুনজরে দেখা হয় না তাদের মধ্যে আছেন – আদিবাসী, সাউথ এশিয়ান, এশিয়ান, ইহুদী এবং কৃষ্ণাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা।

আমেরিকায় বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার পর কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতি প্রদান করা হয়। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়- ‘এখন সময় এসেছে সকল কানাডিয়ানকে এটি অনুধাবন করা যে, কানাডায়ও এন্টি ব্ল্যাক রেসিজম বা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব বিদ্যমান। কানাডায় বর্ণবাদ নেই বা থাকলেও খুব সামান্য পরিমাণে বিদ্যমান, এমন ধারণাটা বাস্তব অর্থে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার পথে একটি বাধা। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, কানাডায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ এবং পদ্ধতিগত বৈষম্যের শিকড়গুলো অনেক গভীরে প্রথিত। বর্ণবাদ ঐতিহাসিক ভাবেই আমাদের সমাজে, আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের আইনে এবং আমাদের মনোভাবে গ্রথিত হয়ে আছে।’ তাই আমরা মনে করি এখন সময় এসেছে বর্ণবাদ দূর করার জন্য জোর পদক্ষেপ নেয়ার। যুগে যুগে এই বর্ণবাদের ভয়ঙ্কর থাবা কলঙ্কিত করেছে মানবজাতিকে। আজো করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের শিকার জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা আবারো প্রমাণ হলো। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরী।